এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৬

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৬
Yasira Abisha

হালকা সোনালি আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করছে। স্নিগ্ধ সকাল, শিশিরভেজা বাতাসের মিষ্টি ছোঁয়া চারপাশে। গাছের পাতাগুলোতে রোদের চিকচিকে ঝিলিক, দূর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কূজন। যেন নতুন এক দিনের শুরুতে প্রকৃতিও হাসছে।
বিছানার এক পাশে ছোট্ট আনাই গভীর ঘুমে, মুখটা এত শান্ত যে দেখে মনে হয় যেন কোনো ছোট পরি। তার পাশেই রুহি, এক হাতে আনাইকে আলতো জড়িয়ে রেখেছে, যেন ঘুমের মধ্যেও মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে মন চাচ্ছে না।
ইরাদ তখনও জেগে। সারারাত ঘুম আসেনি, কিন্তু আজ সকালে কেন যেন তার মনটা হালকা লাগছে। ভোরবেলা উঠে নীরবে রান্নাঘরে চলে গেছে। আজ সে নিজে নাস্তা বানাবে। আনাই আর রুহির জন্য।

গরম গরম পরোটা ভাজছে, সাথে নরম করে ডিমের ভুজিয়া। একপাশে রেখে দিয়েছে টোস্ট আর ফলের সালাদ। কফির মিষ্টি গন্ধ পুরো বাড়িটাকে ভরিয়ে তুলেছে।
ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে যায় রুহির। চোখ খুলতেই দেখে, আনাই ওর কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে। হাতটা ওর ছোট্ট আঙুলের মধ্যে গাঁথা। একটা গভীর প্রশান্তি এসে ছুঁয়ে যায় রুহিকে। আনাইয়ের কপালে হাত রাখতেই বুঝতে পারে—জ্বর নেই! মেয়েটা পুরোপুরি সুস্থ!
রুহির মুখে একরাশ স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে।
“আম্মু…” আনাই আধো ঘুমে ফিসফিস করে ডাকে।
রুহি ওর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে, “গুড মর্নিং, বেবি।”
ঠিক তখনই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইরাদ বলে ওঠে, “গুড মর্নিং টু ইউ টু।”
রুহি তাকিয়ে দেখে, ইরাদের হাতে ট্রে, তাতে সাজানো নাস্তা।
“নাস্তা রেডি। খেতে আসবেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুহি কিছুক্ষণ চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ধীরে হেসে বলে, “স্যার, আপনিই নাস্তা বানিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। বিশেষ করে তোমাদের জন্য।”
রুহির মনে হলো, ইরাদকে আগের চেয়ে একটু আলাদা লাগছে আজ।
সে আজ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চোখের নিচে রাত জাগার হালকা ছাপ থাকলেও, তার কালো গভীর চোখদুটোতে যেন নতুন একটা উষ্ণতা খেলা করছে। চুলগুলো হালকা এলোমেলো, কিন্তু তাতেও তার হ্যান্ডসাম লুক যেন আরও ফুটে উঠেছে। শক্ত চোয়াল, শার্প নাক আর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হালকা হাসিটা আজ কেমন যেন অন্যরকম। একটা রুক্ষ অথচ রহস্যময় সৌন্দর্য আছে তার মধ্যে, যেটা রুহি এতদিন খেয়াল করেনি, বা হয়তো খেয়াল করতে চায়নি।

ডাইনিং টেবিলে তিনজন বসে। আনাই এখন পুরোপুরি চাঙা, দুষ্টুমি করছে, খিলখিল করে হাসছে।
“আম্মু, পরোটা মজা!”
“নিশ্চয়ই! তোমার বাবা নিজে বানিয়েছে তো।” রুহি মজা করে বলে।
ইরাদ হাসে, “আমি কিন্তু ভালো কুক। শুধু সময় পাই না।”
“তা বলার দরকার নেই, আজকের নাস্তা খেয়ে বুঝে গেছি।” রুহি ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এনে বলে।
ইরাদ এবার সত্যিই খুশি হয়। সে লক্ষ্য করে, রুহির মুখে আজ একটা অন্যরকম প্রশান্তি।

