একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৬

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৬
Mousumi Akter

কিচেনে মতিয়াখালা গতরাতের হাড়ি,কড়াই ধোঁয়াধুয়ির কাজ করছে। সারাহ ব্রাশ করে হাত-মুখ ধুয়ে কিচেনে প্রবেশ করল। মতিয়া খালা সারাহ’কে দেখে বলল,
” মা ঘুম ভেঙে গেলো?”
সারাহ মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলল,
” জি খালা ভাঙল।”
মতিয়া কড়াই ধুতে ধুতে বলল,
” বাবার বাড়িতে কি আগে উঠতে মা।”
সারাহ আবারও মৃদু হেসে জবাব দিলো,
” না, খালা। আম্মু ভোরে ডেকে দিত নামাজের জন্য। ঘুম ভাঙতে চাইতোনা। মাঝে মাঝে উঠে নামাজ পড়তাম আবার মাঝে মাঝে মিস হয়ে যেত। যেদিন নামাজ পড়তাম, ওইদিন খুব দ্রুত আবার ঘুমিয়ে যেতাম। আম্মু নয়টার দিকে খাবার নিয়ে আমাকে ডেকে তুলে মুখে তুলে খাইয়ে দিতো।”
মতিয়া মৃদু হেসে বলল,

” বিয়ের আগে আর বিয়ের পরের জীবনের অনেক পার্থক্য মা। বিয়ের আগে মা রান্না করে খাওয়ার জন্য ডাকে। আর বিয়ের পর নিজে রান্না করে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে খেতে ডাকতে হয়। মেয়েদের জীবন এভাবেই একটি কবুল শব্দের মাধ্যমে বদলে যায়। তবে কি জানো, বিয়ের পর মেয়েরা সব কষ্ট হাসি মুখে মেনে নিতে পারে, যদি স্বামী নিজের মনের মত হয়। এক চাঁদ সুখ দিলে হাজার তারা সেখানে কিচ্ছুই করতে পারেনা।”
মতিয়ার মুখে স্বামীর নাম শুনেই সারাহ’র চোখের সামনে তার রোশান স্যারের কথা ভেষে উঠল। সকালের ফুল আর চললেটের কথা ভেবে ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসল। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে, স্বামী হিসাবে ওনার ব্যবহার খুব একটা খারাপ ছিলোনা। আচ্ছা, স্বামীরা কি অমন হয়, নাকি ওর চেয়ে ভালো হয়। সারাহ রান্নাঘরে কি কাজ করবে বুঝতে পারছেনা। মতিয়াকে জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” খালা, আমি কি করব এখন?”
মতিয়া সারাহ’র সরল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আজ থেকে রান্নার দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছে তোমার শ্বাশুড়ি। স্পষ্ট বলল, কাজের লোকের হাতের রান্না আর কতকাল খাবো। আজ থেকে বউমার হাতের রান্না খাবো। আমি জানি, আমি কাজের লোক কিন্তু এটা ভুলে গিয়েছিলাম। রোশান এবং ওশান’কে নিজের ছেলের মত করেই ছোটবেলা থেকে রান্না করে খাওয়াচ্ছি। হঠাৎ আমার হাতের রান্না খেতে পারবেনা ওরা তাই একটু খারাপ লাগল।”
মতিয়ার চেহারায় দুঃখের রুপরেখা স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে। সারাহ’র ভারী দুঃখ হলো মতিয়ার কথা শুনে। সে মতিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল,

” হয়ত উনি বলে ফেলেছেন টেন পাননি। কাজের লোক বলে পৃথিবীতে কিছু নেই খালা। আপনি উনাদের কাজে সাহায্য করছেন। আপনি সাহায্যকারী। আপনাকে যদি ওই নজরে দেখত, তাহলে তো কাজের লোক বলেই ডাকত। আপনি রোশান স্যারের খালা মানে আমারও খালা। বলুন এইবার কি রান্না করা লাগবে। ”
মতিয়া ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,

” ওশান পরোটা আর ডিম ভাজি খাবে। জিনাত রুটি আর ডিম ভাজি খাবে। বাকিদের জন্য পাঁচ প্রকার মাছ, দুই প্রকার ভাজি, ডিম, দুই প্রকাশ মাংস রান্না সাথে পোলাও রান্না করতে বলেছে। আত্মীয় আসার কথা নাকি একটু পরে।”
সারাহ’র মাথার মাঝে চক্কর দিয়ে উঠল। এত এত রান্না সে কীভাবে করবে৷ সে’তো ভর্তা ভাত ছাড়া কিছুই রান্না করতে জানেনা। তাছাড়া রান্না করলে খেতে কেমন হবে এটাই বড় দুঃচিন্তার কাজ। সারাহ দুঃখী দুঃখী মুখে মতিয়াকে বলল,
” খালা আমিতো রান্না জানিনা।”
মতিয়া বলল,

