একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৪ (২)

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৪ (২)
Mousumi Akter

সন্ধ্যা সাতটা বাজে।গোলাপি রঙের বড় পুতুলটা জড়িয়ে ধরে তীব্র মন খারাপ নিয়ে বিছানায় বসে আছে সারাহ। বিগত সাতদিনের হিসাব সে মিলিয়ে পারছে না। তার জীবন টা কীভাবে এলোমেলো হয়ে গেল।কি হওয়ার কথা ছিল আর কি ঘটে গেল।যাকে ভালবেসেছিলো যখন শক্ত করে হাত ধরার কথা সে তখন বাঁধন টা আলগা করে দিল।হঠাৎ একজন অচেনা মানুষের সাথে জুড়ে গেল জীবন।ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তার বিয়েটা হয়ে গিয়েছে।সারা জীবন অশান্তির অনলে পু’ড়’লেও এই বাঁধন ছেড়ে বেরোনো সহজ হবেনা।

এমন সময় সারাহ’র রুমের লাইট জ্বলে উঠল।কৃত্তিম আলো চোখে পড়তেই সারাহ চোখ হাত দিয়ে কৃত্রিম আলোক রশ্মি থেকে আটকালো।রুমে কে প্রবেশ করে আলো জ্বালালো সেটা সারাহ তাকিয়ে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করল।তার এক আকাশ সমান অভিমান মা-বাবার প্রতি।সেই অভিমান অব্যাহত রেখেই কারো দিকে তাকাল না।সারাহ’র মা বিছানায় সারাহ’র পাশে বসল।সারাহ’র বাবা সারাহ’র পড়ার টেবিল থেকে চেয়ার টেনে এনে সারাহ’র কাছাকাছি এসে বসল।সারাহ’র মা বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মামনি, তুমি চুপচাপ থাকলে আমার বাড়ি অন্ধকারে ডুবে থাকে।সারাদিন তোমার চঞ্চলতা মাতিয়ে রাখে এ বাড়ি।তুমি চুপ থাকলে মনে হয় প্রাণহীন আমার বাড়ি।”
সারাহ কোনো কথার উত্তর দিল না।সারাহ’র বাবা সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার জন্মের পর আমার আর কোনো সন্তান হয়নি।তা নিয়ে আমি কোনদিন মাথা ঘামায় নি।তোমাকে আমি এত ভালবেসেছি আমার মনে হয়েছে আমার কোনো সন্তানের প্রয়োজন নেই।তুমি একাই আমাকে প্রশান্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।আমি কখনো তোমাকে নখের আঁচর দিইনি।তোমার চোখে পানি দেখলে আমার হৃদয় টা পু’ড়ে ছাই হয়।তুমি কিছু চাওয়ার আগেই আমি এনে হাজির করেছি।তোমার পোশাক আমি নিজ হাতে পরিষ্কার করেছি।

এখনো তোমার পোশাক আমি ধুয়ে দিই।তোমাকে গালে তুলে খাবার খাইয়ে দিই।কোনদিন হিসাব করে টাকা দিইনি।তোমার মন খারাপ দেখলে আমি রাতে ঘুমোতে পারিনি।তোমার জ্বর হলে সারারাত আমি পাশে বসে থাকি।তুমি কি জানোনা তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই মা।সেই তুমি আমার সাথে অভিমান করে থাকলে আমি সহ্য করতে পারছি না।আমি জানি আমি অন্যায়ভাবে তোমার বিয়েটা দিয়েছি।এটা অনুচিত ছিল আমার।কিন্তু এই ছাড়া তুমি কথা শুনতে না।তোমার খালু আমাকে তোমাকে তোমার আম্মুকে ছোট করে কথা বলেছে।আমাকে যা বলত তা মেনে নিতাম।কিন্তু তোমাকে করা অপমান আমি মেনে নিতে পারিনি।আমি তোমার বাবা। আমার ক* লি* জা*র টুকরো তুমি।যে বাবা তোমার জন্য এত কিছু করতে পারে সে কি তোমার জন্য যেন তেন পাত্র বাছাই করবে।পৃথিবীর উত্তম পাত্রটায় তোমার জন্য খুজে এনেছি।একদিন তুমি বলবে মা-বাবা সন্তানের খারাপ চায়না।”

