একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৬০

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৬০
writer Mousumi Akte

শাশুড়ির জামিন হয়েছে দীর্ঘদিন পরে।শাশুড়ির জামিনের ব্যবস্থা রোশান স্যার-ই করেছেন। ছোঁয়া আর তরী বলেছে উনি আসলেই এখন অনুতপ্ত, ওশানের প্ররোচনায় যা ভুল করার করেছিলেন। উনার এই বয়সে জেলে থাকাটা কম শাস্তির নয়। কৃতকর্মের ফল যথেষ্ট পেয়েছেন। এরপরেও না শোধরালে উনার ব্যাপার। সেদিন জেল খানায় উপস্থিত হয়ে ভীষণ অবাক হয়েছি।

সেদিন অটোতে বিরক্ত করা লোকটা জেলে। রোশান স্যারকে দেখেই মাথা নিচু করে তাকাল। রোশান স্যার হেসে বললেন, ‘কী চাচা, উত্তেজনা কী একটু কমেছে? না কমলে বলুন।’
লোকটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রোশান স্যারের হাত টেনে ধরে বললাম, ‘ দাঁড়ান।’
উনি বললেন, ‘কী ব্যাপার এখানেই আদর শুরু করবা নাকি? এটা পাব্লিক প্লেস, মানুষ কেমন হা করে তাকিয়ে আছে দেখো।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাকিয়ে দেখি আশেপাশে সত্যি মানুষ তাকিয়ে আছে। আমি সাথে সাথে হাত ছেড়ে বললাম, ‘ অসভ্য লোক। বলছি এই লোককে কীভাবে চিনেন।?’
‘ওই লোককে চিনব না! রোশান সিদ্দিকীর বউ-এর সাথে অসভ্যতা করবে আর আমি কিছুই বলব না? যে ফুল আমি কোমল ভাবে স্পর্শ করি নষ্ট হওয়ার ভ’য়ে, সেই ফুল ও ছিঁড়তে চেয়েছিল।’

‘কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছুই বলিনি। কীভাবে জানলেন?’
‘জানতে হয়, বুঝলে?’
‘না, বলুন না প্লিজ।’

‘সেদিন তুমি চলে আসার পর ওখানকার মানুষ আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমার ইচ্ছা ছিল ওর চোখ দু’টো উপড়ে ফেলার। কিন্তু এতে পুলিশ আমায় ধরে নিয়ে যেত।তোমার থেকে আলাদা থাকা লাগত।একদমই ইম্পসিবল ব্যাপার, যে তোমাকে ছাড়া একটা দিন আলাদা থাকব। এই পৃথিবীতে রোজ রোজ আসা হবে না।একবার এসেছি আর এই এক জীবন তোমার সাথেই কাটাতে চাই।’

‘তারপর?’
‘প্রচুর মা* র লা* ম, মে** রে জেলে ঢুকালাম।’
‘আমাকে তো বলেননি।’
‘আমি চাইনি তুমি আমার কাছে অস্বস্তি ফিল করো।’
এই মানুষটা আমার আড়ালেই দেখছি আমার থেকে বেশি ভালবাসে আমাকে।একবার মুগ্ধ নয়নে উনার মুখের দিকে তাকালাম। ঠোঁটের কোনে নিমিষেই হাসি ফুটল।

শাশুড়ি মলিন মুখে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। আমি মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন আম্মা?’
উনি হুহু শব্দে কেঁদে উঠলেন। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকলেন। রোশান স্যার উনার আম্মার দুই বাহুতে হাত রেখে বললেন, ‘অনেক বুঝিয়েছি আম্মা। আমার কথা রাখোনি। আজ কী হতো আমার কথা শুনলে?

ওশানের সঙ্গ দিয়ে কী পেলে আম্মা? পা-প করে কেউ কখনো পার পায় না। তুমি আমার আম্মা, আমাকে পেটে ধরেছ। তোমার প্রতি আমার সম্মান আর ভালোবাসা সবই আছে। তবে আম্মা না হলে হয়তো আমি মুখও দেখতাম না কখনো।’
শাশুড়ি হু হু করে আবারও কেঁদে দিলেন।আমি রোশান স্যারকে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ‘এসব বলছেন কেন? এমনিই আম্মার খারাপ লাগছে।’
শাশুড়ির ওই করুণ মুখটা দেখে সত্যি খারাপ লাগছে।

