এক চিলতে রদ্দুর শেষ পর্ব
Yasira Abisha
রাতের নিস্তব্ধতা যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে। নরম চাঁদের আলো রুহিদের গেটের সামনে ছড়িয়ে পড়েছে, হালকা বাতাস বইছে ধীরে ধীরে। চারপাশটা নির্জন, রাস্তাগুলো ঘুমিয়ে গেছে, শুধু একটা গাড়ির আলো ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল।
গাড়িটা থামতেই ইরাদ দরজা খুলে নামল। একটা অদ্ভুত শূন্যতা তার বুকের ভেতর জমাট বেঁধে আছে। পা যেন নিজে থেকেই সামনে বাড়িয়ে দিল। আজ এই রাতে কেন ডাকল রুহি? কেন ওর গলায় এমন কষ্টের ছায়া ছিল?
রুহি তখনও দাঁড়িয়ে, ওর দৃষ্টি অস্থির। ইরাদকে দেখেই এক ধাপ এগিয়ে এল, যেন অনেক কথা জমে আছে ঠোঁটের কিনারে। কিন্তু প্রথম কয়েক সেকেন্ড, ওরা শুধু তাকিয়ে থাকল একে অপরের দিকে—একটা নিঃশব্দ অনুভূতি দুজনের মধ্যে ছড়িয়ে গেল, যেন হাজার কথা বলা হয়ে গেল চোখেই।
“আপনি এলেন,” রুহির কণ্ঠটা ফিসফিসে, যেন একটা চাপা শ্বাসের মতো বেরিয়ে এল।
“তুমি ডেকেছ, আমি আসব না?” ইরাদের কণ্ঠেও গভীরতা, যেন অভ্যন্তরের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাটা করছিল।
রুহি ঠোঁট কামড়ে সামনের দিকে এক পা এগোল, তারপর খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল—
“আপনি চান আমি কাল অন্য কারও হই?”
ইরাদের নিঃশ্বাস আটকে গেল।
এই প্রশ্নটার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
“রুহি…”
“না, উত্তর দিন, স্যার,” রুহি এবার জোর দিল কণ্ঠে, কিন্তু সেই শক্তির আড়ালেও একটা গভীর ব্যথা লুকিয়ে ছিল। “আপনি চান আমি কাল আফানের স্ত্রী হয়ে যাই?”
ইরাদ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। রুহির চোখ দুটো কাঁপছে, কিন্তু তবু সেখানেও একটা শক্তি আছে—একটা উত্তর জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে ইরাদের। সে জানে, এটা সত্যি। কাল যদি কিছু না বলে, তবে রুহিকে হয়তো চিরতরে হারাতে হবে।
কিন্তু ও কি সেটা চাই?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কখনো না।
“আমি…” ইরাদ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।
রুহি হালকা হাসল। সেই হাসির ভেতর কষ্ট মিশে ছিল, হাহাকার মিশে ছিল।
“আপনি চুপ করে আছেন, তার মানে বুঝতে পেরেছি,” ও ফিসফিস করে বলল।
ইরাদ এবার এক ধাপ এগিয়ে এল, খুব কাছে।
“তুমি কী বুঝলে, রুহি?” তার কণ্ঠ যেন একটু কেঁপে গেল।
রুহি গভীর শ্বাস নিল।
“আমি বুঝলাম, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।”
ইরাদের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল।
“রুহি, আমি…”
“স্যার,” রুহি এবার মাথা নিচু করল, “আমি আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।”
নিঃশব্দ, গভীর অন্ধকার রাত। বাতাসটা স্তব্ধ। আশপাশের পৃথিবী যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
ইরাদ কিছু বলল না। শুধু শুনছিল। ওর ভেতরটা শূন্য হয়ে আসছে।
“আমি আফানকে বিয়ে করতে চাই না। আমি জানি না, এটা ভুল কি না, আমি জানি না, আমি এই অনুভূতিটা কোথায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধু জানি, যখন আপনার সামনে আসি, তখন মনে হয় আমি সম্পূর্ণ। যখন আপনি দূরে থাকেন, মনে হয় আমি হারিয়ে গেছি। আপনি যদি চান, আমি কাল অন্য কারও হয়ে যাবো। কিন্তু তারপর আমাকে আর দেখতে পাবেন না।”
রুহির কণ্ঠে একরাশ বেদনা। চোখের জল তার চোখের কিনারায় ঝুলে আছে, কিন্তু সে ফেলছে না।
ইরাদ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে।
এতদিন ধরে সে নিজের অনুভূতি থেকে পালাচ্ছিল। আজ, এই মুহূর্তে, সেই অনুভূতিগুলো একসাথে বিস্ফোরিত হচ্ছে ওর ভেতরে।
সে হাত বাড়িয়ে রুহির গাল ছুঁয়ে দিল।
“তুমি কি জানো, রুহি?”
