একটুখানি আশা শেষ পর্ব 

একটুখানি আশা শেষ পর্ব 
মেহরাফ মুন(ছদ্মনাম)

তিনদিন গড়িয়ে গেল এরইমধ্যে। সেইদিনের পরদিনই কেন জানি মুনের ফুফি মুন, অহনা আর শাফিনকে ট্যুর দিতে জোর করে পাঠিয়ে দিল বাসা থেকে। আদ্রাফকেও যেতে বলেছিলো কিন্তু তার অফিসে কাজ থাকার কারণে না করে দিয়েছে।
ওদের ট্যুর ছিল উইস্টেরিয়াতে। জাপানের অসাধারণ এক অপূর্ব জায়গা। বসন্তের দিকে বেশি সুন্দর। গাছ কিংবা দেয়ালের গা বেয়ে ঝুলতে থাকা এই উইস্টেরিয়া ফুলগুলো অসাধারণ লাগে। এক প্রশান্তির জায়গা এই টানেলটা।

আজকে ওদের ফেরার দিন কিন্তু মুনের যেন যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না এই জায়গাটা ছেড়ে। মুন অহনা আর শাফিনের দিকে তাকিয়ে মিনতি করে বলল,
‘আরেকদিন থাকো না।’
‘ওহো আপু। আজকে তো যেতেই হবে। অন্তত আমরা না গেলেও তোমাকে যে লাগবেই।’ অহনা হাসিমাখা কণ্ঠে বলে উঠলো।
-‘মানে!’ মুন অহনার কথা শুনে ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
-‘গেলেই দেখবে। এখন আপাতত সারপ্রাইস হিসেবে রাখো এটা। এইবার আসো।’ শাফিন মুনের উদ্দেশ্যে বলল।
মুন মনমরা হয়ে গাড়িতে উঠতেই শাফিন গাড়ি স্টার্ট দিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গাড়ি থেকে নেমেই মুন অবাক হয়ে গেল। বাড়িটা এত সুন্দর করে কী উদ্দেশ্যে সাজালো এটাই মাথায় আসছে না মুনের। মুন পাশ ফিরে অহনা আর শাফিনের দিকে তাকালো। ওদের চেহারায় অবাক হওয়ার বিন্দুমাত্র রেশ নেই যেন ওরা আগে থেকেই জানতো বাড়িটা এভাবে সাজাবে।
-‘অহনা বাসাটা এভাবে সাজালো কেন? যাওয়ার আগেও তো এমন দেখলাম না। ফুফি তো কিছু বলেনি তোমরা জানো কিছু?’
-‘হু জানি তো। আজ আদ্রাফ ভাইয়ার ইনগেজ। এবার আসো।’ এই বলেই অহনা দ্রুত পায়ে বাসার ভেতর ঢুকে গেল।
‘আজ আদ্রাফ ভাইয়ার ইনগেজ’ মুনের মাথায় শুধু এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘মানুষটার ইনগেজ আজ ‘ভাবতেই বুঁকের কোথায় যেন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে মুনের। কিন্তু মুনের কেন এমন মনে হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। কী জানি হয়তো এই জগড়ার মধ্যেই কোথায় যেন কিছু ভালোবাসা নিহিত ছিল।

মুন কাঁপা কাঁপা পায়ে বাসার ভেতরে ঢুকলো। আশে-পাশে আস্তে আস্তে অনেক মেহমান দিয়ে ভরে যাচ্ছে। এই সবকিছুই মুনের ভালো লাগছে না। সে দ্রুত বেগে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। নিজের রুমে যাওয়ার সময় মানুষটার রুমে একটু করে উঁকি দিল। মুনের কেন জানি ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে দ্রুত রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিবে এমন সময় ফুফি একহাতে দরজা ধরে ফেললো। ফুফিকে দেখে মুন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।

