কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৪৫

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৪৫
লাবন্য ইয়াসমিন

মীরা আর জুবায়ের মিলে ভয়ঙ্কর একটা কাজ করে ফেলেছে।দাদুর খাবারের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিক্সড করে উনাকে সেটা খাওয়ায়ে দিয়েছে। মাং/স র/ক্তের শরীর যতই সেখানে অন্য কিছুর বসবাস থাকুক তবুও একটা কথা থেকেই যায়। ভদ্রলোক খাবার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বিছানা নিয়েছে।

জুবায়েরের বুদ্ধি এমনিতেই খামখেয়ালীপনাতে ভর্তি সঙ্গে জুটেছে মীরা। অধরা ভ্রু কুচকে দুজনকে দেখছে। এসবের মানে কি ওর মাথায় আসছে না। রেগে আছে। গতকাল জঙ্গল থেকে ফিরে জুবায়ের ওকে রুমের বাইরে যেতে দেয়নি। অধরা এই বিষয়ে তেমন কিছুই জানেনা।সকালে নাস্তা তৈরী করতে বাইরে এসে হুটকরে দুজনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলো দুজন মিলে বেশ ভালো করে খিচুড়ি পাকিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জামসেদ বাড়িতে নেই সেই সুবাদে মীরারও খামখেয়ালী বেড়েছে। অধরা দুজনকে নিজের কক্ষে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। জুবায়ের মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিচ্ছে যদি অধরার রাগ কমে সেই আশায় আর মীরা ঠোঁট উল্টে রেখেছে। নীরবতা ভেঙে অধরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

দাদুর যদি কিছু হয়ে যায় তখন কি হবে? এসব আজেবাজে ফালতু কাজকর্ম না করে ভালো কিছু মাথায় আসে না? মীরার বয়স কম ও ভুল করেছে কিন্তু আপনি তো ওর বড়। ভাইবোন মিলে একটা মানুষকে মা/র্ডার করতে নেমেছেন।এটা কিভাবে পারলেন? ওষুধ কয়টা দিয়েছেন বলুন? ডাক্তার ডাকতে হবে দ্রুত।

অধরার কথা শুনে জুবায়ের মীরার দিকে তাঁকিয়ে চনচল হয়ে উঠলো। অনেক কষ্টে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। এর মধ্যেই যা করার করতে হবে কিন্তু ঘরে যে হিটলারের বসবাস। এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি নেই আবার ওকে বলতে আসে। জুবায়ের ওকে ইগনোর করে বলল,

মীরা তুমি ওর কথা শুনবে না। তুমি দাদুর কক্ষের বাইরে পাহারা দিবে আমি ভেতরে ঢুকবো। যা কিছু রহস্যজনক দেখবো সবটা নিয়ে আসবো। উনি সহজে ম/রবে না। ম/রলে অনেক আগেই ম/রে গিয়ে আমাদের শান্তি দিতেন। বেঁচে থেকে আমাদের মতো ইনোসেন্ট বাচ্চাদের কষ্ট দিতেন না। প্রতি/শোধ নিতে হলে এসব একটু করতে হয়। চলো আমার সঙ্গে। বাইরে লোক দেখলে তালি বাজাবে আমি সাবধান হয়ে যাবো। লোকটা সজাগ থাকলে জীবনেও ওই কক্ষে আমরা যেতে পারবো না।

জুবায়ের মনে যা ছিল সব উগড়ে দিলো। অধরা চোখ বড়বড় করে ফেলেছে। দাদুর কক্ষের প্রতি ওর যে কৌতূহল নেই তেমনটা না কিন্তু তাই বলে এভাবে অন্যায় করাটা তো ঠিক না। অধরা সহজে অন্যায় করে না। জুবায়ের সেসব বুঝে না। যা মনে আসে করে ফেলে। অধরা চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

একদম না,ভেতরে আমিও যাবো। আপনার বলে কোনো বিশ্বাস নেই। যেখা গেলো দুমকরে আবারও কিছু করে বসেছেন তখন কেঁদে কুল পাবো না। দরকার নেই।মীরা চলো আমি তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি।