নাস্তা শেষ হতেই রুহি গ্লাসে শেষ চুমুক কফি নিয়ে বলে, “ স্যার আমার এখন বের হতে হবে।”
“এখনই?” ইরাদ কপালে ভাঁজ ফেলে।
“হ্যাঁ, স্যার, কিছু কাজ আছে বাড়িতে না গেলেই না। আপনি কিছু মনে না করলে আমি আনাইকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাই।”
” আপনার বাসায় কোনো অসুবিধা হবে না?”
“আমার বাসায় মা বাবা আর আমার ছোট ভাই, তারা সবাই গ্রামের বাড়ি গেছেন, এখন নেই কেউ। আর এমনিতেও আনাই এতো মিষ্টি ওকে দেখলে সবাই আদর করবে তাই থাকলেও কোনো সমস্যা ছিলো না। তাই না আনাই?”
কথাটা বলে রুহি আনায়ের গালে একটা আলতো করে চুমু দেয়।
ইরাদ রুহির যত্ন দেখেছে আনাইয়ের প্রতি তাই কোনো আপত্তি না করে রুহির সাথে আনাইকে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

ইরাদ মৃদু হেসে বলে, “আচ্ছা, আমি গাড়িটা বের করি।”
রুহি আনাইকে কোলে নিয়ে বলে, “বলো তো, আম্মু কোথায় যাবে?”
“ আম্মুর বাড়ি!”
রুহির বাসায় পৌঁছাতেই আনাই উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল। ওর মনে হলো, মা যেন সত্যিই ফিরে এসেছে! চারপাশের সবকিছু ওর কাছে আরও আপন লাগছিল।
— “আম্মু, এটা কি তোমার ঘর?”
রুহি মাথা নাড়ল। আনাই খুশিতে চারপাশ ঘুরে দেখল।
রুহি হেসে ওর কপালে চুমু খেল। আনাইকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও সত্যিই যেন মাকে ফিরে পেয়েছে।
সময় কখন যে সকাল থেকে রাত হয়ে গেল, কেউ বুঝতেই পারেনি। হাসি, খুনসুটি, আর ভালোবাসায় ভরা একদিন।
রুহি আর আনাইকে বিদায় জানিয়ে ইরাদ নিঃশব্দে নিজের রুমে ফিরে এল। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে একবার সহজ চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিল। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। কিন্তু ইরাদের মনে আজ আলো-অন্ধকারের খেলা চলছে—স্মৃতির জানালা খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

প্রথমবার যখন আনাই পৃথিবীতে এলো, ইরাদ এক মুহূর্ত দেরি না করে ফোনটা হাতে নিয়েছিল। ওপাশে ছিল অহনা।
রাগ, জেদ, অভিযোগ, অভিমান সব পেছনে ফেলে অহনাকে ফোন করে ইরাদ।
“মেয়ে এসেছে।”
“আমি ফিরছি ইরাদ, আজ শেষ এক্সাম ছিলো।
অনেক ধন্যবাদ এমন একটা সংবাদ দেবার জন্য।
তুমি….. ”
কিছু বলার আগেই ইরাদ ফোন কেটে দেয়।
এতো ভালোবাসার পরও যে ছেড়ে যায়, তার ওপর রাগ থাকাই স্বাভাবিক। তাই আনাইয়ের জন্মের খবর দিলেও ওহনার সঙ্গে আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হয়নি তার।
তবে সেদিন ইরাদের আনন্দের কমতি ছিল না। পুরো এলাকা জুড়ে মিষ্টি বিতরণ করেছিল সে। সবাইকে জানিয়েছিল— আহসান পরিবারের প্রথম কন্যাসন্তান এসেছে পৃথিবীতে!
ইরাদের পরিবারে ছেলেরা থাকলেও, একমাত্র কন্যাসন্তানের জন্য সবার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। আনাই যেন সেই প্রতীক্ষার পূর্ণতা নিয়ে এসেছিল—এক টুকরো রদ্দুর হয়ে। কথাগুলো ভেবে ইরাদের ঠোঁটের এক কোণে হাসি ফুটে উঠেছিলো।

কিন্তু মাত্র আনাইয়ের জন্মের তিন দিন পর এমন কিছু ঘটবে, ইরাদ কোনোদিন ভাবতেও পারেনি।
এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে—যা পুরো পরিবারকে শোকে ডুবিয়ে দেবে!
আজও সে দিনগুলোর কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। এক নিমেষেই জীবনের আলো ঢেকে গিয়েছিল কালো ছায়ায়।
এরপর আর যেনো কিছুতেই সে কষ্টগুলো কমেনি। বরং গুছিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন কষ্ট এসে ভিড় জমিয়েছে তার জীবনে, একটার পর একটা!

