এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৭
তানিশা সুলতানা
দক্ষিণের জানালাটা খোটা। নীল রংয়ের পর্দা দুলছে বাতাসের তালে তালে। ভোরের মিষ্টি আলোর প্রতিফলন ঘটেছে গোটা কক্ষ জুড়ে। গভীর তন্দ্রাঘোরে আবদ্ধ অর্ণবের আঁখিপল্লব যেনো ঝলসে দিচ্ছে সূর্যের আলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। হাত দ্বারা আড়াল করার চেষ্টা করে মুখখানা। কিন্তু ব্যর্থ হয়। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে অগত্য বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। মাথায় চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার ফেলে হয়। নয়নজোড়া ভাড়ি ভাড়ি লাগছে। টেনেও খুলতে পারছে না যেনো। তবুও জোড় করে নয়ন মেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে ফেলে৷ ডান হাত আপনাআপনি কপালে চলে যায়। দুই ভ্রু এর মাঝে শুক্ষ্ণ ভাজ পড়ে। সেভাবেই বসে থাকে খানিকক্ষণ।
“আমি তন্নিকে দেখেছি। ট্রাস্ট মি আপি ওটা তন্নিই ছিলো।
অর্ণবের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে মেয়েলী চিকন কন্ঠস্বর। উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে বলা হচ্ছে। পূণরায় নয়ন মেলে তাকায়। এখন অসুবিধা হচ্ছে না। হাঁটুর নিচে থাকা পাতলা কম্বলটি সরিয়ে ফেলে। পেটানো পেশিবহুল শরীরখানা দৃশ্য মান। উদরে দুটো ভাজ পড়েছে। প্রসস্থ বুকের বা পাশে চিকন সরু একটা দাগ টানা৷ বুকে অবস্থিত কয়লার মতো কালো স্থানের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। ধবধবে ফর্সা বুকে দাগখানা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বালিশের পাশে ফোন চার্জে রাখা হয়েছিলো। চার্জ হতে ফোন খুলে খাটের পাশে অবস্থিত টেবিলে অযত্নে ফেলে রাখে।
পূণরায় আবার ভেসে আসে
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” নিধি আপুকে দাভাই কি করে নোজপিন গিফট করতে পারলো?
আমাকে তো একটা চকলেটও কিনে দেয় না।
হাই তুলে অর্ণব। আড়মোড়া ভেঙে দেয়াল ঘড়িতে নজর বুলায়। নয়টা বেজে চল্লিশ মিনিট। কিছুটা বিচলিত হলো বোধহয়। দ্রুত ভঙ্গিমায় বিছানা হতে নামে। ফ্লোরে পা জোড়া ফেলেই চটজলদি কম্বলখানা ভাজ করে ফেলে। বিছানা চাদর টানটান করে বালিশ গুছিয়ে রাখে। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে দ্রুত পা চালিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। দাঁত ব্রাশ করে, গোসল দিয়ে বের হয়। একই ভঙ্গিমায়। কালো রংয়ের প্যান্ট এবং সাদা টিশার্ট গায়ে চাপিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ সময় নিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। হাত বুলায় কুচকুচে কালো দাঁড়িতে। গতকালই নতুন নকশায় কেটেছে দাঁড়িগুলো। আদলের ধরণখানাই যেনো পাল্টে গিয়েছে৷ ফর্সা গালে লাল লাল দুটো ব্রণ উঠেছে। বিরক্ত হলো বোধহয় অর্ণব। ছেলে মানুষের ব্রণ কেনো উঠবে? সেলফোন বেজে ওঠে। ধীর গতিতে ফোন খানা তুলে। পুরুষালি শক্তপোক্ত হাতের আঙুল নারিয়ে কল কেটে দেয়। পরপর সাইলেন্ট বাটনে চেপে ফের অযত্নে ফেলে রাখে।
পুরু ওষ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসে একটা শব্দ
“ডিজগাস্টিং”
পরপর ভেসে আসে আশা বেগমের অদুরে ডাক
“আব্বা উঠেছো? অনেক বেলা হয়েছে।
অর্ণব গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়
” আসছি”
অথৈ এবং আর্থির গল্পগুজব এখনো শেষ হয় নি। মহা চিন্তিত দুই বোন। চিন্তার বিষয়টা তন্নি। অথৈ বলছে তন্নিকে দেখে কিন্তু আর্থি মানছে না। এটা নিয়েই জল ঘোলা করে চলেছে দুজন। অর্ণব বোনদের পানে এক নজর তাকিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে৷ আশা বেগম অতিযত্নে ছেলেকে খাবার পরিবেশন করতে থাকেন৷ কাটা চামচে ব্রেড ধরে ছুড়ির সাহায্য ছোট পিচ করে তা মুখে পুরে নেয় অর্ণব৷ পরপর চুমুক বসায় জুসের গ্লাসে। অথৈ আরও একবার তন্নি নামখানা উচ্চরণ করতে যায়। মুখের খাবার গিলে অর্ণব শান্ত স্বরে বলে
“অথৈ জলদি রেডি হয়ে এসো। আমাদের বেরতে হবে।
অথৈ এবং আর্থি ঢেড় বুঝতে পারে অর্ণব তন্নিকে নিয়ে আলোচনা শুনতে চাচ্ছে না। দুই বোনই লেজ গুটিয়ে নিজ কক্ষের পানে ছোটে।
দ্বিতীয় বার খাবার মুখে পুরার আগে আশা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে
” মাম্মাম তুমিও চাইলে যেতে পারো।
মলিন হাসে আশা বেগম। হাত বুলিয়ে দেয় ছেলের মাথায়।
“তোমরা যাও।
মাথা দুলিয়ে নিজের প্লেটে মনোযোগ দেয়। আশা বেগম মুগ্ধ নয়নে ছেলেকে দেখতে থাকে। চার বছর বাদে সামনে থেকে দেখছে যে। গতকাল রাতেই দেশে ফিরেছে।
বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। কালবৈশাখী ঝড় আসবে না? এটা হতে পারে? সারাদিন কাঠফাঁটা রোদ্দুর খাঁ খাঁ করে ছিলো। বাতাসের ছিঁটেফোঁটাও ছিলো না কোথাও। একটা গাছের পাতাও নরে নি। প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস করেছে মানুষ সহ পশুপাখি। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই প্রবল বেগে বাতাস বইছে। যখন তখন আসমান ফেঁটে জমিন পানিতে ভেসে যাবে বলে মনে হচ্ছে। মাঝরাস্তায় জুতো জোড়া ছিঁড়ে গিয়েছে তন্নির। বা হাতে জুতো ধরেছে এবং ডান হাতে ধরেছে গাউনের কিছু অংশ। যাতে দৌড়াতে সুবিধা হয়। না দৌড়ালে বৃষ্টির কবলে পড়বে নির্ঘাত।
তবে দৌড়েও শেষ রক্ষা হয় নি। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই প্রবল জোরে বর্ষণ ঝমঝম করে জমিনে গড়িয়ে পড়ে। ভিজে যায় তন্নির মাথা সহ জামার কিছু অংশ। পা জোড়া কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়।
অতিদ্রুত গেইট অতিক্রম করে বাড়ির সামনের মেইন ডোরের সামনে দাঁড়ায়। জুতো নামিয়ে জামাহতে পানি ঝাড়ার চেষ্টা চালায়।
মনে মনে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। রাজকীয় বাড়িতে নিশ্চয় কাঁদা পায়ে ঢোকা যাবে না। নামি-দামি অতিথিদের মাঝেও বোধহয় আধভেজা তন্নিকে এলাও করবে না।
মেইন ডোর খোলাই ছিলো। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে থাকে ভেতরটা। মানুষ গিজগিজ করছে। আভিজাত্যের ছোঁয়ায় সকলেই সেজেছে ভিন্ন রূপে। বাবা ভাই বা মা কাউকেই দেখতে না পেয়ে আশাহত হয় তন্নি। ফোনটাও কাছে নেই
” এক্সকিউজ মি
তুমি নোংরা পায়ে এসে দাঁড়িয়েছো কেনো?
চমকায় তন্নি। থমথমে মুখে তাকায় সামনে থাকা রমনীর পানে। রেগে আছে বেশ বুঝতে পারলো। তবে পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো কথা খুঁজে পায় না। আমতাআমতা করতে থাকে।
“মানলাম বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এখানে দাঁড়িয়েছো। তাই বলে এখানেই? আরও তো বাড়ি ছিলো। মতলব কি তোমার?
দেখেছো এই বাড়িতে অনুষ্ঠান ওমনি সুযোগ পেয়ে ঢুকে গেলে?
বের হও বলছি।
আশ্চর্য হয় তন্নি। ললাটে তিনটে ভাজ ফেলে সরু দৃষ্টিতে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। বেশ চিনে মেয়েটিকে। আজকে এই মেয়েরই বার্থডে।
” ওমন তাকিয়ে কেনো আছো?
বের হতে বললাম তো আমি।
কোমরে হাত দিয়ে কর্কশ গলায় বলে মেয়েটি। তন্নি এবার কিছু বলার প্রস্তুতি নেয় ঠিক তখনই ভেসে আসে পরিচিত এক কন্ঠস্বর।
“নয়না What happened?
নয়না আহ্লাদী হয়ে হাত জড়িয়ে ধরে অর্ণবের। নালিশের সুরে জানায়
” দেখো না অর্ণব ভাইয়া।
এই মেয়েটি কাঁদা পায়ে ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছিলো। ভিখিরির মতো চলে এসেছে খাবার খেতে। আমি ঢুকতে দিচ্ছি না।
অর্ণব তাকায় তন্নির পানে। কপালে কুঁচকে সরু দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে পরপর দৃষ্টি ফিরিয়ে শান্ত গলায় বলে
“ছেড়ে দাও।
চলো তুমি। ড্রেসে কাঁদা লেগে যাবে।
নয়নাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নিয়ে যায় অর্ণব। তন্নি মলিন হাসে। নিজের দিকে তাকায়। এক হাজার পাঁচশো টাকা দিয়ে গাউনখানা কিনে দিয়েছিলো বাবা। আজকেই প্রথম পড়েছে। জুতো জোড়া কিনেছিলো ঈদে। তিন বার পড়েছে। আঠা খুলে গিয়েছে। চামার দিয়ে সেলাই করে নিলো বছরখানিক পড়তে পারবে অনায়াসে। বড়লোকদের কাছে এগুলো ভিখারির বেশ?
মলিন হেসে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়ে তন্নি। বাবা শিখিয়েছে ” যেখানে সম্মান নেই সেখানে থাকাটা বোকামি”
জুতো জোড়া তুলতে ভুলে গিয়েছে বোধহয়।
এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৬
অথৈ পেছন থেকে তন্নিকে দেখে। চুল দেখেই বুঝে ফেলে এটা তন্নি। হাতে থাকা জুসের গ্লাস রেখে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে যায় তন্নিকে ডাকতে ডাকতে।
বৃষ্টির শব্দে অথৈয়ের ডাক তন্নির কানে পৌঁছায় না। পৌঁছালে হয়ত থেমে যেতো। একবার জাপ্টে জড়িয়ে ধরতো অথৈকে। কেঁদে ফেলতো। হাউমাউ করে। চিৎকার করে বলতো ” আমি তোকে ভীষণ মিস করেছি অথৈ। তোকে ছাড়া ভালো ছিলাম না আমি”