এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৮

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৮
তানিশা সুলতানা

অর্ণবের প্রতি রাগ চেপে রাখতে পারছে না তারেক রহমান। কখনো দাঁত কটমট করছে তো কখনো বিরবির করে বকছেন। তন্নি বাবার দিকে একটু পরপর তাকাচ্ছে আর শুকনো ঢোক গিলছে। তন্নির ছোট্ট মাথায় এই টুকু ঢুকে গিয়েছে যে বাবা ০% ও পছন্দ করে না অর্ণব নামের সুদর্শন মানবকে। বরং অপছন্দের তালিকার প্রথমেই রয়েছেন মানবটি। কিন্তু তন্নির তো লোকটাকে ভালো লাগে। তার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে। তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তার লাগামহীন কথাও ভালো লাগে। তন্নির কি ভালো লাগা কমিয়ে ফেলা উচিত? লোকটার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত? সদ্য জন্মানো অনুভূতিকে আশকারা দেওয়া উচিত নয়?
তন্নির ভাবনার মাঝেই তারেক কর্কশ গলায় বলে ওঠে

“তোমাকে আর কতোবার মানা করবো ওই বাড়িতে না যাওয়ার জন্য? বড় হয়ে গিয়েছো? বাবার কথা আর মানতে ইচ্ছে করে না?
বাবার ধমকে তন্নি মাথা নুয়িয়ে ফেলে। ফট করে জবাব দেয়
“আই প্রমিজ বাবা
আর কখনোই ওই বাড়িতে যাবো না আমি। শুধু অথৈয়ের সাথে কথা বলবো।
রাগ বোধহয় কিছুটা কমে যায় তারেক রহমানের। বেয়াদব ছেলেটার ওপরে থাকা রাগ নিজের একমাত্র আদরের ওপর ভাঙছে বিষয়টা খেয়ালে আসে। এক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। তন্নির আহ্লাদী হয়ে বাবার কাঁধে মাথা রাখে।
“ওই ছেলেটা মারাক্তক বেয়াদব। আর তার বাবা টাকা দেখিয়ে অন্যায়কে ন্যায় প্রমাণ করে ফেলে। দিনে দুপুরে মারামারি করে মানুষকে হাসপাতালে পাঠায় এবং টাকার জোরে কোনো শাস্তি পায় না। এমন টাকার কুমিরদের সাথে আমাদের সম্পর্ক মানায় না মামনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তন্নির আঁখিতে অশ্রু জমে। লোকটাকে নিয়ে গ্রামের আনাচে কানাচে সমালোচনার ছড়াছড়ি। কিছু দিনের জন্য গ্রামে আসলেও পরিবেশ গরম করে ফেলে। মারামারি ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। কেনো করে সে এমন? একটু ভালো ছেলে হয়ে থাকা যায় না?
ইতি বেগম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে মেয়ে বাড়িতে নেই তার বাড়িতে মন টিকছিলো না। অটো থেকে তামিম নামতেই তাকে কোলে তুলে নেয়। তারেক ভাড়া মিটিয়ে মেয়ের হাত ধরে বাড়িতে ঢোকে।
লম্বা চুল হওয়াতে তন্নির মাথা আঁচড়াতে বা তেল নিতে বেশ অসুবিধা হয়। প্রতিবার শেম্পু করার সময় আর তেল লাগানোর সময় ইতি বেগমের কাছে ছুটে যায়৷
আজকেও তেল লাগানোর জন্য ইতি বেগমের কাছে যায়। তিনি টিভি দেখছিলো।
তন্নি তার পাশে দাঁড়িয়ে রিনরিনিয়ে বলে

“মা তেল দিয়ে দিবে?
খানিকটা রাগ হয় ইতি বেগমের। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“ একা যত্ন করতে না পারলে চুল কেটে ফেলবি। আমাকে জ্বালাতে আসবি না।
মন খারাপ হয় তন্নির৷ মাথা নুয়িয়ে প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনই ইতি বেগম আবারও বলে ওঠে
“বস সামনে।
মন খারাপ ভ্যানিশ হয়ে যায় তন্নির। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বসে পড়ে মায়ের সামনে।

