এ তুমি কেমন তুমি পর্ব ৮

এ তুমি কেমন তুমি পর্ব ৮
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

ফারহান রুমে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালো। চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো। সকালে সে রুমটা যথেষ্ট এলোমেলো করেছিল একটা দরকারী ফাইল খুঁজতে গিয়ে। হাতে সময় না থাকায় গুছিয়ে যেতে পারেনি। ছোটবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করে ফারহান, তাই তার রুমে অন্যকেউ প্রয়োজন ছাড়া আসে না। ফারহান না থাকলে তো আরও আসে না। তাহলে রুমটা গোছালো কে? মা অথবা ভাবি করেছে ভেবে আর চিন্তা করলো না। কাবার্ড খোলে টাওজার আর টিশার্ট নিয়ে টাওয়েল খুঁজতে লাগলো। বেলকনি থেকে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাওয়ার শেষে টাওয়েল হাতে নিতেই তাতে লিপস্টিকের দাগ দেখে থমকে গেলো।

চিৎকার করেই বলে উঠলো, “হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস?”
কোনো রকমে চেঞ্জ করে টাওয়েল আর পোশাক লন্ড্রি ঝুড়িতে রেখে দিলো। সে বুঝতে পারছে না তার টাওয়েলে লিপস্টিকের দাগ এলো কোথা থেকে। চিন্তা করতে করতে কাবার্ড থেকে নিউ টাওয়েল বের করে মাথা মুছতে লাগলো। ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় চোখ পড়তেই হাত থেমে গেলো। একটা চিরকুট লাগিয়ে রাখা। ফারহান হাত বাড়িয়ে চিরকুট হাতে নিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার গুছানো ফারহান ভাইয়াটাকেই পছন্দ।এমন এলোমেলো তাকে মানায় না। দুই বছর আগে ডায়েরিটা পেয়ে ভেবেছিলাম আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। তাই ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। তবে সেদিন যখন জানতে পারলাম তেমন কিছুই নয়। কয়েকটা দিন শুধু ভেবেছি কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। কিন্তু যখন সত্যি সেই স্বপ্নের সন্ধ্যাটা এলো, আমি বুঝে গেছি তুমি শুধু আমার। বাকিটা বিয়ের পরের জন্য তোলা রইলো।”
চিরকুট পড়ে ফারহানের বুঝতে অসুবিধা হলো না রুমে লিজা এসেছিলো।

ফারহানের অসহ্য লাগলো চিরকুটের কথাগুলো। হাতের মুঠোয় মুচড়ে ফেললো চিরকুট তারপর রুমের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। ফারহান বসে পড়লো বেডে। গত দু’টো দিন সে কীভাবে পার করেছে একমাত্র সে জানে। অনু এত অসুস্থ সেটা জানার পরও সে যেতে পারেনি নিজের সাথে যুদ্ধ করে। ফারহানের সাহস হচ্ছে না অনুর মুখোমুখি হওয়ার।

শুধু মনে হচ্ছে অনুর দিকে তাকালে অনুর গভীর কালো চোখ দু’টো তাকে দেখে বিদ্রুপ হাসবে আর বলবে যাকে ভালো না বাসো তার জন্য কীসের এত অস্থিরতা? অনুকে সে ভালোবাসে না এটা প্রমাণ করার জন্য সে যায়নি অনুকে দেখতে। পালিয়ে বেরিয়েছে অনুর থেকে, নিজের থেকে। হাতে থাকা অনামিকা আঙ্গুলের রিংটা তার কাছে মনে হচ্ছিল গলার ফাঁসি। সেটা খোলে ফেলে রেখেছে কাবার্ডের এক কোণে। ভাগ্যিস লিজা কাবার্ড খুলেনি। ফারহান কী করবে বুঝতে পারছে না? নিজের সাথে যুদ্ধ করে সে ক্লান্ত। সারাদিন অফিসে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলেও রাতটা তাকে অস্থির করে তুলে।