অধরার কথা শুনে মীরা খুশীতে লাফিয়ে উঠলো। দাদুর বিরুদ্ধে ওর অনেক অভিযোগ আছে। ওর বিশ্বাস সেরাতে ওই লোকটাই ওকে আটকে রেখেছিলো। কতগুলো বছর বন্ধ কক্ষে কেটেছে। কতদিন না খেয়ে থেকেছে তার ঠিক নেই। নিয়মিত খাবার পোশাক বা এমনকি গোসলের জন্য ওয়াশরুম কিছুই পাইনি। নিজেকে মৃ/তদের মতো মনে হতো। চারদিকে হাজারো মেয়ের আহাজারি শুনতে হয়েছে। সবটার প্রতি/শোধ নিতে হবে। কথাটা ভেবে ও আনমনে বলল,

লেট করো না। যা কথা হবে মিশন সফল হবে তখন হবে। কিছুতেই আজকের পর থেকে ওই লোকটা ভন্ডামি করে পার পাবে না। চলো চলো।

জুবায়ের ওর কথা শেষ করতে দিলো না। হাঁটা ধরলো। দাদুর কক্ষ ছাদে উঁঠা সিঁড়ির পাশে। পশ্চিম দিকটাতে। এমনিতেও দাদুর কক্ষের বাইরে কেউ তেমন একটা যায়না কড়া নিষেধ আছে। তবুও মীরাকে জুবায়ের বাইরে থাকতে বলে দুজনে ভেতরে প্রবেশ করলো। দাদু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এতোটা শব্দ করতে দেখে অধরা কানে হাত দিলো। জেগে গেলে মুশকিল আছে। ও সাবধানে পা টিপে টিপে যাচ্ছে দেখে জুবায়ের ফিসফিস করে বলল,

আরে আজকে কেনো আগামী দুদিন ভদ্রলোক বিছানা ছাড়বে না। তিনটা ঘুমের ওষুধ দিয়েছি বুঝতে পারছো কেমন ঘুম হবে?
অধরা চোখ লাল করে ওর কাধে আস্তে করে থাপ্পড় দিয়ে উত্তর দিলো,

কিছু হয়ে গেলে আপনার খবর আছে। আলমারি দেখুন আমি বাকীটা দেখছি।
জুবায়ের সামান্য হেঁসে এগিয়ে গেলো। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। ধরা পড়ার না সামনে আবার কি রহস্য আসতে চলেছে সেটা নিয়েই ভাবছে। দরজার কাছে মীরা চিল মুডে কফি খাচ্ছে। কেউ আসলে বলবে ঘুরছে আর কফি খাচ্ছে। মেয়েটার বুদ্ধি জুবায়ের মতোই। অধরা সেদিকে তাঁকিয়ে চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুঁলে ফেলল।

ভেতরে মোমবাতির পোড়া অংশ সঙ্গে লাইটার আর পোড়া কাগজের ছাই। অধরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সেসব চেক করছে। দ্বিতীয় ড্রয়ারে হিজিবিজি লেখা কিছু কাগজ পেন আর জমির দলিল যেটা বাংলাদেশের হবে। তৃতীয়টাতে তেমন কিছুই নেই। ও নিরাস হয়ে জুবায়েরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো। ততক্ষণে জুবায়ের কি একটা ফাইল চেক করতে ব্যস্ত। অধরা সেখানে বেশিক্ষণ থাকলো না কিছু একটা ভেবে দেওয়ালে কান পাতলো।

তারপর নরম হাতে কয়েকটা থা/বা বসিয়ে দিলো সেখানে। কেমন ধপধপ আওয়াজ হচ্ছে। সাধারণত দেয়ালে আ/ঘাত দিলে এমনটা হয়না। এই বাড়ির নিচের দিকে একটা কক্ষ আছে সেটা অধরা জানে। কারণ সেখানে অগে জামসেদ থাকতো কিন্তু উপরের দিকে দেয়ালের মধ্যে কক্ষ থাকতে পারে এটা ভাবতে পারেনা। সিঁড়ির কাছে লম্বা করে নিচের দিকের কিছু অংশ আছে যেটা ও এতোদিন এমনি ফাঁকা ভেবেছিল।