তারপর কেটে যায় এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে তন্নির সাথে অর্ণবের যোগাযোগ হয় নি। স্কুলে যাচ্ছে না তন্নি। ফোনটাও ভেঙে দিয়েছে পাষাণ মানব। অথৈকে দুবার পাঠিয়েছিলো অর্ণব। খবর দিয়েছিলো দেখা করতে। কিন্তু তন্নি দেখা করে নি। বরং সাফ সাফ অথৈকে জানিয়ে দিয়েছে
“তোর ভাই পাষাণ মানব। তার সাথে আমার কোনো কথা নেই। সে যেনো আমার সাথে কথা বলতে না আসে। তাকে আমার ভালো লাগে না।”
তন্নির ধারণা ছিলো না যে অথৈ সেই কথা পাচার করেছে অর্ণবের কানে। শুধু এই টুকুই না। তন্নির মনে যত ক্ষোপ ছিলো সব প্রকাশ করেছে অথৈয়ের কাছে।
বলেছে

“তোর ভাইকে আমি খু ন করতে চাই। বাজে ছেলে সে। সিগারেট খাওয়া ছেলেরা অবশ্যই ভালো হয় না। নেশাখোর বলে তাদের। তোদের উচিত তোর ভাইকে জেলে পুরে দেওয়া। আমার যদি টাকা থাকতো আমি তার নামে মামলা করতাম। ২০ হাজার টাকা জরিমানা করতাম।
গায়ে যদি শক্তি থাকতো তাহলে তোর ভাইয়ের আলুর মতো নাকটা ঘুষি মেরে উড়িয়ে দিতাম।
আরও কতো কি।
অথৈ সব কথা A to Z অর্ণবকে বলে দিয়েছে।

ভার্সিটির পাশে রয়েছে বিশাল কাঠ বাগান। কাঠবাগানের পাশেই বিশাল পুকুর আর তার পাশেই সরকারি গার্লস স্কুল। অর্ণব এই মুহুর্তে রয়েছে কাঠ বাগানের সামনে থাকা পিচঢালা রাস্তায়। কালো রংয়ের জিপ গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভিং সিটেই বসে আছে। তার সাথে রয়েছে আশিক এবং রনি। দুজনই অর্ণবের সহপাঠী। গ্রামে ফিরলে তারা বরাবরই সঙ্গ দেয় অর্ণবকে। এইবার রাজনীতির একটা পদে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে অর্ণব। যেহেতু এখন থেকে এখানেই থাকবে সেহেতু একটু আতটু রাজনীতি করাই যায়। তাছাড়া রাজনীতি প্রিয় অর্ণব৷ ইন ফিউচার এমপি পদে দাঁড়ানোর ইচ্ছে রয়েছে তার। বাবার পরে সেই আসনে বসতে চায়।

অর্ণবের রাজনীতির প্রতি এই আগ্রহ মেনে নিতে পারছেন না ফারাজ। তার বাবা বিপুল ভোটে হেরেছে আনোয়ার চৌধুরীর কাছে। এখন সে অর্ণবের কাছে হারতে ইচ্ছুক নয়। তাই তার ছেলেপেলেকে নিয়ে তেড়ে এসেছে অর্ণবকে মারতে। অর্ণব জানতো নস বিষয় খানা। সে এসেছিলো তন্নির সাথে বোঝাপড়া করার উদ্দেশ্যে।
হঠাৎ আক্রমণে তাল হারিয়ে ফেলে অর্ণব আশিক এবং রনি। কিছু মাইর খেয়েছে এবং কিছু মাইর দিয়েছে।
বেশ ভালোই আঘাত পেয়ে অর্ণব। এবং ফারাজের দলকেও আঘাত দিতে সক্ষম হয়েছে। পরাজিত হয়ে ফারাজ তার দলবল নিয়ে পগারপার হয়ে যায়।
অর্ণব জিপ গাড়ি কাঠ বাগানে ঢুকিয়ে আগের মতোই বসে থাকে।
আশিক এবং রনি তেমন আঘাত না পেলেও ভয় পাচ্ছে। নিশ্চয় থানা পুলিশ হবে।
আশিক বলে

