এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ২

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ২
Yasira Abisha

আমি অবিবাহিত এর মধ্যে একটা বাচ্চা আমাকে মা বলে জড়িয়ে ধরায় আমি হকচকিয়ে উঠি। ভাবতেও পারিনি চাকরির প্রথম দিন এমন কিছু একটা ঘটবে আমার সাথে।
রুহি কেবিনে ঢুকে চারপাশে চোখ বোলাল। সাজানো-গোছানো পরিবেশ, কোথাও অগোছালো কিছু নেই। দেয়ালের একপাশে একটি সাদা বোর্ড ঝুলছে, যেখানে পুষ্টি সম্পর্কিত নানা তথ্য লেখা। টেবিলের ওপর কিছু মেডিকেল জার্নাল আর নিউট্রিশন চার্ট রাখা। কর্নারের এক পাশে ছোট্ট একটা প্ল্যান্ট, যেন কেবিনের শূন্যতা কিছুটা হলেও প্রাণ পায়। সব মিলিয়ে একদম পেশাদার, কিন্তু আরামদায়ক একটা পরিবেশ।
রুহি চেয়ার টেনে বসতেই হঠাৎ অনুভব করল, পেছন থেকে কেউ এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে!

— “আম্মু! তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? তোমাকে কত খুঁজেছি, কত মিস করেছি!”
রুহি চমকে তাকালো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট মেয়ে, বয়স বড়জোর পাঁচ-ছয়। গোলাপি ফ্রকের ওপর সাদা সোয়েটার, মাথায় দুটো ছোট্ট পনিটেল, চোখ দুটো টলটলে আর মুখভর্তি মিষ্টি একটা হাসি।
নতুন জায়গায় এমন কিছু হবে, রুহির তা কল্পনাতেও ছিল না!
সে হতভম্ব হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, আরেকটু এগিয়ে গিয়ে খেয়াল করল মেয়েটি সত্যিই অপূর্ব— এত মিষ্টি একটা শিশু সে আগে কখনো দেখেনি! নিজের অজান্তেই তার মনটা নরম হয়ে এলো।
এতো মায়াবী শিশুটি রুহি কিছু না বুঝেই তার মাথায় আলতো করে হাত রাখল।
— “তুমি… আমাকে চিনো?”
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল,
— “তুমি তো আমার আম্মু!”
এই কথা শুনে রুহির শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।
“আম্মু”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কেয়ারটেকার যখন দেখল বাচ্চাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না, তখন আর দেরি না করে দ্রুত ইরাদকে ফোন দিল।
“হ্যালো, স্যার! আনাইকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!”
ইরাদ তখন হাসপাতালের নিজের কেবিনে ছিল, রিপোর্টে সই করছিল।
ইরাদের চোখ মুহূর্তেই কঠোর হয়ে উঠল। ভ্রু কুঁচকে রাগী স্বরে বলে উঠল,
“মানে? তুমি কীভাবে খেয়াল রাখছিলে ওর?”
কেয়ারটেকার ঘাবড়ে গিয়ে অসহায়ের মতো বলল, “আমি তো এক মুহূর্তের জন্য ওকে চোখের আড়াল করিনি, কিন্তু…”
ইরাদের মেজাজ আরও চড়ে গেল। হাতের ফাইল টেবিলে ছুড়ে ফেলে এক ধাক্কায় চেয়ার ছাড়ল।

“এই মুহূর্তে আনাইকে খুঁজে বের করো! আমি আসছি এখুনি”
ইরাদ চাবিটা হাতে নিয়েই দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। মাথার ভেতর চিন্তার ঝড় বইছে— মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হয়েছিল, অথচ এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সে জানে, একটা পাঁচ-ছয় বছরের ছোট্ট বাচ্চা কতদূরই বা যেতে পারে! কিন্তু তাও বুকের ভেতর একটা অজানা শঙ্কা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। যদি বিপদ হয় কোনো?
“আল্লাহ, আমার আনাইকে তুমি ভালো রাখো…”

