একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৩
Mousumi Akter
মৃন্ময়, পিহু আর তরী তিনজনে গল্প করতে করতে বাড়িতে ফিরলো। ঘড়িতে তখন সকালো এগারোটা। এই জীবনে প্রথমবার তরী কেন যেন মন খুলে হাসছে। ওকে দেখেই মনে হচ্ছে, মনের আকশের কালো মেঘ সব মুছে গিয়েছে। এই উন্মুক্ত হাসির একমাত্র কারণ মৃন্ময়। মৃন্ময় কিছু বলছে আর তরী সেটা শুনেই হাসছে। দিশা তখন দো’তলার বেলকনিতে ভেজা কাপড় শুকানোর জন্য মেলে দিচ্ছিলো। আচমকা চোখ গেলো নিচের দিকে।
মৃন্ময়ের পরণে হলুদ রঙের পাঞ্জাবী, পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো,হাতে স্মার্ট ঘড়ি,সামনের চুলগুলো খানিকটা বড়, একগোছা চুল কপালে পড়েছে। দিশা অবাক চোখে মৃন্ময়ের সুদর্শন চেহারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পৃথিবীতে সুন্দরের ব্যাখ্যা কি দিশা সেটা জানেনা, তবে এতটুকু বুঝেছে মৃন্ময় সুন্দর পুরুষ। যাকে একবার দেখলেই হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়। গতকাল সারারাত দিশার ঘুম হয়নি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মৃন্ময়ের জন্য সারাটা রাত ছটফট করেছে। এ বাড়িতে পা রেখে মৃন্ময়কে এক নজর দেখার পর থেকেই দিশার সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে আফসোস করছে। কেন সে এই বয়স্ক লোকটাকে বিয়ে করেছিলো? না’হলে আজ ঠিকই জোর গলায় মৃন্ময়কে বলতে পারত, সে মৃন্ময়কে ভালবাসে। মনে মনে তরীর বাবার প্রতি ঘৃণা জমছে দিশার। এই লোকটা জীবনে না আসলেই তো সে আজ মৃন্ময়কে পেয়ে যেত। একটা লাক্সারি লাইফ কাটানোর জন্য দিশা বেছে নিয়েছিলো তার বাবার চেয়ে বয়সে বড় একজন মানুষকে। কিন্তু মৃন্ময়? ওর বাবার ও তো কিছু কম নেই। একটাই তো ছেলে ও। বাবার সব তো ওই পাবে। মৃন্ময়ের সাথে বিয়ে হলেও বা লস কি হবে। এমন সময় তরীর বাবা এসে দিশার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,
” চলো ঘরে।”
দিশা ছ্যাঁৎ করে উঠে বলল,
” শুধু ঘরে যাওয়ার চিন্তা না করে নিচে তাকিয়ে দেখো।”
তরীর বাবা নিচে তাকালো। তারপর দিশার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কি?”
দিশা খিটমিট করে বলে উঠল,
” চুলেও পাক ধরেছে তোমার।আর এখনো বুঝতে পারছো না কি। তোমার বিবাহযোগ্য মেয়ে ওই ছেলের সাথে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। ”
তরীর বাবার সেসব নিয়ে আহামরী চিন্তা নেই। সে গভীর কিছু না ভেবে বলল,
” ওর এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। মাত্র পনেরো বয়স।”
” তাই নাকি? তোমার মত ষাট বছরের বুড়োর সাথে যদি আমি আসতে পারি তাহলে ওদের দু’জনের বয়স তো আরোও কাছাকাছি। ”
দিশার মন যোগাতে তরীর বাবা বলল,
” আচ্ছা মাথা ঠান্ডা করে বলো, কি করতে হবে?”
” সম্পর্কে আমিও তরীর মা হই। আমি কখনো চাইবো না তরী এলোমেলো চলাফেরা করুক।”
তরীর বাবা আবারও দিশাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” এইনা হলে আমার বউ।”
কিছুক্ষণের মাঝে তরী এসে কলিং বেল চাপল। দিশা দরজা খুলে বুকে হাত বেঁধে তরীর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। তরী একবার দিশার দিকে চকিতে তাকালো। তারপর মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা হলো। পেছন থেকে দিশা ডাকল,
” দাঁড়াও তরী।”
তরীর পা’দুটো থেমে গেলো। কিন্তু পেছন ঘুরে তাকালো না। দিশা বলল,
” মৃন্ময় ও গিয়েছিলো? তোমাদের সাথে রাত থেকেছিলো।”
তরী শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
” হ্যাঁ। ” এতটুকু বলেই দ্রুত গতিতে পা বাড়িয়ে চলে গেলো।দিশা কেমন যে৷ হিংসায় জ্বলে পুড়ে অংগার হয়ে যাচ্ছে। ইশ! সে যদি যেত, তাহলে পুরা রাতটা মৃন্ময়ের সাথেই কাটাতে পারত।
তরী এগারোটার দিকে বিয়ে বাড়ি থেকে এসে গোসল করে দুপুরের রান্না শেষ করে বিছানায় গিয়ে শরীর ছেড়েছে কেবল। তখন ই ডায়নিং থেকে কিন্তু আপত্তিকর কথা-বার্তা আসছে। যা একজন মেয়ে হয়ে তরীর পক্ষে শোনা সম্ভব নয়৷ তরীর বাবা দিশাকে খাইয়ে দিচ্ছেন আর আদুরে বিভিন্ন নামে ডাকছেন। বেশ কিছুক্ষণ তরী কানে আঙুল গুজেও এসব কথা থেকে রক্ষা পেলোনা। তাই ছাদে কাপড় নাড়ার নাম করে সোজা ছাদে উঠে গেলো। ছাদে এখন কড়া রোদ। তরী খালি পায়ে গিয়েই বিপদে পড়েছে। পায়ের পাতা কিছুতেই ছাদে রাখতে পারছেনা।
যেন পুড়ে যাচ্ছে। তরী ঘনঘন দু’পা উঁচু- নিচু করছে। তরীকে ছাদে যেতে দেখে মৃন্ময় ও সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ছাদে চলে গেলো। সে সিঁড়ি ঘরে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখছিলো তরীকে। কিন্তু লুকোচুরি করে বেশীক্ষণ থাকতে পারল না। বুঝতে পারলো তরীর পা পুড়ে যাচ্ছে। ছাদের ফুল গাছে পানি দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ আগেই ছাদের কয়েকটা ড্রাম ভরেছে ঠান্ডা পানি দিয়ে। মৃন্ময় দ্রুত এক বালতি পানি ড্রাম থেকে তুলে তরীর পায়ের ওপর ঢেলে দিলো। আচমকা পায়ের নিচে ঠান্ডা অনুভব হওয়ার তরী তাকিয়ে দেখলো পানি গড়িয়ে যাচ্ছে।
আকস্মিক এমন ঘটনা দেখে তরী দ্রুত পেছন ফিরে তাকালো। পেছন ফিরে তাকিয়েই চোখ দু’টো ছানাবড়া হয়ে গেলো। সাথে সাথে চোখ দু’টো বন্ধ করে দিলো। লম্বা পুরুষালী দেহের অধিলারী মৃন্ময় খালি গায়ে,শর্ট প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাতে ঘড়ি বাঁধা। মৃন্ময় জানেনা তরী এতটা লজ্জা পেল কেন? আর লজ্জা পাওয়ার কারণ টাই বা কী? সে শর্ট প্যান্টের পকেটে হাত গুজে ধীর পায়ে তরীর দিকে এগিয়ে গেলো। তরীর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই খেয়াল করল তার আর তরীর হাইটের বিশাল ব্যবধান। তরীর মাথা তার বুক অবধি হবে। মৃন্ময় তরীর মাথায় হাত রেখে বলল,
” একদম পুতুল তুমি। আমার জন্য পারফেক্ট।”
তরী সাথে সাথে বড় বড় চোখে মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। মৃন্ময় তরীর মায়াবী চোখের দিকে তাকালো। কেন যদি এই তপ্ত দুপুরে তরীকে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। মৃন্ময় এর মুখে আজ কিছুই আটকালো না। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
” তুমি যদি কখনো আমাকে জড়িয়ে ধরো, তোমার মাথাটা ঠিক আমার বুকে এসে বিঁধবে। যাকে বলে পারফেক্ট ম্যাচ। একদম হার্টবিট মাপার মত হাইট তোমার। ভাবছি এখন থেকে অসুস্থ হলে তোমাকে দিয়ে হার্টবিট মাপাবো।”
জীবনে প্রথমবার কেউ তরীর মুখের ওপর জড়িয়ে ধরার কথা বলল। লজ্জায় তরীর নাক ফুলে উঠেছে। এত লজ্জা সে জীবনে কখনো পায়নি। মৃন্ময়ের কথার উদ্দেশ্য সে বুঝতে পেরেই বলল,
” আমি কেন আপনাকে জড়িয়ে ধরতে যাবো কাকু?”
মৃন্ময় এর পূর্ণ ফিলিংস এ জল ঢেলে দেওয়ার জন্য তরীর কাকু ডাকটাই যথেষ্ট। মৃন্ময়ের মাথায় সাত আসমান ভেঙে পড়ার জন্য এই কাকু ডাকটাই যথেষ্ট। মুহুর্তের মাঝে মৃন্ময়ের মুখের অবয়ব পরিবর্তন হয়ে গেলো। সে নিবিড় চোখে তাকালো তরীর পায়ের দিকে। ইশ পা’ দুটো কি ছাদের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। পানি ঢেলেও কি কাজ হয়নি। পায়ের পাতা দু’টো ঘনঘন নাড়াচাড়া করছে কেন?
মৃন্ময় আকস্মিক বসে পড়ল। তার হাত দুটো চিৎ করে মেলে ধরে বলল,
” এই অধমের হাতের ওপর আপনার সুন্দর পা’জোড়া রাখুন ম্যাডাম। তাহলে আর পা পুড়বে না।”
মৃন্ময়ের এমন পা’গ’লা’মি দেখে তরী সাথে সাথে চোখ নামালো নিচে। তাকিয়ে দেখল, মৃন্ময় হাত দুটো মেলে হাসিখুশি মুখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তরী দ্রুত পা’জোড়া নিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
” এ কি করছেন? আপনার হাত পু’ ড়ে যাবে।”
” কাকু ডেকে মন পো-ড়া’ নোর চেয়ে, আমার হাত দু’টো বরং জ্বালিয়ে দাও তাতেও শান্তি পাবো।”
তরী দ্রুত বলল,
” দেখুন আমি এত কঠিন কথা বুঝিনা। আপনি হাত সরাণ।”
মৃন্ময় উঠে দাঁড়ালো। নিজের পায়ের স্যান্ডেল জোড়া তরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
” তাহলে এটা পরো।”
তরী শান্ত কণ্ঠে বলল,
” আর আপনি?”
” পুরুষ মানুষের পায়ের চামড়া আর গায়ের চামড়া দু’টোই পুরু হয়। এসব তাপে ওরা পো’ড়ে না। পুরুষ পো’ড়ে সুন্দরীদের রুপের আ’গু’নে।”
তরীর এখনো ভারী বুদ্ধি হয়নি। সুন্দরীদের রুপের আ’গু’ন শুনে ফিক করে হেসে দিলো। মৃন্ময় হা করে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো। কি আশ্চর্য! হাসে এই মেয়ে আর মৃন্ময়ের হৃদয় শান্ত হয়। তরী খেয়াল করল,
মৃন্ময় ঝিম ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
” ওভাবে কি দেখছেন?”
” তোমার পা।”
” আমার পা?”
” হ্যাঁ, একজোড়া নূপুর ছাড়া বড্ড বেমানান লাগছে।”
তরী আবার ও লজ্জা পেলো। মৃন্ময়ের কথা তাকে দিচ্ছে এখন। কিন্তু কেন? মৃন্ময়ের দিকে তাকাতেও লজ্জা পাচ্ছে। এরই মাঝে দিশা ছাদে প্রবেশ করল। সে দুপুরে খেয়ে মৃন্ময়দের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলো মৃন্ময়কে খুজতে। কিন্তু ওখানে গিয়ে শোনে মৃন্ময় ছাদে। তাই ছুটে ছাদে আসে। দিশা জানে পুরুষ আকর্ষিত হয় নারীর দেহে। তাইতো দিশা ছাদে ওঠার আগে বুকের কাপড় একটু সরিয়ে এট্রাকশন তৈরির উদ্দেশ্য মৃন্ময়ের সামনে এসছে। ছাদে এসেই মৃন্ময়কে বলল,
” কি ব্যাপার দেবর জি। তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।”
মৃন্ময় বিরক্তিতে অসহ্য হয়ে পড়ল। মনে মনে এই দিশাকে সে দু’চোখে দেখতে পারেনা। এইজন্য একটু অপমানের সুরে উত্তর দিলো,
” নিজের বর ছেড়ে, দেবর কে কেন খুঁজছেন ভাবি।”
দিশা তরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোমাকে তোমার বাবা ডাকছে।”
তরী কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয় গেলো। তরী যেতেই মৃন্ময় দিশার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার বাবাও আমাকে ডাকছে। আমি আসি ভাবি। আর হ্যাঁ আপনি যখন এসেছেন ই একটা কাজ করে দিন। আব্দুল এক বালতি ধোয়া কাপড় নিয়ে আসতেছে ছাদে। একটু নেড়ে দিয়েন।” বলেই মৃন্ময় চলে গেলো।
দিশা রাগে গটগট হয়ে নিজের চুল ছেড়ার চেষ্টা করল। মৃন্ময়ের জন্য উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে আর মৃন্ময় পাত্তাই দিচ্ছেনা।
মৃন্ময় দ্রুত ছাদ থেকে নামার কারণে তরীর সাথে আবার দেখা। তরীর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২২
” তোমার মা’কে সামলে রেখো।”
তরী এক গাল হেসে দিয়ে বলল,
” আচ্ছা কাকু।”
কাকু ডাক শুনে মৃন্ময় হতাস, পুরাই হতাস। হতাস চোখে চেয়ে বলল,
” এইভাবে আমাকে কাকু ডেকে অত্যাচার না করে নর্দমার সরবত খাওয়াও। ”