“ভাই যাবেন না?
অর্ণব জবাব দেয় না। তাকিয়ে থাকে গার্লস স্কুলের গেইটের পানে। যেনো কিছু একটা দেখার আশায় প্রহর গুনছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটের ফাঁকা গুঁজে নেয়। রনি এবং আশিককেও দিতে ভুলে না। লাইটারের সাহায্যে সিগারেট জ্বালিয়ে মনের সুখে টানতে থাকে। ধোঁয়া উড়াতে থাকে নাক এবং ঠোঁটের ফাঁক দ্বারা।
অতঃপর অর্ণবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। কিছুটা অঃশ কেটেছে ঠোঁটের। সেখানে লাল রক্তেরও দেখা মিলেছে।

আশিক এবং রনি অর্ণবের দৃষ্টি অনুসরণ করে গার্লস স্কুলের গেইটের দিকে তাকায়। দেখতে পায় ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে একটা বালিকা। কাঁধে তার ব্যাগ। মাথায় সাদা হিজাব বাঁধা। পায়ে সাদা শু পরণে স্কুল ড্রেস।
মুহুর্তেই মেয়েটা ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ দুটো তার টলমল করছে। ঠোঁট উল্টাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। এই বুঝি শব্দ করে কেঁদে উঠবে।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে দূরে ফেলে দেয় অর্ণব। তন্নির মুখে ফু দিয়ে ধোঁয়া ঠেলে দিয়ে প্রশ্ন করে
“কি চাই এখানে?
দু পা পিছিয়ে যায় তন্নি। মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেরে ধোঁয়া সরানোর চেষ্টা চালায়।
জবাব না পেয়ে অর্ণব ধমকে বলে
“সর চোখের সামনে থেকে।

কেঁপে ওঠে তন্নি। দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা পানি। নজর পড়ে অর্ণবের হাতের বাহুতে। সেখানে বেশ খানিকটা জায়গা কেটে গিয়েছে। টপটপ করে র ক্ত ঝড়ছে। হৃদয় বিচলিত হয় তন্নির। চিন্তা হানা দেয় মস্তিষ্কে। কান্নার বেগ বাড়ে। হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিয়ে থেমে থেমে বলে
“ হ……হাতে র..কক্ত।
অর্ণব হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে
“ও মা তাই?
আমি তে জানিই না। দেখিই নি
ইডিয়েট
থাপ্পড় খাওয়ার আগে সামনে থেকে যাবি তুই।

শব্দ করে কেঁদে ওঠে তন্নি। অভিমানে বুক ভাড়ি হয়। গলায় কান্না আটকে আটকে বলে
“ঠ..ঠোঁটও কেটে গেছে। ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। ইনফেকশন হয়ে যাবে।
“ চুমু খাওয়া প্রয়োজন। খাবি চুমু? ট্রাস্ট মি ইনফেকশন দৌড়ে পালাবে।
কান্না থেমে যায় তন্নির। নাক টেনে সরু চোখে তাকায় অর্ণবের মুখ পানে। আশিক এবং রনি ততক্ষণে সরে গিয়েছে। তারা ঢেড় বুঝতে পেরেছে মেয়েটি অর্ণবের প্রেমিকা। নাহলে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসতো?
“সদা আমার সাথে এরকম কেনো করেন?
তন্নি রিনরিনিয়ে সুধায়

অর্ণব গাড়ির দরজা খুলে এক লাফে নেমে পড়ে। মুখোমুখি দাঁড়ায় তন্নির।
“ কেমন করি তোর সাথে?
ছুঁয়ে দেই না কি রে প করি?
মনে মনে অর্ণবকে বকে দেয় তন্নি। মনে মনে পণ করে আর একটাও কথা বলবে না। চুপিসারে কেটে পড়বে এখান থেকে। ক্লাসের সকলে বলাবলি করছিলো মারামারি হয়েছে। তন্নি ঢেড় জানে মারামারিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন অর্ণব চৌধুরী। মন পুরছিলো চিন্তা হচ্ছিলো। তুলোর মতো নরম কি না তন্নির মন। তাই তো ছুটে এসেছিলো বাবার বারণ স্বত্বেও।

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৭

বাবা জেনে গেলে বা দেখে ফেললে অনেক বকবে তন্নিকে এটা জেনেও এসেছে। আর লোকটা কি না?
অভিমানি তন্নির আঁখিতপ আবার অশ্রুকণারা ভিড় জমায়। গুটি গুটি পায়ে পিছতে থাকে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
“আর এক পা পিছালে পা কে টে হাতে ধরিয়ে দিবো।
থেমে যায় তন্নি।

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৯