একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫২

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫২
Mousumi Akter

“মেয়েটির হাত থেকে বালা দু’টো খুলে রেখে যাও। ঐ বালা পরার যোগ্যতা এ মেয়ের নেই। তুমি জানো ওতে কতটুকু স্বর্ণ আছে। ”
মৃন্ময় যেন আকাশ থেকে পড়ল তার বাবার কথা শুনে। তার বাবা শেষ অব্ধি এতটা নিচে নামতে পারল। সে ভেবেছিলো বাবা পেছন থেকে ডেকে বলবে,
” যাস না, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে। ” মৃন্ময়ের চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল। তন্ময় আর দ্বীপ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ের বাবার নিষ্টুরতার দিকে। মৃন্ময় তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মা জোর করে হলেও তার বাবাকে আটকায় কীনা! কিন্তু না তার মা আজ চুপ হয়ে আছে। কোথাও যেন সে নেই এমন হয়ে আছে। মৃন্ময় তার মায়ের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তরীর হাত দু’টো ধরল। তরীর কাঁন্নামিশ্রিত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এর চেয়েও ভারী স্বর্ণের গহনা তোমাকে আমি বানিয়ে দিবো, আই প্রমিজ। মন খারাপ করোনা। ” বলেই মৃন্ময় তরীর হাত থেকে বালা দুটো খুলল। বালা দু’টো খোলার সময় মৃন্ময়ের হৃদয়টা জ্বলে পু’ ড়ে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। তরী ফুপিয়ে কাঁদছে। আজ তার জন্য মৃন্ময়ের জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুর জন্য সে দায়ী। জন্ম থেকেই সে অভাগা। যেখানে যায় সব ধ্বংস হয়ে যাই। মৃন্ময় বালা দু’টো খুলে ওর বাবার হাতে দিয়ে বলল,
” নাও তোমার কোটি টাকা দামের অমূল্য সম্পদ বাবা। আমার কাছে এর চেয়ে দামী তরী। স্বর্ণ চাইলেই টাকা দিয়ে কেনা যায়। কিন্তু তরীর মত একটা সরল মেয়ে টাকা দিয়ে কেনা যাবেনা। ওর মত খাঁটি হিরা টাকার বিনিময়ে পাবোনা। আমার বন্ধুরা হিরার চেয়েও দামী। যা অর্থের অঙ্কে পরিমাপ যোগ্য নয়। খালি তুমি যদি একটু মন নরম করতে আজ আমি অনেক সুখী হতে পারতাম।” বলেই মৃন্ময় হাঁটা দিলো।
মৃন্ময়ের বাবা পেছন থেকে ডেকে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” শেষবার বলছি মৃন্ময়, আমি কিন্তু সব পিহুর নামে লিখে দিবো। ওদের হাত ছেড়ে ফিরে আসো।”
মৃন্ময় আর পেছন ফিরে তাকাল না। সে তরী আর তন্ময় আর দ্বীপের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
” জীবনে যতদিন বেঁচে থাকব তোমার সম্পত্তির কিছুই স্পর্শ করব না মনে রেখো। তোমার ছেলেকে তুমি ভালো করেই চিনো বাবা। তোমার ছেলের জিদ নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। ”
পিহু হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,
” বাবা ভাইয়াকে আটকাও। তরীকে মেনে নাও।”
মৃন্ময়ের বাবা পিহুর দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললেন,
” দরজা খোলা আছে তুমিও যেতে পারো। ”

