একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ শেষ পর্ব
Mousumi Akter
ছোঁয়া মঞ্জিলের বিশাল আলিশান বাড়িতে কলিং বেল ক্রমাগত বেজেই চলেছে। ছোঁয়ার পরণে লাল একটা বেনারসি। প্রতিবছর এ দিনে সে একাই তার ম্যারেজ ডে পালন করে। আজ ও তাই। বাড়িতে জমকানো সাজসজ্জা, বিশাল সাইজের কেক অর্ডার সাথে এতিমদের খাওয়ানো। কলিং বেল এর শব্দে ছোঁয়া ওর শাড়ির আঁচল টানতে টানতে গিয়ে দরজা খুলল। নিশ্চয়ই দরজার ওপাশে তার আদরের তনয় দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই চমকে উঠল হৃদপিন্ড। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে তন্ময় আর তন্ময়ের কোলে তনয়। তনয় তন্ময়ের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। ছোঁয়া সেকেন্ডের মাঝে দেখল তন্ময় এর পেছনে সারাহ, রোশান সিদ্দিকী, দ্বীপ, পিহু, মৃন্ময় আর তরী দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সবাই যন্ত্রণা কাতর চোখে দাঁড়িয়ে দেখছে ছোঁয়াকে।
ছোঁয়ার ও চোখে পানি ছল ছল করছে। চমকে উঠল তার হৃদপিণ্ড। থর থর করে কাঁপছে সমস্ত শরীর। ঘন ঘন চোখের পাপড়ি ফেলল। সে তার সামনে কাকে দেখছে? কাদের দেখছে? এটা কি সত্যি? তার সামনে তো তন্ময়ই দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে সারাহ ও দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়ার বিশ্বাস ই হতে চাচ্ছেনা। সে আরো দু’পা এগিয়ে গেল। আজ এত বছর পর দেখা হৃদপিণ্ডে যেন ঝড় উঠেছে। ছোঁয়া আবার দু’পা পিছিয়ে গেল। পেছাতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা লাগল তার। তন্ময় সাথে সাথে তনয় কে নামিয়ে দিয়ে ছোঁয়ার হাত ধরল। মুহুর্তের মাঝেই কেঁপে উঠল দু’জনের শরীর। সেই চেনা সুর, চেনা স্পর্শ। মুহুর্তের মাঝে অতীতে ডুব দিলো দু’জনে। এইতো সেদিন কলেজ ক্যাম্পাসে তাদের আড্ডার কত স্মৃতি ভেসে উঠল। চেনা সুরের ছন্দ বেজে উঠল দু’টি প্রাণে। কি বলবে দু’জন দু’জনকে। কিইবা বলার আছে। বলার তো অনেক কিছুই বাকি আছে। অনেক ব্যাথা, অনেক অভিমান, অনেক যন্ত্রণা। যন্ত্রণার তীব্রতা দিনে দিনে বেড়ে একটা পাহাড় তৈরি হয়েছে। টলমল করে চোখের পানি পড়ছে দু’জনের।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সারাহ, মৃন্ময়, দ্বীপ ছোঁয়ার ঘরে প্রবেশ করল।
সারাহ’র চোখ গেল ওয়ালে টাঙ্গানো ছবির দিকে। ওয়ালের এক পাশে সারাহ আর ছোঁয়ার ম্যাচিং ড্রেস পরা অসংখ্য ছবি। সাথে তন্ময় মৃন্ময় দ্বীপ এর সাথে আড্ডা দেওয়ার অসংখ্য ছবি। আর একটা ওয়ালে শুধু তন্ময়ের ছবি সাথে ওদের ছেলে তনয় এর ছবি। সারাহ, মৃন্ময়, দ্বীপ ওয়ালের দিকে তাকিয়ে অঝরে কাঁদছে। মেয়েটা সত্যি একাকী জীবন যাপন করেছে। ভয়ানক কষ্ট পেয়েছে। এখন নিজেদের ভীষণ অপরাধী লাগছে। এই অপরাধ বোধে ওরা পারছে না ছোঁয়ার সামনে মুখ দেখাতে। অথচ কথা ছিল ছোঁয়ার সামনে কোনদিন আসবে না ওরা। এ কথা কি চাইলেও আর রাখতে পারল ওরা। যে ছোঁয়ার মুখে থুতু ফেলতে চেয়েছিল সেই মুখের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছে না। ছোঁয়ার মুখে আজ কোন কথা নেই। আনন্দ নাকি চাপা অভিমানে, ও শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওদের সবাইকে।
তন্ময় আর ছোঁয়া দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে। আকস্মিক দু’জনে উচ্চারণ করে উঠলো। ব্যাপারটা কেমন কাকতালীয় হয়ে গেল। ছোঁয়া বলল,
” এতটা দূরত্ব কি সত্যি আমরা ডিজার্ভ করতাম?সব দোষ আমার।”
তন্ময় বলল,
” তোমার একটুও দোষ নেই। আজ আমাদের এত দূরত্ব যেন আকাশ থেকে মাটি। তোমাকে বুঝিনি বলেই আজ এত দূরত্ব। ”
” দোষ তোমার ছিলনা। আমি অনেক বড় লোকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলাম সেই পাপেই আজ আমাদের এত দূরত্ব। ”
তন্ময় বলল,