রুহি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি হয়তো অনেক দেরি করে বুঝেছি, কিন্তু সত্যি বলছি, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।”
রুহির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
“আপনি…”
“হ্যাঁ, রুহি। আমি তোমাকে ভালোবাসি,” ইরাদ এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
একটা দীর্ঘ মুহূর্ত ওরা দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ। রুহির চোখ বেয়ে নেমে এলো এক ফোঁটা অশ্রু।
“তাহলে আমাকে ছেড়ে যেতে বলবেন না, স্যার?”
“না, কখনো না,” ইরাদ ফিসফিস করে বলল।
রুহি এবার একটু এগিয়ে এলো, খুব আস্তে বলল, “তাহলে আমাকে আর স্যার ডেকো না।”
ইরাদ হালকা হাসল,
রুহির একদম কাছে যেয়ে জিজ্ঞে করলো,
” আমার স্ত্রী হবে রুহি? আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ভালো রাখতে আমার প্রিয়তমাকে।”
রুহির চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল,
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো সে।
ইরাদ কাছে এসে তার হাত দুটো শক্ত করে ধরল।
“রুহি আজকে থেকে তুমি আমার। আর কখনো ভুলেও ভাববে না যে তুমি একা। তুমি কখনো একা ছিলে না, আর কখনো একা থাকবে না।”
সেই রাতেই রুহির বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই সম্পর্কই তাদের মেয়ে এবং তার ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে সঠিক।
দিন পেরিয়ে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত— ইরাদ আর রুহির বিয়ে।
সারাদেশের আলো-আঁধারিতে রঙিন হয়ে উঠেছে তাদের ঘর। রুহির পরনে গাঢ় লাল বেনারসি, সোনার কারুকাজ করা গয়নায় যেন এক পরী লাগছে তাকে। হাতের মেহেদী এখনো তরতাজা, যেন তার নামের মতোই এক চিলতে রোদের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।
বিয়ের আসরে যখন ইরাদ প্রবেশ করল, তখন পুরো বাড়ি যেন নিঃশব্দ হয়ে গেল। কালো শেরওয়ানিতে তাকে দেখাচ্ছিল অভিজাত, গম্ভীর, অথচ তার চোখে ছিল একরাশ ভালোবাসা, যা শুধু রুহির জন্য।
কাজী যখন বললেন—
“রুহি জামান, আপনি কি ইরাদ আহমেদকে কবুল করছেন?”
রুহি ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাল। একপাশে তার মা, অন্যপাশে ইরাদ… সামনে আনাই, ছোট্ট হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
তারপর সে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল…
“কবুল।”
একবার, দু’বার, তিনবার…
চারপাশে ধ্বনিত হলো “আলহামদুলিল্লাহ!”