চোখের পানি মুছতে মুছতে মৃন্ময় তরী আর তন্ময় আর দ্বীপের সাথে বেরিয়ে গেল। ওদের কারোর মুখে কোনো কথা নেই। শুধু তরী হু হু করে কাঁদছে। তন্ময় এর দ্বীপের ভেতরটা যন্ত্রণায় পু’ড়’ছে৷ ওদের মাঝে সব চেয়ে খামখেয়ালি ছিলো মৃন্ময়। যার মাঝে কখনো ম্যাচুরিটি ছিলোনা। বিশ্রী গা’ লি ব্যবহার করত, সিগারেট খাওয়া আগে শিখেছিলো, ইচ্ছামত বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। বড়লোক বাবার কত আদরের ছেলে। অথচ সে আজ বন্ধুদের জন্য বাবাকে ছাড়তে দু’বার ভাবেনি। এই পৃথিবীতে এমন ও বন্ধু আছে যে কীনা শুধু মাত্র বন্ধুদের জন্য মা-বাবার বিপক্ষে যেতে পারে। মৃন্ময় আজ প্রমান করল র’ ক্তে’ র সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার সম্পর্ক মানুষকে কঠিন এক ভালবাসার বাঁধনে অটুট করে রাখতে জানে। মৃন্ময় বন্ধুত্বের এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। মাঝে মাঝে জীবন আমাদের পরীক্ষায় ফেলে দেয়। সেই পরীক্ষায় না পড়লে বোঝা যায়না কে আপণ কে পর। তরী হু হু করে কাঁদছে আর ভাবছে তার এই পো’ড়া কপালে এত ভালবাসা লেখা ছিলো। কেউ তাকে এত ভালবাসতেও পারে। সে কী জানত কোনদিন কেউ তাকে এতটা ভালবাসবে। কেউ তাকে ভালবাসে বাড়ি অব্ধি ছাড়বে? এই ছেড়ে যাওয়ার যুগে নিঃস্বার্থ ভাবে একটা চাল চুলোহীন মেয়েকে শুধুমাত্র ভালবাসার জন্য শক্তভাবে হাত ধরেছে মৃন্ময়। চারদিকে এত এত স্বার্থপর মানুষের ভীড়ে মৃন্ময় ভালবাসা আর বন্ধুত্ত্বের দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।

তখন সন্ধা ঘুরে গিয়েছে। দ্বীপ ভাবল পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিতে হবে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবেনা। তরীর কান্না আটকাতে হবে। মৃন্ময়কেও স্বাভাবিক করতে হবে।
তন্ময় আর দ্বীপ দু’জনে ইশারা করাকরি করল। তন্ময় বলল,
” আমি বলে দিলাম এক মাস হবে না আঙ্কেল আমাকে ফোন দিয়ে বলবে, বাবা আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি যা করেছি রাগে। আমি তো তোমাদের বাবা আমাকে তোমরা মাফ করে দাও। ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসো।”
দ্বীপ বলল,

” তখন ধুমধাম করে আবার ওদের বিয়ে হবে। সেই বিয়েতে আমি নাচম মাই নেইম ইজ শিলা। শিলা কি জাউয়ানি। আই আম দো হট। ” এতটুকু গাইতেই তন্ময় বলল,
” হ তুই তুই ক্যাটরিনা কাইফ কে নিয়ে আসিস সাথে।”
দ্বীপ বলল,
” গাইস মৃন্ময় আর তরীর বাসর সজ্জা কিন্তু যেখানে সেখানে হবেনা। আমরা আজ রাতেই যাবো কক্স বা কুয়াকাটা। সেখানেই একটা দারুণ হোটেলে ওদের বাসর হবে।”
মৃন্ময় বলল,
” খরচ কে দিবে?”
দ্বীপ বলল,

” রোশান সিদ্দিকী আর ছোঁয়া৷ শালার এই জমিদার ছোঁয়াটার সাথে যোগাযোগ না থাকাতে অনেক লস হচ্ছে। শালীর বাপের যে কত টাকা হিসাবে আসেনা। ”
মৃন্ময় বলল,
” ছোঁয়ার বাপের যা আছে আমার বাপের তার একশ ভাগের এক ভাগ ও নেই। দেখিস না ছোঁয়ার চলাফেরা কেমন। ওর বাপের মত যদি আমার বাপের থাকত কি করত আল্লাহ ভাল জানেন। ”
ছোঁয়ার কথা উঠতেই তন্ময় এর মুখ কালো হয়ে গেল। গত পনেরো দিনে ছোঁয়ার কোনো খোঁজ নেই। কোথায় হারিয়ে গেল ও।
এত এত কথার ভীড়ে তরীর কান্না থামছে না। মৃন্ময় তরীকে বলল,
” তুমি কি তোমার বাবার জন্য কাঁদছো। তোমার বাবার জন্য পরাণ পু’ড়’ছে। ”
তরী মাথা নাড়িয়ে বলল,