মা-বাবার কথায় সারাহ’র হৃদয় টা কেমন যেন ফেটে যাচ্ছে।সত্যি তো তার বাবার মত কেউ ভালবাসেনা তাকে।তবুও কেন এত অভিমান করছে সে।সারাহ তার বাবার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল।সারাহ’র চোখে পানি দেখে সারাহ’র বাবা উঠে দাঁড়াল।মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“নিচে রোশান অনেক্ষণ এসে অপেক্ষা করছে তোমার সাথে কথা বলার জন্য।আমাদের সাথে ঘন্টা খানিক গল্প করেছে।অনেক বুদ্ধিমান ছেলেটা।ভারীবুদ্ধির ছেলে।তোমার কোনদিন অসুবিধা হবেনা দেখে নিও।”
সারাহ কাদতে কাদতে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা।আমার জন্য খালু তোমাকে অপমান করেছে।আমি কোনদিন ওদের সাথে কথা বলব না।”

“আমার পা’ গ’ লি টা।আমি শুধু তোমার হাসি-খুশি মুখ টা দেখতে চাই মা। রোশানের নাম্বার টা নাও।নিয়ে একটা মিস কল দাও।তুমি মিস কল দিলেই ও উপরে আসবে।যদিও ও আসতে চাচ্ছিলো না, আমরাই বলেছি।”
সারাহ’র বাবা রোশানের নাম্বার টা বলল।সারাহ ফোনে নাম্বার টা তুলে নিল।সারাহ’র মা রুম ত্যাগ করার সময় সারাহ’কে বলল,
“জামাই এর সাথে খারাপ ব্যবহার করোনা কিন্তু।”

সারাহ’র বাবা বলল, ” তুমি কি নতুন সময়ে আমাকে কম জ্বালিয়েছো।আমি জামাই-কে বলে দিয়েছি আমার মেয়ের সব আহ্লাদ সব বায়না সে মাথা পেতে নিবে।”
বলতে বলতে সারাহ’র মা-বাবা রুম ত্যাগ করল।সারাহ রোশানের নাম্বারে মিস কল দিল।
মিনিট দু’য়েকের মাঝে দরজায় কেউ টোকা দিল।সারাহ বুঝতে পারল রোশান তার দরজায়। তাই বিনা ভনিতায় বলল, ” ভেতরে আসুন।”

সারাহ চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁটাল। খুব সাবধানতা অবলম্বন করল সে। এইবার যেন অন্তত রোশানের সামনে কোন ভাবে বেইজ্জতি না হয় সে।সারাহ’র পরণে কমলা রঙের একটা থ্রী পিছ।ফর্সা শরীরে কমলা রঙের আভায় আরো বেশী ঝলমল দেখাচ্ছে সারাহকে।জানালার কাচ সরিয়ে জানায় হেলান দিয়ে বুকে হাত বেঁধে থমথমে মুডে দাঁড়াল। রোশান একটা কাশি দিয়ে সারাহ’র রুমে প্রবেশ করল।রুমে প্রবেশ করতেই চোখ গেল জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ অপ্সরীর দিকে।রোশান দরজায় দাঁড়িয়ে থমকে গেল।সারাহ সত্যি অপরুপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী।কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রোশান চোখ নামিয়ে নিল।এভাবে এক দৃষ্টিতে কোনো নারীর দিকে তাকানো এক প্রকার ছ্যাঁচড়ামো ছাড়া আর কিচ্ছু না। রোশানের পরণে ব্লু জিন্স, ব্লু টি-শার্ট। লম্বা চওড়া মানুষটাকে ব্লু জিন্স আর ব্লু টি-শার্টে সকালের চেয়ে আরো বেশী সুদর্শন দেখাচ্ছে।মানুষটার প্রতি সারাহ’র তীব্র রাগ কিন্তু সে যে সত্যি সুদর্শন দেখে চোখ ফেরানোর মত নয় সেটা অস্বীকার করার মত নয়।রুমের ফ্যান বন্ধ। রোশান সুইচ বোর্ডে হাত রাখল। ফ্যানের সুইচ কোনটা আন্দাজ করতে না পারায় রুমের লাইট অফ হয়ে গেল।রুমের লাইট অফ হতেই সারাহ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠল,

“মতলব কি আপনার? রুমের লাইট অফ করলেন কেন?”
সাথে সাথেই আবার রুমের লাইট জ্বলে উঠল।রোশান শান্ত চোখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে দেখল সারাহ ঝগড়ুটে মুডে তাকিয়ে আছে।রোশান প্যান্টের পকেটে হাত গুজে সোজা হয়ে দাঁড়িলে বলল,
“সমস্যা কি তোমার? এত লাউডলি চিৎকার দিলে কেন?”
সারাহ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
“আপনি হুট করে লাইট অফ করলেন, আমি ভেবেছি। ”
রোশান জানালার দিকে এগিয়ে গেল সারাহ’র কাছাকাছি। সারাহ’র সন্নিধ্যে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি ভেবেছো?”

