ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩৩
সারিকা হোসাইন
পুরোটা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার করে রেখেছে।মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে থালার মতো বড় রুপালি চাঁদটা আলো বিলিয়ে দেবার চূড়ান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে।কিন্তু মেঘ এসে পুনরায় তাকে গ্রাস করে সকল আলো গিলে ফেলছে নিমিষে।হঠাৎই শুরু হলো এলোমেলো ভারী বাতাস সেই সাথে বিকট শব্দে বজ্র ধ্বনি।বাতাসের প্রকোপে গহীন জঙ্গলের গাছপালা গুলো মরমর শব্দে গা ছমছমে এক অনুভূতি তৈরি করলো।সেই বাতাসের তান্ডবে গাছের ডালে থাকা নিশাচর প্রাণী গুলো সামান্য নড়েচড়ে উঠলো।এবং চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে ভয়ঙ্কর শব্দ করতে করতে ঝাঁকে ঝাঁকে শিকার খুঁজতে কালো ডানা মেলে নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটে চললো।
এমন ভয়ঙ্কর উগ্র অবহাওয়াতে পরিত্যক্ত বাড়িটির সামনে নিজের ব্র্যান্ডেড গড়ির সাথে হেলান দিয়ে দুই পায়ে ক্রস স্টাইলে দাঁড়িয়ে সমানে বিড়ি ফুকে চলেছে যুবরাজ।মুখে তার ক্রুর হাসি সেই সাথে ভয়ঙ্কর শিকারি দৃষ্টি।কিছুসময় এভাবেই অতিবাহিত হবার পর সিগারেট এর ফিল্টার পায়ে পিষে আঙুলের ডগায় চাবির ছড়া টিকে ঘুরাতে ঘুরাতে শীষ বাজিয়ে বাড়ির অভিমুখে পা ফেলতে লাগলো।বিকট ঘরঘর শব্দে লোহার ভারী দরজার পাল্লা খানা সরিয়ে সন্তপর্নে পুনরায় দরজার পাল্লা ঠেলে মোবাইলের টর্চ জেলে স্যাৎস্যাতে সিঁড়ি বেয়ে ঠক ঠক শব্দে উপরে উঠতে লাগলো যুবরাজ।চাবির সহায়তায় বড় বড় তালা খুলে নিজের বানানো হেল সেল এ প্রবেশ করলো সে।পকেট থেকে লাইটার বের করে দেয়ালে সেটে রাখা মশালে আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে দৃষ্টি বুলালো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মুখে তার পরিতৃপ্তির হাসি।
উটকো দুর্গন্ধযুক্ত কক্ষ মশালের আলোয় আলোকিত হতেই যুবরাজের মুখের হাসি প্রশস্ত হতে লাগলো।
সকল নিস্তব্ধতা ভেঙে হো হো শব্দ তুলে পাগলের ন্যায় সহসাই হাসতে লাগলো যুবরাজ।এরপর বহু কষ্টে নিজের সেই হাসি বন্ধ করে গলার সর্বোচ্চ তেজ ঢেলে ডেকে উঠলো
“মাই ডিয়ার ফেঈদফুল ডগি স্মিথ,কাম টু মি”
যুবরাজের কন্ঠ কর্ণপাত হতেই সাইবেরিয়ান হাসকি দৌড়ে যুবরাজের সামনে এসে দাড়ালো।কুকুরটি কে দেখে যুবরাজের চোখ চকচক করে উঠলো।
হাটু মুড়ে বসে কুকুরটির মাথায় পরম যত্নে হাত বুলালো যুবরাজ।
কুকুরটির সারা গায়ে রক্তের মাখামাখি, মুখে তার তরতাজা র*ক্ত যুক্ত মানুষের মাংসল হাতের টুকরো।
কুকুরটির হিংস্র সবুজ চোখে যুবরাজ তার গাঢ় বাদামি দৃষ্টি পাতলো।এরপর মিনিট দুয়েক অতিবাহিত হতেই খিলখিলিয়ে দম বন্ধকর হেসে উঠলো যুবরাজ ।
“গুড জব ডিয়ার স্মিথ গুড জব”
হাসির তাড়নায় কথাই বলতে পারছে না যুবরাজ।এতো আনন্দ আগে কখনোই লাগেনি তার তবে আজ কেনো এতো আনন্দ হচ্ছে?শিকারকে জালে বন্দি করার আনন্দ বুঝি এতটাই সুখ কর?
