একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৪

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৪
Mousumi Akter

তখন পড়ন্ত বিকাল। সূর্যের আলো ক্রমশ মোলায়েম হয়ে আসছে। দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই যে যার ঘরে রেস্ট করছিলো। রোশান-সারাহ ও নিজেদের ঘরে রেস্ট করছিলো। দু’জনেই ঘুমে বিভোর। ঘুমের ঘরেই সারাহ’র একটা হাত আর একটা পা রোশানের গায়ের ওপর উঠে গিয়েছে। এটা অজান্তেই হয়েছে সারাহ টের পায়নি। তখনই রোশানের মামাতো বোন জিনাত রোশানদের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে প্রবেশ করেই এমন অবস্থা দেখে চোখ কপালে উঠল। দ্রুত পেছন দিকে ঘুরে তাকিয়ে খুব জোরে বলে উঠল,
” ছি! ছি! দিনের বেলা ঘরের দরজা খোলা রেখে এভাবে কেউ ঘুমায়?”

জিনাতের উচ্চকণ্ঠে ঘুম ভাঙল রোশান-সারাহ’র। সারাহ চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল তার হাত রোশানের বুকের ওপর দেওয়া। রোশান ও চোখ খুলে একই দৃশ্য দেখল। সারাহ দ্রুত হাত আর পা সরিয়ে নিলো। বুকের মাঝে যেন কেউ হাতুড়ি পে’ টা করছে। আচমকা কানের কাভহে শব্দ শোনাতে এমন হচ্ছে তার। রোশান সোয়া থেকে উঠে বসল। ডানে বামে তাকিয়ে চশমাটা খুজে চোখে পরল। চশমটা পরেই সারাহ’র দিকে তাকালো। সারাহ কেমন যেন হাঁপাচ্ছে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। রোশানের অভিজ্ঞ দৃষ্টি বুঝতে সক্ষম হলো আচমকা ঘুমের মাঝে শব্দ হওয়াতে সারাহ ভয় পেয়ে গিয়েছে। রোশান চোখের দৃষ্টি ঘুরালো। চেহারায় কেমন থমথমে একটা ভাব। বিরক্তিতে ভরা। অসহ্য রকমের বিরক্ত হয়ে সে জিনাতের দিকে তাকালো। কণ্ঠে তীব্র বিরক্তি নিয়ে কপালের চামড়া কুচকে প্রশ্ন করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এনি প্রব্লেম জিনাত?”
জিনাত পেছনে দিকে ঘুরে থেকেই উত্তর দিলো,
” তোমরা কি স্বাভাবিক হয়েছো?”
জিনাতের এমন ন্যাকামোমার্কা কথায় রোশানের বিরক্তির মাত্রা আরোও কয়েকগুন বাড়ল। রাগে শরীর ফেঁটে যাচ্ছে। এসব তার পছন্দ নয়। কোনোমতে নিজের রাগ সামলে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” এসব ন্যাকামো না করে এদিকে ঘোরো। ”
জিনাত সামনের দিকে ঘুরল। সামনের দিকে ঘুরতেই রোশাণ আগের রুপেই বহাল থেকে প্রশ্ন করল,
” তোমার কোনো কমনসেন্স নেই জিনাত। ঘুমন্ত মানুষের কানের কাছে এসে কেউ এভাবে চিৎকার দেয়? দেখো সারাহ কেমন ভয় পেয়েছে। ওর চোখ -মুখ কেমন শুকিয়ে গিয়েছে।”

রোশানের চোখে- মুখে সারাহ’র ভয় পাওয়া নিয়ে দুঃচিন্তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রোশানের বিরক্তির কারণ ও এটাই সেটাও জিনাত বুঝতে পেরেছে। জিনাতের পায়ের তালু থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সার্বাঙ্গ যেন জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। কেন এই মেয়েটার জন্য রোশানের এত চিন্তা হবে, কেন এই মেয়েটার জন্য কেয়ারিং হবে। কি আছে এই মেয়েটার মাঝে। জিনাতের চোখ দু’টো আ’গু’ন হয়্র গেলো। সে আ’গু’ন চোখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সাথে সাথে রোশানের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,

” কমনসেন্স কি তোমাদের নেই? নবদম্পতি তোমরা দরজা এইভাবে ওপেন রেখে ঘনিষ্টভাবে সুয়ে আছো।” কথাটা যেন সরাসরি সারাহ’র উদ্দেশ্য ছুড়লো জিনাত। কারণ কথাগুলা বলার সময় চোখ ছিলো সারাহ’র দিকে। সারাহ আশ্চর্যজনক ভঙ্গিতে জিনাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখে এত আ’গু-ন কেন তার জন্য। কীসের এত শত্রুতা। জিনাতের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে রোশান যেন বিরক্তিতে অসহ্য হয়ে পড়ছে। সে অসহ্যরকম চাহনিতে জিনাতের দিকে দৃষ্টি মেলে বলল,
” তুমি জানো আমরা নবদম্পতি, তাহলে নক না করে প্রবেশ করলে কেন? এতটুকু ম্যানার্স তো থাকা উচিৎ তোমার। বিকজ তুমি একজন এডাল্ট মেয়ে।”