এটাই তো তার জীবনের একমাত্র শান্তির জায়গা, তার একমাত্র আশ্রয়। যদি কিছু হয়ে যায়?
দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে নিজের বন্ধু কমিশনার বিপ্লবকেও ফোন করলো ইরাদ । আনাই কোথায় গেল? কে নিয়ে গেল? এসব একজন পুলিশই সবচেয়ে দ্রুত বের করতে পারবে, আনাইকে নিয়ে কোনো রকম রিস্ক ইরাদ নিতে পারবে না।
ফোনে কথস বলার পরে বিপ্লব যদিও বললো, যতো দ্রুত সম্ভব আনাইকে খুঁজে সে বের করবেই তবুও ইরাদ আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছিল না। পায়ের নিচের মাটিটাই কেমন যেন সরে যাচ্ছে মনে হলো।
সে দ্রুত বেরিয়ে এল, সিঁড়ির দিকে এগোতেই দেখলো মেরামতের কাজ চলছে, নামার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
লিফট আসতে সময় নিচ্ছে, আর সেই অপেক্ষার মুহূর্তগুলো যেন আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে।
ঠিক তখনই পাশের কেবিন থেকে ভেসে এলো প্রাণখোলা হাসির শব্দ।
ইরাদের কপালের ভাঁজ আরও গভীর হলো। মেয়েটার কোনো হদিস নেই, অথচ এখানে এমন আনন্দময় পরিবেশ কেন?

সে ধীরে ধীরে কেবিনের দিকেই তাকালো।
দরজার ফাঁক দিয়ে সে যা দেখলো, তাতে মুহূর্তের জন্য সময় যেন থমকে গেল।
তার ছোট্ট আনাই, রুহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে!
এই দৃশ্য যেন ইরাদের চিন্তার গতিপথটাই ওলট-পালট করে দিলো। মেয়েটা এখানে এল কীভাবে? আর রুহির সঙ্গে ওর এত আপন সম্পর্ক কবে গড়ে উঠলো?
ইরাদ নতুন নিউট্রিশনিস্টকে প্রথমে ভালো করে দেখেও নি তবে জানতো এই কেবিনেউ সে বসবে।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল না ইরাদ।
ইরাদকে দেখে “আব্বু!”
চিৎকার করে দৌড়ে এল আনাই, এক মুহূর্তও দেরি না করে ইরাদের কোলে উঠে গেল।
ইরাদের বুকের ভেতর জমে থাকা দুশ্চিন্তা, ভয়, রাগ—সব মিলিয়ে যেন একটা বিস্ফোরণ হতে চেয়েও থেমে গেল মেয়ের কোমল স্পর্শে।
সে শক্ত করে আনাইকে জড়িয়ে ধরলো, যেন একটু আগে যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটা দেখছিল, তা সত্যি না হয়ে যায়।

“তুমি এখানে কীভাবে এলে, মা?”—কণ্ঠে কঠোরতা থাকলেও তাতে মিশে ছিল গভীর শঙ্কা।
আনাই মাথা তুললো না, শুধু ছোট্ট হাতদুটো আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে।
এতো গুলো সময়ের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো ইরাদ সত্যিকারের স্বস্তি অনুভব করলো। সে কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে শুধু মেয়েটার অস্তিত্বটা অনুভব করতে চাইল।
” মা তুমি এখানে কেনো এলে? কিভাবে এলে?”
আনাই কোনো উত্তর না দিয়ে বললো,
“ওইযে আমার আম্মু”
ইরাদ থমকে গেল।
“আম্মু?”

তার গলায় একসঙ্গে বিস্ময়, সংশয় আর অজানা এক আতঙ্ক। আনাই কি ভুল করে কিছু বলে ফেললো, নাকি সে যা ভাবছে, সেটাই সত্যি?
রুহি এতক্ষণ নিঃশব্দ দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এবার যেন তার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেল।
“আমি তো আম্মুকে খুঁজে পেয়েছি, আব্বু!”—আনাই আনন্দে চিৎকার করে বললো, তার ছোট্ট হাত দিয়ে রুহিকে দেখিয়ে দিল।
রুহির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
ইরাদ একবার আনাইয়ের দিকে তাকালো, একবার রুহির দিকে। তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করছিল না। এই পরিস্থিতির কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
সে মুহুর্তে ইরাদের ড্রাইভার চলে আসে এবং আনাইকে ইরাদ তার কাছে দিয়ে বলে,
” ওকে আমার কেবিনে নিয়ে যাও, আসছি আমি।”
রুহি স্বাভাবিকভাবে দাড়িয়ে ভাবছে তাহলে এই বাবুটা ডক্টর ইরাদের।
তবে ইরাদ যে কঠিন চাহনি দিয়ে তাকালো ও রুহির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। এতে রুহি ভয় পেয়ে গেলো,
ইরাদ এখন স্পষ্টভাবে তাকিয়ে দেখল রুহিকে।
একটা সময় খুব পরিচিত ছিল এই মুখ, এতোটা নিখুঁত সুন্দর লাগতো ইরাদের কাছে মনে হতো চাঁদের চেয়েও বেশি অপরূপএই মুখখানা অথচ আজ যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত! ইরাদ কিছুক্ষণের জন্য অবাক হয়ে যায় এতো নিখুঁত মিল দেখে চেহারায়!