শাশুড়ি এখন তার বাবার বাড়িতেই আছেন। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছেন।আগের মতো সেই তেজ-অহংকার কিছুই আর নেই। যদিও আমরা বলেছিলাম আমাদের এখানে এসে থাকতে; তবে উনিই রাজি হননি। আর ঐ দিকে শ্বশুর বলেছেন শাশুড়ি আমাদের কাছে এসে থাকলে উনি কোনদিন আমাদের কাছে এসে থাকবেন না। তাছাড়া শ্বশুর এই বয়সে শাশুড়িকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন।

প্রতিটা মেয়েই তার স্বামীকে ভালোবাসে, স্বামীর থেকে কেউই আলাদা হতে চাই না। সবাই স্বামীর সাথে বৃদ্ধে উপনীত হতে চায়। কিন্তু নিয়তির বিধান বড়োই ভয়াবহ। এই বয়সে হয়তো শাশুড়ির ডিভোর্স হয়ে যাবে। শ্বশুর বলে দিয়েছেন, শাশুড়ি চাইলে উনার নামে কেস করতে পারেন। উনি সারাজীবন জেলে থাকলেও শাশুড়ির সাথে আর থাকবেন না। শ্বশুরকে বিষয়টা বুঝানো যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করছি আমরা কিন্তু উনি কিছুইতেই মানছেন না। এক মেয়ের সংসার ভাঙলে তার নিজের সংসারও টেকে না। শাশুড়ি নিজ হাতে তরীর জীবনটা নষ্ট করেছে তাকে ডিভোর্সি বানিয়েছে আর আজ তাকেও ডিভোর্সি হতে হবে।

মাগরিবের নামাজ পড়ে রান্নাঘরে ঢুকে ভাবছি, কী করা যায়। দুপুরের রান্না তো আছেই। বিরিয়ানি রান্না করতে ইচ্ছা করছে।ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলাম। গ্যাসে ডিম সেদ্ধ করতে দিয়ে চাল ধুয়ে নিলাম। বিরিয়ানির সব মশলা ফ্রিজেই ছিল। কেননা, প্রায় প্রায় রোশান স্যার আমাকে রান্না করে খাওয়ান। আমার ফেভারিট বলে উনি হুটহাট করেই বিরিয়ানি রান্না করেন।

খুব মনোযোগ দিয়ে ফ্রাই প্যানে চাল দিয়ে নাড়াচাড়া করছি। ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে বারবার। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই বেশ চমকে গেলাম। ফোনের ওপাশের মানুষ আর কেউ নয়, আরিয়ান ভাই। সেই কন্ঠ, সেই সুরে ডাক। আমার বুক কেঁপে উঠল। সাথে সাথে ফোন কেটে দিলাম। উনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন! আম্মু দিয়েছে! না তো, আম্মুর তো দেওয়ার কথা নয়।

কীভাবে পেল নাম্বার! আর কল-ই বা কেন দিচ্ছেন! এরই মাঝে কলিং বেল বেজে উঠল। আমি দ্রুত বেগে দরজার সিটকিনী খুলে দ্রুত চুলার কাছে চলে এলাম। আরিয়ান কেন ফোন দিয়েছিল সেটা ভেবেই যাচ্ছি; ভাবছি আর খুন্তি নাড়াচ্ছি। হঠাৎ দুটো পুরুষালী হাত পিছন থেকে আমার চোখ বন্ধ করে ধরল। সেকেন্ডের মাঝে আমি হেসে উঠলাম। রোশান স্যারের স্পর্শ আমার সব মন খারাপ, সব চিন্তা দূরীকরণ ওষুধের মতো। পাঁচ সেকেন্ড পরেই আমার ভাবনার ঘোর কাটল।

কেননা আমি একদম নিশ্চিত এটা রোশান স্যার নয়। উনার হাতের গড়ন আমার মুখস্থ, উনার শরীর থেকে আলাদা একটা খুশবু বের হয়। যা আমি ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারে না। সেই সুবাস,সেই খুশবু আমি অনুভব করতে পারছি না। তাছাড়া পারফিউমের ঘ্রাণটাও আলাদা।আর রোশান স্যার এত শক্ত করে আমার চোখ ধরেনন না, আমি ব্যাথা পাব বলে। উনি অনেক মোলায়েম ভাবে আমাকে স্পর্শ করেন। তাঁর স্পর্শও আমাকে ভাবায় সে কতটা ভালোবাসে আমাকে।

