একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৬

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৬
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

ডাক্তার এসে বললেন, অন্বিতার পালস্ একেবারে নেই বললেই চলে। অথচ দুপুরেই তাকে কেবিনে আনার সমস্ত আয়োজন মাহির সেরেছিল। নার্সিংহোমের তৃতীয় তলা আন্দোলিত হচ্ছে কিছু বীভৎস চিৎকারে। করিডোরে গলা ছেড়ে কেঁদে চলছেন আসিয়া বেগম। একটাই মেয়ে উনার, বুকের ধন। তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। আজ মেয়ের এই দুর্দশা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। আভা চোখ মুছছে এক হাতে, অন্যহাতে আসিয়া বেগমকে সামলাচ্ছে।

শশী থম মেরে বসে আছে এক জায়গায়। জিনিয়া বেগম বাবাকে নিয়ে নার্সিংহোমে আসতে চাইছিলেন তবে শশী বারণ করেছে। তার বৃদ্ধ নানাভাই এতসব ধকল সামলাতে পারবেন না।
মাহির তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছে। এই প্রথম কোনো পেশেন্টকে দেখতে গিয়ে হাত, বুক কাঁপছে তার। অন্বিতার নিমীলিত চোখের পাতা। কার্ণিশের পানি শুকিয়ে আছে। মেয়েটা কেঁদেছে খুব। দরজার বাইরে শূন্য বুকে অপেক্ষা করছে অয়ন। সে বিমর্ষ মুখে চেয়ে মৃত্যু পথযাত্রী এক চমৎকার নারীকে দেখছে। তার প্রথম প্রেম, তার প্রথম অনুভূতি। বুকের ভেতরটা কেমন হা হা করছে যেন। মনে হচ্ছে যেন একটু একটু করে কিছু একটা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীটা এত বিষাদের, জানলে সে কখনও ভালোবাসতো না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পালস্ মিটারে ঝিম করে একটা শব্দ হলো। সেদিকে ত্বরিতে চাইল মাহির। দেখল, একটা সোজা দাগ। চোখের দৃষ্টি সরু হলো তার, একবার তাকাল অন্বিতার দিকে। মেয়েটার চেহারার মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই। সে ঢোক গিলল। অপর পাশের ডাক্তারের দিকে চেয়ে দেখল, তিনি ভীত চোখে তাকেই দেখছে। পাযুগল টলে উঠল মাহিরের। গলা শুকিয়ে হলো কাঠ। কিছুক্ষণের জন্য নিশ্বাস আটকে রইল ভেতরেই। শেষ বারের মতো ডাক্তার অন্বিতার পালস্ চেক করলেন, তারপর হাতটা নামিয়ে রাখলেন আস্তে করে। মাহিরকে আর কিছু বলার সাহস পেলেন না তিনি। বেরিয়ে গেলেন। অয়ন সামনেই ছিল। সবটা জেনে দু কদম পিছিয়ে গেল সে। ঢোক গিলে চাইল আভার দিকে। সে ফ্যালফ্যাল করে অয়নকে দেখছে।

মাহির অনেকটা সময় একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আচমকা নিচে বসে পড়ে। মলিন হাসে সে। বলে,
‘তুমি এত নিষ্ঠুর, অন্বি? ঠিকই আমাকে ছেড়ে গেলে? আমার কথা একবারও ভাবলে না তুমি? এত নির্দয় একটা মানুষ কী করে হয়?’
তার অন্বিতা আজ আর জবাব দেয় না। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে না। বলে না, “তুমি ভীষণ অসভ্য, ডাক্তারসাহেব।” মাহিরের কলিজা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। খুব করে চাইছে, সেও মারা যাক। অন্বিতা ছাড়া তার বেঁচে থাকা যে অর্থহীন। এই বিদঘুটে, কুৎসিত সত্যটা সে কী করে মেনে নিবে? সে চিৎকার দেয়। তার চিৎকারে কেঁপে উঠে রুমের প্রতিটি দেয়াল। বলে,

