একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৭
Mousumi Akter
সারাহ’র বিয়ে হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো তার কলেজের বা ফ্রেন্ডসসার্কাল এর কেউ জানেনা বিয়েটা কারসাথে হয়েছে। বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে না হওয়ার জন্য সারাহ কাউকে খুশি খুশি মনে জানাতে পারেনি তার বরের কথা। আগামিকাল শুক্রবার সারাহ’র বিয়ের অনুষ্টান। তাই আজ হলুদের অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়েছে। ভালবাসার মানুষের কাছে প্রতারিত হয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করা এক প্রকার বিষপানের মত যন্ত্রণা। যতই আরিয়ানের ওপর সারাহ’র রাগ হোক, ঘৃণা হোক তবুও তার ভালবাসা তো মিথ্যা ছিলোনা।
আজ মেহেদী দিয়ে দুইহাত্ব আরিয়ানের নামটাই লেখার কথা ছিলো। কিন্তু সম্পর্ক, স্বপ্ন সব একটা নিমিষেই ভেঙে গেলো। এই পৃথিবীতে কেউ কারো হৃদয় ভাঙা যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেনা। কেবল সেই জানে কি নরকীয় যন্ত্রণা যার হৃদয় ভেঙেছে। মানুষ শুধু বাহিরের মিথ্যা হাসি দেখে মানুষকে বিচার করে। কেউ কি ভেতরের দাউ দাউ আ-গু’ন টুকু দেখতে পায়। কেউ দেখেও বা কি করবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মানুষ কেবল স্বন্তণা দিতে পারবে কেউকি শান্তি দিতে পারবে। তাইতো চঞ্চলা সারাহ কাউকে বুঝতে দেয়না তার ভেতরে কি চলছে। কাউকে বলতেও পারেনা। কার কাছে বলবে? আরিয়ান ঠকানোর পর বন্ধুরা তার নামমাত্র শুনতে পারেনা। বাসায় মা-বাবাকে কোনো কষ্ট দিবেনা বলেই হাসি-খুশি থাকে। বাংলা সিনেমার মত সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামীর কাছেও বলতে পারেনি সে অন্য কাউকে ভালবাসে। তাইতো রাগে ক্ষোভে অদ্ভুত, অদ্ভুত সব কাজ-কর্ম করে। নিজের রাগ মেটানোর আর কোনো উপায় তার কাছে নেই। হুট করে এভাবে বিয়ে হওয়াটা সে মেনেই নিতে পারছে না। সদ্য মন ভেঙেছে, একটু সময়ের প্রয়োজন ছিলো ক্ষত ভোলার জন্য। কেউ তাকে বোঝেনি, না কেউ বুঝবে।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ছোঁয়ার গাড়িতে অপেক্ষা করছে ছোঁয়া, তন্ময় আর দ্বীপ। ওরা মেইন রোডের ওপর মৃন্ময়-এর জন্য অপেক্ষা করছে। আলাপ সূত্রে মৃন্ময়ের বোন পিহুকেও সবাই চিনে। এইজন্য সারাহ বারবার করে বলে দিয়েছে পিহু অবশ্যই যেন আসে। সে না আসলে তার আপণজনদের মাঝে একজনের কমতি থেকে যাবে। মৃন্ময় রেডি হয়েছে সেই কখন। ছেলে মানুষ জাস্ট একটা জিন্স আর একটা টি-শার্ট পরেই শেষ। কিন্তু পিহুর হলুদ শাড়ি পরে সাজগোজ করতে দেরি হচ্ছে। গাড়িতে ওরা সবাই অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে। গাড়িতে এসি থাকলেও দম বন্ধ লাগছে দ্বীপের। বিরক্ত কণ্ঠে তন্ময়কে বলল,
” ভাই জানালা টা খুলে দেতো, বিড়ি ধরাবো।”
তন্ময় বিড়ি সিগারেট এর আশে -পাশেও কখনো যায় নাই। তাই এই কাজের পক্ষপাতী সে নয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” গাড়িতে মেয়েরা যাবে, স্মোক করা যাবেনা। খেতে হলে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে খেয়ে আয়।”
দ্বীপ বিরক্ত গলায় বলল,
” ছোঁয়া আবার মেয়ে হলো কবে? সারা -ছোঁয়া ওরা আমাদের ভাই এর মত।”
ছোঁয়ার পরণে হলুদ শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ। শাড়ির সাথে মেকাপের সেটিংস এ সন্ধ্যার ক্ষীন আলোয় মুখখানা পুতুলের ন্যায় দেখাচ্ছে। তন্ময় যেন চোখ সরাতে পারছেনা। ছোঁয়া এত সুন্দর? সবকিছুর ই-তো একটা লিমিটেশন আছে। ওর সৌন্দর্যের কি কোনো লিমিটেশন নেই। তন্ময় আস্তে করে গোপনে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল। খুব গোপনে ছোঁয়ার কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করল। আসলে পরিপাটি আর পোজ নিয়ে দাঁড়ালে ছবি অতটা সুন্দর আসেনা, যতটা কেউ অজান্তে তুললে আসে। ছোঁয়া টের পেলো কারো নজর তার ওপর পড়েছে। এবং সে বুঝতেও পারল। এই নজর তার খুব চেনা। সে পেছন ফিরব তাকালো। সাথে সাথে তন্ময়ের চোখে চোখ পড়ল। তন্ময়ের দৃষ্টি জুড়ে গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। কোনো সাধারণ নারীর পক্ষে তন্ময়ের এই গভীর ভালবাসা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাইতো সারাহ ছোঁয়ার নাম দিয়েছে ইস্পাত। চোখে চোখ পড়া সত্ত্বেও তন্ময়ের একটুও অস্বস্তি অনুভব হচ্ছেনা। ছোঁয়ার মুখের ওপর পড়া কোকড়ানো একগোছা চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
” তোর সামনে পড়ে থাকা চুল গুলো বড্ড ডিস্টার্ব করে চাঁদমুখ খানা দেখতে।” ছোঁয়া মনে মনে বলল,
‘ তন্ময় টা দিন দিন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে কেন এভাবে? দ্বীপ কি ভাববে।’
ছোঁয়ার ভাবনা শেষ হতে না হতেই দ্বীপ গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠল,
” এখানে যে একজন গর্ভবতী সিঙ্গেল আছে সেদিক মাথায় রাখা উচিৎ। আমাকে এভাবে আর কত অত্যাচার করবি বাপ। দিচ্ছিস না বিড়ি খেতে, এইদিকে আমার সামনে বসে রোমান্স করছিস। ওর চেয়ে কি আমার মরণ ভালো না?”
তন্ময় কিছুক্ষণ বাহিরে তাকিয়ে থেকে বলল,
“গাড়ির দরজা খুলে দিচ্ছে যা ম’র।”
দ্বীপ ছোঁয়ার মাথার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ছোঁয়াকে পারলে টাক করে দে। তাহলে ওর চুল আর তোকে ডিস্টার্ব করবে না।”
” আমার বউ আমি বুঝব।”
দ্বীপ এবার তন্ময়ের দিকে আঙুল তুলে বলল,
আমি যতদিন সিঙেল থাকব ততদিন তোদের প্রেম নিষিদ্ধ। আর প্রেম ভালবাসা হারাম জানিস না। একজন সচেতন বন্ধু হিসাবে হারাম কাজে লিপ্ত হতে দিবোনা তোদের।”
দ্বীপ এক নাগারে বকবক শেষ করল। তন্ময় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ছোঁয়া মিটিমিটি হাসছে। তন্ময়কে ভ্রু কুঁচকাতে দেখে দ্বীপ নিজেই বলল,
” কি ভাই? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
তন্ময় ওর এ্যাশ কালারের শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে জিজ্ঞেস করল,
” তুই গর্ভবতী দ্বীপ?”
দ্বীপ গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে, বড় বড় গ্লাসের কালো সানগ্লাসটা চোখে পড়ে খানিকটা ভাব নিয়ে বলল,
” গর্ভবতী মানে গর্বে গর্বিত, আমি যে সিঙ্গেল এটা গর্ব আমার।”
তন্ময় দ্বীপের এই নায়ক জসিম স্টাইল ভাবসাব দেখে বলল,
” তোকে দেখতে একদম একদম নায়ক জসিমের মত লাগছে। কিন্তু কথা সেটা নয়, তুই কি নিজে থেকে সিঙ্গেল নাকি কাউকে পটাইতে পারিস নাই।”
দ্বীপ চোখের সানগ্লাসটা খুলে বলল,
” দুনিয়ে এদিক-ওদিক হয়ে যাবে নিজের দাম কমানো যাবেনা। একশ মেয়ের কাছে রিজেক্ট হয়ে দু’শ মেয়েকে বলব, জীবনে অনেক মেয়েকে পাত্তা দেইনি।”
” এরই মাঝে মৃন্ময়ের ফোন এলো। দ্বীপ ফোন রিসিভ করেই কয়েকটা বিশ্রী গালি দিয়ে বলল,
” শালা মাদারবোর্ড কই তুই?”
ফোনের ওপাশ থেকে মৃন্ময় বলল,
” আমার বোন আজ সাথে যাবে। বোনের সামনে ভুলেও শালা বলবিনা। তাহলে আমার বোন ওর ছেঁড়া জু’ তা দিয়ে তোকে পেটাবে।”
পিহুর প্রতি দ্বীপের একটা সফট কর্ণার আছে। তবে অতটা গভীর নয়। পিহু আসবে এটা কানে পৌঁছাতেই দ্বীপ খানিকটা থমকে গেলো। সাথে সাথে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলো,
” শালাকে শালা ছাড়া আর কি বলব। বোন নিয়ে দ্রুত আয়।”
দ্বীপের ফোন কেটে মৃন্ময় দুই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে তরীদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে ঘুরাঘুরি করছে। তরীদের ফ্ল্যাটের দরজার সিটকিনি খোলা।ঘরের ভেতর থেকে বাহিরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। তরীর নতুন মা দিশা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময়কে দেখার পর থেকেই মৃন্ময়ের প্রতি আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে তার। তার আকার-ইঙ্গিত মৃন্ময় কিছুটা টের পেলেও পাত্তা দিচ্ছেনা। কারণ মৃন্ময়ের চিন্তা -ভাবনায় এ ধরণের মেয়ে কখনো থাকবেনা। এরই মাঝে পিহু রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো। মৃন্ময় পিহুর হাত ধরে টেনে এক কর্ণারে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” শোন যা চাইস তাই দিবো। একটা কাজ করে দিতে হবে।”
পিহু নিচু দিকে ঝুঁকে শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে গভীর সন্দেহ। নিশ্চয়ই কোনো অকাম করেছে সেটা ঢাকা দেওয়ার জন্যই ঘুষ দিতে চাইছে। সে শাড়ির কুচিতে মনোযোগ রেখেই বলল,
” ঘুষ খাওয়া হারাম। আমি কোনো হারাম খেতে পারব না।”
” তাহলে মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে কাজটা করে দে।”
পিহু এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মৃন্ময়ের দিকে সরাসরি দৃষ্টি রেখে বলল,
” কি অকাম করেছো?”
মৃন্ময় তরীদের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ওইযে তরী নামের মেয়েটা আছেনা? ও সারাদিন একাকি ঘরে পড়ে থাকে। আমার মনে হয় ওকে সাথে নিতে পারলে ওর ভাল লাগত।”
পিহুর বুঝতে বাকি নেই ডাল মে কুচ কালা হে। তার ভাই যে তরীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তা চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। পিহুকে ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃন্ময় বলল,
” ওর বাপ সহযে ওকে ছাড়বে না। তুই গিয়ে বল তরীকে আমাদের সাথে যেতে দিন। আপনাদের নতুন বিয়ে হয়েছে একটু কোয়ালিটি টাইম কাটানোর প্রয়োজন আছে। এসব বললেই রাজি হয়ে যাবে।”
পিহু মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” তুমি গিয়ে বলো। আমি কেন?”
পিহুর মাথা একটা চাটি দিয়ে বলল,
” কোন বাপ তার মেয়েকে একটা জোয়ান ছেলের সাথে ছাড়বে। তুই মেয়ে মানুষ তোর সাথে ছাড়বে। পাম পট্টী দিয়ে নিয়ে যায়।”
পিহু চোখ মুখ ঘুচিয়ে তরীদের ফ্ল্যাটের দরজায় উঁকি মারল। ওদের ডায়নিং এই তরী কাজ করছিলো। পিহু তরীকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
” কি করছে পিচ্চি মেয়েটা।”
তরীর মুখে অমায়িক হাসি পিহুকে দেখে। হাতের কাজ ফেলে পিহুকে বলল,
” বসুন আপু।”
এসময়ে তরীর বাবা-মা দু’জনে ডায়নিং এ প্রবেশ করল। পিহু আমতা আমতা করে তরীর বাবাকে বলল,
” ভাইয়া একটা কথা ছিলো।”
তরীর বাবা স্বভাবসুলভ হেসে জবাব দিলেন,
” কি কথা।”
” আমরা একটা বিয়ের অনুষ্টানে যাচ্ছি সাথে তরীকেও নিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের নতুন বিয়ে হয়েছে নিজেদের মত করে সময় কাটান আপনারা।”
সাথে সাথে দিশা বলে উঠল,
” আমিও যেতে চাই।” দিশা ভাবছে মৃন্ময় ও যাবে সাথে। তাহলে মৃন্ময়ের সাথে সময় কাটাতে পারবে। পিহুর সেটা বুঝতে বাকি নেই। সে চালাকি করে বলল,
” আমি আর তরী যাচ্ছি। ভাইয়া গেলে ভাল হত। এতগুকা সুন্দরী মেয়ে দেখেশুনে রাখতে পারত। ”
দিশা খুব আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল,
” মৃন্ময় যাচ্ছেনা?”
” না।”
” আচ্ছা তাহলে তরীকে নিয়েই যাও।”
পিহু মৃদু হেসে তরীকে বলল,
” যাও রেডি হও।”
তরী সিম্পল সাধা-মাঠা একটা ড্রেস পরে রেডি হয়ে এলো।পিহুর সাথে ঘর থেকে বের হলো। তরী বের হতেই চোখে চোখ পড়ল মৃন্ময়ের। মৃন্ময় সিঁড়ির হাতল ধরে দাঁড়িয়ে মাথার পেছনের চুল চুলকাচ্ছে। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। তরী সিঁড়ির কাছে মৃন্ময়ের কাছাকাছি যেতেই মৃন্ময় বলল,
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৬
“মাশাল্লাহ, রাতের প’ রী দিনের আলোয় ধরা দিয়েছে।”
তরীর মুখের সামনে চুল গুলো কানের নিচে গুজতে গুজতে বলল,
” ধন্যবাদ কাকু।”
মৃন্ময় ধপাস করে সিঁড়িতে বসে পড়ে বলল,
” বি’ ষ হবে কালো বি’ ষ, গোলাপি বি’ষ, খয়েরী বি’ষ। ”