এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৪

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৪
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

ভোরের র*ক্তিম ঊষা রাতের আঁধার কা*টিয়ে ধরণীতে নতুন সূচনা নিয়ে এসেছে। ফজরের নামাজ মসজিদে পরে মসজিদেই বসেছিল আলো ফোঁটার অপেক্ষায়। ক্যাডেটের স্টুডেন্টরা অনুশীলন করছে। ওদের রুটিন থাকে। মাশরিফও ওদের সাথে যোগ দিল। স্যারদের তো পরিচিত আগেই। ওয়ার্মআপ শেষে একজন এসে বলল,
“ভাইয়া চলেন আমাদের সাথে ডাইনিংয়ে নাস্তা করবেন।”

মাশরিফ হালকা হাসলো। যখন মাশরিফ সদ্য এইচএসসি শেষ করেছে সেই বছর পূর্ণমিলন অনুষ্ঠানে মাশরিফ ও তার বন্ধুরা এসেছিল সদ্য বের হওয়া এক্স ক্যাডেট হিসেবে। তখন এই যাবের নামের ছেলেটিও ক্যাডেটে নতুন। মাশরিফ বলল,
“মা ব*কা দিবে। বাসায় গিয়েই নাস্তা করতে হবে। তোমার প্রিপারেশন কেমন? টার্গেট তো মেডিকেল।”
“জি ভাইয়া। মেডিকেলে চান্স না হলে আপনার মতো আর্মি জয়েন করব।”
মাশরিফ মলিন হাসে। অতঃপর বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি তো মেডিকেলের টার্গেট নিয়ে পড়েও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেইনি। সরাসরি আর্মিতে গিয়েছি। মা অনেকবার বলেছিল, পরীক্ষা দিতে। আমার রেজাল্টও ভালো ছিল কিন্তু ওইযে জীবনে এমন কিছু ঘটে যার জন্য আমরা লক্ষ্য বদলাতে বাধ্য হই। আমার লক্ষ্যও বদলে গেলো। তুমি মেডিকেলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। মির্জাপুর ক্যাডেটের ছাত্র হয়ে কোনো সরকারি মেডিকেলে চান্স হবে না তা মানাই যায় না।”

“জি ভাইয়া। দোয়া করবেন। আসি তাহলে। ডাইনিংয়ে যাওয়ার জন্য ড্রেস বদলাতে হবে।”
মাশরিফ মুচকি হেসে ছেলেটির দ্রুততা দেখল। অতঃপর আকাশপানে মুখ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনেই বলল,
“অ্যাই মিস ইউ আব্বু। আজ যদি তুমি থাকতে তবে আমার জীবনটা অন্যরকমই হতো। আমার ফার্স্ট ড্রিমকে আমি প্রায়োরিটি দিতাম। তবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। আমি এখন খুব ভালো আছি।”
কথাগুলো ভেবে লম্বা একটা শ্বাস বক্ষগহ্বরে পুরে নিয়ে পুরো মাঠটা আরেকবার চক্কর দিয়ে বাসায় ফিরে। বাসায় ফিরে গোসল করে মায়ের সাথে নাস্তার টেবিলে বসে। রুটি খেতে খেতে বলল,

“মা, আমি দুপুরের দিকে ময়মনসিংহ যাবো।”
মহিমা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকে চাইলেন। পানি খেয়ে বললেন,
“কেনো? ময়মনসিংহতে কী? রাফি, শুভদের সাথে দেখা করতে?”
মাশরিফ হাসার চেষ্টা করে বলল,
“হ্যাঁ। ওরাই তো ময়মনসিংহতে আছে।”
“কাল যাস তবে। আজকে টাঙাইলে যাবো তো।”
“না!”

মাশরিফের আচমকা কিছুটা জোড়ালো চিৎকার শুনে মহিমা বেগম থতমত খেয়ে রুটি হাত থেকে রেখে বললেন,
“কী হলো তোর?”
মাশরিফ নিজের নির্বুদ্ধিতা বুঝে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“টাঙাইলে না গেলে হয় না? না মানে আমি দুই সপ্তাহের মতো আছি এবার। পরে গেলেও তো পারব। তাছাড়া তোমাকে তো প্রতিদিন ক্লাসের জন্য এতোটা পথ আসতে হবে। তার থেকে ভালো এখানেই থাকি। বাড়িতে করিম চাচা তো দেখাশোনা করেনই। আমরা চলো বৃহস্পতিবার যাবো তারপর শুক্রবার, শনিবার থেকে আসব।”

মহিমা বেগম ছেলের একনাগাড়ে কথায় হেসে ফেললেন।
“জানি তো। কেনো যেতে চাস না। আমাদের বাড়ির পাশে যে দুই বছর আগে নতুন বাড়ি করেছে, সেই বাড়ির মেয়ে কাশফা তোর পিছুই লেগে থাকে। তাই যেতে চাস না।”
মাশরিফ মুখ ভাড় করে বলল,

“বুঝতে যখন পেরেছ তাই আমার কথাটা রাখো। আমি তো আজ যাবোই না। পরশুদিন বৃহস্পতিবার। সেদিন যাবো।”
“আচ্ছা যা তোর আবদার মনজুর। এবার নাস্তা শেষ কর। আমাকে আবার ক্লাসে যেতে হবে। বুয়া আসবে কিছুক্ষণ পর। সে এসে পেয়াজ আর যা কা*টাকু*টি করা লাগবে করে দিয়ে যাবে। আমি সাড়ে এগারোটার দিকে এসে চট করে রেঁধে ফেলব।”
মাশরিফ মৌন সম্মতি দিয়ে খেতে থাকে। মহিমা বেগম নাস্তা শেষে বেরিয়ে যান।

সকালের ক্লাসটা করে তিতির যখন ক্লাসরুম থেকে বেরোবে তখন দুইজন ফ্রেন্ড জারিন ও নাদিয়া আসে। জারিন বলে,
“গতকাল না আমরা ফ্রেন্ড হলাম। তাহলে তুই আমাদের ছেড়ে একা একাই ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিস কেনো?”
তিতির চমকালো। আচানক সম্বোধনে হতবিহ্বল হয়ে পরলো। ফরিদপুরের বন্ধুদের কথা খুব করে মনে পরছে। ফরিদপুরের মেডিকেলে ক্লাস শুরু করার পর তৃতীয়দিন ইতি এসে তিতিরকে এভাবেই আচানক অধিকারবোধ নিয়ে কথাগুলো বলেছিল।
তিতিরকে ভাবতে দেখে নাদিয়া তিতিরের মুখের সামনে তুড়ি বাজায়।

“কোথায় হারালি?”
ধ্যান ভাঙে তিতিরের।
“কই না তো। কী বলবে?”
“বলছি কী, চল একসাথে ক্যাম্পাসে বসি। লিরা ও জুলিয়াও ক্যাম্পাসেই আছে।”
জারিনের কথায় তিতির রাজি হয়। কিছু না বলে ওদের সাথে যেতে থাকে। ক্যাম্পাসের এক জায়গায় গিয়ে বসে ওরা। সেখানে তিন জন ছেলেও আছে। আসফি, রণক ও ইমরান। সবার সাথে তিতিরকে পরিচয় করিয়ে দেয়। রণক বলে,
“তুমি হঠাৎ মাইগ্রেশন করলে কেনো?”
তিতির মলিন হেসে বলে,

“ওই শহরে তিক্ততা ভরে গিয়েছিল তাই অচেনা শহরে স্বস্থির খোঁজে এসেছি।”
“ফ্রেন্ডদের ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়নি?”
ইমরানের প্রশ্নে তিতির জবাব দেয়,
“হয়েছে কিন্তু ওইযে নিজের ঠিকানা বদল করাটা ভিষণ জরুরী ছিল।”
লিরা বলল,
“ইটস অকে। আমরা নাউ ফ্রেন্ডস। রেস্ট অফ দ্যা টাইম উই উইল বি টুগেদার।”
“ইয়েস। নাউ উই আর টিম।”

নাদিয়ার কথায় বাকিরাও তাল মিলায়। তিতিরও সায় দিয়ে হালকা হাসে। তখনি সেখানে সিনিয়রদের টিম হাজির হয়। আসফি, রণক ও ইমরান উঠে রাফি, অর্ক, শুভর সাথে ভাতৃত্বপূর্ণ আলিঙ্গন করে। অর্ক বলল,
“তা নতুন জুনিয়র, কেমন লাগছে ক্যাম্পাস?”
তিতির প্রথমবারে বুঝতে পারেনি কথাটা যে তাকেই বলা হয়েছে। তারপর সবার ভাব-ভঙ্গি ও চাহনি দেখে বুঝতে পারে।
“ভালো ভাইয়া।”
রাফি বলল,

