কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৪
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
ইয়াসির তার সিদ্ধান্তে অটল। ঘোষণা যখন দিয়েছে,তখন আর নড়চড়ের উপায় নেই। কাউকে তো আর জোর করে সংসার করানো যায় না। তার
কথার ওপর কেউ রা না করলেও,মনে মনে অসন্তোষ হলেন জয়নব। শত হলেও বিয়েটা আসল। আল্লাহর নামে উচ্চারিত প্রতিটা কলেমা আসল। মেনে না নিলেও তুশি ওর বউ,না নিলেও বউ। সেকেলে মানুষ তিনি। বিয়ে মানি না,হ্যানত্যান এসব কথা কস্মিনকালেও শুনেছেন কারো মুখে?
এক ঘর অতিথিদের সামনে ইয়াসিরের এই রুক্ষতায় খারাপ লাগল তার। কিন্তু টু শব্দ করলেন না। স্বভাবে ইয়াসির এমনিতে শান্ত। তবে ঐ শান্ত মানুষ যখন রেগে যায়?
তখন তা কালবৈশাখির চেয়েও ভয়ানক। যার নমুনা সেবার সায়ন মারা যাবার দিন প্রথম দেখেছিলেন তিনি। তখন তো ইয়াসির সামান্য কিশোর ছিল। কিন্তু আজ সে পুলিশ অফিসার। এখন ক্রোধ চড়ে বসলে কতটা কী ঘটতে পারে,অভিজ্ঞ এই মাথা দিয়ে জয়নব আন্দাজ করতে পারছেন।
প্রৌঢ়া আর বসলেন না। আইরিনকে বললেন,
“ আমাকে একটু ঘরে দিয়ে এসো তো, নানু।”
আইরিন যেতে চায়নি৷ এখানে এখন কত কাহিনী হবে,ও মিস করলে চলে? কিন্তু নানুর মুখের ওপরে কথা বলতে পারল না।
হাতের লাঠিটায় ভর দিয়ে দাঁড়ালেন জয়নব। নরম হাতের বাহু এসে আগলে ধরল আইরিন। যেতে নিয়েও জয়নব থামলেন। আর্ত চোখে দেখলেন মেহমানদের সবাইকে। কাল নিশ্চয়ই সবাই গন্তব্যে ফিরে যাবে! এরপর এই বিয়ের ঘটনা নিয়ে কতদিকে কত ভাবে চর্চা হবে কে জানে!
বৃদ্ধা সিঁড়ির পথ ধরলেন। বুকে থাকা আক্ষেপটুকু গলিয়ে দিলেন নিঃশ্বাসে। বড়ো আফসোস করে বললেন,
“ আজকে তোমার মা দেশে থাকলে খুব ভালো হতো! সার্থটাকে বোঝাতে পারতো একটু!”
কথাটা আইরিনের মন মতো হয়নি। এপাশ ফিরে ভেঙচি কাটল সে। মা নেই ভালোই হয়েছে। কোনো দরকার নেই ইয়াসির ভাইকে বোঝানোর। ইয়াসির ভাই শুধু ওর হয়েই থাকবে। তবে
আজকে এই বিয়ের ঘটনায় একটা তীব্র সাহস পেয়েছে আইরিন। তুশি বয়সে ওর চেয়ে ছোটো। এত ছোটো মেয়ে ইয়াসিরের বউ হতে পারলে,ও কেন পারবে না? সেই হিসেবে ওতো আরেকটু বড়ো। শুধু শুধু এতদিন এসব বয়স ফয়স নিয়ে চিন্তায় মরছিল বেচারি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আইরিন পেছন ফিরে চাইল। মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে থাকা তুশিকে দেখে হাসল ঠোঁট টিপে। মনে মনে ভাবল,
“ কাল থেকে তোমার সাথে কী কী করি, শুধু দ্যাখো।”
এ বাড়িতে দুজন গৃহকর্মীর ভেতর একজনের নাম রেশমী। ৩০ এর মতো বয়স। শ্বশুর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর, এই বাড়িতে কাজ পেয়েছিল। তাও বছর ছয়েক আগের কথা।
রেশমী রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছিল এতক্ষণ। ইয়াসিরের সব কথাই শুনেছে। কিন্তু তাড়িয়ে দেবার ব্যাপারটায়,মুখখানা চুপসে গেছে ওর। এত বাড়ির মানুষগুলো ভালো। হত্যে দিয়ে কাজ করায় না। ব্যবহারও বেশ। এখন হুট করে ভাগিয়ে দিলে ও কোথায় যাবে?
তার ভাবনার মধ্যেই ইয়াসির ঝট করে ফিরল এদিকে। এত ঘাবড়ে গেল মেয়েটা! রীতিমতো ছ্যাৎ করে কেঁপে উঠল বুক। ইয়াসির তর্জন দিলো শান্ত স্বরে।
“ এক কাপ কফি দিন।”
রেশমী সজোরে মাথা নাড়ল। চটপটে হাতে চায়ের হাড়ি বসালো উনুনে।
ইয়াসির চুপচাপ সোফায় এসে বসল। দুপা ছড়িয়ে এক হাত রাখল হাতলের গায়ে। এ ঘরে আপাতত সাইফুল,রেহণূমা,তনিমা আর ইউশা আছে। এই মূহুর্তে আর সার্কাস বাকি নেই। রাতও বেড়েছে। ক্লান্ত মেহমানদের সকলে একে একে শুতে চলে গেল।
তুশির তখন রফাদফা অবস্থা।
শোকে,অনুশোচনায় পুড়ে মরছে বেচারি। কোন কুক্ষণে যে গিয়েছিল ওই সেন্টারের ভেতরে! ভীষণ চিন্তায় মাথাটা ঘুরছে এখন। ও করবে কাজ? জীবনে খাওয়া আর চুরি ছাড়া তুশি কাজবাজ জানে না। দাদি তো একবার এক বাসায় কাজ করাতে নিয়েছিল,থালাবাটি ধোয়া পরিষ্কার হয়না বলে ভাগিয়ে দিলো ওকে। তারপরই না তুশি চুরি করতে নেমেছে। সব সময়
হেলেদুলে চুরি করে ফিরেছে,দাদি খেতে দিয়েছে ব্যস। রাতে পা টানটান করে ঘুমিয়েছে সে। তুশি চোখ দুটো ঘুরিয়ে সব দিকে বোলাল। বিশাল বাড়ি!
এর সব কাজ যদি ওকে দিয়ে করায়,ওর সেলেব্রিটি চেহারাটা থাকবে? তুশির সব রাগ গিয়ে বর্তাল মাজহারের ওপর। বিড়বিড় করে গালি দিলো,
“ শালা মাজহার, তোর কোনোদিন ভালো হবে না,শালা। ষাঁড়ের গুঁতো খেয়ে মরবি, শালা। গরিবের অভিশাপ কোনোদিন বাসি হয় না, শালা। মনে রাখিস।”
ইয়াসিরের কফি হাজির হলো মিনিট কয়েকে। খুব তাড়াহুড়ো করে এসে দিয়ে গেল রেশমী। ছেলেটা বড্ড স্থির! তার সিদ্ধান্তে কে কী ভাবছে,কে কী বলবে ওসব নিয়ে আগ্রহ নেই। তনিমা ফোস করে শ্বাস ফেললেন।
ইয়াসির ঠান্ডা থাকলেও ভেতর ভেতর যে ক্ষিপ্রতার উচ্চসীমায়, এটুকু অন্তত জানেন তিনি। তাই আপাতত এসব নিয়ে বাড়তি কথা বললেন না। রাগটা কমুক! তারপর নাহয় সুন্দর করে বোঝাবেন ।
তনিমা ফিরে চাইলেন ঠায় দাঁড়ানো তুশির পানে। মেয়েটার পরনে এখনো বিয়ের কাপড়। নিশ্চয়ই খিদেও পেয়েছে। ইউশা কে বললেন।
“ ওকে ঘরে দিয়ে আয় তো, মা।”
মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে থাকা ইউশা,নড়ে উঠল কথাটায়৷ মাথা ঝাঁকাল একটু।
“ এসো,তুশি।”
ইউশা সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল। তুশি পেছনে এক পা বাড়াবে,অমনি ডাকল ইয়াসির,
“ দাঁড়া।”
থামলো ওরা।
পরের প্রশ্ন সহসা ছুটে আসে,
“ ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
ইউশা একটু ঘাবড়ে গেল। এক পল দেখল বড়ো মাকে। মিহি স্বরে বলল,
“ তো তোমার ঘরে।”
ইয়াসিরের স্বর ধীর,
“ ও আমার ঘরে কেন যাবে? একটা বাইরের মেয়ের সাথে আমি একই রুম শেয়ার করব?”
তনিমা চ সূচক শব্দ করলেন৷ চোখেমুখের বিরক্তিটা গিলে নিলেন নরম সুরে,
“ তাহলে ও থাকবে কোথায়?”
ইয়াসির কাঁধ উঁচাল,
“ যেখানে ইচ্ছে। একেবারে জায়গা না পেলে স্টোর রুমে থাকুক।”
তুশি বিভ্রান্ত। স্টোর রুমটা আবার কী রুম!
তনিমা আশ্চর্য চোখে বললেন,
“ স্টোর রুম? ওটাতো…..”
ইয়াসির কথা টেনে নিলো। বলল সেই ভারী স্বরে,
“ আমি কিছু শুনতে চাই না। এই চোরের বেলায় তো আরো আগে নয়। যা বলছি তাই করো।”
রেহনূমাও তাল মেলালেন,
“ এটাই ঠিক আছে। ওর জন্যে স্টোর রুমই উপযুক্ত।”
ইউশা মুখ খুলল মিনমিন করে,
“ আমি তো ঘরে একাই থাকি। না মানে, বলছিলাম যে ও আমার সাথে থাকলে হতো না?”
রেহনূমা ধমকে বললেন,
“ তুই চুপ কর। খুব পাকামো তাই না?যা, নিজের ঘরে যা।”
ইউশা মাকে ভয় পায়। খিটখিটে স্বভাবের তিনি। অল্পতে প্রচণ্ড রেগে যান। তাই আর কথা বাড়াল না। তুশির দিকে মায়া মায়া চোখে চাইল এক পল। তুশির কপালে বোকা বোকা ভাঁজ। আহারে, ওতো বুঝতেও পারছে না ওকে কোথায় ঘুমোতে দেয়া হবে! স্টোর রুমে যত্ত ইদুর আর তেলাপোকা আছে,অত লোক এই দেশেও নেই। ততক্ষণে কফি শেষ করেছে
ইয়াসির। কাপটা রেখে নিজের মতো রওনা করল ঘরে। তার পিছু নিলেন সাইফুল।
রেহণুমাও আর দাঁড়ালেন না। ত্রস্ত স্টোর রুমের চাবি আনতে ছুটলেন।
সুযোগটা ইউশা লুফে নেয়। ফিসফিস করে বলে,
“ তুশি, তোমার যদি কিছু লাগে আমাকে ডেকো। ওই দোতলার দুটো ঘর পরেই আমার ঘর। কেমন?”
তুশি মাথা কাত করল। ইউশা চলে গেল ওপরে। মিনিট দুয়েকেই ফেরত এলেন রেহণূমা। কর্কশ গলায় বললেন,
“ এসো। এই মেয়ে?”
তুশি নড়েচড়ে ওঠে। পিলপিল করে পিছু পিছু যায়।
তনিমার এত খারাপ লাগল ব্যাপারটা। স্টোর রুমের যা অবস্থা! ওখানে কীভাবে থাকবে মেয়েটা কে জানে! তিনি সোজা রান্নাঘরে ঢুকলেন। তুশি নিশ্চয়ই তেমন কিছু খায়নি।
রেহণুমার চোখেমুখে আনন্দের দীপ্তি। মনে মনে ভীষণ মজা পাচ্ছেন তিনি। স্টোর রুমের দরজায় একটা বিশাল তালা ঝুলছিল। সেটা খুলতেই, ভকভক করে ধুলো জড়ানো বাতাস ছিটকে এলো নাকে। খুকখুক করে কেশে আঁচলে নাক চাপলেন তিনি। হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,
“ বাবাহ,কী ধুলো!”
তুশির নজর তখন ভেতরে। কৌতূহলে পাশ কাটিয়ে ঢুকল তাড়াতাড়ি। বিরাট বড়ো ঘর। চারপাশে ফার্নিচার স্তূপ করে রাখা। মাঁকড়সার বাসা দিয়ে ভরতি দেওয়াল। এখানে-ওখানে ধুলো,ময়লা দিয়ে যা তা একেবারে। রেহণূমা ছুড়ে ছুড়ে বললেন,
“ এখন থেকে এটা তোমার ঘর। ”
তুশি বড়ো হয়েছে বস্তিতে। নোংরা, কাঁদামাটি, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের সঙ্গে টিনের সেই খুপড়ির কাছে এটা বহুকাংশে বড়ো। পায়ের তলায় টাইলসও আছে।
তুশির বেশ লাগল। হাসিহাসি মুখ করে বলল,
“ হেয়ার আমি একা লিভ করব?”
“ তো এখানে মরতে কে আসবে আর? যে যেমন তার ঘরও তেমন।”
তুশির কণ্ঠে স্ফূর্তি,
“ আরিব্বাস! তাহলে তো দারুণ হবে। বিগ হোম, বিগ জানালা।”
রেহণুমা নাক কুঁচকে ভাবলেন,
“ স্টোর রুম দেখে খুশি হয়ে গেল? ইয়াসিরের ঘর দেখলে বলতো কী তাহলে?”
যাক গে,খুশি হলে হোক। ওনার কী? থমথমে গলায় বললেন,
“ ঘর নিজের মতো ঝেড়েমুছে নাও। আমি যাই বাপু, রাত হয়েছে শোবো।”
ভদ্রমহিলা বিদায় নিলেন। তুশি মাথা চুলকাল। সত্যিই অনেক ধুলো। কী থেকে কী করবে! ক্লান্তও লাগছে। সেই বিকেলের পর কিছু খায়ওনি। ফার্নিচারের মধ্যে একটা খাট রাখা। তবে পাল্লা জুড়তে হবে। তুশি ওসব একা পারবে না। ও জানেও না কী থেকে কীসে জোড়া লাগাতে হয়। তাই মাথা থেকে ওড়নাটা খুলে দড়ির মতো পাঁক দিলো। আপাতত মেঝেটা ঝেড়ে শুতে পারলেই চলবে। এর মাঝেই খাবার নিয়ে ঢুকলেন তনিমা। পায়ের শব্দে চাইল তুশি। কথা বার্তার আগেই চোখ পড়ল সোজা হাতের থালায়।
“ খাবার!”
জ্বিভ দিয়ে ঠোঁটটা চেটে নিলো তুশি। ত্রস্ত এসে দাঁড়াল ওনার সামনে।
“ ফর মাই?”
তনিমা হাসলেন?
“ হ্যাঁ।”
তুশি একরকম ছো মেরে নিলো। এপাশে এসেই মেঝেতে বসল আসন করে। ভাতের সাথে রোস্ট,গোরুর মাংস,এক পিস মাছ সাজিয়ে-গুছিয়ে এনেছেন তনিমা।
তুশি অধৈর্য হাতটা ডোবাতে গেলেই কব্জি চেপে ধরলেন তিনি।
“ উম,হাতটা তো ধোও মেয়ে।”
তুশি কাঁধ উঁচাল,
“ আমারই তো হাত। খাই না! কী হবে?”
“ ছিঃ কী নোংরা কথা! দেখি হাতটা বাড়াও।”
বাটি পেতে, গ্লাসের জল দিয়ে হাতটা ধুইয়ে দিলেন তিনি। তুশির দাদির কথা মনে পড়ে গেল। দাদিও তো কত যত্ন করে খাওয়ায় ওকে। আচ্ছা,ওকে না পেয়ে দাদি কী করছে এখন ? চিন্তায় ঘুমোতে পারছে তো?
“ কী হলো, খাও?”
“ হুঁ? হ্যাঁ।”
তুশি ভাতে হাত দিলো। এক লোকমা খেতেই,পেটের নাড়িভুঁড়িও জানান দিলো ওর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। গপগপ করে খেল তুশি। পুরো সময়
তনিমা ওকে মন ভরে দেখলেন। একদম কাঁটা কাঁটা নিঁখুত একটা চেহারা। চোখ, ঠোঁট সবই সুন্দর। ভ্রুজোড়া ক্যানভাসের মতো! ফরসা খুব!
বস্তির জায়গায় একটু ভালো ঘর পেলে,আরো সুন্দর লাগতো বোধ হয়। জিজ্ঞেস করলেন রয়েসয়ে,
“ তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”।
তুশি রোস্ট তুলে কামড় বসায়। ওভাবেই বলে,
“ দাদি।”
“ আর তোমার বাবা মা।”
“ নেই।”
“ ওহ! তোমার দাদি কী করে?”
“ লোকের বাসায় কাজ করে। প্রতি বাড়িতে দুটো করে কাজ।”
“ তুমি বুঝি চুরি করতে?”
তুশি মাথা নাড়ল দুপাশে।
“ না। পকেট কাটতাম।”
“ একই তো হোলো।”
তুশির খাওয়া থামল। চাইল ক্লান্ত চোখে। চোর আর পকেটমার এক না,এটা ও আর কতজনকে কতভাবে বোঝাবে?
কিন্তু মেয়েটা আজ যুক্তি দিতে গেল না। চুপচাপ খেতে নিলো ফের।
তনিম মাথায় হাত রাখলেন তখনই। কোমল সুরে বললেন,
“ তুমি কিন্তু ইয়াসিরের কথায় কিছু মনে কোরো না। ওর রাগটা কমলেই তোমাকে ঘরে নিয়ে যাবে।”
তুশি হু-হা করল না। তার এসবে আগ্রহ নেই। ইয়াসিরের ঘরে যাবে কী মশা মারতে?
অনীচ্ছায় মাথাটা নাড়ল তাও। এইটুকু সময়ে ও বুঝতে পেরেছে, তনিমা বেশ ভালোমানুষ। অন্তত ওকে খাবার এনে দিলো! এর সাথে তুশি চোটপাট করবে না।
তনিমা জিজ্ঞেস করলেন,
“ আর কিছু দেবো?”
তুশি নিসঙ্কোচে প্লেটটা বাড়িয়ে দেয়।
“ আর দুপিস মাংস দিন না। সাথে একটু ভাত।”
“ আচ্ছা। নিয়ে আসছি।”
তনিমা ফেরত এলেন দু মিনিটে। প্লেটটা সামনে রেখে বললেন,
“ তুমি তাহলে খাও। আমি ঘরে যাই। একটু পর রেশমী এসে তোমার ঘরটা ঝেড়ে দেবে। আর এটা পরে তো শুতে পারবে না,আমি বরং একটা কিছু পাঠাচ্ছি।”
তুশি অর্ধেক শুনল,অর্ধেক শোনেনি। তার মনোযোগের সবটা খাবারের ওপর।
তনিমা হাসলেন। বেরিয়ে গেলেন মাথা নেড়ে।
***
শওকত রুমে এসেছেন অনেকক্ষণ। এখনো কাপড় ছাড়েননি। পিঠে দু হাত বেঁধে পায়চারি করছেন নিরন্তর। কোত্থেকে যে কী ঘটে গেল! ইয়াসির যে কেন মেয়েটাকে নিয়ে এলো বাড়িতে! এখন এই বস্তির মেয়েকে কীভাবে সমাজে পুত্রবধূর মর্যাদা দেবেন তিনি! শওকতের মেজাজের দফারফা দশা। ইয়াসিরকে এ নিয়ে কিছু বলতেও পারছেন না। হঠাৎ এহসান সাহেবের কথা মনে পড়ল ওনার। শ্যালকের অমন কাজে লোকটা কষ্ট পেয়েছেন খুব। কেমন বুকে হাত চেপে বসে পড়লেন তখন! মানুষ হিসেবে ওদিকের কী অবস্থা,একটা খোঁজ নেয়া দরকার।
শওকত বিছানার পাড়ে এসে বসলেন। টেলিফোনের রিসিভার তুলে গুঁজলেন কানে। রিসিভ হলো মিনিট কয়েক পর।
“ হ্যালো।”
“ জি,এহসান সাহেব বলছেন?”
বিমর্ষ গলায় জানালেন ভদ্রলোক,
“ জি।”
“ আমি শওকত আলী বলছিলাম।”
“ জি ভাই সাহেব,বলুন। এতকিছুর পরেও আপনি ফোন করবেন , আমি কিন্তু ভাবিনি।”
“ না করার তো কিছু নেই,ভাই। যা ঘটেছে তাতে তো আর আপনার দোষ ছিল না। আপনি নিজেই ছোটোখাটো একটা চক্রান্তের স্বীকার। বলতে পারেন সেজন্যেই কিন্তু আমি আর কোনো ঝামেলা করিনি। প্রথম দিকে যতটা রাগ হয়েছিল,শুধুমাত্র আপনার মুখের দিক চেয়ে আপনার শ্যালককে কিছু বলিনি। চুপচাপ বেরিয়ে এসেছি।”
এহসান চুপ করে রইলেন। এতগুলো কথার পিঠে যুক্তিসঙ্গত উত্তর না পেয়ে কপালে ভাঁজ ফেললেন শওকত।
শুধালেন,
“ কিছু হয়েছে, এহসান সাহেব?”
সময় নিয়ে উত্তর দিলেন তিনি।
“ বাড়িতে পুলিশ এসেছিল ভাই। মাজহারকে নিয়ে গেছে।”
শওকত যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
“ পুলিশ! কেন?”