“কি ভাবব, একটা ছেলে একটা মেয়েকে দেখে লাইট কেন অফ করবে?”
রোশান আশ্চর্যজনক ভাবে সারাহ’র দিকে তাকাল।ভীষণ অবাক হয়ে ডানে বামে তাকাল।আশ্চর্যজনক মুখভঙ্গিতে বলল,
“এত নেগেটিভ মাইন্ডের কেন তুমি?ফ্যানের সুইচ দিতে গিয়ে লাইট অফ হয়ে গিয়েছিলো।”
“ওহ! তা আগে বলবেন না।আমি ভ’য় পেয়েছি।”
“ভয় ভীতি এসব ও আছে তোমার আছে।যে ঝগড়ুটে মেয়ে তুমি।”
“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন? বিয়ের পরের দিন সদ্য বিয়ে করা বউকে অপমান করছেন?”
রোশান আবার ও অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,

“বউ?”
রোশানের মুখে বউ কথাটা রিপিট শুনে সারাহ লজ্জা পেল।টপিক্স চেঞ্জ করতে বলল,
“বিয়ে যখন হয়েই গিয়েছে বউ ছাড়া আর কি। বউ কে তো আর আন্টি ডাকবেন না।”
রোশান শান্ত কন্ঠে বলল,
” তুমিতো এই বিয়ে মানোনা, আবার নিজেকে বউ দাবি করছো।”
“কেন মানব আমি? আপনি আমার অনুমতি ছাড়া কেন আমাকে বিয়ে করেছেন?”
“তোমার বাবাকে আমি বলেছিলাম তোমার সাথে কথা বলতে চাই। তোমার বাবা বললেন, তুমি নাকি লাজুকপাতা। লজ্জায় কথা বলতে চাও না।”

সারাহ বুঝল এখানে রোশানের দোষ নেই।তবুও ঝগড়ায় জিততে এটা স্বীকার করা যাবেনা।তর্ক চালিয়ে যেতে হবে।
সারাহ আবার বলল,
“সে যায় হউক, আমার জায়গা আপনি থাকলে কি এই বিয়ে মানতেন?আপনি আমার চেয়ে আরোও বেশী বলতেন।”
“তোমার মত এত ইমম্যাচুর কথাবার্তা আমি কোনদিন ই বলতাম না।”
“তা বলবেন কেন? আপনার আর আমার বয়স তো এক না
।আপনি হলেন একজন বুড়ো, আর আমি একটা বাচ্চা মেয়ে।এইটুকু বয়সে জুটল একটা সুগার ড্যাডি।”
রোশানের মাথায় যেন এইবার আকাশ ভে’ঙে পড়ল। তার মস্তিষ্ক যেন ভোঁতা হয়ে এল।দিন শেষে কীনা তাকে সুগার ড্যাডি কথাটা শুনতে হল।রোশান অবাকের চরম পর্যায়ে গিয়ে চোখের চশমা খুলে বলল,

” হোয়াট? কি বললে, আমি সুগার ড্যাডি।”
“সুগার ড্যাডি ছাড়া কি? একজন বয়স্ক মানুষ আর একটা বাচ্চা মেয়ের বিয়ে হলে সেটাকে সুগার ড্যাডি ছাড়া আর কি বলে।আপনি হলেন চিনি বাবা।”
“পৃথিবীর সমস্ত অদ্ভুত কথাবার্তা দেখছি তোমার কাছে আছে।আজব আজব শব্দ ভান্ডার তৈরির কারখানা তুমি।আমার বয়স কত জানো তুমি?”
“কত হবে ৫২ অথবা ৫৪”