‘আমাদের প্রেমটা অপ্রেম’ই রয়ে গেল, অন্বি। তুমি তাকে পূর্ণতা পেতে দিলে না। এত কীসের তাড়া ছিল তোমার? কেন আমাদের গুছানো সুখের সংসারটা এক লহমায় তুমি নিঃশেষ করে দিলে? কেন? আমি তোমায় কখনো ক্ষমা করব না, অন্বি। কখনোই না।’
নিজের পরিচয়, নিজের অবস্থা বেমালুম ভুলে গিয়ে গগনবিধারি কান্নায় মেতে উঠল মাহির। বাইরে শোনা যাচ্ছে, আসিয়া বেগম আর আভার চিৎকারের শব্দ। তাইভিদ শশীকে সামলাচ্ছে। অয়ন এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নিস্তেজ হয়ে। আশেপাশের কোনোকিছুই যেন কানে যাচ্ছে না তার। নার্সিংহোমের প্রতিটি স্টাফের চোখে মুখে বিষাদ। অন্বিতার কলিগরা চেষ্টা চালাচ্ছে, যদি সবাইকে একটু সামলানো যায়।

যদিও এই অমোঘ সত্যি মেনে নেওয়ার সাধ্যি কারোর নেই।
মৃত্যু এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা। সে বলে কয়ে আয়োজন করে আসে না। সেজন্য শেষ মুহূর্তে এসে সামান্য প্রস্তুতিটুকু নেওয়ার সময় পায় না কেউ। কিন্তু তাতে কী, কোনো প্রস্তুতি ব্যতিত’ই সে খুব যত্ন করে আপনাকে তার সাথে নিয়ে যাবে। এতে কোনো ছাড় নেই। আর এই চরম বিদঘুটে সত্যিটা আমাদের মেনে নিতেই হবে। জন্ম যখন হয়েছে, মৃত্যু তখন অনিবার্য। এই সত্য খন্ডানোর সাধ্যি কারোর নেই।

ডায়েরি’টা বন্ধ করে চোখের উষ্ণ জল মুছল তারা। খুব যত্ন করে, ভালোবাসা দিয়ে ডায়েরিটা মুছে দিল। তারপর রাখল আলমারিতে তুলে।
‘তুমি এখনও তৈরি হওনি, তারা?’
আলমারি আটকিয়ে ফিরে চাইল তারা। বাবার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। বলল,
‘দুই মিনিট।’
‘আধঘন্টা পেরিয়েছে, তোমার দুই মিনিট কি এখনও শেষ হয়নি?’
তারা হেসে বলল,

‘এবার পাক্কা দুই মিনিট, তার থেকে এক সেকেন্ডও বেশি নিব না। তুমি নিচে গিয়ে অপেক্ষা করো আমি আসছি।’
তারার বাবা চশমা ঠেলে ঠিক করে নিচে নামলেন। কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল তারা। ডায়েরিটা এই নিয়ে কয়েকশ বার তার পড়া হয়েছে। এই ডায়েরিটা হাতে নিলেই, চোখ বুলালেই কেমন একটা মা মা সুবাস পায় সে। মনে হয় যেন তার মা তার পাশেই আছে। ডায়েরিটাতে শেষ তার মায়ের লেখা থেমেছিল তার জন্মদিনের আগের দিন। তারপর বাকি লেখাটুকু তার বাবা’ই লিখেছে। সেই প্রতিটি লেখা সে নিয়ম করে একবার পড়ে। চোখের পানি, নাকের পানি এক করে তবেই ক্ষান্ত হয়।

নিচে গিয়ে দেখে সবাই তৈরি। হয়তো তার’ই অপেক্ষায় ছিল সবাই। তাই তাকে দেখে মাথা নাড়িয়ে শশী বলল,
‘অবশেষে মহারাণীর হয়েছে?’
দাঁত কেলিয়ে হাসল তারা। বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, হয়েছে। এবার চলো।’
তাহমির ছুটে এল তখন। তারার সমীপে এসে দাঁড়াল। বলল,
‘শুনো, তোমার পাশে আজ আমি বসব।’
তারা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘মোটেও না, আমি মনির পাশে বসব।’
তাহমির রাগ দেখিয়ে বলল,
‘কেন, আমার পাশে বসলে কী হয়?’
‘সেদিন আমার চুল টেনেছিলি মনে আছে? এটা তোর শাস্তি।’