“গতকাল কোথায় গিয়েছিলে। তোমাকে আমি এক বাসার নিচে দেখেছিলাম।”
তিতির কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে জবাব দেয়,
“আসলে ভাইয়া একটা বাসা খুঁজছি। দুই রুমের বাসা। মা আর ভাবীকে নিয়ে আসব তাই।”
“ওহ আচ্ছা। আমাদের বললেই পারতে। প্রায় ছয় বছর ধরে এখানে আছি। এখানের অনেক কিছুই চিনি। তুমি কালকের মধ্যে আশাকরি খোঁজ পেয়ে যাবে। আর কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই বলবে।”
রাফির কথায় তিতিরের ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফোটে।

“ধন্যবাদ ভাইয়া। অনেক উপকার করলেন।”
রাফি হালকা হাসে। লিরা বলে ওঠে,
“অ্যাই টোল্ড ইউ না? সিনিয়রা হেল্প করবে। এন্ড দে আর উইলিং টু হেল্প ইউ।”
রাফি লিরাকে দিকে চোখের ইশারায় শা*সায়। তিতির প্রশ্ন করে,
“কেনো?”

এবারও লিরা কথা ঘুরিয়ে বলে,
“বিকজ দে আর সিনিয়র।”
অর্ক ফুঁস করে মনের ভিতরের আশঙ্কাগুলো ঝেড়ে ফেলে। শুভ নাদিয়াকে বলে,
“নাদিয়া, ডাঃ শাফকাত তোমাকে খুঁজছিল। তোমার ফোন কই?”
নাদিয়া অবাক হয়। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে নয়টা মিসডকল। ফোনের রিংটোন বন্ধ। নাদিয়া আর সময় ব্যায় না করে “সরি গাইজ, অ্যাই হ্যাভ টু গো।” এই বলে ছুটল।
“আচ্ছা থাক। আমরাও গেলাম।”

এই বলে রাফি, অর্করা চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর তিতির জারিনকে জিজ্ঞেসা করে,
“ডাঃ শাফকাতের ডাকে নাদিয়ে এভাবে ছুটে গেলো কেনো?”
তখন পাশ থেকে আরেকটা মেয়ে নাম তার ফাইজা, এসে বলল,
“বিকজ দে আর কাপল।”
জারিন অবাক কণ্ঠে বলল,

“তোর ঘুম ভেঙেছে তবে? আজও সকালের ক্লাসটা মিস দিলি।”
“এই মাসে তিনবার হলো তাই না? প্রমিজ এরপর থেকে আর মিস করব না। সকালের ক্লাসে এতো ঘুম আসে উফপ!”
ফাইজার কথায় তিতির হেসে দেয়। ফাইজা এখন বলে,
“চল নাস্তা করে আসি। তারপর তো আবার ক্লাস।”
ওরা বাকিরাও সায় দিয়ে ক্যান্টিনে যায়।

বেলা বারোটায় সাগর ও পলাশ এলাকার মোড়ের দোকানে এসেছে। চা, পানি খেয়ে তিতিরদের বাড়ির দিকে বেরিয়েছে। সুজন বলে,
“আমায় ময়নাপাখিডা তো এই সময়ে বাড়িতে থাকতো না। তার তো কলেজে আছে। তোরডা তো কোলে গে*দা বাচ্চা লইয়া এহন।”
“ঠিক কইছোস। এই বাচ্চাডাই এহন ঝামেলা।”
পলাশের প্রত্যুত্তরে সুজন বলে,

“শাশুড়িরে একখান সালাম দিয়া আহি।”
পলাশ ও সুজন হাঁটতে হাঁটতে তিতিরদের বাড়ির সামনে চলে আসে তারপর বাড়ির গেইটের কাছে এসে ভেতরে ঢুকে কেচিগেইটের সামনে দেখে তালা ঝুলানো। সুজন বলে,
“এহানে তালা কেন? কেউ নাই নাকি?”
“বুঝতেছি না তো। কই গেছে? চল তো, মোড়ের দোকানে গিয়া জিগাই।”
“চল।”

ওরা আবার মোড়ের দোকানে ফিরে যায়। গিয়ে দোকানীকে জিজ্ঞেসা করে,
“চাচা, তিয়াসের বাড়িতে তালা কেন?”
চা দোকানী চা বানাতে বানাতে বলল,

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৩

“পরশুদিন একটা আর্মি ট্রাক আইছিল তারপর ওই বাড়ির থিকা কী কী জানি নিয়া গেলো। তবে খাটের পায়া দেখছি। তয় কয়দিন ধইরা তিয়াসের বইনেরে তো দেহি না রাস্তা দিয়া যাইতে। ওর মা, ভাবী মনে হয় বেড়াইতে গেছে।”
সুজন ও পলাশ টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁ*চাতে খোঁ*চাতে ভাবতে থাকে ব্যাপারটা।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ১৫