বোঝার উপাই নেই এখানে কক্ষ থাকতে পারে। অধরা আর অপেক্ষা করলো না। আলমারির সাইডের দরজা খুঁলে কাপড় সরিয়ে দিলো। চোখের সামনে বাদামি কাঠের নকশা আঁকা দরজা চকচক করছে। জুবায়েরের চোখে মুখে বিস্ময়। ও দ্রুত দরজার হাতলটা ঘুরিয়ে দিলো। ভাগ্য ভালো দরজা লক করা ছিল না। দরজা খুঁলে সরু রাস্তা দেখা গেলো।

জুবায়ের কিছু একটা ভেবে অধরাকে ইশারা করলো মোমবাতি আর লাইট আনতে। অধরা দ্রুত সেটা নিয়ে ধরিয়ে দিলো ওর হাতে। তারপর নিজেও ওর পিছু নিলো। সঙ্গে ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষ কেমন গুমোট আর কিসের একটা উটকো গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিলো। অধরার বমি পেয়ে গেলো।তাই ও সঙ্গে সঙ্গে নাকে কাপড় চেপে ধরলো। মোমবাতির আলোতে পুরো কক্ষ আলোকিত হয়ে উঠেছে।

লম্বাটে কক্ষের বাম দিকে একটা ক/ফিন আর ছোট একটা আলমারি ছাড়া এখানে তৃতীয় কোনো আসবাবপত্র নেই। ধুলাবালি নেই হয়তো নিয়মিত পরিস্কার করা হয়। জুবায়ের ক/ফিনের কাছে গিয়ে হামু হলো। ইশারায় অধরাকে ডেকে ওর হাতে মোমবাতি ধরিয়ে দিয়ে বক্সটা খুঁলতে গিয়ে থেমে গেলো। অধরা পেছন থেকে ওর শার্ট টেনে ধরেছে।

মেয়েটার হাত কাঁপছে। জুবায়ের দ্রুত পেছনে ফিরে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কাধে থুতনি রেখে ফিসফিস করে বলল,
ভয় পাবে না। আমি আছি না? যেই থাকুক আমি সামলাতে পারবো। বিপদ দেখলে তুমি বেরিয়ে যাবে। আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে আগে নিজেকে সেভ রাখবে।

অধরার কেনো জানি ভয় লাগছে। পা থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ এই ভয়টা কেনো হচ্ছে বুঝতে পারছে না। জুবায়ের হুট করে ওকে ছেড়ে দিয়ে বক্স উন্মুক্ত করতে লেগে পড়লো। চাবিটা উপরেই ছিল। খুঁলতে টাইম লাগলো না। ঢাকনা খোলার আগে একবার অধরাকে দেখে নিলো।

তারপর বিসমিল্লাহ বলে ঢাকনা উপরে তুলতেই থমকে গিয়ে ও পিছিয়ে আসলো। বক্সের ভেতরে এক রমণীর লা/শ যত্ন সহকারে রাখা আছে। গায়ে সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি। অধরা উঁকি দিয়ে বুঝলো গতকাল মারিয়ার গায়ে যেমনটা দেখেছিলো এই মেয়েটার গায়েও তেমনি পোশাক। মেয়েটাকে একটুও মৃ/ত বলে মনে হচ্ছে না।

সাদা ফর্সা গায়ের রঙ সঙ্গে কোঁকড়ানো লম্বা চুল যেগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। তবে মেয়েটা বাঙ্গালী নিশ্চিত। অধরা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো চন্দ্র। জুবায়ের বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অধরাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

একে তোমার চন্দ্র বলে কেনো মনে হচ্ছে? চন্দ্রর মৃ/ত্যু হয়েছে অনেক বছর আগে তাহলে এতো বছরে লা/শ কি করে এমন থাকবে?
অধরা কিছু একটা ভেবে উত্তর দিলো,

