এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১০

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১০
Yasira Abisha

রুহি ব্যাগ গোছাচ্ছিল, তখনও ওর বুকের মধ্যে একটা অজানা অস্থিরতা কাজ করছিল।
ইরাদ ফোনে জানিয়েছে, ও আসবে রুহিকে নিতে। সময় নেই বেশি, পুরো মেডিকেল টিম রেডি হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরেই গাড়ির হর্ন বাজল।
রুহি দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
ইরাদ গাড়ির দরজা খুলে দিল, “তুমি রেডি?”
রুহি হালকা স্বরে বলল, “হুম।”
গাড়িতে উঠে বসতেই ও দেখল, সামনে বসে আছে শুদীপ—গম্ভীর স্বভাবের অর্থোপেডিক সার্জন।
আর পাশেই নওশিন—রুহির সহকর্মী ও বন্ধু। একজন দক্ষ ডাক্তার, সবসময় হাসিখুশি, কিন্তু কাজের সময় ভয়ংকর সিরিয়াস।

“সবাই রেডি তো?” ইরাদ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল।
“হুম, রেডি,” নওশিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
রাতের অন্ধকারে হাইওয়ের পথ। দু’পাশে ছড়িয়ে আছে মাঠ আর অজানা গাছপালা।
দূরে দূরে ছোট ছোট দোকানের আলো, আবার কোথাও কোথাও কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা নিস্তব্ধতা।
গাড়ির জানালা দিয়ে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগছে সবার মুখে।
রুহি জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল।
ওর মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—
এই পাহাড়ি দুর্ঘটনার পেছনে কি শুধুই কাকতালীয় ঘটনা, নাকি এর মধ্যেও কোনো অজানা গল্প লুকিয়ে আছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চারপাশে নিস্তব্ধ অন্ধকার, মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ির সাইরেনের আলো।
ট্রাক আর মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ… গাড়িগুলো একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।
স্থানীয় কিছু লোক সাহায্য করছে। কয়েকজন মাটিতে পড়ে আছে, কেউ অচেতন, কেউবা ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
ইরাদ গাড়ি থেকে নেমেই নিজের সত্ত্বায় ফিরে গেল।
— “শুদীপ, তুমি অস্থি ভাঙার কেসগুলো দেখবে।”
— “নওশিন, তুমি যারা বেশি রক্তপাত হচ্ছে তাদের দেখো।”
— “রুহি, তুমি ফার্স্ট এইড করো।”
সবাই মাথা নাড়িয়ে কাজে লেগে গেল।
রুহি দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে গজ, সেলাইন বের করল।
একজন মাঝবয়সী লোকের মাথা ফেটে গেছে। রুহি দ্রুত ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
একটা ছোট মেয়ে তার নিস্তেজ মাকে ধরে কাঁদছে।
রুহি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে বলল, “মা ঠিক হয়ে যাবে, মা ভয়ের কিছু নেই…”
কিন্তু নিজের মনকেই যেন বোঝাতে পারছিল না।
ইরাদ দূর থেকে রুহির কাজ লক্ষ করছিল।

অন্ধকারের মধ্যে মেয়েটাকে দেখে কেন জানি অহনার ছায়া মনে হচ্ছিল।
কিন্তু সেই অনুভূতিটা এখন আর শুধু অহনার জন্য নয়…
এই মেয়েটা নিজের অজান্তেই একটু একটু করে ইরাদের শূন্যতাকে পূরণ করতে শুরু করেছে।
কিন্তু… ইরাদ কি সেটা মেনে নেবে?
একটার পর একটা জীবন বাঁচানোর লড়াই চলছে।
রুহি, নওশিন, শুদীপ—সবার চোখে ক্লান্তি জমেছে, কিন্তু কেউ থামছে না।
এই অন্ধকার পাহাড়ি রাতের মধ্যে যেন ওরা এক চিলতে রোদ্দুর হয়ে জ্বলছে…
চারপাশে ধীরে ধীরে কুয়াশা ঘনীভূত হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে কাজ করছে সবাই।
শুদীপ তখনও একজন রোগীর পায়ের এক্স-ফিক্স লাগাচ্ছিল, নওশিন ব্যস্ত ছিল এক শিশুর ভাঙা হাত নিয়ে।
ঠিক তখনই এক স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ছুটে এল, মুখে আতঙ্ক।

— “ডাক্তার স্যার! পাহাড়ের ওপাশে একটা পরিবার আটকে আছে! ছোট একটা বাচ্চা আছে, মা-ও খুব আহত। এখানে আনা সম্ভব না, আপনাদের ওখানে যেতে হবে!”
ইরাদ এক মুহূর্ত থমকালো।
পাহাড়ের ওপাশে…?
সেই জায়গাটা দুর্ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরে, এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হলো—রাস্তাটা জঙ্গল আর পাথরের ভিতর দিয়ে গেছে।
“ওখানে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যাবে?” ইরাদ জিজ্ঞেস করল।
“না স্যার, গাড়ি যেতে পারবে না, হেঁটেই যেতে হবে।”
রুহি আর নওশিন একসঙ্গে তাকাল।

শুদীপ দ্রুত বলল, “তাহলে আমরা সবাই চলি, একসাথে থাকলে সুবিধা হবে।”
কিন্তু ইরাদ মাথা নেড়ে বলল, “না। সবাই গেলে এখানে বাকি আহতদের দেখবে কে?”
একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল।
“আমি যাব,” ইরাদ দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
নওশিন বিরক্ত হয়ে বলল, “তাহলে আমাকে নিয়ে যান স্যার—”
“তুমি থাকো, নওশিন। এখানে এখনো অনেক রোগী আছে, তোমাকে দরকার।”
শুদীপ মাথা ঘুরিয়ে বলল, “তাহলে তুমি একা যাবে?”
এর আগে কেউ কিছু বলতে পারার আগেই রুহি ধীর কণ্ঠে বলল, “আমি যাব স্যারের সাথে।”
সবাই ওর দিকে তাকাল।
ইরাদ ঠান্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।
“তুমি যাবে?”
“হ্যাঁ,” রুহি দ্বিধাহীন স্বরে বলল। “আপনি একা গেলে বিপদ হতে পারে, অন্তত একজন থাকা দরকার। আমি যেতে পারব।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ইরাদ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু সাবধানে থাকতে হবে।”
রুহিকে ইরাদ না করতে পারে না নাকি ওর সাথে থাকতে মন চাচ্ছে বুঝতে পারছে না কিন্তু রাজি হয়ে গেলো।

রুহি আর ইরাদ টর্চ হাতে পাহাড়ি পথ ধরে এগোতে লাগল।
চারপাশটা একেবারে নির্জন। কেবল পোকামাকড়ের শব্দ, মাঝে মাঝে কোথাও একটা শুকনো পাতা খসার আওয়াজ।
রুহি একটু শিউরে উঠল।
“এত নিরব কেন?” ইরাদ হঠাৎ বলল।
“কি বলব?”
“তুমি তো সাধারণত চুপ থাকো না।”
রুহি বিরক্ত হয়ে বলল, “এমন একটা জায়গায় এসেছি, একটু ভয় করছে। আপনি তো মজা নিচ্ছেন!”
ইরাদ মৃদু হাসল, কিন্তু কিছু বলল না।
পাহাড়ি পথ সরু হতে লাগল, জায়গায় জায়গায় কাঁটা ঝোপ, পাথর।
একটা জায়গায় এসে হঠাৎ রুহির পা পিছলে গেল!
— “আহ!”
ও পড়ে যেতে নিলেই ইরাদ ওর হাতটা ধরে ফেলল।
কিন্তু জায়গাটা এতই পিচ্ছিল ছিল যে দুজনেই ভারসাম্য হারিয়ে পাশের ঝোপের ওপর গিয়ে পড়ল!

