একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২২

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২২
Mousumi Akter

রোশানের আম্মা সারাহ’র দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,
” উনি সম্পর্কে তোমার দাদী হন, মজা করে কথা বলেছেন। তার জন্য তুমি ওভাবে কথা শুনাবা। কথা তো খারাপ কিছু বলেন নি।”
সারাহ শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও আর বলতে পারলোনা। রোশান ও যেন কি কাজে এদিকে এসছিলো আবার চলে গিয়েছে। রোশানের আম্মা সারাহ’র আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে বললেন,

” এ’কি তুমি থ্রি পিস পরেছো কেন নতুন বউ। এ বাড়ির বউরা সবাই শাড়ি পরে। তুমি হলে এ বাড়ির নতুন বউ, দিন -দুনিয়ার মানুষ তোমাকে দেখতে আসছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা তোমাকে দেখে কি বলবে। তোমার পোশাক নিয়েই বা কি বলবে। পাড়ার মানুষ তো ছি! ছি! করবে। একদিনেই এ বাড়ির মান-সম্মান সব ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিবা তুমি। যাও এখনি গিয়ে এসব থ্রি-পিস খুলে শাড়ি পরে আসো। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারাহ’র মুখটা কালো হয়ে গেলোম রোশানের মায়ের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে নিজের মায়ের মুখটা ভেষে উঠল। কই তার মা তো সামান্য ভুলে এমন আচরণ কখনো করেনি। থ্রি-পিস পরা নিয়ে তো কখনো কথা শোনায়নি। তাহলে কি বিয়ে মানেই একটা মেয়ের জীবনের সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। বিয়ে মানেই কি এক বাড়ির আদরের মেয়ে আরেক বাড়ির অবহেলার পাত্রী। শ্বাশুড়ি আর নিজের মায়ের মাঝে কি এতই তফাৎ? মায়েদের এতগুলো রুপ কেন হয়? তাহলে আমার ভাই থাকলে সে বিয়ে করলেও কি আমার আম্মুও এমন করত। সারাহ’র ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। তার জীবন তার দিন-দুনিয়া সব কি তাহলে আজ থেকে এভাবে পালটে যাবে। সারাহ শ্বাডুড়ির সামনে মাথা নত করে মিহি কণ্ঠে বলল,

” আমিতো শাড়ি পরতে জানিনা। ”
রোশানের আম্মা খিটমিট কণ্ঠে বললেন,
” পারোনা, পারতে হবে। কেউ সব আগে থেকে পারেনা। ধীরে ধীরে শিখতে হয়।”
সারাহ রোশানের আম্মার দিকে দু’চোখ মেলে তাকালো। তাকিয়ে খেয়াল করল, রোশানের আম্মার কেন যেন তাকে পছন্দ নয়।। এ বাড়িতে আসার আগ থেকে কখনো ভালো ভাবে কথা বলেনি। ছেলের বউ হিসাবে কি তাহকে ওনার আমাকে পছন্দ নয়। না’হলে বাড়ির নতুন বউ-এর সাথে তো কেউ এত উগ্রভাবে কথা বলেনা। সারাহ এখনো পুরোপুরি সিওর নয়। তাই চুপ রইলো। কিচেনে উপস্থিত মুরব্বি মহিলাটি সারাহ’র মাথার চুলে হাত দিয়ে বলল,
” তোমার চুল তো ভিজেনি। গোসল করেছো চুল ভেজাও নি?”

সারাহ কৌতুহলী চোখে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। সে কী একবার ও গোসলের কথা বলেছে। তাহলে উনি আন্দাজে গোসলের কথা কেন বলছেন? সারাহ’র মুখের অবয়ব কেমন বোকাদের মত হয়ে গেলো। সে বোকা বোকা চোখে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি গোসল করেছি কে বলল? ”
তখনি মহিলাটি রোশানের আম্মার দিকে কপাল টান টান করে তাকালো। তার মানে এই মেয়ে গোসল ও করেনি। রোশানের আম্মা মহিলাটির কানে ফিঁস ফিস করে বলল,

” আপনি একটু জিজ্ঞেস করেন গোসল করেছে কীনা!”
সারাহ’র এখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে একদম বোকাসোকা লাগছে। তাকে উপস্থিত রেখে অন্য দু’জন কানে কানে ফিস ফিস করছে। নিজেকে ভীষণ বেকুব লাগছে সারাহ’র। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে জিভ দিয়ে বারবার দুই ঠোঁট ভেজাচ্ছে। মুরব্বি মহিলাটি বলল,
” কাল রাতে গোসল করোনি?”
সারাহ কপাল কুঁচকে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” না’তো? কেন করব গোসল?”