ইরাদের কণ্ঠ দৃঢ়, গম্ভীর, কিন্তু আবেগে টলমল— “আমিও কবুল করলাম।”
বিদায়ের আগ মুহূর্তে রুহি আনমনে আয়নার দিকে তাকিয়ে ছিল। লাল বেনারসিতে নিজেকে কেমন যেন অচেনা লাগছে। ঘরভর্তি মেয়েরা হাসছে, ঠাট্টা করছে, কিন্তু তার মন অন্য কোথাও কেমন যেনো একটা আলাদা রকম অনুভূতি কাজ করছে।
কিছুক্ষণ আগেও সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। অথচ এখন, বিয়ের মঞ্চ ছেড়ে একা বসে থাকতে গিয়ে হঠাৎ একধরনের অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করলো সে।
রুহি আজ ইরাদের বাড়িতে এসেছে— আগে কতবার এসেছে, কিন্তু আজ সে এসেছে এই বাড়ির বউ হয়ে।
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! জীবনের এতগুলো বাঁক পেরিয়ে, এত জটিলতা পার করে আজ সে এখানে, ইরাদের ঘরে, ইরাদের জীবনে।
চেনা উঠোন, চেনা দরজা, চেনা দেয়াল— তবুও আজ যেন সবকিছু নতুন লাগছে।
সিঁড়ির ধাপে পা রাখতেই মনে হলো, পুরো বাড়িটাই যেন অন্যরকম হয়ে গেছে।
নতুন জীবনের প্রথম রাতের আবেশ নিয়ে ইরাদের রুমে এসে বসল রুহি।
সোনালী রেশমে মোড়ানো বিছানা, মৃদু আলো, ঘরে ছড়ানো সুগন্ধি আতর—সবকিছুতেই যেন এক অনির্বচনীয় মায়া লেগে আছে। রুহির লাল রঙের কাতান শাড়ি মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে, মাথায় ঘোমটা টানা, হাতের মেহেদী এখনো টাটকা।
সে নিঃশব্দে বসে আছে, বুকের মধ্যে আবেগের ঢেউ খেলছে। আজ সে নতুন এক পরিচয়ে এই ঘরে এসেছে— ইরাদের স্ত্রী হয়ে। হৃদয়ের গভীরে এক মিশ্র অনুভূতি— আনন্দ, লজ্জা, উত্তেজনা, আর এক অজানা শিহরণ।
দরজার বাইরে এখনো হাসি-ঠাট্টা চলছে, আনাই দৌড়ে এসে একবার দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরেছিল, কিন্তু সবাই হাসতে হাসতে টেনে নিয়ে গেছে।
রুহি ধীরে ধীরে হাতের আঙুলের আংটিটা ছুঁয়ে দেখল, মনে পড়ল নিকাহের মুহূর্তটা। আজ থেকে সে শুধু রুহি নয়, ডাক্তার ইরাদের সহধর্মিণী।
কিছুক্ষণ পর রুহির ধ্যান ভেঙে এলো৷ আনাইয়ের ডাকে।
“আম্মু!”— রুমে ঢুকেই আনাই তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছোট্ট শরীরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি এখন আমার আম্মু হয়েছো, তাই না?”
রুহি আনাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসল।
“তোমার আম্মু তো আমি অনেক আগেই ছিলাম, তাই না?”
আনাই মাথা নাড়ল, তারপর মুচকি হেসে বলল, “আব্বুও এখন তোমার!”
