এলিজা পর্ব ৮৫+৮৬

এলিজা পর্ব ৮৫+৮৬
Dayna

মমতাজ শ্রাবণে কে কোথাও পেলো না।একটা টর্চ নিয়ে বাহিরে বের হয়।এদিক সেদিক পরোক্ষ করে, কোথাও নেই‌।রাত ঠিক ১১ টা নাগাদ।এত রাতে কাউকে কিছু না বলে কোথায় যাবে। মমতাজ টর্চ নিয়ে সামনে এগোয়। কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। মমতাজ ভয়ে চাপসে যাচ্ছে।বাড়ির গেট অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। হঠাৎ চোখ পরে কবরস্থানের দিকে। মমতাজ দেখলো , শ্রাবন পাখির কবরের মাথার দিকে বসে আছে। মমতাজ মুখে হাত দিয়ে শব্দহীন ,নিরবে কেঁদে দেয়।ধিরে ধিরে শ্রাবণের দিকে এগোয়। চারদিক অন্ধকার। আকাশে অল্প অল্প তারাদের আগমন। শ্রাবন একটা মোমবাতি নিয়ে বসে আছে পাখির কবরের কাছে। মমতাজ শ্রাবণের ভেঙ্গে পরা দেখে নিজেই, নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবনের কাছে এগোয়। শ্রাবণের পেছনে দাঁড়িয়ে মমতাজ।

আমতা আমতা করে,কাপা ঠোঁটে বললো,এত রাতে কবরের কাছে কি করছিস?
শ্রাবন ভাঙা গলায়, মমতাজ কে হুসসসস করে ইশারা করে বললো,পাখি ঘুমোচ্ছে। কথা বোলো না। মমতাজ হকচকিয়ে উঠে।চোখ গুলো উৎফুল্ল হয়ে যায়।
মমতাজ খেয়াল করলো, শ্রাবণের হাতে থাকা মোমটা গলে গিয়ে গরম আচ গুলো শ্রাবণের হাতে পরছে। মমতাজ ভেজা কন্ঠে বললো,মোমটা ফেলে দে হাতে গলে পরছে,হাত টা যে,পুড়ে যাবে। শ্রাবন কাপা কন্ঠে বললো,পাখির যে , অন্ধকারে ভয় হয়’পুড়ে যাক হাত।যেখানে অন্তর পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ‘সেখানে হাত পুড়লে কি হবে। মমতাজ জবাব দেয়ার মত কোন বাক্য পেলো না। মমতাজ এক পা -দু পা করে পেছনে সরে যায়।বিরবির করে বললো, সৃষ্টিকর্তা, আমার ছেলেকে ধৈর্য ধরার মত শক্তি দাও
শ্রাবন কবরের কাছে বসে আছে।কবরের উপরের অংশে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।যেভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়”।
শ্রাবন কাপা কন্ঠে বললো,কত সুন্দর ভাবনা_হীন মনে ঘুমোচ্ছো। আমার জীবনের ঘুম কেড়ে নিয়ে, কিভাবে এত শান্তি তে ঘুমাতে পারছো!একটুও কষ্ট হচ্ছে না আমার জন্য!!চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।
চারদিক নিশ্চুপ। কোথাও একটা ঝিঁঝিঁ পোকার দমন ও নেই।আজ সবকিছু নিস্তেজ। সবকিছু অন্ধকার। আকাশ টা কালো মেঘে ঢেকে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শ্রাবন কবরের কাছে লুটিয়ে শুয়ে পরে।ক্লান্তিময় দেহ নিয়ে ঘুমিয়ে পরে,পাখির কবরের কাছে।
এলিজা পাখির ব্যবহৃত স্বর্নের কলমটি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ‌।পাখির কথা ভেবেই,চোখ দিয়ে অঝরে পানি পরছে‌। অপূর্ব এলিজার গা-ঘেষে দাঁড়ায়। শান্ত স্বরে বললো, তোমাকে শান্ত না দেয়ার মত কোন শব্দ নেই।পাখি আমার ও ছোট বোনের মত ছিল।খুব কষ্ট হচ্ছে। এলিজা অপূর্ব কে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কান্না শুরু করে। অপূর্বর চোখের দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে এলিজার কপালে পরে। অপূর্ব ভাঙা গলায় বললো, আমায় রেখে কখনো চলে যাবে নাতো! খুব ভয় যে,ম্যাডাম।আপনিহীন আমি যে একটা মুহূর্ত ভাবতে পারি না। এলিজা ফোপাচ্ছে।
অপূর্ব এলিজা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, আমাকে ছুয়ে ওয়াদা করো,কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না! এলিজা অপূর্ব কে ছেড়ে দিয়ে ইতস্তত বোধ করে অন্য দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে।
অপূর্ব দ্বিতীয় বার,ক্লান্তি ভঙিতে এলিজার হাত দুটো ধরে,কাপা কন্ঠে বললো,ওয়াদা করো কখনো ছেড়ে যাবে না তো! এলিজা দৃষ্টি মেঝেতে স্থাপন করে বললো, না, কখনো ছেড়ে যাবো না। অপূর্ব এলিজা কে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে।
এলিজা অপূর্বর বুকের উপর মাথা রাখা অবস্থায় বললো,আমি সবসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, আপনার আগে যেন,দুনিয়া থেকে আমাকে নিয়ে যায়।কারন, আমি আমার,চোখের সামনে আপনাকে হারানোর যন্ত্রণা যে, সহ্য করতে পারবো না।