তোমার সাথে আমার একটু কথা ছিল?
তানভীরের গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম পারাচ্ছিল তামান্না। ইরফানের কথায় হাত থেমে গেলো।
পুনরায় তানভীরের গায়ে হাত বুলাতে লাগলো, “কী কথা বলো?”
এখানে ন, যদি একটু ছাদে যেতে?
তামান্না তাকালো ইরফানের দিকে, “এত রাতে ছাদে কেনো যাবো? সারাদিন কাজ করে আমি ক্লান্ত, এখন ঘুমাবো। যা বলার এখানেই বলো।”

ইরফান অধৈর্য হয়ে গেলো, “সারাদিন কাজ আমিও করেছি। আমাকে নিশ্চয়ই অফিসে বসিয়ে রাখা হয়নি? আমি চাইছি আমাদের সম্পর্কটা ঠিক করতে কিন্তু তুমি?”
ইরফানের কথা শুনে তামান্না কিছু সময় তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলো ইরফানের চোখ কিন্তু ব্যর্থ হলো।

তামান্না তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, “কাঠের তৈরি ফার্নিচারগুলো অনেক সময় উপর থেকে দেখা যায় কত সুন্দর। কিন্তু ঘুনে ধরে ভেতরটা ঝাঁজরা হয়ে গেছে সেটা কেউ দেখতে পায় না। যে সম্পর্কটা ভেতর থেকে মরে গেছে সেটাও ঠিক করা যায় না। যে ইরফানের চোখে তামান্নার জন্য মুগ্ধতা দেখতে পেতাম, ভালোবাসা দেখতে পেতাম। সেই চোখে আজ কেবল দায়িত্বশীলতা, দায়বদ্ধতা।
ইরফান তামান্নার হাত ধরে টান দিয়ে সোজা করে বসালো নিজের সামনে।

হাতটা শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রাখলো, ” অপর জনের চোখের ভাষা বোঝার জন্যও সামনের চোখ দুটোতে ভালোবাসা থাকা লাগে। অভিমান আর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে কী আর ভালোবাসা দেখা যায়?
তামান্না নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, “হাতে লাগছে আমার।”

ইরফান হাত ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। তামান্না ভেজা চোখে ইরফানের চলে যাওয়া দেখলো কেবল।
তারপর বললো, “আমাদের ভালোবাসায় কী কোনো খাঁদ থেকে গিয়েছিল ইরফান? তবে আজ এমন কেনো হলো? একটা সময় দূরে থেকেও দু’জনে ছিলাম একে অপরের নিশ্বাসে মিশে। আর আজ একই ছাদের নিচে, একই রুমে থেকেও আমরা যোজন যোজন দূরে।”

অনু পড়ার টেবিলে বসে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। কোনোদিকে তাকানোর সময়ও নেই যেনো। তখনই রুমে এলো লিজা।
আপু আসবো?
লিজাকে দেখে অনু বললো, “হ্যাঁ আয়। কিছু বলবি?”
লিজা বেডে বসে বললো, “তোমাকে কিছু দেখানোর ছিল।”
কী দেখাবি তাড়াতাড়ি দেখা, আমার অনেক পড়া বাকি।

লিজা ফোনে বেশ কয়েকটা লেহেঙ্গার ডিজাইন দেখালো অনুকে, “দেখো তো আপু কোনটা ভালো?”
মলিন হাসলো অনু, “এই বাড়িতে সবচাইতে বাজে চয়েস নাকি আমার। আর সেখানে তুই আমাকে ডিজাইন জিজ্ঞেস করছিস?”
আমি তো যেটা দেখছি সেটাই ভালো লাগছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। মাকে দেখালাম সে বললো আমাকেই পছন্দ করতে।
অনু তাকালো লিজার মুখের দিকে। খুশী যেনো উপচে পড়ছে এই মুখে। মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা লেহেঙ্গার ডিজাইন দেখছে।

আসলে আপু, আমি ভাবছি কী বিয়েতে আমি সাদা লেহেঙ্গা পরবো। ফারহান ভাইয়ার তো প্রিয় রং সাদা। কিন্তু বিয়েতে সাদা পরলে কেমন লাগবে বুঝতে পারছি না।
তুই যেটা পরবি তাতেই সুন্দর লাগবে।
সত্যি বলছো?
হুম, সত্যি বলছি। আচ্ছা লিজা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
লিজা তাকালো অনুর দিকে, “পারমিশন নেওয়ার কী হলো? যা ইচ্ছে প্রশ্ন করতে পারো।”
বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তোকে কেমন উদাসীন লেগেছিল আমার কাছে। কিন্তু এনগেজমেন্টের দিন থেকে মনে হচ্ছে বিয়েতে তুই সত্যি খুব খুশী।

লিজা মুচকি হাসলো অনুর কথা শুনে। তারপর নিজের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা খোলে বললো। ফারহানের ডায়েরি থেকে শুরু করে সবটা বললো।
ফারহান ভাইয়ার প্রতি আমার একটা ভুল ধারণা ছিলো তাই মনে হয়েছিল ভাইয়া বিয়েটা ইচ্ছে করে করছে না। তারপর ভাইয়ার থেকে সবটা শুনে চিন্তা ভাবনার পর নিজের ভুল বুঝতে পারি। তার জীবনে অন্য কেউ থাকলে সে নিশ্চয়ই তাঁকেই বিয়ে করতো? আচ্ছা আপু তুমি পড়ো আমি তোমাকে বিরক্ত করছি না আর।

লিজা চলে গেলে অনু পড়ার বইটা বন্ধ করে ফেললো। বেলকনিতে চলে গেলো। বেলকনির একটা টবে বেলি ফুলের চারা লাগানো আছে। সেটায় ফুল হয়েছে, তার গন্ধ ম-ম করছে চারপাশ।
অনু গাছটার সামনে ফ্লোরে বসে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো, “ফারহান ভাইয়ার সেই আবেগ কিংবা ভালোবাসা সেটা হয়তো তুই নিজেই লিজা। তাই এত সহজে রাজি হয়ে গেছে বিয়েতে, হয়তো দু’জনের আড়ালে দু’জনেই একে অপরকে ভালোবাসিস।”

অনু অনেকটা সময় সেখানেই বসে রইলো। এভাবে চলতে থাকলে সে এবারও ভালো রেজাল্ট করতে পারবে না। অনু চোখের পানি মুছে নিলো। পুনরায় রুমে এসে পড়ায় মনোযোগ দিলো।
১৪.
কী রে তানিশা কারো বিয়ের কথা শুনলে তো একমাস আগে থেকেই তোর শপিং শুরু হয়ে যায়। এবার শপিংয়ের নাম নিচ্ছিস না কোনো?

তানিশা নিজের ফোনে ব্যস্ত থেকে বললো, “অনেক ড্রেস আছে। এবার আর নতুন করে শপিং করবো না।”
মোমেনা যেনো আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে পরলো, “তুই বলছিস তোর ড্রেস আছে। মা আয়াত দেখ তো রাতের বেলা চাঁদ না উঠে সূর্য উঠলো নাকি।”
তানিশা বিরক্ত গলায় বললো, “বাজে কথা বলো না মা। তোমার শপিং করার হলে করো না গিয়ে।”
মোমেনা চিন্তিত গলায় বললো, “তোর কী হয়েছে মা?”
আমার আবার কী হবে? আমি একদম ঠিক আছি।

তোকে আমার একদম ঠিক লাগছে না তানিশা।
তানিশা রেগে গেলো এবার, ” কেনো ঠিক লাগছে না শুনি। আমার কী দু’টো শিং হয়েছে মাথায়? নাকি একস্ট্রা হাত পা গজিয়েছে?”

এ তুমি কেমন তুমি পর্ব ৭

তানিশা ড্রয়িংরুমের সোফা থেকে উঠে হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। মোমেনা কেবল গোল গোল চোখে মেয়ের কর্মকান্ড দেখে গেলো। মেয়েটাকে সত্যি স্বাভাবিক লাগছে না তার কাছে।

এ তুমি কেমন তুমি পর্ব ৯