রুহি এবার সত্যিই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। পাশের মেয়েরা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে ইরাদ এই দৃশ্য দেখছিল। রুহিকে দেখতে কতো মানুষের ভীড় আত্নীয় স্বজন রুহিকে দেখে খুব খুশি। বেশ করে আনাইয়ের জন্য।
একসময় মনে হয়েছিল, জীবনে আর কখনো কাউকে জায়গা দিতে পারবে না ইরাদ। কিন্তু রুহি ধীরে ধীরে, নীরবে, একটুও জোর না করে তার জীবনে জায়গা করে নিয়েছে।
আর আজ, রুহি ইরাদের জীবনসঙ্গী।
রাত বাড়তে থাকল। ধীরে ধীরে সব আত্নীয়স্বজন ও ইরাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
রুহি এবার একা। আনাই ঘুমিয়ে গেছে, ওর দাদা দাদু আজ রাতে ওকে নিয়ে গেছে সাথে করেই ঘুমানোর পর।
নতুন জীবনের শুরুতে বুকের ভেতর কেমন যেন অজানা শঙ্কা কাজ করছে।
একসময় দরজায় টোকার শব্দ হলো।
তারপর ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেল…
ইরাদ দাঁড়িয়ে আছে, কালো পাঞ্জাবির ওপর সোনালি কাজ করা শেরওয়ানি। চোখে একরাশ অনুভূতি। সবাইকে বিদায় দিয়ে এসেছে ইরাদ।
রুহি ধীরে মাথা নামিয়ে নিল,এখন খুব লজ্জা লাগছে।
ইরাদ দরজা বন্ধ করে রুহির দিকে তাকাল। রুহি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে, হাতের আঙুল মুঠো করে রেখেছে, যেন নিজের আবেগ সামলানোর চেষ্টা করছে। ইরাদ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে রুহিকে নিয়ে বিছানার পাশে বসল। রুহি তখনো চোখ তুলে তাকাচ্ছে না।
ইরাদ হেসে বলল, “এতো লজ্জা পাচ্ছো কেনো?”
রুহি মুখ তোলে এক ঝলক তাকাল, তারপর আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। তার গাল লাল হয়ে উঠেছে, ঠোঁট কাঁপছে যেন কিছু বলতে গিয়েও পারছে না।
ইরাদ হাত বাড়িয়ে রুহির আঙুল ছুঁলো, নরম শীতল স্পর্শে রুহির পুরো শরীর শিউরে উঠল। ইরাদ তার মুখটা আলতো করে উপরের দিকে তুলল, চোখে চোখ রাখল গভীর ভালোবাসায়।
“তুমি আজ আমার স্ত্রী, রুহি। শুধু আমার।” ইরাদের কণ্ঠস্বরে ছিল দখলের দাবি, ছিল অপরিসীম মমতা।
রুহি চোখ বন্ধ করল, যেন অনুভব করছিল সেই কথার গভীরতা। ইরাদ ধীরে ধীরে তার ঘোমটা সম্পূর্ণ সরিয়ে দিল, চুলের একপাশে হাত বুলিয়ে দিলো। “তুমি জানো, তোমাকে আজ কী সুন্দর লাগছে?”
রুহি আবেগে দুলে উঠল, কিন্তু ইরাদ থামল না। সে এক হাতে রুহির মুখ স্পর্শ করল, অন্য হাতে কোমর জড়িয়ে কাছে টানল। রুহির নিঃশ্বাস কেঁপে উঠল, সে ইরাদের শার্টের কলার শক্ত করে চেপে ধরল যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না।
এক চিলতে রদ্দুর শেষ পর্ব ১৬
“ইরাদ…” কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাকল রুহি।
“শান্ত হও, সবে তাও শুরু,” ইরাদ ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে আবারো বলল, “আজ আমাদের রাত। শুধু আমাদের আমি আজ ভদ্র হয়ে থাকতে পারবো না পাহাড়ে কাটানো সে রাতের মতো।”
রুহি চোখ তুলে তাকাল, সেই চোখে ছিল ভালোবাসার গভীর আকুলতা। ইরাদ ধীরে ধীরে তার কপালে চুমু খেল, যেন সে মুছে দিতে চাইল রুহির সমস্ত ভয়, লজ্জা, দ্বিধা।
আজকের রাত হলো আবেগ আর ভালোবাসার পবিত্র এক মিষ্টি বন্ধনে বাঁধা, যেখানে শুধু তারা দুজন ছিল—ইরাদ ও রুহি, একে অপরের হয়ে… চিরদিনের জন্য।