“ ইয়াসির পাঠিয়েছে। লোক ঠকানোর মামলা দিয়েছে মাজহারের নামে।”
শওকত চমকে উঠলেন দ্বিতীয় দফায়।
“ কী বলছেনটা কী?”
“ জি। এই একটু আগেই নিয়ে গেল। আমার অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। জামিন টামিনেও ছুটব না। আপাতত মেয়েটাকে খুঁজব,তারপর দেখি কী করা যায়! দোয়া করবেন ভাইসাহেব। রাখছি, কেমন?”
শওকত পালটা কিছু বললেন না। কান থেকে চুপচাপ রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন আগের জায়গায়। তার মাথার ভেতর দপ দপ করছে বিস্ময়। ইয়াসির পুলিশ পাঠিয়েছে? মামলা দিয়েছে! কখন করল এসব!
তখনই ঘরে এলেন তনিমা।
শওকতকে একই জামাকাপড়ে দেখে বললেন,
“ এ কী! এখনো ফ্রেশ হওনি?”
ভদ্রলোকের ফিরতি জবাব এলো না। তনিমা পাশে এসে বসলেন।
“ কী হয়েছে?”
“ এহসান সাহেবকে ফোন করেছিলাম। বললেন,সার্থ নাকি ও বাড়িতে ফোর্স পাঠিয়েছে। মাজহারের নামে মামলা দিয়েছে প্রতারণার।”
তনিমা বিস্মিত হলেও, গিলে নিলেন সেটুকু। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন,
“ জানতাম এমন হবে। চিনি তোমার ছেলেকে।”
“ এসবের কী দরকার ছিল বলোতো! একজনের নামে যদি মামলাই দেবে,তাহলে ওই তুশি মেয়েটারও তো সমান দোষ আছে এখানে। ওকে থানায় নিচ্ছে না কেন?”
“ কী আবোলতাবোল বোলছো? একটা মেয়ে মানুষকে জেল খাটাবে? তাও ওর বিয়ে করা বউ!”
“ কীসের বিয়ে? লোক ঠকিয়ে কোনো বিয়ে হয় কোনোদিন! আসলে দেখেছে, মেয়েটা দেখতে ভালো। নিয়ে এসেছে বউ বানিয়ে।”
তনিমা হেসে ফেললেন। বিদ্রুপ করে বললেন,
“ বাবা হয়ে এতদিনে এই চিনলে ওকে? তোমার ছেলে সংসার করতে আনেনি। এনেছে মেয়েটাকে শিক্ষা দিতে। কে জানে কীসের শোধ নিচ্ছে!
নিচে তো ছিলে না এতক্ষণ। থাকলে শুনতে।”
শওকত ভ্রু গুছিয়ে ফিরলেন। নড়েচড়ে বসলেন এইবার।
“ কী হয়েছে বলো তো?”
তনিমা বললেন সবটা। শুনেই চোখজোড়া কপাল ছুঁলো তার।
“ হ্যাঁ! এতকিছু ঘটে গেছে? আমি তো কিছুই টের পেলাম না।”
তনিমা নীরস গলায় বললেন,
“ আমার এসব কিছুই ভালো লাগছে না। শুধু শুধু মেয়েটাকে এখানে আটকে রেখে এমন করাটা কী খুব দরকারি?”
“ সেসব তোমার ছেলেই ভালো জানবে। যাক গে, তুমি আবার এসবের মাঝে ঢুকতে যেও না। যা একটা ছেলে বানিয়েছ। দেখা যাবে তার ইচ্ছেমতো কিছু নাহলে তোমার সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দিলো।”
তনিমা কেমন করে চাইলেন। ঠোঁটটা একদিকে বাঁকা করে হাসলেন একটু। বললেন,
“ একটু ভুল বললে..
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৩
ও কিন্তু সামান্য কারণে তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করেনি। করেছিল,তুমি ওর মাকে ফেলে অন্য নারীতে মজে…”
এ অবধি এসেই থামলেন তনিমা। ভেজা কণ্ঠের রাশ টেনে বললেন,
“ থাক ওসব। পুরোনো কথা না তোলাই ভালো। যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো।”
তনিমা হাত চালালেন বালিশ গোছাতে।
কিন্তু শওকত আর সহজ হতে পারলেন না। রাতের সবটুকু অন্ধকার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। অতীত নিয়ে এমন তীক্ষ্ণ খোঁচা, সরাসরি এসে বিঁধল বুকের খাঁজে।
সেই যুবক বয়সে করা একটা ভুল, এখন সারাজীবন বইতে হবে?