এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৭

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৭
লেখিকাঃ নুরুন্নাহার তিথী

ভোরের ঊষা পরিস্ফুটিত হয়ে নতুন সূচনার অপেক্ষায়।
খুব সকালেই মহিমা বেগম ও মাশরিফ মির্জাপুরে ফিরে গেছে। মহিমা বেগমের একটা মিটিং আছে এগারোটার দিকে আর মাশরিফকে দুপুরে ঢাকা একটা কাজে যেতে হবে। তাই জন্য তাড়াহুড়ো। তিতির মেডিকেল কলেজের জন্য বের হওয়ার আগেই ওরা বেরিয়ে গেছে। তিতির কলেজের উদ্দেশ্যে বেরোনোর সময় নাজমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,

“কিছু তো বললি না। আপা যাওয়ার আগে তোর মত জানতে চাইছিলেন।”
“তুমি কী বললে?”
তিতিরের সন্দিগ্ধ প্রশ্নে নাজমা বেগম আফসোস করে বললেন,
“আমি কী আর বলব! বললাম, আজ-কালের মধ্যে জানাব। এখন কী জানাব তা বলে যা। দেখ মা, এমন ভালো ঘর আর তো পাব না। বুঝ একটু। মাশরিফ ছেলে হিসেবে কতোটা ভালো তা তুইও জানিস।”
তিতির মায়ের দিকে কিছু মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে থেকে লম্বাশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“হ্যাঁ বলে দাও!”
কথাটা বলা মাত্রই সেকেন্ডও দেরি করে না তিতির। জলদি জুতো পরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। পেছন থেকে মায়ের অবিশ্বাস্য, প্রফুল্ল কন্ঠে ডাক শুনেও সাড়া দেয় না। মুচকি হেসে চলে যায়। নাজমা বেগম ভীষণ খুশি হয়ে হিয়াকে সংবাদটা দিয়ে মহিমা বেগমকে দ্রুত ফোন করেন।
মহিমা বেগম ও মাশরিফ এখন হাইওয়েতে। বোনের কাছ থেকে কল পেয়ে মহিমা বেগম কল রিসিভ করে কানে নিয়ে সালাম দিয়ে বলেন,

“কী রে? এখন ফোন দিলি।”
নাজমা বেগম নিজের সন্তোষ প্রকাশ করে হাস্যজ্জল কণ্ঠে বললেন,
“আপা, সুখবর আছে। তিতির তো বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছে।”
সুসংবাদটা শোনা মাত্রই আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। মাকে হঠাৎ এতো উচ্ছ্বাসিত হতে দেখে মাশরিফ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে মা? হঠাৎ এত খুশি কেন?”
“আমি খুশি কেন সেটা জিজ্ঞাসা করছিস? সংবাদটা শুনলে তুইও খুশিতে পা*গ*ল হয়ে যাবে।”
মায়ের এত উচ্ছ্বাসতায় মাশরিফ চোখে হেসে সন্দিহান কণ্ঠে শুধায়,
“তাই নাকি? তা কী সংবাদ?”
“তিতির বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছে।”

মহিমা বেগম কথাটা বলার শেষ করল ঠিক তার এক সেকেন্ডের মধ্যে মাশরিফ আচানক মাঝ রাস্তায় গাড়ি ব্রেক কষল। মাশরিফ পুরো হতভম্ব দৃষ্টিতে সম্মুখ পানে চেয়ে আছে। তার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। সে ঠিক শুনল তো? মনের এই দোটানায় সে ক্রমাগত অস্থীরতায় আচ্ছাদিত হচ্ছে। সত্যতা যাচাই করতে জিজ্ঞেসা করে,
“এটা ট্রু? তুমি মজা করছ তাই না?”
বলেই হাসার চেষ্টা করল। মহিমা বেগম ছেলের মুখাবয়বে এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা ও বিস্মিত ভাব দেখে হালকা হেসে ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে বলেন,

“সম্পূর্ণ সত্য। এখন গাড়ি সাইড কর। এটা হাইওয়ে! মাঝ রাস্তায় কেউ গাড়ি ব্রেক করে? জলদি সাইড কর।”
মাশরিফ ঘোরের মধ্যেই গাড়ি স্টার্ট করে একটু সাইড করে থামায়।
“মা, এটা সত্যি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার এখন কেমন রিয়াকশন দেওয়া উচিত বুঝতে পারছি না।”
মহিমা বেগম হেসে প্রত্যুত্তর করেন,