” স্বামীর সাথে মেলামেশা করলে পাক-পবিত্র হতে হয় তাও জানোনা। বয়স যে একেবারে কম তাও তো না।”
সারাহ’র মাথায় এতক্ষণে এটা আসেইনি যে এই মহিলা এসব অসভ্য কথাবার্তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সারাহ যেন অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এইসব কথাবার্তা ও মানুষ মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করে।
এরই মাঝে রোশানের আম্মা সারাহ’র দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,
” তুমি এই অপবিত্র অবস্থায় রান্নাঘরে প্রবেশ করেছো। যাও এখনি বের হও। এখনি গিয়ে গোসল করে শাড়ি পরে এসো।”

শ্বাশুড়ির মুখে এমব কথা শুনে লজ্জায় সারাহ ওখানে দাঁড়াতে পারছেনা। মাথা যেন কে’ টে পড়ে যাচ্ছে। শ্বাশুড়িকে সরাসরি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” তা আগে বলবেন না ওইসব কথা বলছেন। তাহলে তো উত্তর আগেই দিয়ে দিতাম। কাল সারারাত তো আমি ঘুমোই নি শুধু গোসল ই করেছি।” বলেই সারা কিচেন থেকে রওনা হল। কিচেন থেকে বের হতেই একটা মেয়ের মুখোমুখি হলো। মেয়েটা গতকাল রাতেই সেই মেয়ে। সারাহ’র দিকে এমন ভাবে চেয়ে আছে যেন সারাহ মেয়েটার চোখের বালি। সারাহ বুঝতে পারছে না মেয়েটা তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? এ বাড়িতে আসার পর থেকে সবার আচার আচরণ কেমন অদ্ভুত লাগছে সারাহ’র কাছে। সারাহ যেন এ বাড়ির বউ নয় এ বাড়ির শত্রু। সারাহ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নিজেদের রুমে যেতে যেতে ভাবছে,

“এই মেয়ে আমার দিকে কুচক্রী মহিলাদের মত তাকিয়ে থাকে কেন? এই মেয়েকে আমি কী করেছি? কি আশ্চর্য! মেয়েটা কি রোশান স্যারের আগের বউ না প্রেমিকা।”
ভাবতে ভাবতে সারাহ তার আর রোশানের রুমে প্রবেশ করল। রুমে প্রবেশ করতেই দেখল, রোশান বিছানায় পা মেলে দিয়ে বসে আছে। পায়ের ওপর ল্যাপটপ রাখা। কি-বোর্ড চাপতেছে দুই হাত দিয়ে। সারাহ রুমে প্রবেশ করতেই রোশানের হাত দু’টো আপনা-আপনিই থেমে গেলো। সারাহ’র বিরক্ত মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো রোশান৷ চঞ্চল মেয়েটা কেমন বিরক্ত হয়ে আছে সাথে একটু মন খারাপ ও দেখা যাচ্ছে। রোশান ল্যাপটপের সাটার অফ করে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,

” এনি প্রব্লেম সারাহ?”
সারাহ লোহিতবর্ণ চোখে রোশানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এ বাড়িতে আসার পর থেকে বাড়ির সবার আমাকে নিয়েই প্রব্লেম বলে মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে বউ নয় যেন একজন শত্রু নিয়ে এসছে এমন ব্যবহার করছে সবাই।”
রোশান বুঝতে পারল নিশ্চিত সারাহ’কে কেউ কিছু বলেছে। ল্যাপটপ টা পায়ের ওপর থেকে নামিয়ে বিছানার ওপর রাখল। গম্ভীর চোখে -মুখে সারাহ দিকে এসে অত্যান্ত নমনীয় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কেউ কিছু বলেছে?”

সারাহ রোশানের চোখের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে ভাবল, সবার মন মানসিকতা এক নয়। হয়ত রোশান স্যারের মা অমনই। কিছু মানুষের কথা-বার্তায় মুদ্রা দোষ ও থাকে। হয়ত আমিই তাকে ভুল বুঝছি। তাই বলে বিয়ের পর দিনই তারই সন্তানের কাছে তার বদনাম বলব। একজন সন্তান হয়ে নিশ্চয়ই রোশান স্যারের নিজের মায়ের নামে খারাপ কথা শুনতে ভাল লাগবেনা। ছি! ছি! মায়ের নামে বদনাম বলে সন্তানের মনে বিষক্রিয়া তৈরি করা যাবেনা। সে আমার সাথে যতই খারাপ ব্যবহার করুক না কেন? আমি এসব পারব না। তাছাড়া যত যা হোক রোশান স্যার আমার স্বামী, এটাই বড় কথা। যা কিছু হয়ে যাক বাকি জীবন আমাকে মানিয়ে নিয়ে তার সাথেই কাটাতে হবে। তার জীবনে তার প্রিয় মানুষদের খারাপ ভাবে উপস্থাপন করে তার মনে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারব না। তাই সারাহ বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে জবাব দিলো,

” একজন মুরব্বি মহিলা বলেছেন গোসল করে শাড়ি পরতে?”
রোশান ও সরল মনে জিজ্ঞেস করল,
” কেন?”
এই কেন’র উত্তর দেওয়া সারাহ’র পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। যতই হোক রোশান তার স্যার। আর এ ধরণের নোংরা কথা তার পক্ষে বলা সম্ভব ই নয়। সারাহ’কে চুপ থাকতে দেখে রোশান আবারও জিজ্ঞেস করল,
” কি হলো চুপ আছো যে..”
সারাহ মনে মনে বলল, বয়স হয়ে গেলো আশি এখনো এসব জানেনা। ন্যাকা, বিয়ে করতে বলেছিলো কে?
সারাহ’কে বিড়বিড় করতে দেখে রোশান আবারও প্রশ্ন করল,