অপূর্ব শক্ত গলায় বললো, আমার কিছু হবে না।
এলিজা অহংকারী স্বরে বলল,আমি থাকতে আপনাকে কিছু হতে দেবো না।
তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয় মমতাজ।অপূর্ব মমতাজ কে দেখে শান্ত স্বরে বললো,কাকি!এসো বসো।
মমতাজ কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, শ্রাবন এত রাতেও কবরের কাছে বসে আছে। এভাবে চললে তো, শ্রাবন অসুস্থ হয়ে পরবে।তুই একটু গিয়ে দেখ, বুঝিয়ে শ্রাবন কে ঘরে আনা যায় কিনা। মমতাজ এই বলে, অপূর্বর ঘর থেকে চলে যায়। অপূর্ব এলিজা কে বললো, তুমি অপেক্ষা করো আমি শ্রাবন কে নিয়ে আসছি। এলিজা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব বুঝতে পেরেছে, এলিজা নতুন করে সেই অজানা চিন্তায় আহরন করছে। কিন্তু কি চিন্তা করছে। অপূর্ব এলিজার ভাবনা ভাঙিয়ে বললো,কি ভাবছো? এলিজা আমতা আমতা করে বলল,পাখির কথা ভাবছিলাম।মনে পরছে খুব। এভাবে একা করে চলে যাবে, কখনো ভাবতে পারিনি।

অপূর্ব চিন্তিত স্বর নিয়ে বললো,একটা কথা বলবো! যদি কিছু মনে না করো!
এলিজা ভার মুখে বললো,হুমম বলুন। আমায় কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য অনুমতি নিতে হবে না।
অপূর্ব শান্ত স্বরে বললো,তুমি তো চাইলেই পাখির চিকিৎসা করাতে পারতে!তবে করালে না কেন? এলিজা উল্টো দিকে ঘুরে,পাখির ব্যবহৃত কলমটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, আমি আমার পাপের রাজ্যে,কোন ভাবেই,পাখি এবং,মামি, মামাকে জড়াতে চায়নি। এবং পাখির কাছ থেকে সমস্ত কিছু লুকিয়ে রেখেছি‌। আমাদের আসল পরিচয় ও পাখিকে কোনদিন জানাইনি।পাখি সহ্য করতে পারতো না।