এই বলে তারা বেরিয়ে এল। মুখ কালো করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তাহমির। ছেলেটার বয়স পনেরো, তারার থেকে এক বছরের ছোট। সমবয়সী হওয়ায় দুজনের মাঝে সারাক্ষণ খুনশুটি চলে। তবে তাহমিদ আবার তারা বলতেই অজ্ঞান। যদিও তারা তাকে খুব একটা পাত্তা দেয় না।

মায়ের কবরের কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল তারা সহ বাকি সবাই। তারা দেখল, মায়ের কবরের চারদিকে লাগানো নয়নতারা গাছগুলো সব ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছে। সে আপ্লুত চোখে চারদিক দেখে। মায়ের কবরের পাশেই আরেকটা ছোট্ট কবর, তার বোনের কবর। সে নিষ্পলক চোখে কবরগুলোর দিকে চেয়ে থাকে। মাথা হেলিয়ে বাবাকে দেখে একবার। প্রতিবার এখানে এলে তার বাবা খুব কাঁদে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চশমা নামিয়ে চোখের পানি মুছে মাহির। তারাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘দেখো অন্বি, তোমার মেয়ে আজ কত বড়ো হয়ে গিয়েছে।’
তারা বাবার মন ভালো করার জন্য বলে,
‘দেখো মা, তোমার স্বামী কত বুড়ো হয়ে গিয়েছে, আজকাল চশমা ছাড়া কিছুই দেখে না।’
কাঁদার মাঝেই হেসে ফেলে মাহির। মেয়ের মাথায় ভালোবাসার পরশ আঁকে। দূরে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ চেপে ধরেন আসিয়া বেগম। বাবা মেয়ের এই দৃশ্য দেখলে বুকটা হু হু করে উঠে উনার। এখানে তো আজ তাঁর মেয়েও থাকতে পারত, থাকতে পারত তার আরেকটা নাতনি। কী সুন্দর এক পরিপূর্ণ পরিবার হতো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তা আর কিছুই হলো না।

শহর থেকে সবাই এসেছে শুনে সিতুল আজ একটু বেশিই সেজেছে। তাকে দেখে বিরক্ত হলেন হালিমা বেগম। বললেন,
‘এত সেজেছিস কেন?’
মায়ের কথায় সলজ্জ হেসে সিতুল বলল,
‘আজ তো তারারা এসেছে।’
‘তো? এখানে তোর সাজার কী আছে?’
‘বাহ রে, সাজব না? তারার বাবা, মানে ডাক্তারবাবুও তো এসেছেন সাথে।’
হালিমা বেগম গর্জে উঠলেন। হাতের খুন্তিটা সিতুলের দিকে ছুড়ে মেরে বললেন,

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৫

‘বেয়াদব মেয়ে! হায়া লজ্জা বলে কিছু নেই। ঐ বুড়ো লোককে তোর মনে ধরেছে? ঐ লোকের তোর সমান একটা মেয়ে আছে। ওর কথা আরেকবার মুখে আনলে চড়িয়ে গাল লাল করে ফেলব তোর।’
সরে যাওয়ায় সিতুলের গায়ে খুন্তিটা লাগেনি। সে বেণী দুলিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল। স্পষ্ট স্বরে বলল,
‘শুনো মা, আমার কাছে বয়স কোনো ব্যাপার না। উনার মন এখনও যথেষ্ট জোয়ান আছে, আমার তাতেই চলবে।’
হালিমা বেগম আবারও তেড়ে আসতে নিলে সিতুল দৌড়ে পালায়। এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে, নির্ঘাত প্রাণ যাবে তার।

একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৫৭