ঠিক কোনো না কোনো উপাই আছে এই লা/শ টাটকা আর সতেজ রাখার পিছনে। আচ্ছা তবে কি এতোগুলো মেয়েদের ব/লি এই লা/শের জন্যই দেওয়া হতো? আলমারিতে কি আছে চলুন খুঁজতে হবে।
জুবায়েরের ওকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুতগতি আলমারি খুঁললো। সেখানে বেশ কিছু বই অর একটা সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো ডাইরী রাখা ।জুবায়ের আলগোছে সবগুলো তুলে নিলো। ক/ফিনের ঢাকনা চাপিয়ে দিয়ে বলল,

ক /ফিনে আ/গুন লাগিয়ে দিলে কেমন হবে? মোমবাতির মোমগুলো বক্সের উপরে ছড়িয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলো বেরিয়ে যায়। না থাকবে বাশঁ না বাজবে বাশিঁ।
জুবায়ের কথা শুনে অধরা চোখ বড়বড় করে বলল,

এই না,একদম এমন কিছু করবেন না। সারা বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে যাবে। বিপদ হবে। তাছাড়া এই লা/শের সঙ্গে ঠিক কি হয় আর হবে সবটা আগে জানা খুব জরুরি। কেউ অসার আগে চলুন বেরিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে আবারও আসবো।
অধরার কথা শুনে জুবায়ের উত্তর দিলো,

ততদিনে ভুলভাল কিছু হয়ে না যায়। আমার মনে হচ্ছে এটা পুড়িয়ে দিলেই সব ঝামেলা শেষ হবে। চলো যেতে হবে।
অধরা মাথা নাড়িয়ে জুবায়েরের পেছনে পেছনে গোপন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলো। ওরা জানতেই পারলো না কফিনের মধ্যে থাকা রমনীর খোলা চক্ষুদ্বয় থেকে অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে। কতদিনের তপস্যার ফল এভাবে এই দুজনে নষ্ট করবে সেটা তো সহজে ও মানতে পারবে না।

জুবায়ের আর অধরা ততক্ষনে বেরিয়ে গেছে কক্ষের বাইরে। দাদু এখনো ঘুমিয়ে আছে। মীরা তালি দিচ্ছে অনবরত। মানে কেউ আসছে। জুবায়ের অধরাকে নিয়ে দ্রুতগামী বাইরে বেরিয়ে আসলো। মীরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সিঁড়িতে জুবায়ের ড্যাড আরমান ফারুকী উপরের দিকে উঠছে।

ভদ্রলোক খুব ফরমাল পোশাকে থাকেন। র/ক্তে বাঙালিআনার ছাপ আছে সেটা লুকিয়ে রাখার এতো প্রচেষ্টা পুরোপুরি যে ব্যার্থ যেটা যদি বুঝতো। অধরা সেদিকে তাঁকিয়ে নিজেদের কক্ষে ফিরে আসলো। মীরা নিচের দিকে নেমে গেছে। সবাইকে এক সঙ্গে দেখলে সন্দেহ বাড়বে। কক্ষে ঢুকেই জুবায়ের সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লো। অধরা পা গুছিয়ে ওর পাশে উঠে বসলো। ও একে একে সবগুলো কাগজ চেক করতে শুরু করেছে। জুবায়ের চোখ বন্ধ রেখেই বলল,

এতো ভীরু তুমি আগে কখনও ভাবিনি। সামান্য ক/ফিনের ঢাকনা খুলতে গিয়ে কেঁদে ফেললে।
অধরা ভ্রু কুচকে উত্তর দিলো,
বুঝবেন না আপনি। ওখানে আপনি না থেকে যদি আমি থাকতাম কখনও এতোটা ভয় পেতাম না। আপনাকে নিয়ে আমার যত ভয়। চুপচাপ পড়তে দিন। দেখি আবারও কি রহস্য বেরিয়ে আসে।
অধরার কথা শুনে জুবায়ের হাসলো। ভালোবাসা তো এমনিই হওয়া উচিত।