-‘ফুফি তুমি?’
-‘হ্যাঁ আমি। এভাবে দরজা আটকে দিচ্ছিলি কেন? নেয় এগুলো পড়ে নেয় দ্রুত আমি অহনাকে তোর সাহায্যের জন্য পাঠাচ্ছি।’ ফুফি হাসিমুখে অপর হাতের শাড়ি আর জুয়েলারীভর্তি ডালাটা মুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেল।
মুন তার হাতে ফুফির ধরিয়ে দেওয়া শাড়ির দিকে তাকালো। তার ইচ্ছে করছে সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দিতে। কিন্তু ফুফির নির্দেশ অনুযায়ী পড়তেই হবে। মুন শাড়ি আর জিনিসগুলো বিছানার দিকে ছুঁড়ে মারলো। তার এই মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না। হঠাৎ করেই মুডটা এত চেঞ্জ ক্যান হয়ে গেল তা মুন নিজেই ভেবে উঠতে পারছে না।
মুন এভাবেই মেঝেতে বসে রইল। খেয়াল আসলো অহনার ডাকে। অহনা একটা গোলাপি রঙের গ্রাউন পড়েছে। দেখতে একদম ভার্বিডলের মত লাগছে।

-‘আপু তুমি এখনো রেডি হওনি!’
-‘আমার ভালো লাগছে না অহু। মাথা ব্যথা করছে আমি বরং শুয়ে থাকি।’
-‘এখন চলে যাবে মাথা ব্যথা। আসো তোমাকে রেডি করিয়ে দিই আপু।’ অহনা মুখকি হেসে ফুফির মুনকে দেওয়া গ্রাউনটা হাতে তুলে নিলো।
মুন এক নজর গ্রাউনটার দিকে তাকালো। পুরোটাই অহনারটার মত। শুধু রঙ এর পার্থক্য। অহনারটা গোলাপি আর মুনেরটা কালো। মুনের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রেডি হলো।

-‘আপুউউউ তোমাকে কী মিষ্টি লাগছে!’অহনা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে গালে হাত দিয়ে বলে উঠলো।
-‘তোমাকে আরও বেশি লাগছে। একদম বার্বিডলের মত।’
অহনার জোরাজোরিতে মুন নিচে নামল। আস্তে আস্তে নিচের সম্পূর্ণ ড্রয়ইং রুমটা মেহমানে পূর্ণ হয়ে গেল। নিচে নামতেই ফুফি হাসিমুখে এগিয়ে এসে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-‘বাহ্! মাশ’আল্লাহ, আমার দুই মেয়েকেই অনেক সুন্দর লাগছে।’
মুন মুচকি হাসলো। সে আশেপাশে চোখ ঘুরাচ্ছে মানুষটাকে একটু দেখার আশায়।

এমন সময় মুনের সামনে আদ্রাফ এসে দাঁড়াল। আর এরপরই ফুফি এসে হাসিমুখে আদ্রাফের দিকে একটি রিং এগিয়ে দিল। আস্তে আস্তে মেহমানরা মুন-আদ্রাফকে ঘিরে দাঁড়ালো। মুন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে মনে করল এটা তার ভ্রম। সে চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা তার ভ্রম নয়। ফুফি, অহনা সবারই মুখে হাসি দেখে সে আন্দাজ করে নিলো এইটা আগে থেকেই প্ল্যান। এজন্যই বুঝি তিনদিন আগে এত তাড়াহুড়ো করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো!

আদ্রাফ মৃদু হেসে মুনের হাত ইশারা করতেই মুন কাঁপা কাঁপা ভাবে হাত বাড়িয়ে দিল। মুন এখনো ঘোরের মাঝেই আছে। সে ভাবেনি সবাই তারে এমন একটা সারপ্রাইস দিবে। হঠাৎ পর্দায় বাবা-মাকে দেখে মুনের চোখ আটকে গেল। তার বাবা-মা, চাচা-চাচী আর আরিফারা সবাই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। তার মানে বাবা-মা’রাও জানতো সব। ভাবতেই অভিমান হচ্ছে তাঁকে কেউই বলেনি এই ব্যাপারে।