” সারাটা জীবন জানতাম আমার থেকে বেশি তোকে কেউ ভালবাসতে পারবে না।বা আমার থেকে পৃথিবীতে কোন মেয়ে বেশী ভালবাসতে জানে না। কিন্তু আমি ভুল ছোঁয়া। আমার ভালবাসার কিছুই জানিনা। তোর ভালবাসার কাছে আমি তুচ্ছ একজন মানুষ। আমার সব অহংকার ভেঙে গিয়েছে। একজন বন্ধু হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, একজন সন্তানের মা হিসেবে তুই পারফেক্ট। আমার নিজেকে ভীষণ অযোগ্য লাগছে। যে তোর চোখের ভাষা বোঝেনি মন বোঝেনি সে কি সত্যিই তোকে ভালোবেসেছিলো। হয়ত না। ভালবাসলে তোকে আমি বুঝতাম ছোঁয়া। আমি তোকে বুঝিনি।”
” ভালবাসলেই সব কিছু বোঝা যায় না তন্ময়। বয়সটাও তোরও কম ছিলো আমার ও কম ছিলো। দু’জনেজ ভুল করেছি। আমি বেশী ভুল করেছি। চাইলেই ইঙ্গিতে তোকে বুঝিয়ে দিতে পারতাম আমি ইচ্ছাকৃত কিছু করছি না। আমার হয়তো এই মেসেজটি তোকে তখন দেওয়া উচিৎ ছিলো যে আমি নিরুপায়। তখন তোদের হারানোর ভ’য় আমাকে পা-গ-ল করে তুলছিলো। তোকে হারানোর ভয়ে, সারাহ লে হারানোর ভ-য়, মৃন্ময় দীপকে হারানোর ভ’য়। আমার বাবা যদি তোদের মে’রে ফেলতো আমি কীভাবে বেঁচে থাকতাম। তার চেয়ে এটাই ভাল হয়েছে আমার জীবনের এতোটুকু কষ্টের বিনিময়ে তোরা বাঁচে আছিস, ভালো আছিস এটাই আমার জন্য শান্তি।”
কেটে গেল অনেক্ষণ। ছোঁয়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। তন্ময় সাথে সাথে ছোঁয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ছোঁয়া আর তন্ময় দু’জনেই কাঁদছে। তন্ময় কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি আবার ও এসছি তোমার ভালবাসা ভীক্ষা চাইতে। যদিও আমি তোমার ভালবাসার যোগ্য নই। তবুও আর একবারের জন্য কি সুযোগ দেওয়া যায়।”
ছোঁয়া চোখের পানি মুছে বলল,
” মৃত্যুর পরে জীবন পেলে আমি তোমার জন্য আমার মনের ঘরের দরজা খোলা রাখব। ”
তন্ময় কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
” এই বেঈমান কে কি কখনো মন থেকে ক্ষমা করতে পারবে? আমি ক্ষমা চাইব ও না। শুধু তোমাকে দেখার জন্য আমাকে তোমার কাছে থাকতে দাও।”
” তুমি কেন এভাবে বলছো? সেসময়ে যে কারণেই হোক দোষ আমার ই ছিলো। থাকনা অতীত এর কথা। তোমার তনয়কে তোমার মত মানুষ করার চেষ্টা করছি। ”
” তুমি এত বড় একটা উপহার আমার জন্য রেখেছো জানতাম না। এতদিন ভাবতাম এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আমার চেয়ে অভাগা কেউ নেই। কেউ ভালবাসেনা আমাকে। আজ মনে হচ্ছে আমার চেয়ে ভাগ্যবা কেউ নেই।”
পিহু একটা শুকনো কাশি দিয়ে বলল,
” রোশান স্যার দেখছেন কিন্তু। পরে আবার জড়িয়ে ধরো তোমরা।”
ওরা দু’জন দু’জনকে ছেড়ে দিলো। চোখের পলকেই যেন মান অভিমান হারিয়ে গেল।
টলমল চোখে সারাহ এসে ছোঁয়ার সামনে দাঁড়াল। ছোঁয়া কোনো কথা না বলে সারাহকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আজ কি কাঁদার দিন। আজ আনন্দের দিন। আমি আর কাঁদতে চাইনা। প্লিজ তুই ও আর কাঁদবি না। তখন থেকে দেখছি ওপাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছিস।”
সারাহ বলল,
” আই হেট ইউ তোকে। আগে তোর কোন অন্যায় ছিল না। কিন্তু ইচ্ছাকৃত আমাদের সাথে যোগাযোগ করিস নি এটা মহাঅন্যায়। আমাকে এত কষ্ট দেওয়ার জন্য তোকে মাফ করব না। আমাদের সবটা বলতে পারতি তাহলে আজ আর এত দূরত্ব হতনা।”
মৃন্ময় বললে,
” বললেই কি আর আমারা বিশ্বাস করতাম। আমাদের জীবনে তো অবিশ্বাসের তালিকায় ওই শীর্ষে ছিলো।”
দ্বীপ বলল,
” তাও বলা উচিৎ ছিলো। কেন বলেনি ও।”
তরী বলল,
” আপু আমি রোজ আল্লাহর কাছে বলতাম কোনদিন যেন আপনারা মিলে যান।”
পিহু বলল,
” তরী ভাবিই মনে হয় সব চেয়ে বেশী মিস করেছে। ”
রোশান সিদ্দিকী বললেন,
” মান অভিমান আজ এখন, এখানেই শেষ। সারাহ অসুস্থ না হলে সবাইকে সেই কুয়াকাটা আবার ও নিয়ে যেতাম।”
মৃন্ময়, দ্বীপ আর তন্ময় একসাথে জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে সারাহ’র।”
ছোঁয়া মুচকি হেসে বলল,
” খালামনি হবো?”