“এখন বাসায় চল। হেডকোয়াটারে বলে বুধবার পর্যন্ত ছুটি শুক্রবার পর্যন্ত বাড়িয়ে নে। তোর আপু, দুলাভাইকে আসতে বলব। শুক্রবার গিয়ে আকদটা করিয়ে ফেলব। তারপর আবার লম্বা ছুটিতে এলে অনুষ্ঠানও হবে।”
মাশরিফ গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসছে। সে নিজের আনন্দ প্রকাশের সুযোগ্য ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।

ক্লাস শেষে তিতির ও তার বান্ধবীরা ক্যাম্পাসে বসে আছে। আজ শনিবার তাই ক্লাসের প্যারা কম। সকালের ক্লাসটাও এক্সট্রা। তিতির ওদেরকে বিয়ের কথাটা জানাতে কিয়ৎ ইতস্তত করছে। সে তার বান্ধবীদেরকে বলল,
“শোন না, তোদেরকে আমার কিছু বলার আছে।”

নাদিয়া, জারিন, ফাইজারা অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। মূলত হাসি-তামাশা করছিল। তখন নাদিয়া হাসতে হাসতে বলে,
“দোস্ত, সকালে এক নিউ ইন্টার্ন ডাক্তারের সাথে ফাইজার ধা*ক্কা লেগেছে। যেনতেন না! আমি ছিলাম সাথে। আমাদের তো ক্লাসের সময় হয়ে গেছিল তাই দ্রুততায় ছিলাম। ওদের ধা*ক্কা লাগা দেখে ভেবেছিলাম কোন রোমান্টিক মোমেন্ট ক্রিয়েট হবে বাট দুইজনেই ধ*পাস করে দুইদিকে ছি*টকে পরে গেছে।”

এটা বলেই নাদিয়া হাসতে হাসতে পরে যাওয়ার অবস্থা। তিতির বিহ্বলতার সাথে বলল,
“আমার কথাটা শোন না!”
জারিন হাসতে হাসতে বলে,
“বল।”
“একটু স্থির হয়ে বস। তারপর বলছি। আমার আনইজি লাগছে।”

তিতিরের আনইজি লাগছে শুনে জারিন, নাদিয়া ও ফাইজার হাসি যেন আরও বেড়ে গেল। ওরা জোড় করেও হাসি থামাতে পারছে না। তা দেখে তিতির মন খারাপ করে মুখ ভাড় করে রাখল। তখন লিরা তিতিরের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“ক্লোজ ইউর আইস এন্ড ব্রিথ ইন এন্ড ব্রিথ আউট দেন জাস্ট ছে। আমরা শুনছি।”
তিতির তাই করল। অতঃপর নয়নজোড়া মুদন করে এক রুদ্ধশ্বাসে হড়বড়িয়ে বলে ফেলল,
“আমি বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছি!”

বলেই চোখ-মুখ খিঁচে নেয়। জারিন কথাটার ভাবার্থ খেয়াল না করে হাসির রেশে বলে,
“ওহ আচ্ছা!”
পরক্ষণেই তিতিরের বলা কথাট যখন মস্তিষ্কে নাড়া দিল তখন অক্ষিপট বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলে,
“কী বললি তুই?”
তিতির মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। নাদিয়া, ফাইজ,লিরা, জুলিয়া সবারই এক প্রশ্ন। ফাইজা এবার জোড় করে তিতিরের মুখমণ্ডল উুঁচু করে কৌতুহল প্রকাশ করে,

“তুই বিয়েতে রাজি হয়েছিস? কার সাথে? বিয়ের কথা কবে ওঠল?”
তিতির মৃদুস্বরে বলল,
“মেজর মাশরিফ ইকবাল।”
তিতিরের মুখনিঃসৃত নামটা শুনে জুলিয়া লিরাকে আলতো ধা*ক্কা দেয়। লিরা জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে তিতিরকে বলে,
“ইজ ইট ট্রু? আই অ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ। মে গড(আগেই বলা লিরা ভিনদেশি) ব্লেস বোথ অফ ইউ।”
তিতির লাজুক হেসে বলে,

“থ্যাংকিউ লিরা।”
“এবার বল, কীভাবে কী হলো? মানে মেজর মাশরিফ তোর কাজিন এটা জানি। কিন্তু সে বলেছিল তোর সামনে ভালোবাসার অধিকার নিয়ে আসবে না। এপ্রোচটা কীভাবে হলো?”
নাদিয়াকে অধীরচিত্তে প্রশ্নে তিতির জবাবে বলে,
“উনার মা আমার মাকে প্রস্তাব দিয়েছেন। উনি কিন্তু সত্যি আমার সাথে আগের মতো কথা বলেন না। প্রথমদিকে উনার বিহেভিয়ারে আমি বিরক্ত হলেও এখন মনে হচ্ছিল লোকটা টোটালি চেঞ্জড! মা এতোবার বলাতে আমি রাজি না হয়ে পারলাম না। তাছাড়া উনি খুব ভালো ও সাপোর্টিভ। গতকালকের ঘটনার পর বুঝলাম।”
ফাইজা শুধাল,

“ওহ, তুই না কালকে তোর শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলি? মানে ফরিদপুরে গিয়েছিলি। কিছু হয়েছে ওখানে?”
“রুমি আপু একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিল। মাশরিফ তার উচিত জবাব দিয়েছে।”
কথাটা বলার মাঝেই তিতিরের মুখশ্রীতে এক অন্যরকম দীপ্ততা কাজ করছিল। জারিন, ফাইজারা এটা দেখে বেশ খুশি হয়। জারিন বলে,
“যাক আলহামদুলিল্লাহ্‌। এবার তোর জীবনে সুখ পরিস্ফুটিত হোক।”
“দোয়া করিস।”

“মিস কাশফা, আপনাকে একটা হেল্প করতে হবে।”
“কী হেল্প?”
“মেজর মাশরিফের মাকে টাঙাইলের বাড়িতে একবার আনতে হবে। এবং সেটা খুব শিঘ্রই। যথাসম্ভব আপনার মন ভাঙতে চলেছে।”
কাশফার ভ্রুঁ কুঁচকে এলো। সে সন্দিহান কন্ঠে শুধায়,
“মানে? ক্লিয়ারলি বলেন।”

“কিছুদিন আগে আপনি আমাদেরকে খবর দিয়েছিলেন মেজর মাশরিফের বাসায় তিনজন মহিলা এসেছিল। আপনি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন কারণ, মেজর মাশরিফ অন্য কাউকে ভালোবাসে তাই। সব খবরাখবর আপডেট দিচ্ছেন। এখন আপনাকে একটা খবর দেওয়ার আছে। তিতির নামের মেয়েটার সাথে মেজর মাশরিফকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সামনে দেখা গেছে।

ইকুয়েশন মিলিয়ে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে, তিতির নামক মেয়েটার সাথে মেজর মাশরিফের কিছু একটা হতে চলেছে। আরেকটা খবর, তিতির মেয়েটার মৃত স্বামী মেজর রাহান আহমেদকে কিন্তু আমরাই সরিয়েছি। এখন আরেকজনকে সরানোও কোনো ব্যাপার না। আপনিও বাঁচাতে পারবেন না কারণ আমাদের টার্গেটই মেজর মাশরিফ। তাই এখন আপনাকে সাহায্য করতেই হবে নয়তো…!”

কাশফা ভয় পেয়ে যায়। সে যে রাগের মাথায় এই চক্রের ভিতর ঢুকে গেছে! এখন তার পরিণাম বুঝতে পারছে। নিজের মাথাই তার এখন ফা*টাতে মন চাচ্ছে। কেন যে সেদিন বিকেলে ওই চাদর মোড়ানো লোকটার সাথে দেখা হলো আর নিজের অজান্তেই অনেক তথ্য দিয়ে ফেলার পর কন্টাক্ট রেখেছিল! রুমির থেকে মাশরিফের ব্যাপারে জানার পর তো রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওদেরই সাহায্য নিতে গিয়ে এখন নিজেই ফেঁসে গেছে। সে তো বুঝতে পারেনি ওটা টে*রো*রি-স্ট দল!

ফোনের অপরপাশ থেকে হুংকার শুনে কাশফা বড়ো একটা ঢোক গিলে বলে,
“আমি দেখছি। আমি ব্যাবস্থা করছি। প্লিজ একটু সময় দিন।”
“এই সপ্তাহটাই সময়। মেজর মাশরিফের ছুটি বুধবার পর্যন্ত। এর আগেই তাদেরকে আনতে হবে। সবগুলোকে একদিনে শেষ করব। কারণ ছুটি শেষ হলে ওরা নতুন মিশনে বের হবে। এখন সেটা কোথায় জানা যায়নি।”
“জি আমি চেষ্টা করব।”

দেখতে দেখতে দুটো দিন চলে গেছে। মহিমা বেগম একা হাতেই সময় পেলেই প্রয়োজনীয় বিয়ের জিনিসপত্রের ব্যাবস্থা করছেন। এদিকে রিতিকাকে জানানোর পরেও রিতিকার থেকে আশানুরূপ তুষ্টি দেখা যায়নি। সায়ান ও রিয়ান বলেছে বুধবারেই চলে আসবে কিন্তু রিতিকা একদম নিরুত্তাপ। সে ভালো-মন্দ কিছুই বলছে না। রিতিকা চাইলে এখনি চলে এসে মায়ের হাতে হাতে হাত বাটাতে পারত। মেয়ের এতো অনাগ্রহের কারণ মহিমা বেগম জানেন তাই তিনি আর ঘাটালেন না। একা একাই সবকিছু সামলানোর জিদ ধরে বসলেন। এদিকে কাশফার কলের উপর কল! ফোন করেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। কাশফার মাও মেয়ের এই নাজেহাল অবস্থা দেখে একবার বোঝানোর জন্য হলেও আসতে অনুরোধ করেছেন। কাশফার মা তো আর মেয়ের অভিলাষ জানেন না।

মহিমা বেগম বাধ্য হয়ে একদিনের জন্য যেতে রাজি হন। মাশরিফকে ডেকে বলেন,
“শোন, কালকে আমরা একবার টাঙাইলে যাব।”
মাশরিফ ল্যাপটপে কিছু কাজ করতে করতে প্রশ্ন করে,
“কেন মা?”
“কাশফা তো পাগলামি শুরু করেছে। ওকে বুঝাতে হবে।”

কাশফার নামটা শুনে মাশরিফের চোখে-মুখে বিরক্তির আভা ছড়িয়ে পরল। বিরাগী কণ্ঠে বলে ওঠল,
“ওই মেয়ের কথা রাখ। নামটা শুনলেই বিরক্তি চলে আসে। কেঁদে-কে*টে যা খুশি করুক। আমি তার জন্য বাধ্য নই।”
“আরে ওর মাও কয়েকবার অনুরোধ করছে। মেয়েটা দুইদিন যাবত নাকি কিছু খাচ্ছে না।”
মাশরিফ তাচ্ছিল্য করে বলল,

“রিয়ালি! তুমি এটা বিশ্বাস করেছ? ওর মতো স্বার্থপর মেয়ে কারও জন্য দুই দিন না খেয়ে থাকবে? অসম্ভব! দেখো ঠিকই লুকিয়ে খাচ্ছে কিন্তু ওর মায়ের সামনে অভিনয় করে চলেছে।”
তাও মহিমা বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,

“তাও, আমরা এখানে বসে তো জাজ করতে পারি না। হতেও পারে সত্যি। তুই আর তিতির একটা নতুন, পবিত্র সম্পর্ক করতে যাচ্ছিস আমি চাইনা এর মধ্যে কোন অশুভ কিছু হোক আর তোদের সম্পর্কটাতে কারও খারাপ নজর লাগুক।”
“মা, তুমি অযথাই চিন্তা করছ। বাদ দাও।”
“নারে। খুব ভয় করছে। মনে শান্তি পাচ্ছি না। চল কালকে গিয়ে একবার বুঝিয়ে আসি।”

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৬

মাশরিফ বেশ কয়েকবার মহিমা বেগমকে বোঝাতে চাইল কিন্তু মহিমা বেগম শুনলেন না। তার মনের ভয় কিছুতেই সরছে না। তার ছেলের জীবনে খারাপ কিছু হওয়ার ভয়ে সে কুঁড়ে কুঁড়ে ম*র*ছে।

এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব ৩৮