একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩৩

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩৩
Mousumi Akter

বিশ মিনিট পরেই রোশান বাড়িতে পৌঁছালো। বাইক সোজা ঘরের সিঁড়ির কাছে স্ট্যান্ড করে ঘাড় হালকা ঘুরিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকল,
” তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো? আমরা পৌঁছে গেছি।”
কথা বলার শক্তিটুকু সারাহ’র শরীরে নেই। সে রেসপন্স ও ঠিকভাবে করতে পারছেনা। রোশান এক হাত দিয়ে বাইক সামলে আরেকহাত সারাহ’র গায়ে দিয়ে বলল,
” আমরা পৌঁছে গেছি।”
সারাহ জরাজীর্ণ কণ্ঠে সায় দিলো,
“বেঁধে রেখেছেন,নামব কীভাবে?”

রোশান তার পেটের সাইড থেকে ওড়নার গিট খুলে দিলো। সারাহ আস্তে বাইক থেকে নামল। সারাহ নামার সময় রোশান তাকে সাহায্য করতে করতে নিজেও বাইক থেকে নামল। কারণ সারাহ’র দাঁড়ানোর মত শক্তি নেই গায়ে। মাথার মাঝে চক্কর দিচ্ছে। কেমন অচেতন করে ফেলছে সারাহ’কে। বাইক থেকে নেমে সারাহ কোনোমতে দাঁড়ালো। রোশান বাইক বন্ধ করতে করতেই দেখল সারাহ কেমন ঢুলছে। এখনি পড়ে যাবে। রোশান বাইকের চাবি দ্রুত পকেটে গুজে সারাহকে ধরল। সারাহ সাথে সাথেই ঢুলে পড়ে গেলো রোশানের ওপর। রোশানের বুকের ওপর সারাহ’র মাথা রাখা, চোখ দু’টো বন্ধ,শুধু নিশ্বাসটা বইছে। রোশান সারাহ’র গালে হাত দিয়ে কয়েকবার ডাকল,
” সারাহ! শুনতে পাচ্ছো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারাহ’র কোনো রেসপন্স নেই। রোশান চিন্তায় পা–গ-ল হওয়ার উপক্রম প্রায়। সারাহ’র কি হলো? হঠাৎ রাগ দেখলো, বৃষ্টিতে ভিজলো, এখন আবার অচেতন। এমন সময় রোশানের মা-বাবা,জিনাত, ওশান সবাই উপস্থিত হল। রোশান-সারাহ দু’জন’কে এভাবে ভেজা অবস্থায় দেখে রোশানের বাবা কি প্রশ্ন করবে বুঝতে পারছেনা। কারণ তার ছেলে খামখেয়ালি কাজ কখনো করেনা। বৃষ্টিতে ভিজতে সে কখনোই পছন্দ করেনা। সামান্য বৃষ্টির পানিতে ঠান্ডা লেগে যায়। আজ ভিজল কেন? বিকাল ফোন দিলে বলল,

” একটু কাজ আছে, ফিরতে লেট হবে।” কিন্তু কাজটা কি ছিলো। রোশানের বাবা মনে মনে দুনিয়ার চিন্তা করলেও রোশানের মা কোনো ভাবা চিন্তা না করেই প্রশ্ন করল,
” তুমি জানোনা বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার ঠান্ডা লাগে। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছো কেন? আমরা বাড়ির সবাই চিন্তায় পা-গ-ল হয়ে যাচ্ছি, ফোনের ওপর ফোন দিচ্ছি তোমার কোনো খোঁজ নেই।”
রোশান কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো,
” আমি তো বাবাকে জানিয়েছিলাম যে ফিরতে লেট হবে। তাহলে অকারণ এত চিন্তার কি আছে বুঝলাম না। আমি তো বাচ্চা নই আম্মু। এত চিন্তা করতে হবে।”

