কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৩

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৩
লাবন্য ইয়াসমিন

আধরার সামনে বসে আছে আহির। দুজনেই চুপচাপ,মুখে কথা নেই। কহিনুরের কক্ষ থেকে বেরিয়েই আহির অধরার সামনে এসে বসেছে। নির্জনতা কাটিয়ে অধরা বলে উঠলো,

তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবে কহিনুর বাচ্চা একটা মেয়ে। ওর বিয়ের বয়স হয়নি। আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে আপাতত ভাবছি না। তুমি বললে উনি শুনবেন।
অধরার কথা শুনে আহির বাঁকা হাসলো। কোনো রকম জড়তা না করে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মা আর বোন ওকে পছন্দ করেছে আন্টি তাই বাবা কিছু না ভেবে এমন একটা কাজ করেছে। আমি বুঝিয়ে বলবো আপনি চিন্তা করবেন না। বাবা না বুঝে এতসব চিন্তা করেছে। ক্ষমা করে দিন আন্টি। বাবার হয়ে আমি আপনার থেকে ক্ষমা চাইছি।
আহির অধরার পা ধরতে চাইলো কিন্তু পারলো না। অধরা চমকে উঠে পা সরিয়ে নিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

ছিঃ ছিঃ এসব কি? পায়ে হাত দিওনা। আমি কিছু মনে করিনি। মেয়েটাকে নিয়ে আমার পৃথিবী। আমি ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইছি না। বড় হোক তখন না হয় ভেবে দেখব।
অধরা বেশ সরল ভাবে কথাগুলো বলে থামলো। মিহির কিছু একটা ভেবে বলল,

আন্টি আপনার যেটা ভালো মনে হবে তাই করবেন। সমস্যা নেই। আমার মাকে আমি বড্ড ভালোবাসি । উনি চেয়েছিলেন তাই আমি রাজি হয়েছি। ভবিষ্যতে যদি কখনও আপনার মনে হয় আমি আপনার মেয়ের উপযুক্ত তবে ভেবে দেখবেন আমি আপনাকে নিরাশ করবো না।
মিহিরের কথাগুলো অধরার পছন্দ হলো। ছেলেটা সত্যি ভালো তবুও হুটকরে সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। বলল,

অবশ্যই ভাববো তবে এখন না। সময় হোক তুমি বা কহিনুর কেউ তো আর পালিয়ে যাচ্ছো না। যদি ভালো দেখি তবে আমি সিদ্ধান্ত নিবো।

অধরা কথা শেষ করে চলে আসলো। মিহির চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মৃদু হাসলো। অধরার মস্তিষ্কে যে ওকে নিয়ে যে পজেটিভ ইফেক্ট ফেলতে পেরেছে বেশ ভালো করে বুঝলো। আজ থেকে মিহির নামের ছেলেটার নামে যত রকম অপবাদ ছিল সব লুকিয়ে যাবে। এই ছেলেটা ভালোর থেকেও ভালো হয়ে চৌধুরী পরিবারের লোকদের উপরে প্রভাব বিস্তার করবে।

রিসোর্টে লোভে না হলেও কহিনুর নামক রত্নটির লোভে। নেহা এতক্ষণ মিষ্টির কাছে ছিল বাইরে এসে ভাইয়ের এমন আবভাব দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। মিহির ওকে পাত্তা দিলো না। সবাইকে নিমন্ত্রণ করে বেরিয়ে আসলো। ওদের নতুন রিসোর্ট খোঁলা হয়েছে।

সেই উপলক্ষে কিছু লোকদের নিমন্ত্রণ করা হবে। সুলতান রিসোর্টের পাশাপাশি হওয়ার দরুন চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে ওদের মোটামুটি কথাবার্তা চলে। তাছাড়া জমির মাহমুদের নজর সুলতান রিসোর্টের দিকে প্রথম থেকেই ছিল। একজন মহিলা হয়ে এভাবে রমরমা করে রিসোর্ট চালাতে পারে উনি মানতে নারাজ। এবারতো একটা সুযোগ পেয়েছেন কাজে লাগানোর জন্য উঠেপড়ে লাগবেন।