রমজান মামা , যেভাবে সংসার চালাতো,সেটা দিয়েই চলতাম।হারাম টাকা দিয়ে তাদের, প্রয়োজন মিটাতে চাইনি।
অপূর্ব কিছু বললো না। এলিজার দিকে কয়েকবার দৃষ্টি স্থাপন করে চলে যায় শ্রাবণের কাছে‌। অপূর্ব যেয়ে দেখলো শ্রাবন পাখির কবরের কাছে সুয়ে আছে‌। অপূর্ব হকচকিয়ে উঠে। অপূর্ব ধিরে ধিরে কাছে এগোয়। শ্রাবন কে ডাকবে, কিনা ভাবছে। অপূর্ব কাপা কন্ঠে,বিরবির করে বললো, ভালোবাসার কি নির্মম পরিহাস ‘নির্বিশ থেকে নিঃস্ব করে দেয়। শ্রাবণের আজ এমন অবস্থা দেখতে ভালো লাগছে না।তবে শ্রাবণের মত, শ্রেষ্ঠ প্রেমিক দুটো হয়না,তার প্রেমিকা বেঁচে থাকবে ৬ মাস”এটা জেনেও তাঁকে,প্রেমিকা থেকে স্ত্রী বানিয়েছে।
অপূর্ব ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্থান ত্যাগ করে।ভাবলো, শ্রাবন এখন মানসিক ভাবে ঠিক নেই।ও ওর মতো কিছু টা সময় থাকুক।

সকাল হয়ে যায়।কড়া রোদের সোনালী আলোর রঙে রঙিন হয় নতুন একটি সকাল। রোদের খুব তেজ। চৈত্র মাসের শুরু,।রোদের সোনালী ঝিলিকের তেজ থাকার ই কথা। শ্রাবন পাখির কবরের কাছেই বসে আছে। শ্রাবন যে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শ্রাবণের প্রতিটি নিশ্বাস আড়ন্ন,বড্ড ভারী। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কবরের দিকে।শ্রাবনের আঁচরনে প্রকাশ পায়,পাখি মৃত নয়, বেঁচে আছে। মমতাজ শ্রাবণের কাছে আসে। শ্রাবন মমতাজ কে এক নজর পরোক্ষ করে। মমতাজ শান্ত স্বরে বললো,বাবা, এখন তো ঘরে চল। গতকাল থেকে এভাবে পরে আছিস। শরীর খারাপ করবে। আমার কষ্ট টা তো, উপলব্ধি করবি।আমি যে তোর মা,তোকে এই অবস্থায় দেখতে আমার ভালো লাগছে না। বুকের ভেতর খাঁ _খাঁ করছে। শ্রাবন কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে উঠে দাঁড়ায়। মমতাজ কে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি যাও।আমি আসছি। মমতাজ পাখির কবরের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে চলে আসে‌। মমতাজ ভাবলো, শ্রাবণের আঁচরন স্বাভাবিক আমি যা ভেবেছি তা নয়।

এলিজা ঘুম থেকে উঠে স্নানঘরে প্রবেশ করে।স্বচ্ছল হয়ে নিচে আসে। এলিজা দেখলো, জাহাঙ্গীর বৈঠকখানায় বসে বসে পেপার পরছে। জাহাঙ্গীর এলিজার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করলো। এলিজা জাহাঙ্গীর কে , ভেজা কন্ঠে বললো,চা খাবেন? জাহাঙ্গীর আর চোখে দেখলো। হঠাৎ এলিজার নরম স্বাভাবিক আচরন, জাহাঙ্গীর কে ভাবালো। জাহাঙ্গীর ভাবনা উপেক্ষা করে বললো, চিনি কম,সাথে আদা দিও।
এলিজা রান্না করে চলে যায়। মনজুরা খেয়াল করলো, এলিজার চোখ মুখের ভাষায় কিছু লুকিয়ে আছে। মনজুরা কাট গলায় বলল,কি এমন ভাবছো! আজকাল ভাবনাতে মশগুল থাকছো যে,। কিছু হয়েছে!নাকি পাখি চলে যাওয়ায় এমন? এলিজা কাঁপা গলায় বলল,হুমম পাখির জন্য কিছু ভালো লাগছে না। আমার এই দুনিয়াতে রক্তের বলতে কেউ রইলো না।মনজুরা বললো, এভাবে বলতে নেই।স্বামীর মত আপন কেউ হয়না।

