ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ২৬
সারিকা হোসাইন
নিস্তব্ধ হসপিটালের দামি কেবিন জুড়ে ফিনাইলের উটকো গন্ধের উপস্থিতি বিদ্যমান।জানালার সাদা পাতলা পর্দা গুলো স্থির হয়ে দেয়াল গড়িয়ে সটান হয়ে ঝুলে রয়েছে।নরমাল টেম্পারেচার এ এসি চলছে।দুজন মানুষের অতিরিক্ত আবেগ জড়ানো ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।মিসেস তনুজা রায়াফের বা হাতটা শক্ত করে এখনো ধরে রয়েছেন আর নীরবে কেঁদে বুক ভাষাচ্ছেন।এখন আর তিনি শব্দ করে কাঁদতে পারেন না,সামান্য একটু কাঁদলেই বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করেন।রায়াফ এবার তার চোখের কঠিন শাসনে আটকে রাখা জল গুলোকে ছেড়ে দিলো।মাথা নিচু করে রাখার কারনে রায়াফের উষ্ণ জলরাশি মিসেস তনুজার হাতে উপর পতিত হলো।
“তোর কাছে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা আমি চাইবো না বাবা।তুই বেঁচে আছিস এটাই আমার কাছে অনেক।আমি শুধু চাই যেরকম ভাবেই হোক তুই ভালোভাবে বেঁচে থাক আমাদের সামনে থাক।আর কিছু চাওয়ার নেই রে বাবা”
তনুজার কথা খানা শেষ হবার সাথে সাথেই ছোট অবুঝ শিশু দীর্ঘ সময় ধরে তার মায়ের দেখা না পেয়ে ব্যাকুলতায় কেঁদে যখন বুক ভাষায় আর হঠাৎই মায়ের আগমনে সব ভুলে মাকে জাপ্টে ধরে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে রায়াফ ও ঠিক সেভাবেই তনুজাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
“তোমাদের ছেড়ে এতো গুলো বছর থাকতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে মা।আমি তো মরেই গিয়েছিলাম।দ্বিতীয় বার যে আমার জন্ম হয়েছে গো মা”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মা ছেলের কান্নার দমকে ভারী হলো কেবিন রুম।হঠাৎ রাজ্যের আগমনে হকচকিয়ে উঠলেন তনুজা এবং রাগাফ দুজনেই।
রাজ্য তার হাতের সমস্ত কিছু ফেলে দৌড়ে গিয়ে রায়াফের পিঠ খামচে ধরে কাঁদতে লাগলো।রাজ্যের চোখের জলে রায়াফের পুরো শার্ট ভিজে উঠলো।ঘটনা কি হলো কিছুই বুঝতে পারলো না এনি।শুধু দরজায় দাঁড়িয়ে এতটুকুন বুঝলো
“কারো পার্সোনাল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো মানেই হয় না।ওরা ওদের মতো ভালো থাকুক।আমার উচিত ওদেরকে স্পেস দেয়া।”
এনি সন্তপর্নে দরজা চাপিয়ে দিয়ে লিফট ধরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এলো।এসে একটা টেক্সি ক্যাব ধরে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।।আর মনে মনে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো।
রায়াফের পেট জড়িয়ে ধরে পিঠে মুখ গুজে জোরে জোরে শব্দ করে ক্রমাগত কান্না করে চলেছে রাজ্য।সকাল বেলা যখন সে রায়াফ কে দেখছিলো তখন থেকেই তার মনের মধ্যে খচখচনি শুরু হয়েছিলো।রায়াফ কে দেখার পর থেকে সারাদিন সে কোনো কাজেই মন বসাতে পারেনি।একটা মানুষের শরীরের গঠন থেকে শুরু করে কথা বলার ধরন,চুল আচড়ানোর স্টাইল হুবুহু কখনোই মিলে যাবার কথা নয়।আর তার চাহনি ই যেনো বারবার অন্য কিছু নির্দেশ করছিলো।একজন বিচক্ষণ স্পেশাল ফোর্সের অফিসারের কাছে এসব কিছুই কাকতলীয় মনে হবার প্রশ্নই আসে না।এইজন্যই তো সে মনে মনে ঠিক করেছিলো মিসেস তনুজাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেয়া মাত্র সে এই লোকের পিছনে স্পাই এর মতো লেগে থাকবে।কিন্তু তার মা ঠিক তার সন্তান কে চিনে নিয়েছে।তার দাদা ভাই তাদের সামনে জীবিত অবস্থায় আছে।এর চাইতে সুখের,আনন্দের আর কি হতে পারে?