“২৯ বছর বয়স আমার,আমার বয়সী অনেকে বিয়েই করেনি।আর তুমি বলছো আমি বুড়ো।”
সারাহ মনে মনে বলল, আমাকে এইভাবে বিয়ে করার জন্য এইসব ই শুনতে হবে।
“এভাবে বয়স কমিয়ে লাভ কি আপনার?আরেকটা বিয়ে করতে চান নাকি?”
“ওটা মেয়েদের অভ্যাস, আমার নয়।”
“আবার আমাকে অপমান করছেন?কিছু বলতে এসেছিলেন।”
রোশান আবার ও চশমা চোখে দিতে দিতে বলল,
“নাকে ছিদ্র আছে তোমার?”রোশানের এমন প্রশ্নে সারাহ’র চোখ ছানাবড়া হল।সে রোশানের দিকে মুখ উঁচিয়ে দিয়ে নাক কুচকে বলল,

” নাকে ছিদ্র নেই মানে? দেখুন কি সুন্দর বড় বড় দুইটা ছিদ্র। চাইলে আপনিও ঢুকে যেতে পারবেন।”
“ওয়াস নাইস ছিদ্র,কারো নাকের ছিদ্র এত সুন্দর হয় তা জানা ছিলনা।”
বলেই রোশান সারাহ’র গালে হাত রাখল।রোশানের আকস্মিক এমন স্পর্শে সারাহ চমকে উঠল।সে বড় বড় চোখে শ্যামসুন্দর মুখের অবয়বে তাকাল।রোশান এভাবে সারাহ’র গালে হাত রাখল কেন?রোশান এইবার সারাহ’র নাকের নথি ধরল।সারাহ আরেক দফায় অবাক হল।কি করতে চাইছে রোশান।রোশান প্যান্টের পকেট থেকে তিন পাথরের ডায়মন্ডের একটা নাকফুল সারাহ’কে পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।সারাহ বুঝতে পারল রোশান তাকে নাকফুল পরাচ্ছে।বুঝতে পেরে আর ছটফট করল না।অনায়সে চোখ দুটো বন্ধ করল।রোশান সারাহ’র চোখ বন্ধ মুখের অবয়বে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।নাকফুল পরানো হয়ে গেলে রোশান বলল,

“আম্মু প্রেসার দিল তার বৌমাকে যেন নাকফুল পরিয়ে যায়। আম্মুর কথা রাখতেই নাকফুল পরানো।আসি এখন।”
সারাহ কোনো কথা বলতে পারল না।সে শুধু অনুভব করল কিছুক্ষণ আগে কেউ একজন পরম যত্নে তাকে নাকফুল পরাচ্ছিলো।বিন্দুমাত্র ব্যাথা যেন না লাগে সেদিক খেয়াল রাখছিলো।স্পর্শতে কোনো পাপ ছিলনা, অসৎ উদ্দেশ্য ছিলনা।রোশান যেতে গিয়ে আবার থমকালো।সারাহ’কে বলল,
” তোমার ফোন কোথায়?”
“কে, কেন?”
“আমার ফোনটা এ রুমে কোথায় রেখেছি জানিনা।কল দিব।”
“বিছানায়।”

রোশান বিছানায় তাকিয়ে দেখল সারাহ’র ফোন রাখা।বিছানা থেকে ফোন হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটন চেপে দেখল পাসওয়ার্ড দেওয়া।রোশান ভ্রুঁ নাচিয়ে বলল,
“পাসওয়ার্ড কি?”
সারাহ থতমত খেয়ে বলল,
“আই লাভ ইউ।”
“হোয়্যাট?”
“স্যার আই লাভ ইউ।”
“কাকে বলছ?”
“কাউকে না, ওটাই পাসওয়ার্ড।”
“ওহ শীট! তোমার দ্বারা সব ই সম্ভব।”
রোশান সারাহ’র ফোনে নিজের নাম্বার টা তুলল।নাম্বার তুলে কল দিতেই ভেষে উঠল,
“ডিপজল।”

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৪

তার নাম্বার ডিপজল নামে সেভ দেখে অদ্ভুত নয়নে সারাহ’র দিকে তাকাল।রোশান সারাহ’র সামনে ফোন উঁচু করে বলল,
“হোয়াট ইজ দিস।”
সারাহ রোশানের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,
“কে সেভ করল এই নামে? আ’ আমি না।”
রোশান অদ্ভুত দৃষ্টিতে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে রইলো।

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