মশালের কেরোসিন প্রায় শেষের পথে।তাই আলো টাও নিভু নিভু।সেই ঝাপসা ঘোলাটে হলদেটে আলোয় যুবরাজের হেল সেল এর বিভৎস অবস্থা স্পষ্ট দৃশ্যমান।
সেখানে সকল কয়েদির টুকরো টুকরো ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীরের অংশ হুটোপুটি খাচ্ছে নোংরা মেঝেতে।কয়েদিদের কারো চোখ উপরে ফেলা হয়েছে তো কারো হাত ছিড়ে নেয়া হয়েছে।কারো বা আবার মুখের অবয়ব থেতলে দেয়া হয়েছে।টেনে টেনে ছেড়া হয়েছে ঠোট এবং পা।
নয়নাভিরাম সেই দৃশ্য পুনরায় নজরবন্দি করে নিজের সিংহাসনে গিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসলো যুবরাজ।
“তোমাকে এই পর্যন্ত আনতে বহুত কাঠখড় পোড়াতে হলো মামাতো ভাই,বহুত।তোমার গড়া পাপের সাম্রাজ্য তোমাকে দিয়েই শেষ করলাম।তোমার পালানোর পথ পর্যন্ত সুগম করে দিলাম কিন্তু ব্রেইনলেস তুমি বুঝতেই পারলে না।বড় মামা বড্ড বোকা।সারাদিন খুন খারাবীর ট্রেনিং না দিয়ে তোমাকে একটু কমপ্লেইন খাওয়ালে তার কি খুব লস হতো?
কথা গুলো উঁচু স্বরে বলতে বলতে আবারও কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো যুবরাজ।এরপর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মুখে হিংস্রতা এনে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
“তোকে তোর ছেলেকে দিয়েই আমি শেষ করাবো সুবহান শেখ,এরপর তোর পাগল ছেলের তদবির করবো।আমাকে বরফ পানিতে চুবিয়ে মা*রার প্ল্যানিং টা তোর ই ছিলো নাই না?কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মজাই বেশ আলাদা।
কথা গুলো শেষ করে উঠে দাঁড়ালো যুবরাজ,এরপর সাইবেরিয়ান হাসকির নেক বেল্ট ধরে টেনে নিয়ে বাড়িটির বাইরে বেরিয়ে এলো।বাইরে বেরিয়েই কুকুরটি ভয়ানক স্বরে ডেকে উঠলো।সেই স্বরে ভয়ার্ত হয়ে গাছের ডালে বসে থাকা হুতুম পেঁচা পর্যন্ত ডানা ঝাপটিয়ে দূরে উড়ে পালালো।
যুবরাজ তার গাড়ি থেকে বড় বড় দুটো কেরোসিন এর গেলন নিয়ে বাড়িটির দিকে অগ্রসর হলো।এরপর সুনিপুণ ভাবে সেগুলো ঘরের ভেতর ছড়িয়ে দিয়ে পকেট থেকে লাইটার বের করে অভিনব কায়দায় আঙুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আগুন জ্বালিয়ে লাইটার ছুড়ে মারলো মেঝেতে গড়িয়ে যাওয়া কেরোসিন এর উপর ।মুহূর্তেই আগুনের লকলকে লেলিহান শিখা কেরোসিন এর উপর প্রভাব বিস্তার করে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।
যুবরাজ আয়েশী ভঙ্গিতে গাড়িতে হেলান দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কুকুরটিকে সাথে নিয়ে মচ মচ শব্দে বাড়িটির দগ্ধ অবস্থা উপভোগ করতে লাগলো।কিছুক্ষন পরেই যখন মানুষ পোড়ার গন্ধে পুরো জঙ্গল আলোড়িত হলো ঠিক সেই মুহূর্তে কুকুরটি উন্মাদের ন্যায় ছোটাছুটি করতে লাগলো সে সাথে ভয়ংকর শব্দে ডাকতে লাগলো।কুকুরের ছটফটানি দেখে যুবরাজের হাসি যেনো আর ধরে না।কুকুরটির নেক বেল্ট শক্ত হাতে খামচে ধরে যুবরাজ হিসহিসিয়ে বলে উঠলো
“এখানে থাকা ঠিক হবে না আমাদের,চল আমার সাথে।এখানে বাতাসে লাশের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।এই গন্ধ তোর আর আমার দুজনের জন্যই ক্ষতিকর।এই গন্ধ তোকে ক্ষুধার্ত করে তুলছে আর আমাকে শিকার খুঁজতে পাগল করে তুলছে”
রেজোয়ান চৌধুরীর সামনে সোফার উপর দুই পা তুলে বাবু হয়ে বসে আছে রায়াফ।সমানে সে আঙ্গুল কামড়ে চলেছে আর রেজোয়ান চৌধুরীর দিকে অপরাধীর দৃষ্টি দিচ্ছে।এভাবেই কিছু সময় পেরিয়ে যাবার পর রেজোয়ান চৌধুরী শুধালেন
“গোপনেও কি একটি বার তোমার বেঁচে থাকার খবর আমাদের পৌঁছাতে পারলে না?তোমাকে হারিয়ে কি অবস্থায় আমরা দিন যাপন করছি সেটাও জানার চেষ্টা করলে না?
“আহ ছেলেটাকে এভাবে বকছো কেনো?জানায়নি মানে অবশ্যই কোনো কারণ ছিলো তাই না?সকাল সকাল তাকে সামনে বসিয়ে জেরা জেরা না করলে তোমার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না নাকি?
কঠিন কন্ঠে কথা গুলো বলে মিসেস তনুজা রায়াফের সামনে জুসের গ্লাস মেলে ধরলেন।
“নে বাবা জুস খা,তোর বাবার মাথা দিনে দিনে একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছে।ওসব কথা কানে তুলিস না!
“বাবা প্লিজ দাদা ভাইকে এতো জেরা করোনা।সময় সুযোগ বুঝে সব জানা যাবে।দাদাভাই ভালো আছে সুস্থ আছে এই অনেক।এতো প্রশ্ন করে সবকিছু ঘোলা করার কি দরকার বলো?”
সকালের নাস্তা চিবুতে চিবুতে কথাটি বলে রাজ্য পুনরায় খাবারে মনোযোগ দিল।
জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে রায়াফ এক চুমুক খেয়ে চোখ বন্ধ করে পুনরায় খোলে রেজোয়ান চৌধুরীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।এরপর ধীর কন্ঠে বলতে লাগলো
“আমি একজনের ব্যাক্তিগত লাইফে ঢুকে পড়েছিলাম বাবা।আর ঢুকে পড়ার জন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই।আজকে তার জন্যই আমি তোমাদের সামনে।ডক্টর ইউভি না থাকলে তোমরা তোমাদের ছেলের মৃ*ত্যুর খবর পর্যন্ত পেতে না!সামনে থেকে দেখা তো দূর।সময় এলে আমি নিজেই সব খোলাসা করবো।আজ আমাকে যেতে হবে।মাঝেমধ্যে আমি এসে দেখা করে যাবো।অনুরোধ থাকবে কারো কাছে আমার বেঁচে থাকার কথা প্রকাশ করবে না প্লিজ।
“নিজের সন্তানকে নিজের বাড়িতে রাখতে পারবো না,কারো কাছে তার বেঁচে থাকার কথা শেয়ার করতে পারবো না এ কেমন রীতি?তুমি কি কোথাও কোনো অন্যায়ের সাথে জড়িত রেহান?
বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথাটি বলে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন রেজোয়ান চৌধুরী।
রায়াফ বসা থেকে উঠে ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলে উঠলো
“আমি জেনে বুঝে কখনো কোনো অন্যায় করিনি বাবা।আমি আমার আগে তোমাদের সেফটির কথা চিন্তা করছি।কারন তোমার বন্ধু সুবহান শেখের একমাত্র ছেলে আমাকে পৃথিবীর সব চাইতে কঠিন শাস্তিতে খু*ন করতে চেয়েছিলো বাবা!
রায়াফের মুখের এমন ভয়ংকর কথায় রেজোয়ান চৌধুরী বিস্ফারিত নয়নে রায়াফের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেই সাথে রাজ্য আর তনুজা থরথর করে কেঁপে উঠল।
খাওয়া থামিয়ে রাজ্য টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো
“কিহ”!
“এসব তুই কি বলছিস বাবা?তোর বাবা তো আরো ওই ছেলের সাথে রাজ্যের বিয়ের কথা ভাবছে”
“আমি সব জানি মা।সে একটা সাইকো ক্রিমিনাল, সে রাজ্যকে বিয়ে করে কখনো সুখের সংসার পাতবে না।রাজ্যকে চূড়ান্ত শাস্তি দিয়ে দিয়ে সে সুখ উপভোগ করবে।কারন মানুষের আহাজারি আর কান্নায় তার সুখ লুকায়িত।সে মানসিক ভাবে অসুস্থ”
“তোমাকে আমি বলেছিলাম না মা ?ওই লোকের চোখের চাহনি বড্ড অদ্ভুত?কিছুতো একটা অবশ্যই আছে।কিন্তু সেটা কি?আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
সকলের কথা বলার মাঝামাঝি সময়ে কলিং বেল বেজে উঠলো বিকট শব্দে।সেই শব্দে ভীত হয়ে রায়াফকে খামচে ধরলেন তনুজা।এরপর চোখ চাওয়া চাওয়ি করে নিজের অসাড় হয়ে আসা শরীরকে কোনোমতে টেনে হিচড়ে দরজার সামনে এসে দাড়ালেন তনুজা।কম্পনরত হাতে দরজা খুলে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
“কে এসেছে তনু?
মাঝবয়সী রেজোয়ান প্রশ্নখানি করে আগত ব্যাক্তির চেহারা দেখতে দরজায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।কিন্তু তনুজার পক্ষ থেকে কোনো উত্তর এলো না।
তনুজা কে পাশ কাটিয়ে হাস্যজল মুখে লম্বা লম্বা পা ফেলে প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে রেজোয়ান চৌধুরীর সামনে এসে দাড়ালো আগত ব্যাক্তি।
“আমি আংকেল,আপনার মেয়ের হবু জামাই ডক্টর শেরহাম ফাইয়াজ”
শেরহামকে দেখে বাড়ির প্রত্যেক সদস্য আতঙ্কে ভর শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।প্রত্যেকের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে শেরহাম বলে উঠলো
“আমি কি ভুল টাইমে এসে আপনাদের বিরক্ত করলাম?
কারো পক্ষ থেকে যখন কোনো উত্তর এলো না তখন শেরহামের নজর গেলো রায়াফের দিকে।
রায়াফকে দেখে তার চিনতে একটুও বেগ পোহাতে হলো না।রায়াফকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুখে মায়াবী হাসি ঝুলিয়ে শেরহাম নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো
ওয়েলকাম টু মাই ডার্কসাইড পর্ব ৩২
“হেই ডুড অনেক দিন পর দেখা,সেই যে এয়ারপোর্ট এ দেখেছিলাম।তা এখানে কি করছো তুমি?আর তোমার সেই ট্যাটু ওয়ালা হাঙ্ক কোথায়?
“আমি এখানে ডক্টর ফাইয়াজ ওপস সরি, মামাতো ভাই”