“আমি জানতাম দাদা ভাই তুমি বেঁচে আছো।এভাবে তুমি আমাদের কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে পারো না।”
আরো অনেক কিছু বলার চেষ্টা করলো রাজ্য।কিন্তু কান্নার দমকে কন্ঠ রোধ হয়ে জিভ জড়িয়ে গেলো।
“তোমাদের কিছু কথা বলার বাকি আছে মা।আমাকে এখন যেতে হবে।নয়তো তোমরা বিপদে পড়ে যাবে”
কঠিন কন্ঠে কথা খানা বলে শক্ত হয়ে বসে রইলো রায়াফ।রায়াফের যাবার কথা শুনেই তনুজা এক হাতে রায়াফের গলা জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে চোখে মুখে মমতার পরশ বুলাতে বুলাতে উন্মাদের ন্যায় কেঁদে কেঁদে বলে উঠলেন
“কতো বছর পর তোকে কাছে পেলাম রে বাবা!আমার হাহাকার করা শূন্য বুকটা কেবলই ভরতে শুরু করেছে আর তুই চলে যাবার কথা বলছিস?এই অসহায় মা কে একা ফেলে কোথায় যেতে চাইছিস বাবা?এভাবে আমাকে ফেলে যদি তুই চলে যাস তাহলে আমি কিভাবে বাঁচবো বল?
“দাদা ভাই কেনো যাবে তুমি?আমাদের ফেলে কোত্থাও যেতে পারবে না তুমি।আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না।”
রাজ্যের পানে তাকিয়ে মুচকি হাসলো রায়াফ।এরপর রাজ্যের নরম তুলতুলে গাল টেনে ধরে কিছুটা মেপে হেসে বলে উঠলো
“পুচকি টা অনেক বড় হয়ে গেছে দেখছি!আমাকে শাসনের স্বরে কথা বলে হুম?
রায়াফের এমন হেঁয়ালি কথায় কোনো কান দিলো না রাজ্য।সে তার কথায় অনড়।দুনিয়া দু ভাগ হয়ে গেলেও সে আজ তার দাদা ভাইকে এখান থেকে এক পা ও যেতে দিবে না।
রাজ্য তার চোখের জল গুলো মুছে সিক্ত কন্ঠে আহত স্বরে বলে উঠলো
“বাড়ি ফিরে চলো দাদা ভাই।তোমাকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো নেই।মা মৃত্যু পথযাত্রী,আমার জীবনটাও ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে আর বাবা?
“কি হয়েছে বাবার?
উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে হসপিটালের বেড ছেড়ে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে কথা খানা শুধালো রায়াফ।
রাজ্য হসপিটালের বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পদে রায়াফের সামনে এসে দাড়ালো।এরপর রায়াফের চোখে চোখ রেখে কাতর কন্ঠে বলে উঠলো
“বাবা আর আগের মতো নরম মনের মানুষ টি নেই দাদা ভাই।উনি হুটহাট রেগে যান,সকলের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেন,আর চুপি চুপি কাঁদেন।আমাদের সাথে ঠিক ঠাক কথা পর্যন্ত বলেন না।বাবা দিন দিন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে দাদা ভাই।”
রাজ্যের মুখে নিজ বাবা সম্পর্কে এমন কথা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে যেনো ভীষণ কষ্ট হলো রায়াফের।রাজ্যের কাছ থেকে শোনা কথা আর নিজ চোখে নিজের বাবাকে দেখা দুটোই যেনো রাত দিনের ফারাক মনে হলো তার কাছে।
একজন হাসিখুশি সহজ সরল শান্ত মেজাজের মানুষের হঠাৎ এমন পরিবর্তন যেনো তার কাছে চূড়ান্ত অবিশ্বাস্য।নিজের পরিবারের এমন ভঙ্গুর রূপ দেখে কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে চকচকে সাদা টাইলসের মেঝেতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রায়াফ।এরপর অপরাধীর কন্ঠে বললো
আমাকে যেতে দে রাজ্য।নয়তো আমাকে আবার হারিয়ে ফেলবি।এখন আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করে বিভ্রান্ত করিস না।সময় এলে আমি নিজেই সব কিছু খোলে বলবো ”
রায়াফের চোখের ভাষা পড়তে বেশি সময় লাগলো না রাজ্যের।অবিশ্বাসের চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নীরবে অশ্রু ফেলে গেলো শুধু।
কিন্তু মিসেস তনুজা ছেলেকে ছাড়তে নারাজ।এক পর্যায়ে তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন।রায়াফ কে কাকুতি মিনতি করে বলে উঠলেন
“বাবারে একটা রাত মায়ের পাশে থাক না!একটা রাত তোকে দুই নয়ন ভরে আমাকে দেখতে দে।এরপর না হয় যাস”
মায়ের এমন পাগলামিতে দুই চোখ ফেটে জলের আনাগোনা হলো রায়াফের কপোল বেয়ে।অতঃপর রাজ্যকে চোখের ইশারা করতেই রাজ্যের ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো।দুই হাতে নিজের চোখের জল মুছে উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলো
“মাকে বাড়িতে নেবার সকল ব্যাবস্থা আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি দাদা ভাই”
নিজের ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে নিয়ে কেবিন থেকে এক প্রকার দৌড়েই বেরিয়ে গেলো রাজ্য।উদ্দেশ্য একটাই মিসেস তনুজার রিলিজ নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফেরা।
রাজ্যের কক্ষে ঘন্টা খানেক সময় ধরে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে যুবরাজ।রাত প্রায় দেড়টা বাজতে চললো অথচ মেয়েটির কক্ষে আসার নাম গন্ধ নেই।এবার যেনো যুবরাজের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো।চারপাশে নজর বুলিয়ে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে শয়তানি হাসলো যুবরাজ
“আজ রাতে আমাকে এভাবে অপেক্ষা করানোর উচিত শিক্ষা দেবো তোমাকে আমি শ্রেয়সী!”
ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত দুটো ছুই ছুঁই এমন সময়ে ক্লান্ত শরীরে কক্ষে প্রবেশ করলো রাজ্য।সুইচ টিপে কক্ষ আলোকিত করতেই নিজের অগোছালো কক্ষটাকে হঠাৎ গুছালো দেখে বেশ অবাক হলো সে। পুরো কক্ষ পরিপাটি করে সাজানো গুছানো।বিছানার চাদর পর্যন্ত টানটান করে পাড়া হয়েছে।কোথাও যেনো একটা ধূলিকনার অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই।
অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তাড়াতাড়ি কক্ষের দরজা আটকে দিয়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলালো রাজ্য।পুরো কক্ষ জুড়ে কারো কোনো অস্তিত্ব নেই।নিজের গায়ের পোশাক টেনে টুনে ঠিক করে বেলকনি তে নজর দিতেই অন্ধকার চিড়ে সিগারেট এর জলন্ত স্ফুলিঙ্গ নজরে এলো।মুহূর্তেই মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে জানান দিলো মানুষ টি কে হতে পারে।
ঠোঁটে প্রস্তুত হাসি ঝুলিয়ে নিজের একান্ত ব্যাক্তি গত পুরুষটির সামনে এসে দাড়ালো রাজ্য।
রাজ্যের উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেট পায়ে পিষে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো যুবরাজ।এরপর মেকি রাগ দেখিয়ে শুধালো
“ভাইকে পেয়ে জামাই ভুলে গেলে বুঝি”
যুবরাজের মুখে রায়াফ সম্পর্কে এমন কথা শুনে কেঁপে উঠলো রাজ্য।এক মুহূর্তের জন্য যুবরাজকেও তার অবিশ্বাস হতে লাগলো।তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো
“কিসের ভাই কার ভাই?কার কথা বলছো তুমি?
যুবরাজ স্মিত হেসে রাজ্যের থুতনি চেপে ধরে রসিকতা করে এক ভ্রু উঁচিয়ে চোখ টিপে বলে উঠলো
“ডক্টর রেহান চৌধুরী তোমার দাদা ভাই তাই না?
ভয়ে রাজ্যের কান্না পেয়ে গেলো নিমিষেই।এই মুহূর্তে যুবরাজকে তার মোটেও সুবিধার ঠেকছে না।
“যুবরাজ এই ভাবে কথা বলছে কেনো?তবে কি দাদা ভাইয়ের গুম হবার পেছনে ওর কোনো হাত আছে?
রাজ্যের মুখের ঘনঘন পরিবর্তনে ফিক করে হেসে দিয়ে শক্ত কন্ঠে যুবরাজ বলে উঠলো
“ঠিকই ধরেছো ,তোমার ভাইকে এতোগুলো বছর আমি ই গুম করে রেখেছিলাম,এবার তোমাকেও গুম করবো” রেহনুমা রাবাব রাজ্য”
কথাটি বলেই হো হো শব্দ তুলে হাসতে লাগলো যুবরাজ।
যুবরাজের এমন হাসিতে রাজ্যের বড় বড় নেত্র বেয়ে ভারী বর্ষনের সৃষ্টি হলো।মনে নানা কুচিন্তা এসে ধরা দিলো।
“তবে কি ভুল মানুষে মন বিনিময় হলো?দাদা ভাইকে কি আবার হারিয়ে ফেলবো আমরা?এবার কে বাঁচাবে আমার পরিবারকে?
যুবরাজ তার উষ্ণ হাতের আঙ্গুলির স্পর্শে রাজ্যের চোখের জল মুছিয়ে কপালে ঠোঁটের উষ্ণ পরশ একে বলে উঠলো
“এতোটাই অবিশ্বাস যখন, তখন আমাকে ভালোবাসলে কেনো জান?”
যুবরাজের কন্ঠে এমন আহত স্বর শুনে মুখ তুলে যুবরাজের মুখপানে তাকালো রাজ্য।এরপর তার চোখে চোখ রেখে সত্যি উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলো সে।কিন্তু ওই বাদামি রঙা গভীর চোখের বিষাদে রহস্য উদ্ঘাটনের পরিবর্তে নিজেই বিষদিনী হলো।
সহসাই যুবরাজের পায়ের উপর পা রেখে উঁচু হয়ে গলা জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো রাজ্য।রাজ্যের সম্মোহনী স্পর্শে যুবরাজের সর্বাঙ্গ ভূমি কম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো সাথে দূর হলো সকল অভিমান।পায়ের রক্ত মাথায় ছলকে উঠে উত্তপ্ত শরীররে নিষিদ্ধ বাসনার জন্ম নিলো।নিজেকে সংযত করতে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দুই চোখ বুজে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো যুবরাজ।
ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ২৫
যুবরাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে রাজ্য বলে উঠলো
“আপনাকে চিনতে বড্ড দেরি হয়ে গেলো ডক্টর ইউভি”