রাত গড়িয়ে গেছে। ইরাদ আনাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ড্রাইভার পাঠিয়ে দিয়েছে।
রুহি নিজে হাতে আনাইকে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়েছে, যত্নে, মমতায়। বাচ্চাটার ছোট ছোট হাত, মিষ্টি হাসি, আর ‘আম্মু’ বলে ডাক সবকিছুই যেনো রুহির মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এনে দিয়েছে।
আনাই চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়িটা একেবারে নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো।
জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে, নরম, শান্ত, কিন্তু কোথাও যেনো বিষণ্ণ এক অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। রুহি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আনাইয়ের ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসে।
কেনো যেনো বুকটা হালকা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

এতোদিন মনে হয়েছিলো, একা থাকা রুহির জন্য অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আনাই আসার পর এই দু’দিনে সে অনুভব করেছে, একা থাকা আসলে কতোটা কঠিন।
অদ্ভুতভাবে আফানের কথা খুব একটা মনে পড়েনি এই ক’দিন।
এই ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে একটু চমকে ওঠে রুহি।
আসলেই, মনটা পরিবর্তন হচ্ছে।
বাচ্চাটার ছোট্ট অস্তিত্ব যেনো তার জীবনের অনেক শূন্যতা ঢেকে দিয়েছে। আনাইয়ের ছোট ছোট হাত ধরে থাকলে, বাচ্চাটার হাসিমুখ দেখলে, ওকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে যেনো ভেতর থেকে সব কষ্ট মুছে যেতে থাকে।
রুহি জানে না, এই অনুভূতি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে।
কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারছে, আনাইয়ের আগমনে তার হৃদয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তি এসেছে—একটা শান্তি, যা সে বহুদিন ধরে অনুভব করেনি…

বাইরে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে আকাশজুড়ে। পুরো বাড়িটা নীরব, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আনাই চলে গেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা হলো, অথচ মনে হচ্ছে যেনো অনেক বড় একটা অংশ হারিয়ে ফেলেছে সে।
রাতের খাবার খাওয়ানোর পর আনাইকে ওর গরম কাপড়গুলো পরিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়েছে রুহি। ড্রাইভার আসার পর আনাই হাত বাড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “আম্মু, আমি কাল আবার আসবো, তুমি কষ্ট পেও না, ঠিক আছে?”
আম্মু! এই ডাকটা কষ্ট দেয় না, বরং বুকের ভেতর এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়।
রুহি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আনমনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এই দুদিনে ওর জীবনে অনেক কিছু বদলে গেছে।

এতদিন যে শূন্যতা ছিল, আজ যেনো একটু একটু করে ভরাট হচ্ছে। আনাই যখন ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে রুহির গলা জড়িয়ে ধরত, কিংবা ওর চোখের দিকে চেয়ে হাসত, তখন মনে হতো যেন সব কিছু ভুলে যাওয়া সম্ভব। আফানের কথা কেনো জানি খুব একটা মনে পড়েনি এই দুইদিনে। সেই শূন্যতা আজ আর নেই, যেনো কোথাও একটা প্রশান্তির ছোঁয়া এসে পড়েছে।

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৫

আনাইয়ের আগমনে রুহির জীবনে এক নতুন রঙ লেগেছে, এক নিখাদ সুখের অনুভূতি এসেছে।
সুখ? হ্যাঁ, এটা হয়তো সুখই। একটা ছোট্ট শিশুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় রুহির হৃদয় যেনো নতুন করে জাগছে। এতদিন সে ভেবেছিল সুখ হয়তো শুধুই কল্পনা, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সুখ ঠিকই আছে—আনাইয়ের ছোট্ট অস্তিত্বের মাঝে লুকিয়ে ছিলো এতদিন!

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৭