” না। ”
মৃন্ময় বলল,
” আর যদি কাঁদো আমি ভেবে নিবো তোমার বাবার জন্য কাঁদছো। তুমি চাইলে এখনি দিয়ে আসব৷ দেখো আমার চোখে পানি নেই আমি কিন্তু কাঁদছি না। আমার বাবার জন্য পরাণ ও পু’ড়’ছে না।”
তরী ছোট হলেও জানে মৃন্ময়ের কষ্ট হচ্ছে। সেই কষ্ট সে লুকিয়ে রেখেছে৷ দ্বীপের সদ্য হওয়া সেই প্রেমিকাকে একটা মেসেজ করা হয়নি দীর্ঘক্ষণ। সে হয়ত ফোন হাতে মেসেজের অপেক্ষায় আছে। অন লাইন যেতেই দেখল ছোঁয়াকে আজ দীর্ঘদিন পরে এক্টিভ দেখাচ্ছে। দ্বীপ লাফিয়ে উঠে বলল,

” এ তন্ময় ছোঁয়া এক্টিভ।”
মৃন্ময় বলল,
” ফোন লাগা। ”
দ্বীপ বলল,
” টেক্সট দিচ্ছি, ওয়েট। ”
দ্বীপ ছোঁয়াকে ওর বিকাশ নাম্বার পাঠিয়ে দিয়ে বলল,
” এতদিন হারিয়ে গেছিলি তার শাস্তি হল আমার বিকাশে টাকা পাঠা ৫০,০০০। মৃন্ময় বিয়ে করেছে ওর হানিমুন ট্রিট তুই দিবি৷ ওর বাবা বিয়ে মেনে নেয়নি। ওর মন খারাপ। মন ভাল করতে ট্যুরে নিয়ে বাসর করাব। তুই আমাদের সাথে যোগাযোগ না রেখে যে শাস্তি দিয়েছিস যে টেনশন দিয়েছিস তার জন্য হানিমুনের খরচ তুই দিবি। আর আগামিকাল যদি তোকে কুয়াকাটা না দেখি খোদার কসম ছোঁয়া নাম টা ভুলে যাবো। আর হ্যাঁ মৃন্ময়ের বউ এর জন্য গিফট হিসাবে দুইটা বালা আনিস।”

ছোঁয়া মেসেজ সিন করল। মেসেজে একটা ওয়াও রিয়েক্ট দিলো। মৃন্ময় বিয়ে করেছে। আমাদের মৃন্ময়। ছোঁয়ার মনে হাজার টা প্রশ্ন। কীভাবে বিয়ে হল। ও মেসেজের রিপ্লাই দিলো,
” আগামিকাল কুয়াকাটা দেখা হচ্ছে। ”
দ্বীপ লাফিয়ে উঠল,
” আরে ছোঁয়া আসবে কাল। সারাহ কে ফোন লাগা তন্ময়।”
তন্ময়ের হৃদয়ে কোথা থেকে যেন একটা শীতল বাতাস প্রভাহিত হচ্ছে। ওরা ঘন্টা খানিকের মাঝে হোটেল বুকিং দিলো। নিজের দুই চারটা টি-শার্ট আর প্যান্ট নিলো মেস থেকে। একটা রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়া দাওয়া করে রাত দশটার বাসে উঠে রওনা দিকো কুয়াকাটার উদ্দেশ্য।
তখন রাত দশটা বাজে। রোশান সিদ্দিকী সারাহ’কে পড়তে বসিয়েছেন। একাউন্টিং এর ম্যাথ করাচ্ছেন সারাহ’কে। সারাহ ম্যাথ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বলল,