রোশানের মায়ের মেজাজ আরোও খারাপ হলো সারাহ’র দিকে তাকিয়ে। খিটমিট কণ্ঠে বলল,
” এই মেয়েটা এতরাত অবধি বাড়ির বাইরে কি করছিলো। কোন বাড়ির বউ এত রাতে বাহিরে থাকে। ওর তো শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। আগেও উশৃংখল ছিলো,এখনো তাইই আছে।”
রোশান বিরক্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার স্ত্রী আমার সাথে বাহিরে ছিলো, এখানে শৃঙ্খল আর উশৃংখল এর কিছুই নেই।”
রোশানের বাবা তার স্ত্রীর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,

” তুমি দেখছো না বৌমা অসুস্থ। আজেবাজে কথা বলে ছেলের মাথা খাচ্ছো।”
রোশানের মা তার বাবার দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
” তোমার বৌমাকে কে বলেছে মাঝ রাত অবধি এই ঝড় বৃষ্টির মাঝে বাইরে থাকতে।”
রোশানের কারো কথা শুনতে ভাল লাগছে না। সে ওশান’কে গাড়ির চাবি দিয়ে বলল,
” গাড়িটা ঘড়ে তোলো। আমি রুমে যাচ্ছি।”
রোশানের মা আবার বলল,
” মা তো হওনি তাই বুঝবা না। এখন মায়ের কথা বিরক্ত লাগছে তোমার।”
রোশান সারাহ’কে পাজা কোলে তুলে নিয়ে বলল,

” মা শব্দটার অপমান করছো তুমি। সারাহ তোমার মেয়ের মত। ওর অসুস্থতায় বিচলিত হতে দেখলাম না তোমাকে। যতটা জিনাত অসুস্থ হলে তুমি হও।” বলেই সারাহকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। জিনাতের চোখ দু’টো হিংসায় জ্বলে উঠল। সে বলল,

” দেখলে ফুপি নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছে রোশান। কীভাবে সবার সামনে সারাহ’কে কোলে তুলে নিলো।”
রোশান সারাহ’কে ঘরে নিয়ে চারদিকে চোখ বুলালো। ভেজা শরীরে বিছানায় সুইয়ে দিলে আবার বিছানা ভিজে যাবে। রাতে সারাহ’র ঘুমোতে অসুবিধা হবে। কি করা যায়। দু’মিনিট চিন্তা করে ফ্লোরে সুইয়ে দিলো। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। ভেজা শরীরে সারাহ’র জামা একদম লেগে আছে শরীরের সাথে। কীভাবে খুলতে হবে রোশান বুঝতে পারছেনা। জামা খোলার মত কোনো সিস্টেম ও নেই। এই মুহুর্তে সহজ উপায় হিসাবে সারাহ’র জামা কাটা ছাড়া উপায় নেই। রোশান ড্রেসিন টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট কাঁচি বের করে সারাহ’র জামা সাধধানে দুই সাইড থেকে কেটে জামা খুলল। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
” এত টাইট জামা কেউ পরে। মনে হচ্ছে শরীরের সাথে প্লাস্টার করে রেখেছে।”

মেয়েদের কামিজ কীভাবে পরাতে হয় রোশান জানেনা। সে দ্রুত তার একটা সাদা টি-শার্ট আর সারাহ’র একটা স্কার্ট পরিয়ে সারাহ’কে বিছানার ওপর সুইয়ে দিলো। ভিজে আঙুল গুলো কেবল রক্তশূণ্য দেখাচ্ছে। মুখটা যেন সতেজ আর পবিত্র দেখাচ্ছে। ভেজা চুল গুলো থেকে পানি ঝরছে। রোশান ভেজা চুলে দ্রুত টাওয়াল পেঁচিয়ে দিয়ে নিজে চেঞ্জ করতে গেলো। অয়্যারড্রব থেকে একটা ব্লু রঙের টি-শার্ট আর একটা ব্লু রঙের ট্রাউজার বের করে পরে মাথার পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বাইরে বেরিয়ে এলো।

ঠান্ডায় কয়েকবার হাঁচি দিলো রোশান। ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে লোসন মাখাতে মাখাতে খেয়াল আয়নার ভেতর খেয়াল করল, সারাহ ঠান্ডায় গুটি সুটি মেরে সুয়ে আছে। রোশান আলমারি থেকে কম্বল বের করল। ভাজ করে কম্বলটা সারাহ’র গায়ে জড়িয়ে দিলো। টাওয়াল দিয়ে মাথার পানি ভালো ভাবে কিছুক্ষণ মুছে চুলগুলো ঝরঝরা করে দিলো। কপালে হাত দিয়ে দেখল, কপালে অনেক তাপমাত্রা অথচ হাত পা ঠান্ডা। রোশান খানিকটা সরিষার তেল নিয়ে সারাহ’র পায়ের তালুতে আর হাতের তালুতে ঘষতে লাগল। হাত-পা একটু গরম করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই গরম হচ্ছেনা। এমন সময় এক কাপ চা হাতে জিনাত রুমের দরজায় এসে টোকা দিলো। রোশান কোনো উত্তর না দিয়ে দরজা টা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই জিনাত’কে দেখে বলল,

” কি চায়?”
জিনাত ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা রোশানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
” তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে। গরম চা টা খাও। ভালো লাগবে।”
রোশান গম্ভীর মুডে বলল,
” নো নিড।”
জিনাতের মুখটা সাথে সাথে কালো হয়ে গেলো। সে মুখ কালো করে বলল,
” কেন?”
রোশান আবারও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমি চা খাওয়ার মুডে নেই জিনাত।”
জিনাত রোশানকে খুশি করতে হাসি হাসি মুখে বলল,

“তাহলে চলো তোমার ফেভারিট গরুর মাংস আর খিচুড়ি রান্না করেছি। আমার নিজের হাতে রোশান।”
রোশান খুশীর পরিবর্তে বিরক্ত হলো। কপালের চামড়ায় তিনটা ভাজ পড়ল বিরক্তিতে। বিরক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
” বাট হুয়াই জিনাত?”
জিনাত ও প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,
“কীসের হুয়াই?”
রোশান চোয়াল শক্ত করে বলল,
“তুমি আমার জন্য কেন আমার ফেবারিট কিছু রান্না করবে?”
জিনাতের মুখটা কালো হয়ে গেলো। একগা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তোমার পছন্দের গুরুত্ব আমি আজীবন ই দিই রোশান। প্লিজ চলো! তুমি না খেলে আমি খেতে পারব না।”
রোশান সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার ওয়াইফ না খেয়ে আছে আর আমি গিয়ে আমার ফেবারিট খাবার খাবো। আমার ওয়াইফ না খেলে আমিও খেতে পারব না। সো প্লিজ জিনাত যাও তুমি!”

জিনাতের চোখে অটোমেটিক পানি চলে এলো। সে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“তুমি আমার সামনে কীভাবে সারাহ’র প্রতি এত কেয়ার দেখাও রোশান? তোমার কি এতটুকুও খারাপ লাগেনা। তোমার বিবেক কি ম’রে গিয়েছে। তুমি আমার সামনে বিয়ে করে নিজেকে সুখী প্রমান করতে চাও। কীসের এত রাগ। একটা ভুলকে কেন্দ্র করে আমার গোটা জীবনটা ধ্বংস করে দিলে। সাথে নিজের জীবন ও ধ্বংস করে দিলে। আমি জানি তুমি নিজেকে সুখী দেখাতে গিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছো। কিন্তু তুমি সুখে নেই। তুমি আমাকে কষ্ট দিতে গিয়ে এই মেয়েটার প্রতি ভালবাসার অভিনয় করে যাচ্ছো। এখানে ভালবাসা বলে কিচ্ছুই নেই আমি জানি। প্লিজ রোশান রাগে তুমি অনেক কিছু করেছো, অনেক কিছু বলেছো কিন্তু সারাহ নামের ওই মেয়েটাকে তুমি ভালবাসোনা। তুমি আমাকে ভালবাসতে আর এখনো আমাকেই ভালবাসো।”

