এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ৭

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ৭
ইফা আমহৃদ

সূর্যের প্রথম কিরণ নেত্রপল্লবে পতিত হতেই ব্যাঘাত ঘটল নিদ্রার। আড়মোরা ভেঙে উঠে বসলাম। গতরাতের ঘটনা দৃশ্যমান হতেই ধরফরিয়ে উঠলাম। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। সবটা আমার দুঃস্বপ্ন ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। কিট্টি ঘুমিছে আছে। গতরাতে আধ খাওয়া গাজর এখনো পড়ে আছে। তাহলে সেটা আমার স্বপ্ন ছিল না। আমি ওয়াশরুমে গেলাম। চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে দিলাম। বড়োলোক বাড়ি, বড়োলোকি চালচলন।

ড্রাইনিং টেবিলে গিয়ে নিজেই চেয়ার টেনে বসলাম খেতে। পেটে ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে। আশেপাশে না তাকিয়ে পরোটা মুখে দিতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সামনে। দুজন উদিতা বসে আছে সমানে। থমকে গিয়ে ডায়ে-বায়ে দৃষ্টি দিলাম। দুজনকে দুবার করে দেখছি। মুখ থেকে নিচে পড়ল রুটির টুকরো। দৃষ্টি ভ্রম ভেবে চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় তাকালাম। অগ্নি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললেন, “এটা তোমার দৃষ্টিভ্রম নয় ক্যান্ডেল। আমি আর অভ্র যেমন জমজ। উদিতা আর ঊষাও তেমন জমজ। আমি গতকাল রাতে তোমাকে এটার কথাই বলেছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তারমানে গতকাল সবটা সত্যি ছিল, আমার দুঃস্বপ্ন নয়।”
অগ্নি রুটির টুকরো মুখে দিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, তুমি জ্ঞান হারানোর পর মাটিতে শুয়ে পড়েছ। ‘তুমি যা কিপ্টা’ আমি বুঝে উঠতে পারি না, তোমার শরীরের ওজন এত কেন? আলুর বস্তা টানতে টানতে তোমাকে ঘরে রেখে এসেছি।” অগ্নির কথাতে সৌজন্য হাসি দিলাম। সামনে দুটো জগ। একটাতে দুধ, আরেকটাতে জুস। দুধ গ্লাসে ঢালতে ঢালতে অভ্র স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি বিরক্তির সাথে খাচ্ছেন। দুধে চুমুক দিয়ে বললাম, “আপনার বউ যদি জমজ হতো, তাহলে ভালো হতো। আপনার শালিকাকে অগ্নি স্যার বিয়ে করতেন। আপনার মতো অগ্নি স্যারের দুটো জমজ মেয়ে হতো। চারজন দেখতে প্রায় একই ধরনের হতো। কোনটা কার মেয়ে বুঝতেই সময় শেষ হয়ে যেতো।”

“স্টুপিড মার্কা কথা বার্তা। চুপচাপ খান।”
কথা বলতে বলতে আটটা পরোটা খেয়ে ফেললাম, সবজি ভাজি খেয়ে ফেললাম, জগ ভর্তি দুধ আর জুস তাও শেষ। পেটে ক্ষুধা শেষ হচ্ছে না। ঊষা গ্লাসটা সরিয়ে রেখে বলে, “খাবো না বাবাই। দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না।”
অভ্র স্যারের প্লেটে একটা অর্ধ সিদ্ধ ডিম। এক কামড় মুখে নিয়ে বললেন, “চুপচাপ খাও। দুধ না গেলে বড়ো হবে কীভাবে?”

সৌজন্য হাসি দিয়ে বললাম, “কেউ কিছু খেতে না চাইলে জোর করা ঠিক নয়। তাছাড়া বাচ্চাদের তো নয়ই। (ঊষাকে উদ্দেশ্য করে) দাও তোমার গ্লাসটা আমাকে দাও। খাবার নষ্ট করা ঠিক নয়, আমি খেয়ে ফেলি।” বলেই হাত বাড়িয়ে দিলাম। উদিতা তার বাবাইয়ের দিকে তাকালো। অভ্র স্যার ডিমটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “নিন, আমার মেয়েরটা শুধু কেন খাবেন? তার বাবাইয়ের টাও খান।”

“ধন্যবাদ।” বলেই কেড়ে নিয়ে মুখে দিলাম। তৃপ্তিকর ঢেকুর তুললাম। অগ্নি ব্যঙ্গ করে বললেন, “একটা মানুষ এতো খায় কীভাবে? (বিরতি দিয়ে) অভ্র আজকে তুই উদিতা আর ঊষাকে অফিসে নিয়ে যাস। আমাকে গার্মেন্টে যেতে হবে। গত সপ্তাহে এক হাজার পিস পোশাকে ডেলিভারিতে যাবে আজ। তদারকি করতে হবে।”
“আগামীকাল ফ্যাশন শো। ড্রেস ডিজাইনিং ব্যাপার আছে না? আজকে ড্রেস পরে তারা ওয়ার্ক করবে। ফটো তোলা হবে। সেখানে ওদের দুজনকে আমি কীভাবে সামলাবো?” অভ্র স্যার বললেন। বিপরীতে অগ্নি বলেছেন, “ফ্যাশন হাউস ছোটো জায়গা, মাত্র দুতলা। আর আমি যেখানে যাবো সেখানে দশ তলা, লোকসংখ্যা বেশি। হারিয়ে যেতে পারে। তোর মেয়েকে তুই দেখ।”

অভ্র চেয়ার চেয়ে উঠে দাঁড়াল। তেজ নিয়ে বলে, “আমি ওদের বাবা, মা নেই। আমার মেয়েকে তো আমরাই দেখব। তোর তো কিছু হয়না, হলে দেখতি।”
“অভ্র তুই ভুল ভাবছিস।”

অভ্র অগ্নির কথায় কোনো প্রতুত্তর না দিয়ে উদিতা ও ঊষাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তোমরা দুজনে তৈরি হয়ে নাও।”
অতঃপর অভ্র স্যার দুই মেয়েকে নিয়ে নিজ ঘরের দিকে অগ্ৰসর হলেন। অগ্নি আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অভ্র স্যার চোখের আড়াল হতেই অগ্নি বলে উঠে, “দেখেছ, অভ্র শুধু আমার উপর রাগ দেখালো। বড়ো গার্মেন্ট, অচেনা মানুষ‌। হারিয়ে গেলে তখন?”

নীরবতা পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। অভ্র স্যার উদিতা আর ঊষাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই আমি বললাম, “আপনি, উদিতা, ঊষা অফিসে চলে যাবেন অন্যদিকে অগ্নি স্যার নিজেও চলে যাবেন। এবার যদি আমি আপনার বাড়ির সবকিছু চু/রি করে পালিয়ে যাই?”
অভ্র স্যার দু মেয়ের হাত ধরে আছেন। ঊষা অভ্র স্যারের হাত চে/পে ধরে বলে, “সে আমার আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছিল বাবাই।”

“চো/রে চো/রের টাই খায়। ভালো মানুষের টা নয়। তোমার এক বাটি আইসক্রিম না খেয়ে সবগুলো খেলে ভালো হতো।”
ঊষা চুপ করে গেল। ঘাড় কাত করে বললেন, “আপনার দ্বারা তাও সম্ভব। তবে আমি আমার মেয়েদের আপনার কাছে রেখে যেতে পারি না। আমার সম্পদের চেয়ে মেয়েরা আমার প্রিয়। আপনি যদি আমাকে সাহায্য করতে চান। তাহলে আমার সাথে অফিসে আসুন। ওদের একটু সামলাবেন।”
অগ্নি ইশারায় বললেন অভ্র স্যারের সাথে যেতে। কিট্টিকে গাজর দিয়ে পুনরায় ফিরে এলাম। ততক্ষণে অভ্র স্যার দুই মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেছেন‌। গাড়িতে উঠতেই গতিশীল হলো গাড়ি। গন্তব্য ফ্যাশন হাউসে।

মডেলরা নিজেদের মতো ড্রেস পড়ে ওয়ার্ক করছে। জুস খেতে খেতে আমি উদিতা ও ঊষা দেখছি মডেলদের কাজ। মেয়ে দুটো মিশুক প্রকৃতির। অনেক সহজেই আমরা মিশে গেছি একে অপরের সাথে। অভ্র স্যার সামনে দাঁড়িয়ে ফটোগ্রাফারকে ইন্সটাকশন দিচ্ছে কীভাবে ছবি তুলতে হবে। কারণ ফ্যাশন হাউসে আগের ফটোগ্রাফারকে বের করে দিয়েছেন। মডেল দুটো আমাকে ভাব দেখিয়ে মডেলিং করছে। নম্র গলায় বললাম, “স্টেজে যখন আপনি ওয়ার্ক করবেন তখন সবাইকে এক নজরে দেখবেন। হাসবেন। দেখবেন এক নজরেই আপনি সবার মন কেড়ে নিয়েছেন।”

আমার কথাতে মডেল রেগে গেল। তীক্ষ্ণ গলায় বলেন, “আপনি তো একজন আয়া। অভ্র স্যারের মেয়েদের দেখাশোনা করেন। আপনি কী বুঝবেন?”
“আমি ফ্যাশন ডিজাইনার। কোন পোশাকের সাথে কোন ধরণের গেট আপ করতে হয়, একটু হলেও বুঝি।” মৃদু হেসে বললাম। মডেল আমার কথায় রেগে গিয়ে বলেন, “তাহলে এই পোশাক পড়ে দেখান। আপনার পোশাক দেখলে বোঝা যায়, ক্ষত থেকে উঠে এসেছেন। লাইক সরিষা ক্ষত। জনগণ কীভাবে আকর্ষণ করতে হয়, আমি ভালো জানি। জানি বলেই শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউসের এত সুনাম।”

একবার ইচ্ছে করল, পোশাকটি পড়তে। পোশাকটি দেখতেই বেশি অস্বস্তি দায়ক। স্লীভ ল্যাস, পা পর্যন্ত হলেও হাঁটুর একটু উপরে কম করে হলেও চারটা ফাড়া। গলাটাও বেশ চওড়া। আমি কাচুমাচু করে রইলাম। মডেল ভাব প্রকাশ করল। একই ডিজাইনের আরও একটি পোশাক আমার গায়ে ছুড়ে দিয়ে বললেন, “এই শহরে এক নাম্বার মডেল আমি। আমাকে হায়ার করতে সবাই উঠে পড়ে লাগে। চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আমার চেয়ে ভালো মডেল পারলে এনে দেখান।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ৬

পোশাকটা হাত দিয়ে চেপে ধরে রইলাম কিছুক্ষণ। রাগে শরীরটা কাঁপছে। এই ‘শাহরিয়ার ফ্যাশন হাউসের’ কারণেই সে শহরে নাম্বার ওয়ান। ইচ্ছে করছে পোশাকটা পরিধান করে, জবাব দিতে। অভ্র স্যার নিজের আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “আপনাকে আমার মেয়েদের দেখাশোনা করতে এনেছি আর আপনি মডেলের সাথে বিবাদ করছেন। একবার মডেল চলে গেলে আমার কত লস হবে আপনার ধারণা আছে?”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ৮