দূর থেকে বিয়ের গান ভেসে আসছে অধরা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। কহিনুর ঘুমিয়ে আছে তাই রুমের লাইট বন্ধ করে বাইরে এসেছে। আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না। দূর থেকে ভেসে আসা বিয়ের গানটা কানে লাগতেই বারবার নিজের বিয়ের কথা মনে হলো। বাবা মা পরিবার পরিজন কেউ নেই পাশে শুধুমাত্র মেয়ে ছাড়া ।

স্বামি নামক লোকটা কি আদো বেঁচে আছে কি তাও জানানেই। অধরা আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,”জুবায়ের ফারুকী আমরা তো এই এক আকাশের নিচে অবস্থান করছি তাইনা? তাহলে এতো কেনো দূরত্ব আমাদের মধ্যে? সুলতান বংশের না আমি বরং ভালোবাসার অভিশাপে অভিশপ্ত।এই শাপ মোচন জানিনা কবে হবে। ফিরে আসুন না। আপনার বলা সব কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।

আমাদের মেয়েটা বড় হচ্ছে কিছুই তো দেখতে পারলেন না।” কথাগুলো বলে অধরা চোখ বন্ধ করে ফুপিয়ে উঠলো। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। কাকে দোষারোপ করবে এই ছন্নছাড়া জীবনের জন্য বুঝতে পারছে না। জুবায়ের জীবিত কি মৃত কথাটা না জানা থাকলেও অধরা কখনও ভাবেনা জুবায়ের পৃথিবীতে নেই।

লোকটা আছে আর থাকবে। হৃদয়ের প্রতিটা কোণায় লোকটার ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ। শুধুমাত্র এক জীবন না এরকম বহুজীবন অধরা কাটিয়ে দিতে পারবে। অধরা চোখের পানি মুছে কক্ষে ফিরে আসলো। কহিনুর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্তাবস্থাই মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে। অধরা ওর কপালে চুমু দিয়ে পাশের শুয়ে পড়লো। ঘুম পাচ্ছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ও গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে গেলো।

ঠিক তখনই কহিনুর ঝটকরে চোখ খুলে উঠে বসলো। ধীরগতিতে পা ফেলে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের জোছনা উপছে পড়ছে পৃথিবীতে। দূর থেকে মনে হলো সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে যদিও এখান থেকে সমুদ্রের দূরুত্ব বেশ অনেক।

কহিনুরের ইচ্ছে হলো সমুদ্রের তীর ধরে হাটতে। সমুদ্রে জোয়ারের এসেছে কহিনুর চোখ বন্ধ করে বাইরে হাত বাড়িতে জোছনার আলো গায়ে মাখার চেষ্টা করলো। শনশন বাতাসে ওর দীর্ঘ কেশ পল্লব মৃদু মৃদু দুলছে। বাগান থেকে শিউলি ফুলের সুবাস ভেসে আসছে।ঠিক তখনই গুন গুন আওয়াজ করে মিষ্টি সুরে কেউ বলে উঠলো, ধরণীতে সুলতান জুবায়েরের ফারুকীর একমাত্র কন্যা কহিনুর ফারুকীকে স্বাগতম।

জমির মাহমুদ খুব তোড়জোড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। ছেলে উনাকে কথা দিয়েছে কহিনুরকে ও এই বাড়ির বউ করে নিয়ে আসবে। ছেলে চালাকি করে অধরার থেকে একপ্রকার কথা আদায় করে নিয়েছে। মেয়ে বড় হলে তার বিয়ে দিতে হয় এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। অধরা নিশ্চয়ই চাইবে না মেয়ের বিয়ে না হোক।

সেই হিসেবে বিয়ে তো একদিন দিবেই আর তখনই ও জামাই হিসেবে মিহিরকেই নির্বাচন করবে। মহিলা মানুষ বুদ্ধি কম তাই এতোটা চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। ছেলের ভবিষ্যৎ শশুর বাড়ির লোকজন আসছে তাদের আদর আপ্যয়নের ত্রুটি উনি রাখবেন না। রিসোর্টে অনুষ্ঠান হচ্ছে। ও বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে অধরাকে। যদিও আসবে কিনা বলা মুশকিল। মিহির এতো চিন্তা করছে না।