মনজুরার মুখে এরকম বাক্য শুনে, এলিজা হকচকিয়ে উঠে।ভাবনা নিয়ে বললো,মনজু বুবু,একটা কথা বলবো? মনজুরা বলতে বললো, এলিজা বললো,এই বাড়িতে কাজ করছো অনেক বছর। তোমাদের আমরা বাহিরের বলে মনে করি না।আর তোমরাও কখন ও এমনটি মনে করো না।
মনজুরা বললো,হুমম।
এলিজা চা টা কাপে নিতে নিতে বললো, সবসময় বাড়ির সবার যত্ন নিবে। বিশেষ করে তোমার ছোট দাদাবাবুর।তার কিন্তু হৃদরোগ আছে।তার সবকিছুর প্রতি খেয়াল রাখবে। মনজুরা এলিজার কথায় অবাক হয়। হঠাৎ এসব বলছে কেন।মনজুরা
কোন জবাব দিলো না।
এলিজা, জাহাঙ্গীর কে চা দেয়।
এলিজা ভেজা কন্ঠে বললো,বাবা!
জাহাঙ্গীর চোখ বড় করে এলিজার দিকে তাকায়। হঠাৎ এলিজার মুখে এরকম বাক্য শুনে জাহাঙ্গীর উৎফুল্ল হয়। জাহাঙ্গীর নরম গলায় বললো,বলবে কিছু?

এলিজা নত মাথায় বললো,বয়স হয়েছে আপনার। জীবনে যা হয়েছে,হয়েছে।আমি জানি অতিতের সে ,সব কিছুর জন্য আপনি অনুতপ্ত।আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনার উপর আমার কোন অভিযোগ নেই। জাহাঙ্গীর ভারবহন লাঠি টা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে যায়। এলিজার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো, তোমার আমার উপর কোন অভিযোগ না থাকলেও, আমার নিজের উপর নিজের,হাজার টা অভিযোগ। সারাজীবন নিজের কাছেই নিজে দোষী থাকবো। এলিজা কিছু বললো না। জাহাঙ্গীর স্থান ত্যাগ করে।
তৎক্ষণাৎ নিচে আসে অপূর্ব। এলিজা অপূর্ব কে দেখে মৃদু হাসলো। অপূর্ব এলিজার কাছে এসে বললো,ম্যাডাম আমাকে , একবার থানাতে যেতে হচ্ছে। এলিজার দৃষ্টিতে আপত্তির ছাপ। অপূর্ব বললো,ফিরে আসবো তারাতাড়ি। এলিজা নত স্বরে বলল,আমি আপনার জন্য আপনার পছন্দের খাবার বানিয়ে রাখবো। অপূর্ব মৃদু হেসে এলিজার কপালে চুমু খায়। অপূর্ব বাহিরে যেতেই, পেছন থেকে এলিজা কাট গলায় বলল,’আজকে একসাথে সন্ধ্যা তারা দেখতে ইচ্ছে করছে।যাবেন,আজ ও অজানা পথে!

অপূর্ব এলিজার মুখে হঠাৎ এরকম কথা শুনে হকচকিয়ে উঠে। গতকাল পাখি চিরজীবনের জন্য চলে গেলো‌।সেই প্রভাব এত তাঁরাতারি কেটে গেছে।যাক,শোক থেকে মুক্তি পেলেই ভালো। অপূর্ব পেছন ঘুরে এলিজার দু-কাদে হাত দিয়ে বললো, আমার মহারানি বলবে আর আমি যাবো না।আজ দ্রুত ফিরে আসবো। এবং দু’জন মিলে একসাথে,অজানা পথের বাঁকে হাঁটতে হাঁটতে, সন্ধ্যা তারা উপভোগ করবো।
অপূর্ব থানার উদ্দেশ্য বের হয়। অপূর্বর চিন্তা বেড়ে চলেছে। এলিজার হঠাৎ এরকম আচরণ কেন করছে!
কি চাইছে এলিজা!নাকি ,পাপের সম্রাজ্য ছেড়ে আসায় এমন করছে!সত্যিই কি সবকিছু ছেড়ে এসেছে,নাকি গহিন আরহনে নতুন ভাবনা এটে রেখেছে!
অপূর্ব অস্থিরতা অনুভব করলো‌।,কোন প্রশ্নের ব্যাখ্যা মিলছে না।

মমতাজ সকালের ফজরের নামাজ পরে জায়নামাজ থেকে আর ওঠেনি। নামাজে বসে কাঁদছে। শ্রাবন এর ফ্যাকাশে মুখ,ক্লান্তি চোখ, নিস্তেজ শরীর দেখতে পারছে না।ছেলের এরকম করুন অবস্থা মা হয়ে সহ্য করার মত নয়।
শ্রাবন ঘরের এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে।হাতে পাখির ছবি।পাখির ফেলে যাওয়া স্মৃতির পাতায় নিজেকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে‌।পাখির বলা প্রতিটি বাক্য , চারদিকে ঘুরে বেড়ায়।কানের কাছে ভেসে আসছে পাখির বলা মিষ্টিমধুর শব্দ গুলো। শ্রাবন কোন ভাবেই নিজের মন কে শক্ত করতে পারছে না।পাখির ছবিটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে অঝরে কাঁদছে। ভাঙা গলায় বার বার বলছে,পাখি কিভাবে থাকবো আমি তোমায় ছাড়া।কি করে বাঁচবো, নিঃশ্বাস টা যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবন এর বুক ফাটা কান্নায় থমকে যাচ্ছে চারদিক। নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

মমতাজ শ্রাবণের ঘরের বাহিরে দাড়িয়ে। শ্রাবণের কান্নার আওয়াজ তার কানে ভেসে আসছে। মমতাজ হাতের উল্টো দিক দিয়ে চোখের পানি মুছে।ধির পায়ে শ্রাবণের ঘরে প্রবেশ করে। খাটের সাথে হেলান দিয়ে, মেঝেতে লুটিয়ে বসে আছে শ্রাবন। মমতাজ ভাঙা গলায় বললো,বাবা! শ্রাবন কোন সাড়া দিচ্ছে না। মমতাজ শ্রাবণের শরীরে স্পর্শ করে বললো,তোর বেদনা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু এভাবে কাঁদলে যে,পাখি মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে।মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতে হয়।তুই চাস না ,পাখি পরপারে ভালো থাকুন। শ্রাবন ঘার সোজা করে বসে। হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে। মমতাজ পরোখ করলো, শ্রাবণের চোখের কার্নিশে কার্নিশে রক্তের দানা ভেসে উঠছে। মমতাজ শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, গোসল করে নিজেকে স্বচ্ছল কর। জোহরের আজান দিলেই, নামাজ আদায় করবি। মসজিদ শান্তির জায়গা। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের ভেতরের বেদনা গুলো প্রকাশ করবি।পাখি মায়ের জন্য দোয়া করবি।পাখির আত্মাও শান্তি পাবে,আর তোর মনেও শান্তি অনুভব হবে। মায়ের কথা শুনতে হয়।যা, গোসল করে স্বচ্ছল হয়ে-নে। শ্রাবন ভাঙা গলায় বললো,মা আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।

ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।কোন ভাবেই শান্তি পাচ্ছি না। মমতাজ শ্রাবণের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এখন আমি যা বলেছি তাই কর।
শ্রাবন মায়ের কথা মত গোসল করে। আলমারি থেকে পাঞ্জাবি বের পরে নেয়। শ্রাবন ঘরের চারদিকে বারবার পরোখ করছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাখির স্মৃতি। শ্রাবন নিজের মনকে শক্ত করে মসজিদ এর উদ্দেশ্য বের হয়।
এলিজা রান্নাঘর থেকে শ্রাবণের যাওয়ার পানে- পরোখ করে।
এলিজা অপূর্বর সমস্ত পছন্দের খাবার তৈরি করে। এলিজার চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু চোখের পানি গড়িয়ে পরছে।মনজুরা খেয়াল করলো। ভাঙ্গা গলায় বললো, বউমনি কি হয়েছে তোমার গত-দু-তিন ধরে তোমার মুখের ভাষায় কিছু একটা প্রকাশ পাচ্ছে।কি হয়েছে তোমার? এলিজা মৃদু হেসে বললো,পাখির জন্য ভালো লাগছে না কিছু।মনজুরা এলিজার জবাবে সত্যতা পেলো না।

মনজুরা ভাবনা উপেক্ষা করে বললো, হঠাৎ করে দাদাবাবুর জন্য এত এত পছন্দের খাবার তৈরি করছো!! এলিজা নত স্বরে বলল, আমার হাতের রান্না উনি ভিষন পছন্দ করেন। এভাবে মাঝেসাঝে তার পছন্দের খাবার গুলো তৈরি করে দিবে।
আচ্ছা শোনো, তুমি এদিক টা দেখো।আমি গোসল করে আসছি, কেমন!বলেই এলিজা নিজের ঘরে চলে যায়।
মনজুরা এলিজার যাওয়ার পানে চেয়ে চেয়ে দেখলো। এলিজার অদ্ভুত আচরণ মনজুরা কে ভাবালো।
এলিজা গোসল শেষ করে, অপূর্বর পছন্দের রঙের শাড়ি পরে। অপূর্বর মিষ্টি রঙ পছন্দের।তার সাথে চুল গুলো বেনুনি। ছোট করে কপালে টিপ পরেছে।

এলিজা তৈরি হয়ে নিচে আসে। রান্না ঘরে যেতেই চোখে পরে ,বাহিরে। বায়েজিদ বসে বসে কাঠ কাটছে। এলিজা বায়েজিদ এর কাছে আসে। বায়েজিদ এলিজা কে দেখেই মৃদু হাসলো। শান্ত স্বরে বললো,আপা!
এলিজা মৃদু হেসে বললো, আজকে ভালোমন্দ, অনেক কিছু রান্না করেছি। তোকে কিছুক্ষণ_পর পাঠিয়ে দেবো। বায়েজিদ অমৃদু হাঁসি দিয়ে বলল,আপা তুমি আর বাবর রাজ্যে যাবে না?
এলিজা মুখের রঙ বদলে ফেলে।কাপা কন্ঠে বললো,আমি আর কোনদিন যাবো না।আর তুই ও এই বাড়ি ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাবি না। ছোট দাদাবাবুর সাথে থাকবে। বায়েজিদ ভ্রু কুঁচকে দেয়।
এলিজা ঘরে চলে আসে।

এক প্রহর দুই প্রহর কেটে যায় অনেক প্রহর। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এলিজা না খেয়ে অপূর্বর জন্য অপেক্ষা করছে।এখনো আসছে না। এলিজা বৈঠকখানায় পায়চারি করতে থাকে। তৎক্ষণাৎ জাহাঙ্গীর উপর তলা থেকে বললো, অপূর্ব ফিরেনি? এলিজা না সূচক মাথা নাড়ে। জাহাঙ্গীর শান্ত স্বরে বললো, আমার ঘরে পানি নেই।খুব পিপাসা পেয়েছে।মনজুরাকেও দেখছি না। এলিজা নত স্বরে বলল,আমি নিয়ে আসছি।
এলিজা পানি নিয়ে জাহাঙ্গীর এর ঘরে উপস্থিত হয়। জাহাঙ্গীর বারান্দায় উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। এলিজা পানির জগ টা টেবিলের উপর রাখে। জাহাঙ্গীর আড় চোখে পরোক্ষ করলো। এলিজা চলে আসতেই থমকে দাঁড়ায়, জাহাঙ্গীর কে উদ্দেশ্য করে বললো,একটা কথা বলবো? জাহাঙ্গীর চেয়ারে উপর বসে বললো,বলো।
এলিজা ভাঙা গলায় বললো, আপনার ছেলে আপনাকে খুব ভালোবাসে।বাবা ছেলে একসাথে ,সবসময় ভালো থাকবেন। ভালো থাকার চেষ্টা করবেন। আম্মার জন্য,মন খারাপ করবেন না।,পরপারে সে ভালো আছে। জাহাঙ্গীর আড় চোখে এলিজাকে পরোখ করলো। হঠাৎ এরকম আচরণ, এবং তার সাথে বলা বাক্য গুলো ভারী অদ্ভুত। জাহাঙ্গীর শান্ত স্বরে বললো, এগুলো বলছো কেন!এলিজা বললো, কখনো বলা হয়নি।তাই বললাম।আর আপনার উপর আমার কোন অভিযোগ নেই।

এলিজা জাহাঙ্গীর এর ঘর থেকে চলে আসে। বৈঠকখানায় বসে বসে অপূর্বর জন্য অপেক্ষা করছে। হাতের উল্টো দিক দিয়ে চোখের পানি মুছলো।মনজুরা নিজের ঘর থেকে পরোখ করলো।
তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয় অপূর্ব। অপূর্ব এসেই এলিজা কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। এলিজা হকচকিয়ে উঠে। অপূর্ব মৃদু হেসে বললো, আমার জন্য অপেক্ষা করছো বুঝি। এলিজা মৃদু হেসে হ্যা সুচক মাথা নাড়ে। অপূর্বর বা হাত পেছনে,ডান হাত এলিজার কাদের উপর। এলিজা ঘুরে বসে বললো,হাতে লুকিয়ে রেখেছেন কি? অপূর্ব ভাবনা নিয়ে বললো,কি লুকিয়ে রেখেছি, আন্দাজ করো তো! এলিজা উঁকি মেরে দেখল,বললো, হেঁয়ালি করবেন না।

অপূর্ব হাত টা সামনে আনতেই, এলিজা চোখ দুটো বড় বড় করে বললো,বেলিফুল! অপূর্ব মৃদু হেসে বলল ,আমার মহারানি বলেছে, আজকে আমার পছন্দের খাবার তৈরি করবে। এবার তারজন্য তো, উপহার আনতেই হতো‌। এলিজা মৃদু হাসলো। অপূর্ব বেলি ফুলের মালা টা,পরিয়ে দেয় । এলিজা বেলিফুলের মালা টা আলতো হাতে স্পর্শ করলো। অপূর্ব খেয়াল করলো, এলিজার চোখে পানি। অপূর্ব এলিজা কে জড়িয়ে ধরে বললো, চোঁখে পানি কেন?কি হয় আজকাল তোমার? কোনো কিছুর,ব্যাখা মিলছে না।বলো আমাকে! কষ্ট ভাগ করে নেই!

এলিজা অপূর্বর হাত সরিয়ে শান্ত স্বরে বললো, জীবনটাই একটা রহস্যময়,প্রতিটি পদক্ষেপে থাকে রহস্য,যার ব্যাখা আমরা কেউ জানি না। অপূর্ব এলিজার ভাবনা উপেক্ষা করে মৃদু হেসে বললো, ম্যাডাম, সারাদিন কিছু খাইনি। তোমার হাতে রান্না খাওয়ার জন্য যে, ছটফট করছি,আর তুমি অজানা ভাবনায় বিভোর।
অপূর্ব খাবার টেবিলে বসে। এলিজা খাবার দেয়। অপূর্ব এলিজার দিকে পরোক্ষ করলো,তার পছন্দের রঙের শাড়ি পরেছে।চুল গুলো বেনুনি করা,মায়াবী চোখ,ভি-কার থুতনি, চিকচিক করছে ঠোঁটের দর্পন। অপূর্ব অপলকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। এলিজা আড় চোখে দেখে বললো,কি দেখছেন? অপূর্ব মৃদু হেসে বললো, আমার নিজস্ব পরীকে আমি দেখছি।

অপূর্ব টেবিলের দিকে পরোক্ষ করলো।তার সব পছন্দের খাবার সাজানো। অপূর্ব হাত ঘেঁষে,বললো, লোভনীয়।বাড়ির সকলে খেয়েছে?এলিজা অপূর্বর পাশে গিয়ে বসে বললো, সবাই খেয়েছে।শ্রাবন খায়নি। জোহরের নামাজ পরে,এসে থেকে ই ঘরের মধ্যে।আর বের হয়নি।
অপূর্ব খাবার মাখাতে মাখাতে বললো, তুমি ও তো খাওনি।সেটা বললে না। এলিজা মৃদু হাসলো।
অপূর্ব নিজ হাতে এলিজা কে খাইয়ে দেয়। এলিজা জ্বলজ্বল চোখে অপূর্ব কে পরোক্ষ করছে। মায়াভরা কন্ঠে,বিরবির করে বললো, আপনার দাগহীন অঙ্গে,আমি কোনদিন চুলের দর্পন ও লাগতে দিবো না। অপূর্ব কথাটি শুনে নেয়। এলিজার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো, তোমার মত সাহসী স্ত্রী থাকলে , কিভাবে আমার দেহে দাগ পরবে।কেউ, আমার দিকে তেরে আসলে, তুমি তাকে ভস্য করে দিবে‌।কারন,`আর কেউ না জানুক,আমি তো জানি আমার বউটা কত সাহসী!

এলিজা আওয়াজ করে হেসে বললো, আপনি না!
রাত বেড়ে চলেছে। চারদিকে তারাদের আনাগোনা। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত চারদিক। নিস্তব্ধ পরিবেশ।শান্তশীরে কিছুটা মেঘ চাঁদের গা-ঘেষে উড়ে যাচ্ছে। চৈত্র মাসের শুরু, কিন্তু এখনো শীতল হাওয়ার হাতছানি।
অপূর্ব ,এলিজা, দু’জনে হাঁটতে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় অনেক দূর। অপূর্ব এটা সেটা,থানাতে কি হয়েছে,কে কোন কেস নিয়ে এসেছে ব্লা ব্লা অনেক কথা বলছে। এলিজা অপলকে অপূর্বর দিকে দেখছে। মনে মনে ভাবছে, আমার পাশে থাকা মানুষ টি কতটা মায়াবী ।যার,জোড়াশয় ভ্রুর দর্পনে বারবার হারিয়ে যাই আমি।
অপূর্ব হাতে তুরি দিয়ে এলিজার ভাবনা ভাঙিয়ে দেয়।বললো,কি ভাবছো ম্যাডাম? এলিজা মৃদু হেসে না সূচক মাথা নাড়ে।

চাঁদনী রাতের ভরাকান্ত জোনাকির দর্পন দু’জনে উপভোগ করলো।
রাত বেড়ে চলেছে। অপূর্ব এলিজা , দুজনে ঘরে ফিরে আসে। অপূর্ব এলিজার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করলো,এলিজা কোন ভাবনাতে মশগুল।কোন অজানা ভাবনাতে তাকে একাকার করে দিচ্ছে। কিন্তু কি!
অপূর্ব এসব ভাবতেই, এলিজা বললো,সুয়ে পরুন।রাত অনেক হয়েছে।
অপূর্ব সোয়।এলিজা অপূর্বর বুক পাঁজরে মাথা রেখে বললো, আপনার বুক পাঁজর আমার শান্তির স্থান। সমস্ত ক্লান্তি ভাবনা সব দূর হয়ে যায়,যখনই আপনার স্পর্শ পাই। অপূর্ব এলিজার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ম্যাডাম আপনি ও যে আমার অনন্ত সুখ।
শ্রাবন হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে পাখির কবরের কাছে।ভাঙা গলায় বললো,ফিরে আসো না!কি করে থাকবো,। তুমিহীনা বেঁচে থাকা যে,বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
শ্রাবন কবরের কাছে লুটিয়ে সুয়ে পড়ে।
পরদিন সকাল বেলা—-

এলিজা পর্ব ৮৩+৮৪

কষ্ট জড়িত হৃদয়ের,ভার বহনে বহনে রাত ফুরিয়ে দিনের আলো ফুটে।
পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ।কড়া রোদের সোনালী ঝিলিকের আলো এসে অপূর্বর চোখে। অপূর্ব চোখ মেলে দেখলো এলিজা পাশে নেই। অপূর্ব বিছানার এপাশ ওপাশ করলো।চোখ পরিষ্কার করতে করতে নিচে আসে।ভাবলো এলিজা রান্না ঘরে। অপূর্ব পরোখ করে দেখলো সেখানেও নেই। অপূর্ব এদিক সেদিক পরোক্ষ করলে কোথাও এলিজা নেই। অপূর্ব অস্থিরতা নিয়ে মনজুরা কে জিজ্ঞেস করলো,এলিজা কোথায়?মনজুরা বললো, সকাল থেকে দেখিনি। অপূর্ব দ্রুত পায়ে জাহাঙ্গীর এর ঘরে যায় ।সেখানেও নেই। অপূর্ব বাড়ির প্রতিটি কোনায় কোনায় দেখলো, কোথাও নেই। অপূর্বর বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয় যায়। কোথায় যাবে।আমায় কিছু না বলে তো কোথাও যায়না,আজ কোথায় যাবে! কোথায় এলিজা?….

এলিজা পর্ব ৮৭+৮৮++৮৯