রুহিও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন চোখ তুলে তাকাতে ভয় পাচ্ছে।
ইরাদের মনের মধ্যে তোলপাড় চলছিল।
” তাহলে এই মেয়েই কি সে……”
বিগত চার মাস ধরে তার মা তাকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন, আর বারবার যে মেয়েটির কথা তুলছিলেন, সেই মেয়েই— কি মিস রুহি.. মায়ের পছন্দের মেয়ে?
তা না হলে, তাকে কেন এই হাসপাতালে চাকরি দেওয়া হলো? আর আজ আনাই হঠাৎ করে তাকে ‘আম্মু’ বলে ডাকল কেন?
সে মুহূর্তটা এই ভেবেই ইরাদের ভেতরে যেন একটা বিস্ফোরণ হলো!
— “তোমার এত বড় সাহস?!” ইরাদ ধমক দিয়ে উঠলো।
রুহি মাথা তুলে তাকাল। এই ব্যাবহারের কারণ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও
ইরাদের চোখে প্রচণ্ড রাগ, অবিশ্বাস আর কোথাও যেন একটা চাপা কষ্ট!
— “কি চেয়েছিলে তুমি? চাকরি? সেটার ব্যবস্থা আমার মা করেছে, জানি! কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাবে!”
রুহি হতভম্ব হয়ে গেল।

— “ডক্টর ইরাদ, আমি?
— “আমার নাম মুখে আনতে হবে না! আনাইকে কীভাবে বুঝিয়েছো তুমি যে তুমি ওর মা?”
রুহির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
— “আমি কিছু বলিনি, ও নিজেই…”
— “ও নিজে কেন বলবে? নিশ্চয়ই ওর মনে কোনো ভুল ধারণা তৈরি করেছো!”
ইরাদের কণ্ঠে প্রচণ্ড আক্রোশ।
— “বলো! আমার মা তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাই না? তার ইচ্ছা ছিল আমাকে বিয়ের জন্য রাজি করানো, তাই তো? আনাইকে ব্যবহার করছো? জানো তুমি কী করছো? টাকা দরকার তোমার? এইজন্য এমন করছো?”
রুহি কোনো উত্তর দিতে পারছিল না, চোখ থেকে শুধু অশ্রু ঝরছিলো। ইরাদ ক্রমশ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠছিল!
এবং রাগে রুহির হাত চেপে ধরে, এতে রুহি ব্যাথা পাচ্ছিলো খুব,
— “তোমাকে চিনতে ভুল করেছিলাম আমি! তুমি এতটা নিচে নামতে পারবে ভাবিনি! আমার আনাই এখানে এলো কি করে?

বলো? তুমি নিয়ে এসেছো?”
রুহির চোখ ছলছল করছিল, কিন্তু সে কোনো কথা বলল না।
কারণ তার কোনো কথাই ইরাদ বিশ্বাস করছে না।
ঠিক তখনই দরজার বাইরে ড্রাইভার ও আনাই
— “আম্মু!”
রুহি তাকিয়ে দেখল, আনাই দৌড়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
— “আব্বু, তুমি আম্মুকে বকা দিচ্ছো কেন?”
কথাটা বলে আনাই কান্না করতে চাইছে তখনই ইরাদ স্বাভাবিক হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলে
“না মা আমি বকা দিচ্ছি না!”
রুহি কান্না থামাতে না পেরে এক দৌড়ে বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে।
এরই মধ্যে ড্রাইভার সাদিক বলে

“সে আনাইকে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে আনাই তার বাবার জন্মদিন উপলক্ষে সারপ্রাইজ করতে চেয়েছে কিন্তু রুহিকে দেখার পর সে এখানেই মায়ের কাছে গল্প করতে থাকে।
সাদিক দেখেনি কখন আনাই ওর হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে এই কেবিনে
সে নিজেও আনাইকে খুঁজতেছিলো। যখন ইরাদের আওয়াজ শুনতে পায় তখনই সাদিক এসে দেখে আনাই এখানে….

রুহি তাদের পূর্ব পরিচিত কেউ নন বরং যে মেয়ের সাথে তার মা বিয়ে দিতে চেয়েছিলো সে তো এখন বাংলাদেশেই নেই বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে গেছেন।”
এসব শুনে ইরাদ বুঝতে পারে সে মাত্রই একটা বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে।
“মেয়েটার চেহারা শুধু আনিকার মতো, সে তো আনিকা না….”
এদিকে রুহি কাদতে কাদতে ভাবে,

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১

“আমি বোধহয় কোথাওই সুখ পাবো না, জীবনে একটা চাকুরী করতে এলাম, এতেও বিনা দোষে এতোগুলো অপমান হতে হলো বড্ড একা লাগছিলো সে মুহুর্তে।

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৩