আমি তড়িৎ বেগে চোখ খুলে পেছনে ঘুরে তাকালাম। তাকিয়ে কেঁপে উঠলাম। ধবধবে ফরসা গোল মুখশ্রী লম্বা আরিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে হাসছেন। আমি অবাকের চরম পর্যায়ে গিয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে আমার; অথচ আরিয়ান ভাই হেসেই যাচ্ছেন। আমার মুখে বিন্দুমাত্র হাসি নেই। জীবনের সব সুখ-শান্তি বিনাশ করতেই কি উনি এসেছেন! এখন যদি রোশান স্যার এসে উনাকে দেখেন কী হবে! আমার এই সাজানো-গোছানো সুখের নীড় ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে! আমাকে ভুল বুঝবেন।

আরিয়ান ভাই এক গুচ্ছ ফুল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বিবাহিত জীবনের শুভেচ্ছা সারাহ!’
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ‘আপনি এক্ষুনি বের হন এখান থেকে, এক্ষুনি বের হন।’
‘আগে ফুলটা তো নাও।’
‘আপনার কাছে ফুল চাইছি আমি, যে ফুল নিয়ে এসছেন?’
‘আগে তো চাইতে।’

‘আগের আমি আর আজকের আমি কি এক, হুম?’
‘আগে খালার মেয়ে ছিলে, এখন এক বেটার বউ।’
‘আপনি আগে বের হন আমার বাসা থেকে।আমার হাজবেন্ড এসে দেখলে ভুল বুঝবে।’
‘তুমি বলবা তোমার কাজিন এসেছে।সিম্পল। এত চিন্তার কী আছে? আত্মীয় কি আত্মীয়ের বাসায় আসে না?’
‘না আসে না। আর আপনি আমার বাসায় আসুন এটা আমি চাই না। আমার নাম্বার আর ঠিকানা কে দিয়েছে?’
‘মন থেকে খুঁজলে অনেক কিছুই পাওয়া যায়, বুঝলে?’

‘আমাকে মন থেকে খুঁজেছেন?’
‘হুম।’
‘কেন?’
‘এমনিই।’
‘আপনি এখান থেকে বেরোবেন? ‘

‘কাজিনের বাড়ি এসেছি, না খেয়ে দেয়ে কীভাবে যায়? বিরিয়ানি রান্না করছ। যাক অনেকদিন পর তোমার হাতের রান্না খেতে পারব। ভেবেই শান্তি লাগছে। বিরিয়ানি থেকে দারুণ ঘ্রাণ আসছে।’
‘আমার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আরিয়ান ভাই।’
‘তুমি তো সব সময় ধৈর্যহীন মেয়ে। তাই তো বিয়ে টাও করে নিলে। ধৈর্য থাকলে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করতে।’
‘কীসের অপেক্ষা?’

‘কিছু না, বাদ দাও ওসব। তোমার জন্য বিদেশ থেকে কিছু উপহার নিয়ে এসেছি। যা যা তোমার ফেভারিট।’
‘আপনি একটু বেশি বেহায়াপনা করছেন না?আমি যে এতবার বলছি বেরিয়ে যান যাচ্ছেন ই না।’
আরিয়ান ভাই এবার ড্রয়িং রুমে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে বললেন, ‘অনেক জার্নি করেছি আজ, ক্লান্ত খুব। চা দাও। এই যে বসলাম তোমার আপ্যায়ন না নিয়ে উঠছি না।’

‘আপনি কী চান আরিয়ান ভাই?’
‘তোমাকে।’
‘মানে!’
‘মানে– তোমার হাতের রান্না।’
‘এসেছেন যখন বউ নিয়েই আসতেন।’
‘বিয়ে তো করিনি।’

‘কেন? বিদেশ গেলেন না, সেখানে বিয়ে করবেন বলে তো কত কাহিনি।’
‘মেয়েরা ধোঁকাবাজ।’
‘আর আপনি খুব ভালো।’
‘ভালোই তো।’

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৫৯

‘এবার আসতে পারেন। বাইরে গিয়ে হোটেল থেকে যা ইচ্ছা খেয়ে নিন।’
‘আমার মুখ দেখতে কী এত ঘৃণা, সারাহ!আমার দিকে তাকাচ্ছোই না।’
‘আপনার মুখের দিকে কেন তাকাব?’
আমি জানতাম তাকাবে না; তবুও এসেছি।’
এরই মাঝে মনে হচ্ছে নিচে বাইকের হর্ন বাজছে। রোশান স্যার মনে হয় চলে এসছেন।

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৬১