” আমি সেটা তোমার শ্বাশুড়িকে বলেছিলাম আজও রান্নাটা আমি করি, বৌমা রান্না দেখতে দেখতে শিখে যাবে৷ কিন্তু তোমার শ্বাশুড়ি বলল, ‘ আমি যেন আজ খুন্তিতে হাত না দিই। সমস্যা নেই মা, আমি সব দেখিয়ে দিচ্ছি। আস্তে আস্তে সব পারবা। আর একদিন তুমি অনেক বড় রাঁধুনী হবা। তোমার রান্না যে খাবে সেই প্রশংসা করবে।”
মতিয়া দেখিয়ে দিচ্ছে আর সারাহ সেমতো রান্না চড়াচ্ছে। জীবনে প্রথম একসাথে এতরান্না। কতটুকু লবন আর কতটুকু হলুদ-লবন দিবে এটা বুঝতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সারাহ। শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে নিয়েছে। চুল হাত খোঁপা করা। দেখতে একজন পাক্কা রাঁধুনি লাগছে। সারাহ’র কেমন খুদা পেয়েছে। কিন্তু কিছু যে খাবে লজ্জায় সেটা পারছেনা। খাবার খেলে মানুষ কি ভাববে? অথচ নিজেদের বাড়ি হলে বিছানায় সুয়ে অর্ডার দেওয়া যেত, আম্মু আমাকে একটু নুডুলস দাও।

এমন সময় রোশান বাইরে থেকে এলো। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে একাকার অবস্থা। রোজ সকালেই রোশান নামাজ পড়ে, মর্ণিং ওয়াকের উদ্দেশ্য বের হয়। মর্ণিং ওয়াক শেষ করে সাতটার দিকে বাসায় এসে গোসল করে চিনিছাড়া চা খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হয়। আজও তাই। সকাল সাতটা বাজতেই বাড়িতেই পৌঁছালো। রোশান সিঁড়ি থেকেই মতিয়া খালাকে ডেকে বলল,
” খালা এক গ্লাস পানি দেনতো।”
মতিয়া উঁকি দিয়ে রোশানকে দেখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
” বৌমা রোশান এসছে, এক গ্লাস পানি দিয়ে এসো মা।”
সারাহ খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে বলল,
” আপনিই দিন খালা। আপনার কাছে চেয়েছে।”
মতিয়া লাজুক হেসে বলল,

” মনে মনে তোমাকেই খুঁজছে। ওকি আর বেসরম ছেলে যে বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে তোমাকে ডাকবে।”
সারাহ ভ্রু উঁচিয়ে মতিয়ার উদ্দেশ্য বলল,
” আপনাদের ছেলের কি খুব লজ্জা খালা।”
” হ্যাঁ, মুরব্বিদের খুব সম্মান করে।”
সারাহ দুষ্টুমি করে বলল,

” উনি নিজেই তো মুরব্বি। কলেজের স্যার বলতেই আমরা বুঝি মুরব্বি মানুষ। ”
মতিয়া সারাহ’র হাতে ফিল্টার থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিয়ে বলল,
” ওর খুব কম বয়সে চাকরি হয়েছে। অনেক মাধাবী ছাত্র তো এজন্য।”
নিজের বরের প্রশংসা শুনতে কারনা ভাল লাগে। যদিও সারাহ’র আগে ভাল লাগত না। কিন্তু আজ একটু একটু ভাল লাগছে। সারাহ পানির গ্লাস নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখল,

রোশান নিচু দিকে ঝুঁকে জুতার ফিতা খুলছে। পরণে কালো ট্রাউজার, গায়ে সাদা টি-শার্ট, হাতে ঘড়ি, চোখে চশমা। চুলগুলো কেমন যেন এলোমেলো দেখাচ্ছে। সারাহ’র দু’চোখ জুড়ে মুগ্ধতা। কেন যেন এই এলোমেলো চুলে শ্যামবর্ণের মানুষটাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। শ্যামবর্ণের মানুষদেরও বুঝি এত সুদর্শণ লাগে। সাত সাকালে এত সেজেগুজে উনি কোথায় গেছিলেন।