” এই জন্যই কি বিয়ে করেছিলাম যে বিয়ের পর সারারাত জামাই এর কাছে অংক করব।”
রোশান সিদ্দিকী চশমা টা ঠিক করে বললেন,
” কেন কোথায় অসুবিধা হচ্ছে তোমার?”
” আপনার মত একজন বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমার জীবনে কি অসুবিধার শেষ আছে। জীবন আমার শেষ। আমার জীবন তেজপাতা হয়ে গিয়েছে। জীবনে কত শখ ছিলো, আমার সোয়ামি আমাকে বলবে,
‘ তোমাকে দিয়ে আমি চাকরি করাব না। তোমার ইনকাম খাওয়ার মত ইচ্ছা আমার নেই। তোমার এত পড়া লাগবে না। বছর বছর দু-চারটে বাচ্চা জন্ম দিয়ে আমার বংশের বাতি জ্বালাও।”
রোশান সিদ্দিকী অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,

” বছরে দু’চারটে বাচ্চা। হাউ ইজ ইট পসিবল!”
” এটা আর কি এমন ব্যাপার। আমি প্রতি বছর দু-চারটে বাচ্চার জন্ম দিতে পারব। যদি আপনি পারেন। আপনার পারার ওপর নির্ভর করছে।”
রোশান সিদ্দিকী থমথমে মুখে সারাহ’র দিকে তাকিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ দু-চারটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে আমাকে উদ্ধার করবে তুমি। ননসেন্স। এসব বাজে কথা কোথায় পাও। কে শেখায় তোমাকে।”
” আমাকে গা-লি দিলেন কেন?”
রোশান সিদ্দিকী চরম অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
” হাউ!”
সারাহ মুখ বাকিয়ে বলল,

” মনে মনে বিশ্রী গা’লি এসছে আপনার। দিতে পারেন নাই দেখে ননসেন্স বলেছেন। ইংলিশে বলেছেন তাও। দেখেছেন আমি ধরে ফেলেছি। আমার ট্যালেন্ট নিয়ে আপনার ধারণা নেই। দেখেছেন কতটা ট্যালেন্টেড মেয়ে আপনি বিয়ে করেছেন। আপনার মনের কথা আমি বুঝে ফেলেছি।”
” এত এডভান্স ভাবনা কীভাবে আসে মাথায়। মাথায় এসব না ঢুকিয়ে ম্যাথ ঢুকালেও তো পারো।”
সারাহ বই বন্ধ করে বলল,
” আপনার সাথে বিয়ে হয়ে আমার জীবনের সব প্রতিভা ধ্বংস। আমি আমার প্রতিভা কাজে লাগাতে পারছি না। আজ আমি আমার প্রতিভা কাজে লাগিয়ে দেশ দশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারতাম। দেশের জন্য আমি হতাম একটি স্বর্ণমুখ।”

রোশান সিদ্দিকী বেশ কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলেন,
“আচ্ছা কি প্রতিভা ছিলো। বলো শুনি।”
“ঝ-গ-ড়া করা। কলেজে স্কুলে আমার সাথে ঝ-গ-ড়া করে কেউ কোনদিন পেরে ওঠেনি। ক্লাসমেটরা ঝ-গ-ড়ায় পেরে না উঠলে আমাকে ডেকে নিয়ে যেত। আমি গিয়ে সেই ঝ-গ-ড়ায় এটেন্ট করে ফার্স্ট হতাম। এ নিয়ে আমার বেশ সুনাম ছিলো। ঝ-গ-ড়ায় একটা পয়েন্ট ভুলে গেলে যার সাথে ঝ-গ-ড়া লাগত তাকে আবার মনে করিয়ে দিতাম। আপনি আমাকে দিশার সাথে ঝ-গ-ড়া করতে না দিয়ে প্রতিভার মহৎ বিকাশ ঘটাতে দিচ্ছেন না। আপনার জন্য আমার সুবিশাল প্রতিভা ভেতরে আটকে আছে।”

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫১

রোশান সিদ্দিকী চশমার ফ্রেম ধরে একটু নাড়াচাড়া করে খুব হয়ে ভাবছে, ঝ-গ-ড়া ও বুঝি কারো মহৎ প্রতিভা হয়। সে গম্ভীর চোখে সাহার’র দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
” যাও ঝ-গ_ড়া করে দেশের মুখের সাথে আমার মুখ ও উজ্জ্বল করে এসো।”

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫৩