এসো বৃষ্টি হয়ে পর্ব ২

এসো বৃষ্টি হয়ে পর্ব ২
লেখিকা- সায়ুরী দিলশাদ

নিজের স্বামীকে একটা মেয়ের হাত ধরে অন্য বাসায় ঢুকতে দেখে বুকের ভিতরটায় আবার সেই ব্যাথা উঠে বেলির। তাহলে এই সেই মেয়ে,সুখনের দ্বিতীয় স্ত্রী। পাশের গাছটায় হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে। তার হাত পা কাঁপছে থরথর করে।ঐখানেই বসে থাকে বেলি একঘন্টা। সুখন এখনোও বের হচ্ছে না। কি করছে এখনো। যাবে একবার! মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টায়, উঠে হাটা শুরু করে বাসার উদ্দেশ্যে। তাহলে এতদিন যে মানুষ বলতো সুখন আরেকটা বিয়ে করেছে এটা সত্যি, সেদিনের কাগজটাও তাহলে সত্যি। সব সব সত্যি। তাহলে তার সত্যি কি! নিজেকে পাগল পাগল লাগে বেলির। ঐদিন জেঠার হাতে সুখনের দ্বিতীয় বিয়ের কাগজটা দিয়ে আসার পর জেঠা খোঁজ করে। তিনি ফোন দিয়ে বলেছিলেন সব সত্যি। তিনিই ঠিকানা দিয়েছিলেন ঐ।বাসার। বেলি বিশ্বাস করতে পারে নি তাই সে নিজেই এসেছিলো খোঁজ করতে।কিন্তু চোখের সামনে সুখনকে ঐ মেয়ের হাত ধরে বাসায় ঢুকতে দেখে বেলি সব বুঝে গেল।

এলোমেলো পায়ে বাসায় ঢুকতেই বেলির শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলো,
– কই গেছিলা বউমা
মলিনমুখে বেলি জবাব দিলো,
– কই যাওয়ার মতো জায়গা রাখছে আপনার ছেলে। সেইখানেই গেছিলাম।
কথাটা শুনে কুলসুম বেগমের হাতের তসবি দ্রুতগতির হয়। তসবিহ ঘুরছে কিন্তু তার মুখ থেকে সঠিক দোয়াটা বের হচ্ছে না। তিনি ভুলে গেছেন দোয়াটা কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও তো পড়ছিলেন। বিপদের সময় পড়ার দোয়া, ইউনুস নবী পড়েছিলেন মাছের পেটে থাকার সময়। আজকাল তিনি এই দোয়া বেশি পড়ছেন। যেদিন থেকে শুনছেন যে ছেলে দ্বিতীয় আরেকটা বিয়ে করেছে সেদিন থেকেই এই দোয়া পড়া শুরু করেছেন। যেন আল্লাহ তাকে এই বিপদ থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু এই কয়দিন ধরে বউমা কে কেমন জানি লাগে, মুখ শুকনো করে ঘুরে বেরায় সবসময়। কিছু একটা করতে হবে। দোয়াটা আরেকবার মনে করার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। অতঃপর তিনি বাধ্য হয়ে বেলিকে ডাকলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– বউমা, ও বউমা। দেইখা যাও তো একটু।
বেলি নিজের রুমে গিয়ে গোপনে অশ্রুবিলাস করছিলো। শাশুড়ীর ডাক শুনে চোখ মুখ মুছে রুম থেকে বেরোয়, বলে,
– ডাকেন আম্মা!
কুলসুম বেগম মাথা নেড়ে হ্যা বলে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে ,
– আমি দোয়া ইউনুস টা মনে করতে পারতাছি না। একটু কও তো দেখি।
বেলি অবাক চোখে চেয়ে বলে,
– মনে করতে পারছেন না।

কুলসুম বেগম অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে না বললেন। বেলি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললো,
-লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ-লিমিন।
কুলসুম বেগম পান খাওয়া লাল দাত বের করে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হাসলেন যেন একটা বিশাল লজ্জার কিছু লুকাতে চাইচেন।হঠাৎ একটা কথা মনে পড়াতে বললো,
– ও একটা কথা। এদিক আসো, শুনো।
বেলি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো। আজকাল বেলি শরীরে বল পায় না। হাত পা মোটামুটি টেনে টেনে কাজ করতে হয়। কুলসুম বেগম আগের
চেয়েও ফিসফিস করে বললেন,

– তোমারে নিয়া আমি এক জায়গায় যায়াম। তুমি কিন্তু কেউরে কিছু বইলো না৷
বেলি আগের চেয়েও অবাক হয়ে বললো,
– কই যাইবেন আম্মা।
কুলসুম হাসলেন এইবার। বললেন,
– সুখনের আবার বিয়া নিয়া মানুষ যে মেয়ের সাথে কথা বাইর করছে ঐ মেয়ের বাসায় যাবো। তোমারে আর লিখনরে দেখায়া আনবো। যে সুখনের বউও আছে ছেলেও আছে। যাতে ঘটনা সত্যি হইলে ঐ ছেরি আর সুখনের পিছে না ঘুরে।
বেলি মনে মনে বললো,” ঘটনা সত্যি আম্মা। আপনার বেঈমান ছেলে আরেকটা বিয়া করছে। সে তার বাসায় ঘন্টার পর ঘন্টা থাকে। ঘটনা সত্যি, আমি সব জানি। ”
কিন্তু মুখে বললো,

– তার দরকার কি আম্মা। আপনে কি তারে বিশ্বাস করেন না!
কুলসুম বেগম চমকালো। মুখ ভার করে বললো,
– আল্লা ছাড়া আর কেউরে বিশ্বাস করা যায় না। তুমি যাইবা আমার সাথে। দরকার আছে বলেই আমি কইতাছি।
বেলি মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শাশুড়ী মানুষটা ভীষণ ভালো তাকে বেশ আদর স্নেহ করে। তাই তার কথা ফেলা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা বেলির নিজেরও ইচ্ছা ঐ মেয়েটা একবার দেখবে সামনাসামনি, মুখোমুখি হয়ে কি দেখে সুখন তাকে ছেড়ে ঐ মেয়ের কাছে গিয়েছে সেটা সে দেখতে চায়।

বিকালের দিকেও বেশ গরম লাগছে। বেলি লিখনকে কোলে নিয়ে সামনে সামনে হাঁটছে পেছনে কুলসুম বেগম আসছে। বেলি জানে তাদের গন্তব্যস্থল কোথায় কোনদিকে যেতে হবে তাও জিজ্ঞেস করলো,
– আম্মা কোনদিকে যাবেন? রিকশা নিবো?
কুলসুম বেগম পানের ফিক ফেলে বললেন,
– তোমার রুনু খালার বাসাটা চিনো না।
বলে কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন,
– ঐ যে লিখনের জন্মদিনের দিন যে বাসায় উঠছিলা তাদের বাসায় যাইবা। ওদের বাসাতেই নাকি উপরে ভাড়া থাকে মেয়েটা। আমারে রুনুই বলছে সব। ওই দেখছে..

কথাটা আর শেষ করলেন না তিনি। বেলিও কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পড়লো রিকশায়। গন্তব্যস্থলের ঠিকানা বলা ছাড়া পুরো রাস্তায় আর কেউ রা শব্দটি করলো না। লিখনও একদম চুপ। যেন সে বুঝে গেছে সব কিছু।
রুনু খালার বাসায় যাওয়ার পর চা বিস্কুট দিলো। দুজনের কেউই চায়ে চুমুক দিলো না। তারা উদগ্রীব হয়ে আছে ঐ মেয়েটির মুখোমুখি হওয়ার জন্য। রুনু খালা হয়তো বুঝলেন বিষয়টি। তাই চা নাস্তার পর্ব বাদ দিয়েই তারা গেল সেই মানুষটির সাথে দেখা করতে।

মিনিট খানেক অপেক্ষা করার পর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সেই নারীটি। ৫ ফুট অথবা ৫ফুট ১ হবে হয়ত, চাপা গায়ের রং, গোলাকার মুখশ্রী তে চাপা নাক মনে হলো যেন হাতি পা দিয়ে চ্যাপটা করে দিয়েছে। চোখগুলো বড় বড়। তার চোখের মনির রং আর বিড়ালের চোখের মনির একরকম। মাথাটা সবুজ রংয়ের ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বেলি বুঝে পারলো না সুখন কেন এই মেয়েটাকে বিয়ে করছে। এই মেয়েটার থেকে সে কোনদিক দিয়ে কম? বরং সে সবদিক দিয়ে তার থেকে বেশি। গায়ের রং, উচ্চতায় সবদিক দিয়ে।

মায়মুনা হঠাৎ দুজন অপরিচিত মানুষকে দেখে অবাক হলো। সে রুনু খালার দিকে তাকিয়ে বললো,
– খালা ভিতরে আসেন। বাইরে দাড়িয়ে আছেন কেন?
ওরা ভিতরে ঢুকলো। বেশ অপরিষ্কার বাসাটা। ভেতরে ঢুকতেই গা গুলিয়ে উঠলো বেলির।মেয়েটার দিকে তাকাতেই অবস্থা আরোও খারাপ লাগলো। রুনু ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো বোন আর ভাগিনা বউ বলে। মায়মুনা সালাম দিলো। কুলসুম বেগম সালামের জবাব দিয়ে বললো,

– দেখো মেয়ে। আমি সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করি। তাই সোজাসাপটায় বলে ফেলি। তোমার আর সুখনের সম্পর্কে চারদিকে বিভিন্ন রকমের কথাবার্তা হইতাছে, সেটা তো তুমি জানোই। আমি হইলাম গিয়া সুখনের মা। আর এই যে দাড়ায়া আছে এইটা আমার ছেলের বউ। আর এইটা আমার নাতি। চার বছর চলে ওদের বিয়ার।
মায়মুনা চমকে উঠে।কিন্তু সেটা তার মুখে প্রকাশ পায় না। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বেলির দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপা বসেন।
বেলি একবার মায়মুনার দিকে তাকায়। চোখে পানি টলমল করছে। মায়মুনাকে সে স্পষ্ট দেখতে পায় না। বেলি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মনে মনে বলে,”বড্ড নোংরা তুমি ”
কুলসুম বেগম বলেন,

– না তোমার বাসায় বসার জন্য আসি নি। দেখাইবার আসছিলাম। আমার সুখের সংসারে যাতে কোনো ডাইনীর নজর না লাগে।
মায়মুনা হাসলো এবারেও। বেলি একবার মায়মুনার দিকে তাকালো তারপর দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। রাস্তায় পা রাখতেই হরহর করে বমি করে দিলো। ঘৃণায় বমি আসছে তার। মেয়ে মানুষ এমন হয় কিভাবে। বেলির পাশে কুলসুম আর রুনু এসে দাড়ায় রুনুর কোলে লিখন। হাতে বিস্কুটের প্যাকেট।
রুনু জিজ্ঞেস করে,

– বেলি! কি হইছে? শরীর খারাপ লাগতেছে!
মাথা নাড়ে বেলি। বিস্কুটের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কোত্থেকে আনলো এইটা?
কুলসুম বেগম বলে,
– মেয়েটা দিসে ওরে।
বেলির মুহূর্তের মধ্যেই রাগ উঠে যায়। বিস্কুটের প্যাকেট টা ছেলের হাত থেকে ছুড়ে মারে রাস্তায়। মুহূর্তেই প্যাকেটটা পিসে দিয়ে যায় একটা গাড়ি। লিখন বিস্কুটের প্যাকেটটার জন্য কান্না শুরু করতেই গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় বেলি। লিখন আরও জোরে কাঁদতে শুরু করে
আকস্মিক ঘটনায় বোকা বনে যায় ঘটনাস্থলের সবাই। কুলসুম বেগম বলেন,

– এইটা কি করছো তুমি? ওরে মারলা কেন?
দাঁতে দাঁত চেপে বেলি বললো,
– আমার সব কিছুতেই ওর ভাগ বসাতে হবে। আমার জামাই নিয়ে গেছে। এখন আবার আমার ছেলেকে নেয়ার পায়তারা করছে। ভালো সাজে আমার সামনে। সবগুলারে জেলের ভাত খাওয়াবো।
কুলসুম বেগমের মুখে কথা জোটে না। রুনুর হাত থেকে লিখনকে ছো মেরে নিয়ে বেলি হাঁটা শুরু করে। কুলসুম বেগম বেলির পিছন পিছন হাঁটতে থাকে। কিন্তু বেলিকে নাগাল পায় না তিনি।
বাসায় ঢুকতে ঢুকতেই মাগরিবের আজান পড়ে যায়। সুখন দাড়িয়ে আছে গেইটের সামনে । বেলিদের আসতে দেখে বললো,
– কই গিয়েছিলে? কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
সুখন সবটাই জানে। ওরা বেরুতেই কল দিয়ে সুখনকে সব বলে দিয়েছিলো মায়মুনা। সব জেনেও সুখন না জানার ভান করলো নাহলে সে ধরা পরে যাবে।

কুলসুম বেগম বললেন,
– তোমার রুনু খালার বাসায় গেছিলাম।
তারপর আর কোনো কথা হলো না। সবাই চুপচাপ যে যার রুমে চলে গেলো। বেলি রুমে গিয়ে লিখনকে রেখে চলে আসতে নিলেই সুখন বেলির পথ আটকে দাঁড়ায়। মৃদু হেসে বলে,
– কি হয়েছে তোমার? কয়দিন ধরে থমথমে মুখ করে আছো। এমন মুখ করে থাকলে আমার খারাপ লাগে তো।
কথাগুলো বলেই সুখন বেলিকে জড়িয়ে ধরতে যায়। বেলি নিজের শরীরের সবটা শক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে সুখন কে সরিয়ে দিলো। বিদ্রুপের সুরে বললো,

– দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় মনে ছিলো না যে আমার কষ্ট দেখলে খারাপ লাগে।
সুখন ঘাবড়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বলে,
– কি বলো দ্বিতীয় বিয়ে! তুমিও মানুষের কথায় বিশ্বাস করছো। আমাকে বিশ্বাস করো না তুমি!
বেলি চিৎকার করে বলে উঠে,
– আর কত নাটক করবা তুমি! এতদিন তোমাকে বিশ্বাস করেই আমার আজ এই অবস্থা। ছোটলোক তুমি।
সুখন বেলিকে বিছানায় বসিয়ে বেলিকে বুঝানোর স্বরে বলে,

এসো বৃষ্টি হয়ে পর্ব ১

– দেখো মানুষের কথায় আমাদের সম্পর্ক টা নষ্ট করতেছো কেন। ওরা আমাদের সুখ দেখতে পারে না তাই এমন বলে। ওরা পরের বার কিছু বললে বলবা প্রমান সহ দেখাতে।
বেলি এক ঝটকায় সুখনকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
– প্রমাণ! দাঁড়াও
বলেই দৌড়ে কাগজটা বের করে সুখনের দিকে ছুড়ে মেরে চিৎকার করে বলে,
– আরও প্রমাণ লাগবে! এর থেকেও বড় প্রমাণ লাগবে! লোক কি বলবে আমাকে। আমিই তো গতকাল তোকে ঐ মেয়ের হাত ধরে বাসায় ঢুকতে দেখেছি। পুরো একটা ঘন্টা বসেছিলাম ঐখানে। তোর কোনো খোঁজ খবর নেই। কি করছিলি ঐ মেয়ের সাথে একঘন্টা ধরে।

বেলির চিৎকার শুনে লিখন কান্না শুরু করে দিলো। পাশের রুম থেকে কুলসুম বেগম বলতে লাগলেন,
– চিৎকার করতেছো কেন তোমরা। ঝগড়া কইরো না। নামাজটা পড়তে দিলা না ঠিক করে।
বেলি আরও কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি সুখন বেলির মুখ চেপে ধরলো৷ বললো,
– আস্তে কথা বলো। পাশের ফ্ল্যাটের মানুষ শুনবে।
বেলি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আগের চেয়েও দুগুণ জোরে চেচিয়ে বললো,

– শুনুক। শুনার জন্যই বলছি। তুই দুইটা বিয়ে করতে পারলে আমি বলতে পারবো না কেন?
সুখন এইবার রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলো বেলি গালে। বেলি দেয়াল আঁকড়ে শরীরের ব্যালান্স রাখলো।
বেলি আবারও চিৎকার করতে গেলে সুখন এগিয়ে আসে।

এসো বৃষ্টি হয়ে পর্ব ৩