সারাহ লজ্জা রাঙা মুখে উত্তর দিলো,
“৩ মাস চলে।”
ছোঁয়া বলল,
” মেয়ে হোক, বউমা বানাব।”
মৃন্ময় বলল,
” ছেলে হোক আমার মত ভাদাইমা বানাব।”
আস্তে আস্তে সেই পুরণো আড্ডা আবার জমে উঠল ওদের। খেয়াল ই নেই ওদের এত গ্যাপ গিয়েছে, এত দূরত্ব ছিলো। ছোঁয়ার ড্রয়িং রুমে বসে সেই কলেজ ক্যাম্পাসের আড্ডা শুরু হল। আড্ডা দিতে দিতে ওরা রোশান সিদ্দিকী’কে বলল,
” স্যার আমাদের এক করে দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার। সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।”
তন্ময় এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে রোশান সিদ্দিকীর দিকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। রোশান সিদ্দিকী ইশারা দিয়ে বলল,
” ইটস ওকে।”
সেদিন রাতে গাছে অনেক শিউলি ফুল ফুটেছে। কি মিষ্টি সুবাস! সারাহ’র পরণে একটি নাইটি।বেলকনির লাইট অফ করে দিয়ে সারাহ ফুলের সুবাস নিচ্ছে। আকস্মিক রোশান সিদ্দিকী এসে সারাহ’র কোমর জড়িয়ে ধরল। সারাহ’র ঘাড়ে ঠোঁট ডুবিয়ে বলল,
” আমার চেয়েও কি এই শিউলি অনেক বেশী সুবাস ছড়াচ্ছে মিসেস সিদ্দিকী। ”
সারাহ রোশান সিদ্দিকী’র গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
” আপনার জীবনের সেই সুবাস শ্যামসুন্দর পুরুষ। যার সুঘ্রাণে আমি মাতোয়ারা হয়ে যাই।”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’কে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” সেই সুবাসের মাত্রা আরো একটু বাড়িয়ে দিতে চাই।”
সারাহ দুষ্টুমি করে বলল,
” পেটে বেবি কিন্তু।”
রোশান সিদ্দিকী সারাহকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে নিজেও সুয়ে পড়লেন। সারাহ কে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন,
” এই বুকটা খালি খালি লাগে তুমি ছাড়া। ইচ্ছা করে তোমাকে লুকিয়ে রাখি।”
সারাহ বলল,
” রাখুন না।”
রোশান সিদ্দিকী বলল,
” অনেক টা বছর তুমি ক্লান্ত। বিভিন্ন কারণে মন খারাপ তোমার।।ইচ্ছা হচ্ছে কোনো নির্জন প্রহরে হারিয়ে যাই দু’জন।”
সারাহ রোশান সিদ্দিকীর বুকে মাথা রেখে বলল,
” আমার একটি নির্জন প্রহর চাই শ্যামসুন্দর পুরুষ। ”
” যেখানে কোলাহল নেই, ঝামেলা নেই, দূরে একটি বাড়ি, যেখানে পুকুরে পদ্ম ফোটে।”
সারাহ বলল,
” সেই স্বপ্নের দেশে কবে যাবো।”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” বেবিটা হোক, আমরা আমাদের এই কোলাহল ছেড়ে সেই নির্জনে যাবো। সেজন্য তো এত কষ্ট করে সবাইকে মিলিয়ে দিলাম। তুমি যেন নির্জন প্রহরে শান্তিতে প্রশান্তি নিতে পারো।”
সারাহ বলল,
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৬৯
” বুড়ো হলেও ভালবাসবেন?”
” নিঃশ্বাস বইলে ভালবাসবো, আদর করব, যত্নে আগলায় রাখব।”
গল্প করতে করতে দু’জন শান্তিতে ঘুমিয়ে গেল। আজ পাঁচ বছর পর সারাহ শান্তিতে ঘুম দিলো। এই শান্তির জন্য রোশান সিদ্দিকী রাত দিন এক করে ওর বন্ধুদের মিলিয়ে দিলো।