এত ভোরে চোখে চশমা হাতে ঘড়ি, সাদা টি-শার্ট। রোশান জুতার ফিতা খুলতে খুলতে ঝুঁকা অবস্থায় হঠাৎ সামনের দিকে তাকালো। তাকাতেই পানির গ্লাস হাতে সারাহ’কে দেখে কিছুটা অবাক হলো। সে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে থেকেই বাকি ফিতাটুকু খুলল। জুতা খুলে সিঁড়ির সাইডে রেখে ভ্রুঁ যুগল সুঁচালো করে সারাহ’র দিকে এগিয়ে গেলো। যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! রোশান সারাহর কাছাকাছি যেতেই সারাহ পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। রোশান পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে সারাহর দিকে ভ্রুঁ কুচকে তাকিয়ে বলল,
” এ কি তুমি? এত সকালে ঘুম থেকে উঠলে কীভাবে?”
সারাহ মিহি কণ্ঠে বলল,
” উঠলাম।”

রোশান খেয়াল করল, সারাহ’র কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ব্লাউজ ঘেমে পিঠের সাথে লেগে গিয়েছে। দু’হাতের তালুভর্তি হলুদের গুড়া। রোশান এক ঢোক পানি খেয়ে সারাহ’কে পর্যবেক্ষণ করছে। সারাহ’র ফর্সা গালে হলুদ লেগে আছে। কি অপূর্ব লাগছে দেখতে। রোশান গ্লাসের বাকিটুকু পানি খেয়ে ফিনিশ করল। কপালের চামড়া টানটান করে সারাহ’কে প্রশ্ন করল,
” তুমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠলে কীভাবে? ইটস মিরাক্কেল।”
সারাহ মিহিকণ্ঠে উত্তর দিলো,
” এমনিই ঘুম ভেঙে গিয়েছে।”
” তোমার গালে হলুদ, হাতে হলুদ, কপালে ঘাম, তুমি কি রান্না করছো?”
সারাহ রোশানের দিকে চোখ মেলে তাকালো। জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ”
রোশানের চোখ কপালে উঠল। সে ভীষণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

” কেন? সকালে যখন ঘুম থেকে উঠেছো, বই পড়তে তো বসতে পারতে?”
সারাহ’র কাছে রোশানের প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে শুধু। রোশান বুঝতে পারল কিছু একটা গড়মিল হয়েছে। সে নিজেই রান্নাঘরে প্রবেশ করল। ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত গুজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে মতিয়াকে প্রশ্ন করল,
” খালা, আপনি কি আজ অসুস্থ? ”
মতিয়া হাসি-মুখে উত্তর দিলো,
” না বাবা।”

” সারাহ কি নিজেই শখ করে রান্না করতে এসছে?”
মতিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সকালের ঘটনা খুলে বলল। রোশান মনযোগ দিয়ে মতিয়ার কথা শুনে রান্নাঘর থেকে বের হল। যাওয়ার সময় আচমকা সারাহ’র হাতের কব্জি ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে এলো। সারাহ রোশানের এমন কান্ড দেখে গোল গোল চোখে রোশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” আরে, আরে কি করছেন আপনি? রান্না করতে হবে আমার।”
রোশান রাগান্বিত চোখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি তোমার স্বামী। আমি যেটা হুকুম করব, সেটাই করবে তুমি। ক্লিয়ার?”

সারাহ মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ সুচক বুঝালো। রোশান রুমে এসে বিছানার ওপর বসল। মাথাটা দপদপ করছে তার রাগে। সারাহ রোশানের রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনি এত রেগে আছেন কেন? সকালে কি জিনাত আপুর মুখ দেখেন নি?”
রোশান দাঁতে দাঁত চেপে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
” এমনিই মেজাজ হট আছে। বাজে কথা বলোনা।”
সারাহ দুষ্টমি করে বলল,

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৫

” আপনি তো এমনিই চব্বিশ ঘণ্টা হট থাকেন। এ আর নতুন কি? লাইক ইমরান হাশমি।”
সারাহ’র কথা শুনে রোশানের মেজাজ আরোও খারাপ হয়ে গেলো। সে বসা থেকে উঠেই সারাহ’কে ধরে নিয়ে ওয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল,
” কিছু করেছি তোমার সাথে আমি? আমাকে ইমরাণ হাশমি হতে বাধ্য করোনা। ফলাফল তোমার ই শূন্য হবে।”

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ২৭+২৮