লোকজন নিয়ে কাজকর্ম করছে খুব মনোযোগ দিয়ে। নেহা বন্ধুদের নিয়ে বসে আড্ডা জমিয়েছে। অনুষ্ঠান শুরুর কয়েকমিনিট পরে চৌধুরী বাড়ির গাড়ি রিসোর্টের সামনে এসে থামলো। অধরা আসতে চাইছিল না তবুও আসতে হলো। ও সাদা রঙের বোরকা পরে মুখে নাকাব লাগিয়ে আছে। কহিনুর আর মিষ্টি বাড়িতে আছে। বাকিরা এসেছে। কহিনুর বাড়িতে একা থাকবে তাই মিষ্টি আসেনি।

তাছাড়া দুজনে মিলে আজ ড্রয়িং করবে রঙ লাগাবে। ওদের এসব করতে কোনো বিরক্তি আসে না। গাড়ি থামতে দেখে মিহির এগিয়ে আসলো। আশা ছিল কহিনুর আসবে কিন্তু ওকে না দেখে নিরাশ হলো। সবাইকে নিয়ে ভেতরে বসতে দিয়ে আবারও কাজে মনোযোগ দিলো। অধরা বসে ছিল কিন্তু হঠাৎ কেমন জানি মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। ভাবলো একটু মুখে পানি দিলে ফ্রেশ লাগবে। ভাবনা অনুযায়ী ওয়াশরুমের খোঁজে বেরিয়ে আসলো।

লোকজন অনেক তবে বেশ পরিপাটি করে গোছানো। অধরা সাইড করে যাওয়ার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। রাগ হলো কিন্তু রাগ করতে পারলো না। পেছনে ঘুরে কিছু বলতে চাইলো তখনই একটা মুখের উপরে ওর নজর পড়লো। বুকের মধ্যে ধুপ করে উঠলো। বহুকাল আগে দেখা সেই মুখ নাক চুল কোনো পরিবর্তন নেই।

চোখের দৃষ্টির কথা ভাবতেই অধরার ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। আল্লাহর নাম স্মরণ করে দ্রুত পেছনে ফিরে কম্পিত পায়ে দ্রুতগতিতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। এতবছর পরে দেখা লোকটাকে ওর ভয় হচ্ছে। নিশ্চয়ই ও একা আসেনি। ওরা কহিনুরের খোঁজে এসেছে ভেবেই ওর চোখে পানি চলে আসলো।

নেকাব খুলে মুখে পানির ছিটা দিয়ে বেরিয়ে আসলো। এই রিসোর্টে আর এক মিনিটও না। ফোন বের করে ডালিয়া হককে বলে দিলো ওর শরীর খারাপ লাগছে বাড়িতে চলে যাচ্ছে। গাড়িতে বসে বিড়বিড় করে বলল, মানুষের গর্ভে শয়তানের জন্ম হয়েছে। ভাইকে পযর্ন্ত ছাড়ে না কতটা নিচ। এক গর্ভে জন্ম নেওয়া আরেকজনের সঙ্গে কত অমিল।

অধরা একা হলে লোকটার মুখোমুখি হতে পারতো কিন্তু কহিনুরকে যদি ওরা নিয়ে যায়? মেয়েকে হারাতে ও কিছুতেই পারবে না। বাড়িতে পৌঁছে অধরা অবাক হলো কারণ বাড়িতে নাকি মেহমান আসছে। কাজের লোকগুলো চরকীর মতো ঘুরে ঘুরে কাজকর্ম করছে। কেউ রান্না করছে তো কেউ ঘর গোছানোতে ব্যস্ত। অধরা কাজের মেয়ে লতিফাকে জিঞ্জাসা করতেই লতিফা বিস্তার হেসে বলল,

অফা স্যারের ছেলেমেয়েরা আসছে বিদেশ থেকে। স্যার ফোন করেছ আপনি জানেন না?
অধরা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। বিদেশ থেকে মানে জার্মান থেকে। জার্মানির নাম শুনলেই ভয়ে ওর শরীর কেঁপে উঠে।

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ২

আর আজ যাকে দেখলো তাতে মনে হলো ধরা পড়া এখন সময়ের অপেক্ষা। খুব তাড়াতাড়ি কোনো খারাপ কিছু হতে চলেছে। কহিনুরের কথা ভেবে আরও ভয় করছে। ইচ্ছে করছে এখানে থেকে আবারও পালিয়ে যেতে। সেবারতো জুবায়ের ওকে রক্ষা করেছিল কিন্তু এবার?

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৪