আস্তে আস্তে শেষ হয়েই গেল মুন-আদ্রাফের ইনগেজ। মেহমানরা সবাই বিদায় নিচ্ছে। এতটুকুর মাঝেও আদ্রাফের প্রতি মুনের অভিমান হলো। একটু ভালোমতো কথাও বলল না মানুষটা শুধুই মুচকি হেসেছিলো। মানুষটাকে এখানে আসার পর এই প্রথম হাসতে দেখল মুন, কী মায়াবী হাসি! অথচ মুখে সবসময় গম্ভীরত্ত ভাব নিয়ে থাকতো।

সময় বহমান। কারো জন্য থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে কেটে গেল মুনের বিয়ের দুইটা মাস। মুন-আদ্রাফের মধ্যে এখন আর আগের মত জগড়া হয় না যা হয় রাগ-অভিমান।
সন্ধ্যায় বাবা-মার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে মুন কল দিল। পাশেই আদ্রাফ বসে মনোযোগ দিয়ে লেপটপে কাজ করছে।
মুনের সাথে বাবামার কথার পর্ব শেষ হওয়ার পর উনারা আদ্রাফকে খোঁজার কারণে মুন তার মোবাইলটা আদ্রাফের দিকে বাড়িয়ে দিল।

-‘আসসালামু আলাইকুম।’ আদ্রাফের শুদ্ধ বাংলা ভাষায় সালাম শুনে মুন শক খেল। আবার ভাবছে শুধু সালামটাই পারে হয়তো আর কিছু কিভাবে পারবে! সালাম পারলেই কী বাংলা ভাষা পারা যায় না-কি! মুন বিদ্রুপ করে হাসলো এই ভেবে, এই খাটাস জিন্দেগী গেলেও এই ভাষা পারবে না, আমি শিখতে দিবও না।
-‘আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। আর পরিবারের সবাই কেমন আছেন?’
আদ্রাফের আবারও শান্তস্বরে কোনো বাঁধা ছাড়া বাংলা বলা দেখে মুন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। সে দ্রুত পিছন ফিরে দৌড় দিতে নিলে আদ্রাফ মোবাইল কানে নিয়ে ওই অবস্থায় মুনের পথ আগলে ধরলো। মুন আদ্রাফের পাশে একটু ফাঁক পেতেই ঐদিকে চলে যেতে চাইলে আদ্রাফ মুনের হাত ধরে ফেলে।

একটুখানি আশা পর্ব ১১

মুনের তো অবস্থা খারাপ। সে হাত মুচড়া-মুছড়ি করতে লাগলো কিন্তু আদ্রাফও ছাড়া পাত্র নয়।
আদ্রাফ কল কেটে দিয়ে না জানার ভান করে বলল,
‘কী কী যেন বলছিলে সেদিন।’
‘কই কীকী ববলছিলাম ভাইয়া?’
‘মনে পড়েছে, আমি খাটাস, রামছাগল, ভুম্বা মরিচ তারপর আরও কী কী জানি!’ আদ্রাফ মুমের দিকে এগুতে এগুতে বলল।
‘এই কানে ধরলাম আর জীবনেও গালি দিব না ভাইয়া। আজকের পর থেকে আমার মাথা থেকে গালি শব্দটাই ডিলিট দিয়ে দিলাম। মাফ করে দিন ভাইয়া।’

‘উহু, যেগুলো দিছো ঐগুলোর শাস্তি তো পেতেই হবে। কানে ধরে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকো আপাতত।’ আদ্রাফ লেপটপ নিয়ে আবারও বসতে বসতে বলল।
মুন আদ্রাফের কথা অনুযায়ী কানে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুসময় বাদে আবারও আদ্রাফ উঠে এলো,’উহু, হচ্ছে না, পা মাঠিতে কেন ফেলছো?’

‘ছেড়ে দাও না ভাই।’ মুন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে উঠলো।
‘ছেড়ে দিব একটা শর্তে ‘ আদ্রাফ বাঁকা হেসে মুনের দিকে এগিয়ে আসতেই মুন আদ্রাফের হাতে জোরে কামড় দিয়ে রুম থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
‘পাগলী ‘~আদ্রাফ মুনের যাওয়ার দিকে মুচকি হেসে আবারও লেপটপের দিকে নজর দিল।

( লেখাঃ মেহরাফ মুন ) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এই গল্পের সিজন ২ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন

1 COMMENT

Comments are closed.