” এক্সকিউজ মি!”
সারাহ এবার বিরক্ত চোখে রোশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ঠিক বয়সে বিয়ে করলে এতদিনে ছত্রিশ টা সন্তানের বাবা হতেন। আর এখনো এসব জানেন না। আপনাদের কিচেনের ওই বুড়ি মহিলা বলেছে বিয়ের পরের দিন গোসল করতে হয়। তাই আমিও যেন গোসল করি।”
রোশান চোখ বড় বড় করে সারাহ’র দিকে তাকালো।
দ্রুত কয়েকটা শুকনো কাশি দিয়ে বলল,
” তার জন্য রিজন লাগে। তুমি তো জানো এসবের প্রয়োজন নেই তোমার।”
সারাহ তরতর করে বলে উঠল,

” তা আমি জানলে কি হবে। আপনাদের বাড়ির মানুষের ই তো বিশ্বাস নেই আপনার প্রতি। ” বলেই সারাহ গোসলে ঢুকল। রোশান হা করে ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে মাথার চুল চুলকাতে চুলকাতে বলল,
” এই বাচ্চা মেয়েকে কে বুঝাবে? আমার মত ভদ্র পুরুষ দুনিয়াতে একটাও নেই। আমি বলেই বেঁচে গিয়েছো।”
আধাঘন্টা পরে সারাহ গোসল শেষ করে লাল টকটকে একটা সুতি শাড়ি পরে বের হলো। রোশান হা করে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। কেমন যেন মনে হলো সাত সকালে একটা পুতুল ওয়াশ রুম থেকে বের হলো। স্নিগ্ধ কোমল যাকে দেখেই স্পর্শ করতে ইচ্ছা করছে। রোশানের শরীর এক প্রকার ঝিম ধরে গেলো। সে যেন সারাহ’কে দেখল না, নিজ চোখে নিজের সর্বনাশ দেখল। সারাহ নিচু দিকে ঝুঁকে শাড়ির কুচি ঠিক করছে। কিন্তু নিচ থেকে বারেবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে রোশানের দিকে তাকিয়ে বললো,

” একটু কুঁচিটা ধরে দিবেন?”
রোশান কেমন টালমাটাল ভাবে সারাহ’র দিকে এগিয়ে গেলো। নেশাক্ত চোখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সারাহ’র শাড়ির কুচি ধরে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সারাহ’র মুখের দিকে। সারাহ কুচি ঠিক করছে আর বিড়বিড় করে বলছে,

” বিয়ে যখন করেছেন কুচি তো ধরতেই হবে”
রোশান এবার মৃদু হেসে বলল,
” তাহলে দাও কুচিটা গুজে ও দিই। সবটুকু সাহায্য আমিই করি তোমাকে।”
কথাটা সারাহ’র কর্ণকুহরে যেতেই সে রোশানের দিকে দৃষ্টি মেলল। দ্রুত দু’পা সরে গিয়ে শাড়ির কুচি গুজে বলল,
” আপনার কাজ শুধু কুচি ধরা, আর কিচ্ছু না।”
রোশান ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে বলল,
” আচ্ছা।”

সারাহ ড্রেসিন টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়নায় নিজেকে দেখছে। এদিকে চুলের পানিতে পেছনের শাড়ি সব ভিজে যাচ্ছে। সারাহ’র সেদিকে খেয়াল নেই। কিন্তু রোশানের খেয়াল আছে। সে সারাহ’র প্রতিটা নখের ও খেয়াল রাখে। আচমকাই রোশান সারাহর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ টাওয়াল দিয়ে সারাহ’র চুল মুছে দিতে লাগল। সারাহ আয়নায় দেখল তার পেছনে দাঁড়িয়ে একজন সুদর্শন পুরুষ আলগোছে তার চুলের পানি মুছে দিচ্ছে খুব যত্নের সাথে। একটা পুরুষ এতটা যত্নশীল হতে পারে রোশান’কে না দেখলে বোঝা যেতনা। সারাহ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে আর রোশান চুলের পানি মুছে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেলো। এরই মাঝে সারাহ’র ফোন বেজে উঠল। সারাহ ফোন রিসিভ করতেই ছোঁয়া বলে উঠল,

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২১

” ফুলসজ্জা কেমন হলোরে সারাহ?”
সারাহ রোশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যে লোক ফুলসজ্জার রাতে সারারাত চোখে চশমা পরে কাটিয়ে দিতে পারে, তার ফুলসজ্জা আর কেমন হবে। ওটাকে ফুলসজ্জা নয়, বলে চশমাসজ্জা।”
সারাহ’র মুখে এম এমন কথা শুনে রোশান দ্রুত চোখের চশমা খুলে অদ্ভুত চোখে সারাহ’র দিকে তাকালো।

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৩