বিশালাকার খান প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাথর। কিছু কাহিনী ওর জানাটা খুব জরুরী। এই প্রাসাদে ওর অগাধ যাতায়াতের সুব্যস্থা আছে। যেটা খান সাহেব নিজে হুকুম দিয়েছেন। তফসিল এখানে থাকতে পারে না। এখানে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। পাথর কথাটা ভেবে মুখ বাঁকালো। যারা নারীর সঙ্গ ছাড়া চলতে পারেনা।

রাত হলে ঘুরে বেড়ায় নারীদের সান্নিধ্য লাভের আশাই তাদের বাড়িতে নারী প্রবেশ নিষিদ্ধ কেমন অদ্ভুত বিষয়। বাধ্য হয়ে এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বুঝতে ওর বাকী নেই। পাথর চুপচাপ ভেতরে ঢুকলো। এই বাড়িটার প্রহরীদের সহজে নজরে আসে না। বাইরের কেউ কোনো কিছু স্পর্শ করলেই তারা হাজির হয়ে যায়। পাথর তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে সদর দরজা দিয়ে করিডোর পেরিয়ে উপরে উঠে আসলো।

নিজের জন্য প্রস্তুত রাখা কক্ষের দরজা খুঁলতে গিয়ে থেমে গেলো। কিছু একটা ভেবে বেরিয়ে এসে হাট করে একটা বন্ধ দরজা খুঁলে ফেলল। আজ খান সাহেব এখানে নেই। বাইরে আছে। পাথরের অগাধ বিচরণ আছে এই বাড়িতে তাই ওকে আটকাতে কোনো প্রহরি আসলো না।

পাথর ভ্রু কুচকে আছে। ওর সামনে অজস্র শিঁকলে আটকানো আছে এক যুবক। পাথর একপা দুপা করে লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভালো করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে দেখতেই লোকটা চক্ষুদ্বয় পিটপিট করে খুঁলল। লোকটার চোখেমুখে বিস্ময়। বহুবছর পরে নতুন কোনো মানুষের মুখ দেখতে পেয়ে কৌতূহলী হয়ে উচ্চারণ করলো,

কে তুমি?
পাথর খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
আমি পাথর। আপনাকে এখানে কে আটকে রেখেছে? আপনি কে?
পাথর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। সিঁকল ধরে টানতেই সবটা ওর হাতের সঙ্গে চলে আসলো। লোকটার পা, হাত আর গলা থেকে একে একে সবটা খুঁলে উনি মুক্ত হয়ে গেলেন। পাথর অবাক হয়েছে কিন্তু তার থেকেও বেশি অবাক হলো সামনের দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক। উনি দ্রুতগতিতে এসে পাথরকে ঝাপটে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। পাথর কিছুটা পিছিয়ে এসে ভদ্রলোকের পিঠে হাত রেখে সরে আসতে গিয়েও থমকে গেলো। দুজনের মধ্যে থাকা শক্তি জানিয়ে দিলো দুজনের পরিচয়। পাথর হতভম্ব হয়ে গেলো। চাপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
> বাবা
লোকটা মাথা নেড়ে সাড়া দিলো তবে শব্দ করলো না। তবে হুটকরে উনি পাথরকে ছেড়ে দিয়ে ওকে ঠেলতে ঠেলতে দেওয়ালের কাছে নিয়ে গেলেন। হাতের মুঠো শক্ত করে দেওয়ালে আ /ঘাত করতেই কেমন গালাকার একটা রাস্তা তৈরী হলো। পাথর কিছু বুঝে উঠার আগেই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে লোকটাও ঝাপ দিলো সেখানে।

অতল গহিনে দুজন তলিয়ে গেলো চোখের নিমিষে। শূন্যে ভাসতে ভাসতে পাথর হুড়মুড় করে একটা অন্ধকার কুঠরিতে পড়ে গেলো। ওর চোখের জোতী বেশ ভালো তবুও কিছু বুঝতে পারছে না। হাত উচু করে আশেপাশে দরজা জানালা আছে কিনা খোঁজ করলো।

বুঝে উঠতে পারলো না বাবা হয়ে কিভাবে ছেলেকে এভাবে বিপদের মুখে ফেলে দিলো। লোকটা তো ওর সঙ্গেই ছিল তাহলে সে এখন কোথায় হারিয়ে গেলো?এমন হাজারো প্রশ্ন ওর মাথায় এলোমেলো হয়ে ঘুরছে। রাগ হচ্ছে কিন্তু ততটা শক্তি পাচ্ছে না যতটা পেলে নিজের রূপ পরিবর্তন করতে পারবে। পাথর ভড়কে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,

কেউ আছেন?
চার দেয়ালে ওর আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে কেউ উত্তর দিচ্ছে না। পাথরের মেজাজ ভয়ংকর খারাপ হলো। বিড়বিড় করে কহিনুরের নাম উচ্চার করলো দুবার। তৃতীয় বারের সময় ওকে চমকে দিয়ে কক্ষ আলোকিত হয়ে উঠলো। সেই সঙ্গে আওয়াজ আসলো,

ওকে ডেকো না। মহা প্রলয়ের এখনো বাকী আছে। ধ্বং/স নিশ্চয়ই হবে যার সৃষ্টি আছে তাঁর অন্ত আছে। জন্মালে মর/তে হয়। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে কালো শক্তি ধ্বংস করতে সে নিজেও ধ্বংস হবে। ওকে এতোটা ভালোবাসা তোমার উচিৎ হয়নি। সে নিজের সঙ্গে তোমাকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করবে।

পাথর ভ্রু কুচকে তাঁকিয়ে দেখল ওর সামনে ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে তবে আগের মতো সেই মলিন পোশাকে আর নেই। ঝকঝকে নতুন সাদা পাঞ্জাবীতে উনাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। কি হচ্ছে সবটা পাথরের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওকে এখানে আনার মানে কি বুঝলো না। তবে কহিনুরের জন্য ও অস্থির হয়ে উঠলো। যার মুখটা না দেখলে দিন ভালো যায়না। তাকে ভালোবাসতে নিষেধ করছে কিভাবে সম্ভব এটা? কখনও না। পাথর আপাতত সেসব মাথা থেকে বের করে প্রশ্ন করলো,

আপনার রহস্যটা কি বলবেন? আমার মায়ের সঙ্গে আপনার পরিচয়,বিয়ে আর আপনার পালিয়ে আসা সবটাই শুনতে চাই। কোনো ভনিতা করবেন না। আর আমি নিজের স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসবো আর কিভাবে আগলে রাখবো সেটা আপনার থেকে আমি ভালো বুঝি। এটা নিয়ে কিছু বলবেন না আমি শুনবো না।

পাথরের তীক্ষ্ণ বাক্যের খোচা ভদ্রলোকের হৃদয়ে কোনো ক্ষতচিহ্ন আঁকতে পারলো না। বরং তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসলেন। পাথরের বয়সের স্বল্পতা ভেবে মজা পেলেন হয়তো। পাথর হাতের মুঠো শক্ত করে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু উনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,

আমি তোমার পিতা এটা তো মানবে? জানি আমার বিরুদ্ধে তোমার হাজারটা অভিযোগ। আজকে সবটা তোমাকে বলবো। তারপর তুমি সিদ্ধান্ত নিবে। আর এখানে তোমাকে নিয়ে আসার কারণ হচ্ছে এটা পবিত্র জায়গা। তোমার দাদুর সাহস নেই এখানে এসে আমাদের বিরক্ত করার। আর কহিনুর আসতে পারবে তবে ওকে ডেকোনা। তার মাথায় খু/ন চেপে থাকে। কিছু বিষয় ভেবে চিন্তা করে করতে হয়।
পাথর চোখ বড় বড় করে বলল,

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৪৪

আপনি নূর মানে কহিনুরকে চিনেন?
সুলতান জুবায়ের ফারুকীর কন্যা সে। যে এসেছেই ধ্বং /স করতে। সামনে থেকে দেখিনি তবে শুনেছি তাঁর গল্প। আমার জাদুলিপি এখন তার দখলে।
পাথর বিড়বিড় করে বলল” জাদুলিলি”?

কহিনুর দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৪৬