রোশান খানিকটা অবাক হয়ে কপালের চামড়া কুচকে জিনাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে জবাব দিলো,
” আমার একটুও খারাপ লাগেনা জিনাত। তোমার মাথায় সমস্যা আছে,তাই আবোলতাবোল বকছো।”
জিনাত কাঁন্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“তুমি কি অতীত ভুলে গিয়েছো?”
রোশান বিরক্ত কণ্ঠে জিনাতের কথার উত্তর দিলো,
“মেবি তুমি ভুলে গিয়েছো।”
“আমি কিছুই ভুলিনি। তুমিই আমাকে ভালবাসতে আর আজও আমাকেই ভালবাসো। রাগ আর জিদে তুমি আমাকে রেখে অন্যাত্র বিয়ে করেছো। অথচ আজ আমাদের বিয়ে হবার কথা ছিলো।”

রোশান কৌতুহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“তোমাকে আমি ভালবেসেছিলাম কবে?”
জিনাত কাঁন্নামিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“বাসোনি? তাহলে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে কেন?”
রোশান রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
“শুধুমাত্র মা চেয়েছিলো বলে সম্মতি দিয়েছিলাম। নিজের বউ হিসাবে কোনদিন তোমাকে পছন্দ ছিলোনা আমার।”
জিনাত আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“তোমার বিয়েতে সম্মতিকে ভালবাসা ভেবে একজন কে ঠকিয়ে তোমার কাছে এসছিলাম। আর তুমি কীনা আমাকে রিজেক্ট করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে। আমার এই সামান্য ভুলের শাস্তি তুমি আমাকে এভাবে দিলে। দিনের পর দিন তোমাকে ভালবেসে ক্লান্ত ছিলাম। একাকিত্ব কাটাতে অন্য একজনের সাহায্য নিয়েছিলাম। আর তুমি এই সামান্য ইস্যুটার জন্য আমাকে ছেড়ে সারাহ’কে বিয়ে করলে। এমন তো হতে পারে সারাহ ও কাউকে ঠকিয়ে তোমার কাছে এসছে। সেদিন কি সারাহ’কেও ছেড়ে দিবে। আর সেদিনের কথা বাদই দিলাম। তুমিতো মেয়েটা’কে ভালোইবাসোনা। তাহলে কেন বলে দিচ্ছোনা তুমি ওকে ভালবাসোনা, তুমি আমাকে ভালবাসতে।”
রোশান তাচ্ছিল্যের স্বরে আবারও হাসল। হেসে বলল,

” সারাহ কখনো কাউকে ঠকানোর মেয়ে নয়। আর তুমি সিওর কীভাবে আমি সারাহ’কে ভালবাসিনা। আমি সারাহ’কে ভালবাসি।”
জিনাত রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
” ভালবাসলে তো এতদিনে ইন্টিমেন্ট পর্যন্ত গড়াতো সম্পর্ক। সারাহ ও ছোট নয় আর তুমিও পরিপূর্ণ পুরুষ। দু’জনেই সব বোঝো। ইন্টিমেন্ট তো দূর একটা চুমুও হয়নি তোমাদের।”
এত গোপন কথা জিনাত কীভাবে জানল ভেবে অবাক হচ্ছে রোশান। সে প্রশ্ন করল জিনাতকে,
” এত গভীর খবর তুমি কীভাবে পেলে। এ ঘরে সিসিটিভি লাগিয়েছো?”
” তোমার বউ কাজের বুয়াদের সাথে শেয়ার করেছে। বোঝো কেমন ইমম্যাচিউর মেয়ে বিয়ে করেছো। এসব ও বাইরে বলে।”

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩২

রোশান সারাহ’র প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,
” একটা সম্পর্কে কি ইন্টিমেন্ট ই সব। যদি তাই হয়, সেটাও হবে। ” বলেই ঘরের দরজা জিনাতের মুখের ওপর বন্ধ করে দিলো রোশান।

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩৪