এক চিলতে রদ্দুর গল্পের লিংক || Yasira Abisha

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১
Yasira Abisha

ভালোবেসে ৯ বছর অপেক্ষার পর সে আমার বোনকে বিয়ে করে ফেলে। সত্যি বলতে, প্রিয় মানুষটা যখন হুট করে অন্য কারও হাত ধরে চলে যায় তবুও মানা যায় কিন্তু আপন কারো সাথে মেনে নেওয়া যায় না। তখন বুকের ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি হয়। এমন নয় যে, আমি ভেঙে পড়িনি শুধু কাউকে বুঝতে দেইনি। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়েছে, আমি শারীরিক ভাবে বেঁচে আছি, অথচ আত্নিক দিক থেকে মরে গেছি।
এতোটা বছরে আমি কখনও ভাবিনি, আফান আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমাদের সম্পর্কটা এত সহজ ছিল না, মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই আফানের আগমন ঘটে আমার জীবনে, তখন ওর বয়স ছিলো ১৮। আমাদের প্রথমে বন্ধুত্ব হয়, তিন বছর এরপর প্রেম। ভালোবাসা কি রকম হয় বুঝার আগেই সে আমার জীবনে জড়িয়ে যায় যা হুট করে ভুলে যাওয়া আসম্ভব।

শেষ দুইটা বছর সে বলতো আমি তাকে বুঝতে চাইনা তার মন কি চায় তার প্রায়োরিটি দেই না! এতোটা জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে বিশ্বাস করেছি, আমাদের প্রেম শুরুর ঠিক ৬ মাসের মাথায় সে লন্ডন চলে যায়, আমি দূর থেকে তার দেশে ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনেছি। অথচ সে!
শেষবার যখন তাকে ফোন করেছিলাম, আমার কণ্ঠ আটকে যাচ্ছিলো। তবুও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলাম,
“কি করলে তুমি আমার পাশে থাকবে? আমি তো তোমার সাথে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একা আমাকে ঠেলে দিলে আমি কীভাবে বাঁচব, আফান? প্লিজ, আমাকে তোমার জীবনে থাকার একটা সুযোগ দাও!”
কিন্তু সে একটিও কথা না বলে ফোন কেটে দিল।
আমি তখনও জানতাম না, কেন সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলো! ভেবেছি ফিরে এলে আমি বুঝিয়ে বলবো এইতো আর মাত্র ১০ দিন পরই তো ও দেশে আসবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আফান যখন বিদেশে পড়তে গিয়েছিল, আমি তার প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী ছিলাম। আমার বন্ধু-বান্ধব, আনন্দ-বিনোদন, স্বপ্ন—সব ভুলে গিয়ে শুধু তার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি জানতাম, সে ফিরবে, আমাকে নিয়েই নতুন করে জীবন শুরু করবে।
কিন্তু যেদিন শুনলাম, সে আমার চাচাতো বোন সুহাকে বিয়ে করেছে, সেদিন আমার শরীরের রক্ত যেন জমে গেল।
আমার কাজিন সুহা আমাদের প্রেমের সবকিছু জানত। তবুও সে আমার সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটাকে কেড়ে নিতে একটুও পিছপা হয়নি। ওকে তো আমি অনেক বিশ্বাস করতাম এই কারণেই,
আমি নিজের হাতে তাকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম।

এইতো ঠিক দুই বছর আগে সুহা যখন বিদেশ যেতে চাইলো, আমিই ওকে আফানের কাছ থেকে সাহায্য নিতে বলেছিলাম। ভাবিনি, আমার হাত ধরেই ও আফানের জীবনে প্রবেশ করবে। একসময় সেই সুহাই আমার জায়গাটা দখল করে নেবে।
সুহা আফান একই শহরে থাকতো। আমি জানতে পারিনি, ওরা কখন কাছাকাছি এলো, কখন একে অপরকে ভালোবেসে ফেললো।
আমি আর পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, আমার নয়টা বছর—আমার সমস্ত অপেক্ষা, ভালোবাসা—সব যেন একটা তামাশা ছিল!

আমি এতটা বছর যে মানুষটার জন্য নিজের জীবন বন্ধ করে রেখেছিলাম, সেই মানুষটা এভাবে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো! আর আমি? আমি কি সত্যিই ভালোবাসার যোগ্য ছিলাম না? নাকি আমার ভালোবাসাটাই ভুল ছিল?
আফান চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলাম। চারপাশের সবকিছু নিষ্প্রাণ লাগছিলো, যেন আমার অস্তিত্বের কোনো মূল্যই নেই। মন-মেজাজ ঠিক থাকতো না, সারাক্ষণ ক্লান্ত লাগতো। এমনকি যাদের সঙ্গে আগে প্রাণ খুলে হাসতাম, তাদের সামনেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম।
আমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে নিউট্রিশন নিয়ে, কিন্তু পড়াশোনার পর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই করা হয়নি। কারণ, আমার জীবনের সব পরিকল্পনাই তো ছিল আফানকে ঘিরে! সে ফিরে এলে কী করবো, কীভাবে জীবনটা সাজাবো—এসব ভেবেই তো এতগুলো বছর কাটিয়েছি।

আমার ছোট ভাই—ও আমার চেয়ে চার বছরের ছোট, কিন্তু মানসিকভাবে অনেক পরিণত। ও আমার এই অবস্থা দেখে আর চুপ থাকতে পারছিলো না। একদিন রাতে আমার পাশে এসে বসল, গলার স্বরটা ছিল কেমন যেন ব্যথাভরা,
“আপু, তুমি কি এভাবেই জীবনটা শেষ করে দিবে? আফান চলে গেছে, এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে—আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু তুমি তো বেঁচে আছো! এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে গেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে!”
আমি কিছু বললাম না। কারণ সত্যিই আমার কিছু বলার ছিল না।
ও আমার হাতে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি নিউট্রিশনে ভালো পড়াশোনা করেছো, রেজাল্টও ভালো। একটা হসপিটালে নিউট্রিশনিস্ট পদের জন্য লোক নিচ্ছে। তুমি একটা চেষ্টা করো না!”
প্রথমে রাজি হতে চাইনি। চাকরি করতে মন চাচ্ছিল না, নিজের মধ্যে সবকিছু গুটিয়ে রাখতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার ভাই জোর করলো,

“একটা ইন্টারভিউ দিয়েই দেখো! যদি ভালো না লাগে, করবে না। কিন্তু একবার চেষ্টা করাটা তো দরকার, তাই না?”
তার কথাগুলো মনে দাগ কাটলো। আমি ভাবলাম, হয়তো সত্যিই আমাকে নতুন কিছু শুরু করতে হবে। নাহলে এই কষ্ট আমাকে ধ্বংস করে দেবে।
তারপর ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। খুব একটা আশা ছিল না, তবুও নিজের সেরাটা দিলাম।
আর অবাক করার মতো ঘটনা ঘটে গেল—প্রথম ইন্টারভিউতেই আমি চাকরি পেয়ে গেলাম!

একটা হসপিটালের নিউট্রিশন বিভাগে আমাকে রাখা হলো, যেখানে ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে, রোগীদের ডায়েট প্ল্যান দিতে হবে। চাকরিতে জয়েন করার আগে শুনতে পারলাম ডিন নাকি প্রচুর পরিমাণে কঠিন লোক। তবে আমি একটু হাফ ছেড়ে বাচলাম কারণ আমি যেহেতু একদম নতুন আমাকে সুপারভাইজারের আন্ডারে থাকা লাগবে।
সেদিন বাড়ি ফেরার পর বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে জীবনে প্রথমবার মনে হলো, হয়তো এখান থেকে একটা নতুন শুরু সম্ভব ভালোবাসা না থাকুক অন্তত নিজেকে ভালো রাখার একটা ছোট চেষ্টা তো করতে পারি।
কিন্তু আমি তখনও জানতাম না, এই চাকরিই আমাকে এমন একজন মানুষের সামনে নিয়ে যাবে, যে আমার জীবনটাই পাল্টে দেবে…

সকালের হালকা রোদ জানালার পর্দা গলে ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছিলো। রুহি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিলো। আজ তার জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের শুরু—প্রথম চাকরির প্রথম দিন।
সে একটা গোলাপি রঙের সফট শিফন ড্রেস পরেছে, যেটা হালকা বাতাসে একটু একটু দুলছে। কোমর পর্যন্ত সোজা চুলগুলো খোলা রেখেছে, নরম কাঁধ ছুঁয়ে হালকা দুলছে। মুখে খুব হালকা মেকআপ, ঠোঁটে সফট পিঙ্ক লিপস্টিক, আর চোখে সামান্য কাজল। রুহি এমনিতেই অসম্ভব সুন্দরী, কিন্তু আজ যেন তার মধ্যে একটা অন্যরকম গ্লো কাজ করছে।
আজ তার সৌন্দর্যের আড়ালে একটা বিষণ্ণতা লুকিয়ে আছে, যেটা শুধু সে নিজেই জানে। আফানের চলে যাওয়ার কষ্ট, বিশ্বাস ভাঙার ব্যথা—সবকিছু বুকের গভীরে চেপে সে নতুন জীবনের পথে হাঁটতে চলেছে।
ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। এক মুহূর্ত আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সে মনে মনে বললো, “রুহি, তুমি পারবে।” তারপর একটা ছোট ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো।