— “উফফ!”
রুহির পুরো শরীরটা ইরাদের ওপর। ও এত কাছে যে ইরাদের হালকা পারফিউমের গন্ধ স্পষ্ট লাগছে নাকে।
মূহূর্তের জন্য সময় যেন থমকে গেল।
রুহি এতটাই কাছাকাছি যে ওর চুল ইরাদের গালে স্পর্শ করছে।
শরীরে কেমন একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল।
এতো কাছাকাছি এসে রুহির, ইরাদ মুহুর্তের জন্য যেনো ঘোরে এসে যায়।
ইরাদ কাশতে কাশতে বলল, “আমার মনে হয়, তুমি একটু উঠতে পারো।”
রুহি তখনই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়াল।
ওর মুখটা পুরো লাল হয়ে গেছে।
“সরি, আমি… আমি পিছলে গিয়েছিলাম। মাফ করবেন আর হবে না এমন।”
ইরাদ ধীর গলায় বলল, “আমি জানি, অসুবিধে নেই। আপনি সরি বলেন না। আমি আছি আপনার জন্য। ”
কথাটা ইরাদ বলে নিজেই চমকে যায়, কেনো এভাবে বললো ও
আর এমন কথায় রুহি থতমত খেয়ে তাকাল।

“কি…?”
ইরাদ হালকা হাসল, কিন্তু কিছু না বলে আবার হাঁটতে লাগল।
রুহি ওর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলল—
এই লোকটা সত্যিই রহস্যময়…
প্রায় ত্রিশ মিনিট হাঁটার পর ওরা জায়গামতো পৌঁছে গেল।
একটা পুরনো কাঠের ঘর। তার সামনে এক মহিলা বসে কাতরাচ্ছে, কোলে একটা ছোট্ট মেয়ে।
রুহি দ্রুত মহিলার কাছে গিয়ে নড়াচড়া করল, “আপনি শুনতে পাচ্ছেন?”
মহিলার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর, কপালে কেটে রক্ত শুকিয়ে আছে।

ইরাদ মেয়েটাকে কোলে তুলে বলল, “শরীরে জ্বর, পানিশূন্যতা হয়ে গেছে। আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে।”
রুহি দ্রুত ব্যাগ খুলে সেলাইন বের করল ও চালের সেলাইন খাইয়ে দিলো।
সকালটা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের আকাশে।
সারা রাত ধরে কাজ করার পর ইরাদ ক্লান্ত হয়ে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে রুহির দিকে তাকাল।
রুহি তখনও গ্রামের এক বৃদ্ধার হাতে গরম পানি ধরিয়ে দিচ্ছিল, আর তার পাশে এক কিশোরীকে বোঝাচ্ছিল কোন খাবার খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
গ্রামের মানুষজন বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল।
“তোমরা দেবদেবী পাঠিয়েছে!”
এক বৃদ্ধ এসে রুহির মাথায় হাত রাখলেন।
“এমন ডাক্তার আর এমন মেয়ে আমরা জীবনে দেখিনি! এই পাহাড়ে কে আসে আমাদের জন্য? তোমরা না থাকলে ওরা বাঁচত না!”

রুহি একটু লজ্জা পেল, মাথা নেড়ে বলল, “এটা তো আমাদের দায়িত্ব…”
কিন্তু লোকেরা যেন শুনতেই রাজি না।
এরপর যা হলো, সেটা ইরাদের জন্যও অভাবনীয় ছিল।
পুরো গ্রাম একত্র হলো, ওদের সামনে ফুল, ফল, আর পাহাড়ি কাপড় এনে রাখল।
গ্রামের প্রধান ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা আমাদের অতিথি, আমরা তোমাদের কিছু দেবার ক্ষমতা রাখি না, শুধু আশীর্বাদ দিতে পারি। এই পাহাড়ের দেবতার আশীর্বাদ তোমাদের ওপর থাকুক!”
রুহি অবাক হয়ে ইরাদের দিকে তাকাল।
ইরাদ ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসল।
“দেবতার আশীর্বাদ, তাই তো?”

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৯

রুহি মৃদু হেসে বলল, “আমাদের ডাক্তারি শেখানো হয়নি কিভাবে দেবতার মতো হতে হয়… কিন্তু এরা যদি সত্যিই মনে করে আমরা তাদের সাহায্য করতে পেরেছি, তাহলে হয়তো এটা কিছুটা সত্যিও হতে পারে।”
ইরাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “হয়তো আমরা সত্যিই কারও জন্য কিছু করতে পেরেছি।”
গ্রামের লোকেরা তখন ওদের থাকার ব্যবস্থা করছিল, আর ঠিক তখনই এক বৃদ্ধা এসে বললেন, “রাতে পাহাড়ে ঝড় হতে পারে, তোমাদের আমাদের ঘরেই থাকতে হবে।”
রুহি আর ইরাদ একসঙ্গে তাকাল।

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১১