” ঘরের দরজা খোলা দেখে আমি ভেবেছি, সমস্যা নেই। তাই এসছিলাম। কিন্তু কে জানত তোমরা দরজা খোলা রেখেই… ” এটুকু বলেই জিনাত থামল। এ ধরণের নোংরা কথার সাথে রোশান কখনো অভ্যস্ত নয়৷ তাই তার শরীর রি ‘রি করে উঠল ঘৃণায়। বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে বলল,
“দরজা খোলা রেখেই কি? হোয়াট ডু ইউ মিন? দিনে দুপুরে ঘরের সিঁটকিনি কেন লাগাতে হবে। তবে তোমার ম্যানার্সলেস কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে দরজার সিঁটকিনি না দেওয়াই ভুল ছিলো। ”
জিনাত আবারও বিস্ফোরিত কণ্ঠে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি ঘুমোনোর পরে, এই মেয়েটা এসছে। দেখো তুমি কেমন মেয়ে বিয়ে করেছো? যে জানেই না স্বামী-স্ত্রী একসাথে সময় কাটালে ঘরের সিঁটকিনি দিতে হয়। এই ম্যানার্স ওর নেই। এইভাবে আজীবণ ভর এই মেয়ের জন্য অপদস্থ হতে হবে তোমাকে। ”
জিনাতের কথাবার্তা সব সারাহ’র মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এমন উদ্ভট আচরণ আর বেয়াদবের মত কথা-বার্তা কেন বলছেন উনি? কি সমস্যা ওনার। সারাহ রোশানের দিকে তাকিয়ে শীতল চোখে প্রশ্ন করল,
” উনি কে?”
সারাহ’র এই সামান্যতম প্রশ্নে রোশানের বুকের মাঝে কেমন যেন বাড়ি মেরে উঠল। অজানা এক ভয়ে কেঁপে উঠল বুক। রোশান কিছু বলার আগেই জিনাত বলল,

” আমি কে সেটা পরে জানলেও চলবে৷ তোমাকে তোমার শ্বাশুড়ি ডাকছে। কুইক যাও। বাইরে লোকজন এসছে।”
সারাহ কোনো কথার উত্তর না দিয়ে সন্দিহান চোখে জিনাতের দিকে তাকাতে তাকাতে বাইরে চলে গেলো। সারাহ বাইরে যেতেই রোশান বিছানা ছেড়ে নামল। জিনাতের দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলল,
” কি চাও তুমি? সারাহ আর আমার জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করতে। সারাহ’কে না নয় আমি সামলে নিবো। কিন্তু তুমি? তুমি নিজেকে কোথায় নামাচ্ছো? নিজের খারাপ ব্যবহার দিয়ে নিজেকে থার্ডক্লাস প্রুভ করছো। আর এসব করে কি লাভ তোমার? ভবিষ্যৎ এ কখনো কোনদিন সারাহ’র সাথে বাজে ব্যবহার করবে না তুমি। ”
আচমকা জিনাত রোশানের কলার চেপে ধরে বলল,

“মেয়েটা কে হয় তোমার? কেন এত ভাবছো ওকে নিয়ে? কই আমাকে নিয়ে তো কখনো এতটুকু চিন্তা করোনি।”
রোশান জিনাতকে ধাক্কা দিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,
“মাই কুয়েশ্চন ইজ, হু আর ইউ? শী ইজ মাই ওয়াইফ। বউ হয় আমার। একটা মেয়ের জন্য চিন্তা হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় সম্পর্ক আর কিছু লাগে?”

বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। জিনাত রাগে গটমট হল। রোশানের তার প্রতি বিতৃষ্ণা দেখে ফ্লোরে বসে পড়ল। ভেতর থেকে কান্না উপচে পড়ল। নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগছে তার। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। রাগে, অস্থিরতায় নিজের মাথার চুল নিজে টেনে ছেড়ার চেষ্টা করছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” একটা ভুলের শাস্তি তুমি আমাকে আর কত দিতে চাও রোশান? আর কত প্রায়শ্চিত্ত করলে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। আর আর পারছি না। সারাহ ‘কে আমি খু’ন করে ফেলব রোশান। একদম খু’ ন করে ফেলব।”
রোশানের মা বারান্দায় বসে আছেন। সারাহ সামনে আসতেই কেমন একটা চোখে তাকালেন। সারাহ’কে তার চোখের কাটা মনে হচ্ছে। ওইযে কথায় আছেনা, দেখতে নারী চালন বাঁকা। রোশানের মায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। জিনাতের কারণে সারাহ কে তিনি মেনে নিতে পারছেন না। নিজের ভাতিজিকে ছেলের বউ হিসাবে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা না হওয়ার জন্য সারাহ ‘কে সহ্য করতে পারছেন না। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

” তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
সারাহ নমনীয় কন্ঠে বলল,
” জি বলুন।”
” এ বাড়ির দায়িত্ব আজ থেকে তোমার। আগামিকাল সকাল থেকেই এ সংসার তুমি সামলাবে। আমি আর কত বয়স তো হয়েছে।”
সারাহ রোশানের মায়ের কথায় বেশ চিন্তিত হয়ে উত্তর দিলো,
” এত বড় দায়িত্ব আমি পালন করতে পারব না আম্মা। আপনি দেখিয়ে দিলে কাজ করতে পারব।”
” সব ই শিখে যাবা আস্তে আস্তে। কাল সকালে উঠে রান্নাটা তুমিই করবা।”
সারাহ রান্নার কথা শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়ল। সে তো রান্না জানেনা। এখন কি হবে। এখন আর কিছু না বলে চুপ রইলো।

রাত এগারোটায় রোশান বাড়িতে ফিরলো। বাইকের হর্ণ বাজাতেই জিনাত গিয়ে গেটের দরজা৷ খুলে দিলো। বাইকের হর্ণের শব্দ শুনে সারাহ ও বাহিরে এসে উঁকি দিলো। উঁকি দিতেই দেখল গেটে জিনাত দাঁড়ানো। রোশানের হাতে ছিলো একটা ফুলের তোড়া। সেখান থেকে একটা ফুল জিনাতের হাতে দিলো। একটু আগেও সারাহ রোশানকে নিজের স্বামী বলে মেনে নিচ্ছিলোনা কিন্তু জিনাতকেও রোশানের পাশে মেনে নিতে পারছে না। অকারণ ই সারাহ ভয়ানক ভাবে রেগে গেলো।রুমে এসে খাটের ওপর মুখ কালো করে বসে রইলো। সারাক্ষণ চঞ্চল থাকা মেয়েটার মুখের অবস্থা এমন কেন রোশান তা বুঝতে পারছে না। কিছু না বুঝেই সারাহ’র দিকে তাকিয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল,

” ফুলের তোড়াটা নাও। আমার বন্ধু তোমার জন্য পাঠিয়েছে।”
সারাহ অগ্নিচোখে রোশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার ফুল লাগবে না। ওগুলো আপনার মামাতো বোন জিনাতকে দিয়ে আসুন সে খুব খুশি হবে।”
সারাহ’র মুখে জিনাতের নাম শুনে রোশান ঘাবড়ালো। তার মানে কি? সারাহ কিছু সন্দেহ করেছে জিনাত কে নিয়ে। রোশান ঘড়ি খুলে রেখে বলল,
” দিয়েছে তোমাকে, জিনাত কে দিবো কেন?”
সারাহ সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। রোশানের দিকে তাকিয়ে বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলল,
” অন্যোর ইউজ করা জিনিস সারাহ ব্যবহার করেনা, হোক সেটা ফুল অথবা মানুষ। ”
রোশান ভ্রু কুচকে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” ফুল আবার অন্য কেউ কীভাবে ব্যবহার করে।”

” যে ফুল আপনার মামাতো বোনকে দিয়েছেন সে ফুল আমি নিবো ভাবলেন কীভাবে? ওইফুল সারাহ ম’রে গেলেও হাতে নিবেনা। যান আপনার মামাতো বোনকে দিয়ে আসুন।”
রোশান ঠান্ডা মেজাজে বলল,
” জিনাতকে একটা ফুল দেওয়াতে কি তুমি রেগে গিয়েছো?”
সারাহ মুখভঙ্গী অদ্ভুত আকার ধারণ করে বলল,
” নাহ, নো, নেভার, ইম্পসিবল, হুয়াই, আমি কেন রাগতে যাবো?”
সারাহ’র এমন ইংলিশ শুনে রোশাণ অদ্ভুত চোখে সারাহ’র দিকে তাকালো। হাসি ও পেলো তার। তাও হাসি আটকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৩

” তুমিতো আর আমাকে ভালবাসোনা, তাহলে রেগে যাচ্ছো কেন?”
সারাহ রোশানের দিকে এক আঙুল উঁচিয়ে বলল,
” আমি ভালবাসিনা বলে অন্য কেউ ভালবেসে যাবে, তাও আমি হতে দিবোনা। আমিও ভালবাসবো না অন্য কাউকেও কাছে ঘেষতে দিবোনা সাফ সাফ কথা।”
রোশান ড্যাব ড্যাব চোখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে রইলো।

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৫