নতুন চাকরির উত্তেজনা আর অজানা কিছুর ভয় মিলিয়ে রুহির বুকের ভেতর একটা কাঁপুনি কাজ করছিলো। হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখছিলো সে—সবাই ব্যস্ত, কোথাও রোগীর স্বজনরা উৎকণ্ঠায় বসে আছে, কোথাও নার্সরা ফাইল হাতে দৌড়াচ্ছে।
রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে যখন সে নিজেকে পরিচয় দিলো, তখন একজন সিনিয়র নার্স তাকে বললেন,
“আপনার ফাইনাল ওরিয়েন্টেশনের জন্য হসপিটালের ডিন স্যারের কেবিনে যেতে হবে। উনি সব নতুন রিক্রুটদের প্রথমে ব্রিফ করেন।”

রুহি কিছুটা অবাক হলো। ডিন? সে জানতো সুপারভাইজার থাকবে, কিন্তু সরাসরি ডিন স্যারের কাছে যেতে হবে? কিছু না বলেই মাথা নেড়ে সে সামনে এগিয়ে গেলো। আর ভাবতে লাগলো ডিনের ন্যাচারের কথা। বয়স্ক মানুষ হবে নিশ্চিত, তাই সবাইকে বকাবকি করে হয়তো।
বেশ ভয় নিয়ে কেবিনের দরজার সামনে এসে রুহি একবার চোখ বুজে নিলো। তারপর আস্তে করে নক করলো।
“স্যার আসতে পারি?”
“Come in.”
ভেতর থেকে গম্ভীর অথচ ভারী একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।
রুহি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, আর ঢুকতেই মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো।
ওয়ালনাট কাঠের টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটাকে দেখে, এরকম পুরুষকে যে কেউ একবার তাকিয়ে থাকবে।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার”
শেলফে থাকা অন্য একটা ফাইল নিয়ে এসে সে বসতে বসতে বললো,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম
Have a seat”
৫’১১” উচ্চতা, তীক্ষ্ণ চোয়াল, গভীর চোখ, নিখুঁত দাড়ি, আর চওড়া কাঁধের ওপর হালকা ক্লাসিক ব্ল্যাক শার্ট। সাদা অ্যাপ্রোনের নিচে ব্যক্তিত্বের এক অদ্ভুত আভা, চোখে অদ্ভুত রকমের আত্মবিশ্বাস। সে টেবিলের ওপরে রাখা ফাইলের পাতা ওল্টাচ্ছিলো, হাতের কলমটা অনায়াসে ঘোরাচ্ছিলো, কিন্তু তার চোখ যেন সমস্ত কিছু বিশ্লেষণ করতে পারে এমন একটা অনুভূতি ছিলো।

এক মুহূর্তের জন্য রুহির চোখ আটকে গেলো তার চেহারার ওপর। এমন কারও দিকে তাকালে হয়তো মনে হয়, মানুষটা যেন বেশি নিখুঁত, সিনেমার চরিত্রের মতো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো রুহি।
সে এখনো আফানের চলে যাওয়ার ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছে। কারো সৌন্দর্য দেখলেই তার মধ্যে অনুভূতি জাগবে—এমন কিছু হয়নি। তবে ইরাদকে যেমন অর্ধবয়স্ক কাউকে ভেবেছিলো সে সম্পূর্ণ বিপরীত।
“আপনি নিউট্রিশনিস্ট সুবহানা শিকদার রুহি?”
রুহি দ্রুত নিজের ভেতরের চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিলো, তারপর মাথা নেড়ে বললো,
“জি, স্যার।”
ইরাদ আহসান চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। এক ঝলক দেখলো তার ড্রেস, খোলা চুল, তারপর চোখ নামিয়ে নিলো।
“কাজে ঢোকার আগে আমাদের কিছু নিয়ম জেনে নিন। আপনি প্রথম দিনেই লেট করে এসছেন। কারণ জানতে পারি?”
তার কণ্ঠে কোনো আবেগ নেই, শুধু কঠোর পেশাদারিত্ব। রুহি কিছুটা নার্ভাস হয়ে বললো,
“স্যার আমাকে ডিউটি টাইম ৯টা বলা হয়েছিলো।
সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৯:০৭
রুহি বললো,
“কাল থেকে খেয়াল রাখবো স্যার”
“ইউ হ্যাভ টু”

ইরাদের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে রুহি মনে মনে ভাবলো, “৭ মিনিটের লেট কি কোনো লেট? আমিতো হাসপাতালেই ঢুকলাম ৯টায় এতো নড় হসপিটাল হেটে আসতেই তো ৫-৭ মিনিট চলে যায়! তাকে কথা গুলো বলতে পারলেও হতো কিন্তু এমন স্ট্রিক্ট লোককে কিভাবেই বলতাম? যদি প্রথম দিনই আমাকে বকা দিয়ে ফেলতো? থাক তার সামনে আর যাওয়া লাগবে না। ”
কিন্তু তখনও সে জানতো না, এই মানুষটাই তার জীবনের বাঁক বদলে দিতে চলেছে…
রুহি কেবিন থেকে বের হতেই ইরাদের ফোনে একটা কল এলো
“স্যার আপনার মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছি না”

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ২