কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৮
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সময়ের এক নরম,আবছা ক্যানভাসে হেলে পড়ছে সূর্য। লালচে-সোনালি আকাশে তখন দাপুটে পাখিদের আনাগোনা। ওদের নীড়ে ফেরার তাড়ায়,পাখা ঝাপটানোর শব্দে একরকম ক্লান্ত সুর। নরম রোদের তালে গাছের ছায়াগুলো মাটিতে দীর্ঘ হয়ে ভাসছে। চারপাশে অসংখ্য সবুজের মাঝে,একটা সাদা রঙের গোলটেবিলে বসে আছে অয়ন। ফরসা,সুতনু মুখখানায় প্রগাঢ় চিন্তা তার। হাস্যহীন ঠোঁট দুটো একটার গায়ে আরেকটা চেপে বসেছে। সামনের মেলে রাখা মোটা বইটায় মনোযোগের ছিঁটেফোঁটাও নেই। অদূরের শ্যাওলা পড়া দেওয়ালে নিষ্পলক চেয়েছিল অয়ন। আচমকা পাশের চেয়ার টানার শব্দ হলো। ধ্যানের সুতো ছিঁড়ে চমকে পাশ ফিরল ছেলেটা। ইয়াসির বসেছে মাত্র। হাতের ভাঁজে ল্যাপটপ। অয়ন সোজা হয়ে বসল অমনি। হাসার চেষ্টা করল ঠোঁট টেনে।
মুখ খোলার আগে প্রশ্ন এলো ওদিক থেকে,
“ কী ভাবছিলি?”
“ হুঁ? কই,কিছু না।”
“ হয় বই পড়,নাহয় বন্ধ করে রাখ।”
“ না, পড়ছি তো।”
পড়ছি বললেও বেখায়ালির মতো খোলা বইটা অয়ন বন্ধ করে ফেলল।
ইয়াসিরের কপালে ভাঁজ বসল তাতে। অগোছালো, উদাস চিত্তের ছেলেটাকে সূক্ষ্ম চোখে দেখল সে।
প্রশ্ন করল দ্বিতীয় দফায়,
“ কী হয়েছে তোর?”
“ হু? কই,কিছু না। পড়ছিলাম তো।”
ইয়াসির ভ্রু উঁচাল ,
“ বই বন্ধ রেখে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অয়ন যেন হুশে এলো। মুখ তুলল চটক কাটার ন্যায়। বই বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে সামনে। ও তাহলে কী পড়ছিল এতক্ষণ? ছেলেটা চোখ খিচে চ সূচক শব্দ তুলল জিভে। কপালে হাত ঘষতে দেখে জিজ্ঞেস করল ইয়াসির,
“ আর ইউ ওকে অয়ন? কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
“ না না। আসলে একটু টেনশান হচ্ছে ক্যাম্পেইন নিয়ে। সিম্পল ব্যাপার ভাইয়া!”
“ তোর মুখে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না সিম্পল!”
“ না ভাইয়া,ঠিক আছি আমি। আচ্ছা ছাড়ো,নাস্তা করেছ তুমি?”
“ না, পরে।”
“ তুমি তো কখনো গার্ডেনে আসো না, হঠাৎ এলে!”
“ কেন, বিরক্ত করলাম!”
অয়নের কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ না না। তা কখন বললাম? এসেছ ভালো হয়েছে। তুমিও ব্যস্ত,আমিও। কথাই হয় না আমাদের।”
তারপর থামল সে। যেন সময় নিলো একটু। খুব স্পষ্ট একটা উশখুশে ছাপ বসল গৌড় ত্বকের মাঝে।
হয়ত বুঝল ইয়াসির। জিজ্ঞেস করল,
“ কিছু বলবি?”
অয়ন অপ্রস্তুত হাসল। বলল,
“ না। কিছু না।”
কিন্তু ইয়াসিরের খটকা লাগল। মেলে রাখা ল্যাপটপ বন্ধ করল হাত দিয়ে। পুরোপুরি ফিরল ভাইয়ের দিকে। মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
“ যেটা মনে আছে বলে ফ্যাল। নিজেদের মধ্যে এত ইতস্ততা কীসের?”
অয়ন ফের হাসল। নিজেকে তৈরি করা, অথবা বিব্রতকর হাসি! চপল ছেলেটার মাঝে আচমকা এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণ ইয়াসির বোঝেনি। ওকে সহজ করতে প্রসঙ্গ পালটায় সে,
“ ক্যাম্পেইন কেমন যাচ্ছে?”
“ ভা ভালো।
প্রতিদিন যে এত বাচ্চা অসুস্থ হয়, একেকটা ভয়াবহ রোগে ভুগতে পারে,এই পেশায় না এলে আমি হয়ত কোনোদিন বুঝতাম না।”
একপেশে হাসল ইয়াসির। ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“ তাহলে আমার কী বলা উচিত? প্রতি সেকেন্ডে যে দেশে এত ক্রাইম হয়,হাজারটা খুন, হাজারখানেক নৃসংশতা, পুলিশ অফিসার না হলে আমিও কী জানতাম!” অয়ন বলল,
“ তা আর বলতে! তোমার ওপর দিয়ে তো কম ঝামেলা যাচ্ছে না। একেবারে ঘরে-বাইরে সমান সমান।”
ভ্রু গোটায় ইয়াসির
“ ঘরে কী ঝামেলা?”
অয়নের উত্তর তৈরি,
“ কেন,ঐ তুশি মেয়েটা। ও এখন তোমার জীবনের অন্যতম সমস্যা নয়?”
ইয়াসিরের মুখের ধরণ পালটে গেল। স্বভাবসুলভ ভারী হলো স্বর,
“ না। ওইটুকু পুচকে মেয়ে আমার সমস্যা হবে কেন?”
কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলল অয়ন।
“ কী বোলছো ভাইয়া!
যে তুমি একটু অন্যায় দেখলেও বরদাস্ত করো না সেই তোমার বউ একটা চোর হয়ে গেছে। তাও লোক ঠকানো বিয়ের মতো ঘটনা! রাগ থেকেই তো মেয়েটাকে আটকে রাখলে এখানে। প্রতিনিয়ত সকাল-বিকাল মেয়েটাকে চোখের সামনে দেখছো,সহ্য কোরছো। এটা ঝামেলা নয়?”
ইয়াসির কিছু বলতে গিয়েও, বলল না। ঠোঁট টিপে চুপ করে রইল। সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে, ধীরস্থির জানাল,
“ না।”
অয়ন নড়েচড়ে বসল। সাগ্রহে শুধাল,
“ আচ্ছা মেনে নিলাম। কিন্তু বাকি সব?
ও যে তোমার স্ত্রী, তাতো মিথ্যে নয়। তাহলে?”
মৃদূ ধমকাল ইয়াসির,
“ মায়ের মতো কথা বলবি না। কীসের স্ত্রী? এই বিয়ের কোনোরকম কোনো ভেল্যু আমার কাছে নেই।”
অয়ন বিস্মিত হয়ে বলল,
“ হ্যাঁ? এর মানে তুমি ওকে শুধু এখানে আটকেই রাখবে? সংসার টংসার করবে না? সারাজীবন একটা মেয়েকে এমন জিম্মি করে রাখা তো অনেক বড়ো অন্যায়,ভাইয়া।”
ইয়াসির চোখ ছোটো করল,
“ তোর কি মাথা গেছে অয়ন? সারাজীবন ওকে কেন রাখব এখানে? ওকে আমি যে কারণে এনেছি, আমার যদি মনে হয় সেটা হয়েছে তাহলে আমি নিজে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”
অয়নের কণ্ঠে কৌতূহল,
“ কী কারণ?”
ইয়াসির ফের চুপ করে গেল। বলল তারপর,
“ আছে কিছু একটা। কিন্তু এই মুহুর্তে চাইছি না সেটা অন্যকেউ জানুক।”
অয়নের সন্দেহ হোলো। কী এমন কারণ? ঠোঁট কামড়ে সেকেন্ড কয়েক ভাবল সে। কিন্তু রহস্যের তল পেলো না। জিজ্ঞেস করল সময় নিয়ে,
“ কিন্তু মামুনি যে চান তুমি ওকে নিয়ে হ্যাপি ফ্যামিলি লিড করো। সেটার কী হবে?”
ইয়াসির স্পষ্ট জবাব দিলো,
“ দ্যাটস নট পসিবল। আই’ল ডিভোর্স হার সুন।”
অয়নের চোখ বেরিয়ে এলো। হতভম্ব আওড়াল,
“ ডিভোর্স! সত্যি সত্যি ডিভোর্স দিয়ে দেবে?” সরু চোখে চাইল ইয়াসির। বলল সোজাসাপটা,
“ তো? কেন দেবো না! যাকে আমি স্ত্রী হিসেবে মানিনি। যার প্রতি আমার না আছে সম্মান,না আছে ভালোবাসা তার সাথে অহেতুক একটা সম্পর্কের বোঝা বয়ে নেওয়ার তো মানে হয় না। শুধু আমি কেন, ওই চোর মেয়েও হয়ত আমাকে নিয়ে একইরকম ভাবে। আমরা দুজনেই একটা উদ্ভট সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে গেছি। যার কোনো ভিত্তি নেই,সেটা যত কম বাড়ানো যায়,তত ভালো!”
অয়ন অধৈর্য হয়ে বলল,
“ আর ইউ শিয়র ভাইয়া? তাহলে মামুনি,দিদুন এরা?”
“ সেসব আমি বুঝব। তুই হঠাৎ মেয়েটাকে নিয়ে এত প্রশ্ন করছিস কেন?”
নিভে এলো অয়ন। উদ্বীগ্ন মুখখানায় থতমত খাওয়ার চিহ্ন বসল কিছু। নিচু স্বরে বলল,
“ না, আসলে এমনিই। এতদিন হয়ে গেল এসব নিয়ে তোমার সাথে কথা বলা হয়নি। ইউশার কাছে শুনেছিলাম অনেক কিছু। তাই আরকি আজ জানতে চাওয়া। কিন্তু ভাইয়া,তুমি শিয়র তুমি তুশিকে ছেড়ে দেবে?”
ইয়াসির শক্ত কণ্ঠে বলল,
“ শিয়রের কিছু নেই। এটাই একমাত্র সত্যি। খুব তাড়াতাড়ি একজন লইয়্যারের সাথে কথা বলব আমি। তুইপড়ছিলি না,পড়।”
অয়ন মাথা ঝাঁকাল। কিন্তু পড়ল না। বইটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল হঠাৎ।
“ রুমে যাচ্ছি। কাজ আছে কিছু। তুমি থাকো।”
ইয়াসির ঘাড় নাড়ল। নিঃশব্দে বোঝাল তার সম্মতি। অয়ন পিছু ঘুরে পথ ধরল বাড়ির। এক ফালি কোমল রোদের ছটায় মুখায়ব চকমকে তার। হঠাৎই একটা তীক্ষ্ণ,বাঁকা হাসি নিটোল ওষ্ঠপুটে শির তুলে চাইল। কেমন করে হাসল অয়ন। বুক ফুলিয়ে ভীষণ দীর্ঘকায় শ্বাস টানল তারপর। যেন নেমেছে,খুব ভারি মস্ত বড়ো কিছু একটা বুক থেকে নেমে গেছে এক্ষুনি। সাথে উবে গেছে তার সমস্ত দোটানা, সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
ইয়াসির আজ থানায় যায়নি। হাতে উত্তাল কেস-টেস নেই বলে ফুসরত পেয়েছে কিছুটা। সন্ধ্যের পর বসার ঘরে বসেছিল সে। এক ফাঁকে তনিমা এসে সামনে চা রেখে গেলেন। বিশালাকার টেলিভিশনে চোখ রেখেই কাপ হাতে তুলল ছেলেটা। তার একটু পরেই নামল অয়ন। মিন্তু চানাচুর চিবোচ্ছে। ও পাশে বসল। কটমট শব্দ শুনে বিরক্ত চোখে বলল,
“ গোরুর মতো চিবোচ্ছিস কেন? আস্তে খা।”
মিন্তু চোখ বড়ো করল। খুব কৌতূহল নিয়ে বলল,
“ গোরু বুঝি এভাবে চিবোয়? ওদেরও কি আমাদের মত ৩২ টা দাঁত আছে?”
“ তোর ৩২ টা নেই, ৩১ টা হবে। কারণ উদ্ভট প্রশ্নের জন্যে এক্ষুনি চড় মেরে আমি একটা ফেলে দেবো।”
মিন্তু মুখ গোজ করে বলল ,
“ তুমি আর ইউশা এক রকম। আমাকে এত ধমকাও কেন তোমরা? ছোটো বলে কি আমার মান ইজ্জত নেই?”
ইউশার কথা উঠতেই আশেপাশে চাইল অয়ন। জিজ্ঞেস করল,
“ কোথায় তোর বোন? বিকেল থেকে দেখা নেই। ঘুমোচ্ছে?”
“ না, ভাবির ঘরে।”
এতক্ষণ টিভিতে মগ্ন ইয়াসির, অমনি ঝট করে তাকাল। বলল খুব নিম্বভার স্বরে,
“ ও তোর ভাবি নয়। এসব যেন আর না শুনি।”
চুপসে গিয়ে মাথা নাড়ল ছেলেটা। অয়ন হাঁক ছুড়ল মাকে।
“ মামুনি,চা খাব।”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
“ আসছি।”
একটু পরেই এলেন তিনি।
চা রাখতেই, ইয়াসির বলল
“ সারাক্ষণ রান্নাঘরে কী করছো এত? বোসো এখানে।”
তনিমা বললেন,
“ বসে কী করব? তুই কি গল্প করবি আমার সাথে? শুধু তো শুনবি। সব সময় কি বক্তা হতে ভালো লাগে? একটু তো শ্রোতা হতেও মন চায়।”
ছোট্ট শ্বাস ফেলল ইয়াসির,
“ আচ্ছা,বলব । বোসো।”
তনিমা খুশি হলেন। হাত গুছিয়ে বসলেন অয়নের পাশে।
কথা শুরুর আগেই তুশির ঘর থেকে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বের হলো ইউশা।
স্ফূর্ত পাখির মতো বলল,
“ ও বড়ো মা,ও বড়ো মা দেখো দেখো।”
তার চিৎকারে সরব সারাবাড়ি। আওয়াজ শুনে এক যোগে পিছু ঘুরল সকলে। তুশিকে ধরে ধরে এনে দাঁড় করিয়েছে ইউশা। মেয়েটার পায়ের হাড় নড়বড়ে। এক্সরের করায় ধরা পড়েছে ব্যাপারটা। সেজন্যে কেউ না ধরলে হাঁটতে পারে না। তবে আজ পায়ের থেকেও,তার বেশভূষায় নজর আটকে গেল সবার। রেশমী ছাদের কাপড় নিয়ে নিচে নামছিল। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই চোখ পড়ল তুশির দিকে। বিস্ময়ের তোড়ে হাত থেকে পড়ে গেল সেসব। আর্তনাদ করল মিহি স্বরে,
“ ও আল্লাহ! এইডা ক্যাডা?”
তুশি লজ্জা পেলো একটু। চিবুক নামিয়ে নিলো নিচে। তনিমা দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখজোড়া গোলাকার,বিকট করে আপাদমস্তক দেখলেন মেয়েটার। সব সময় আলুথালু পোশাক জড়ানো তুশির পরনে লাল রঙের শাড়ি। নিঁখুত তার কুচির ভাঁজ। কোকড়ানো জট বাঁধা চুল স্ট্রেইট করে পিঠ অবধি নেমেছে। ভীষণ ফরসা মুখে মেক আপের ছোঁয়া। পুরন্ত ঠোঁটদুটো লিপস্টিকে ভরতি।
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন,
“ এ আমি কাকে দেখছি? এ কি আমাদের তুশি?”
ইউশা গর্বের হাসি হাসল। বলল মাথা নেড়ে,
“ কেমন চমকে দিলাম সবাইকে? সকাল সকাল পার্লার থেকে লোক এনে করিয়েছি এসব। কত সুন্দর লাগছে না বলো!”
মিন্তু স্ফূর্ত কণ্ঠে বলল,
“ হ্যাঁ। এক্কেবারে ঐশ্বরিয়ার মতো।”
অয়নের হাতে চায়ের কাপ ছিল। অথচ চুমুক দিতে ভুলে গেল ছেলেটা। মুগ্ধতা আর অভিভূতি, দুইয়ের মিশেলে যে অনুভূতি হয়? সেই অনুভূতির এক গাঢ় প্রসারণে হাঁ করে চেয়ে রইল সে।
অন্যমনস্ক চিত্তে একটু শ্বাস নিলো অয়ন। বুকের কোথাও কিছু ভারী ভারী লাগছে। অপ্রতিভ মেজাজের রাশ টানতে চোখ নামাল সে। লুকোতে চাইল তুশির দিকে ছুঁড়তে থাকা ওসব বিমোহের বান।
কিন্তু তুশি! তার ধ্যান আপাতত ইয়াসিরের ওপর। লোকটা কি ওকে দেখছে? ইউশা সাজানোর সময় বলেছিল,ওকে এভাবে দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন উনি। পড়েছে কী? চোখের কোণ তুলে কোনোরকম চাইল তুশি। ইয়াসির তাকিয়েছিল। তবে ওই তাকানোতে বিশেষ প্রাণ নেই। খুব জোর সেকেন্ড কয়েক নিঃশব্দ দৃষ্টি ফেলে, ফের মুখটা ঘুরিয়ে নিলো সে। হাসল না,কথা বলল না। এমনকি একটা আওয়াজও এলো না বাইরে। তনিমা এপাশে সরে এলেন। তুশির সামনে দাঁড়িয়ে আরো ভালো করে দেখলেন ওকে। চিবুক ছুঁয়ে বললেন,
“ মাশ আল্লাহ, মাশ আল্লাহ! পরীর মতো লাগছে। আমার সার্থের জন্যে এমন টুকটুকে একটা বউমাই তো চেয়েছিলাম আমি।”
তুশি বিব্রত হলো। ঘাড় চুলকাল অপ্রস্তুত ভাবে। কিন্তু তপ্ত চোখে ফিরল ইয়াসির। তেমনই উষ্ণ তার স্বর,
“ মা!”
ভদ্রমহিলা থতমত খেলেন,
“ ইয়ে মানে, মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে।”
ছেলেটা বিরক্ত হোলো। বাকি চা আর খেলো না। কাপ নামিয়ে উঠে দাঁড়াতেই তনিমা শুধালেন,
“ বলছিলাম যে,ওকে কেমন লাগছে বললি না তো।”
“ আমি বলতে যাব কেন? আশ্চর্য!”
“ না আসলে, ইউশা সাজাল তো। বোনের জন্যে বলতি নাহয় একটু। কেমন কী লাগছে?”
“ এসব সার্কাজমের জন্যে অনেক সময় পাবে। এই চোরের পায়ে এক্ষুনি এত প্রেশার দেয়া বারণ। ঘরে নিয়ে যা ওকে।”
শেষটুকু ইউশাকে বলল ও। তারপর লম্বা পায়ে কক্ষে রওনা করল। তনিমা হতাশ হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফোস করে।
নাহ,এই ছেলে দিয়ে হবে না। এর দ্বারা আশা নেই। বললেন মৃদূ গলায়,
“ যা,ওকে নিয়ে যা। এই অবস্থায় এত হাঁটাস না। সমস্যা হতে পারে।”
ইউশা মাথা নাড়ল।
তুশি হড়বড় করে উঠল,
“ হ্যাঁ চলো, এসব পালটে ফেলি। গা কুটকুট করছে। গরম লাগছে। চুলটাও বাধব। আর এসব সাজব না। কেমন মেয়ে মেয়ে লাগছে আমাকে!”
ইউশা চোখ পাকিয়ে বলল,
“ চুপ করো। তুমি তো মেয়েই,মেয়ে মেয়ে লাগবে না কেন?
আর খবরদার এসব খুলে ফেলার কথা ভুলেও বলবে না। কত সুন্দর লাগছে তোমাকে, তুমি জানো?”
“ না।”
“ জানবে কী করে?
নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখেছ? বড়ো মা,রেশমী, মিন্তু , অয়ন ভাই তোমরা বলো সুন্দর লাগছে না ওকে?”
অয়ন জবাব দিলো না। আড়চোখে একবার তাকাল শুধু। পরপর গলা ঝেড়ে বসা থেকে উঠে গেল সেও। ইউশার মুখ কালো হোলো একটু!
সবাই এমন করছে কেন? অয়ন ভাইও মেজো ভাইয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে ইদানীং। কিন্তু সজোরে মাথা নাড়ল মিন্তু। রেশমী প্রকট চোখে বলল,
“ লাগতাছে মানে! পুরা নায়িকা বানাইলাইছেন আফা। আমিতো দেইক্ষা কই এই সুন্দর বেডিডায় কেডা। দ্যাহেন না,হাত দিয়া সব কাফইরডি পইররা গ্যালো।”
বলতে বলতে ওসব ফের তুলল সে। তনিমা হেসে বললেন,
“ আমিও চমকে গেছি। ইউশা যখন বলেছিল তোমাকে সাজাবে,আমি বুঝিইনি এত ভালো লাগবে! ইউশা,কাল বরং ওর জন্যে আরো কিছু শাড়ি কিনে আনিস।”
তুশি জোরে মাথা নাড়ল,
“ না না। আমি এসব পরব না।”
ইউশা ধমকায়,
“ আবার কথা বলে! তুমি পরবে,তোমার ঘাড় পরবে। বুঝেছ? এখন চলো ঘরে।”
মেয়েটা কাঁধ আগলে ধরে নিয়ে চলল তুশিকে। ঠোঁট ফুলিয়ে হাঁটা ধরল সে। হঠাৎ মনে পড়ল কিছু একটা। ফিসফিস করে বলল,
“ অ্যাই, তুমি যে তখন বলেছিলে আমাকে দেখে বিটকেলটা মাথা ঘুরে পড়ে যাবে? কই, পড়ল না তো। সে যে দিব্যি হেঁটে হেঁটে ঘরে চলে গেল।”
ইউশার মন খারাপ। এত কষ্ট করে তুশিকে সাজাল, ভাইয়া দেখলই না। তুশির বোকা বোকা কথায় সেটা বাড়ল আরো। বিরক্ত গলায় বলল,
“ উফ! ওটা তো কথার কথা বলেছিলাম। ধরে বসে আছ?”
“ ও আচ্ছা।”
পরপরই অনুনয় করল তুশি,
“ ইউশা আমাকে শাড়ি-ফারি এনে দিও না পিলিচ। আমার এসব পরতে ভালো লাগে না।”
“ লাগবে। আস্তে আস্তে সয়ে যাবে,তুশি। তুমি কত সুন্দর! এত সুন্দর যদি আমি হোতাম না? শোনো,নিজের যত্ন নাও দেখবে আমার ভাইয়া কেমন পাগল হয়ে পিছু ঘোরে তোমার!”
তুশি কিছু বলল না। ইউশা ওকে সাজাতে চাইছে সাজাক। কিন্তু ইয়াসির পিছু ঘুরবে? ওই বিটকেল, অহংকারী পুলিশটা? তা কখনো হয়!
তুশির পায়ের অবস্থা মোটামুটি। ওইদিন সন্ধ্যের পরপর ব্যথা বাড়াতেই তনিমা ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেছিলেন। এক্সরে রিপোর্টে এলো, হাড় নড়ে গেছে। হাঁটাচলা নিষেধ। তবে সপ্তাহখানেক পার হয়েছে এর। এখন একটু একটু হাঁটে ও। তাও কাউকে না কাউকে ধরতে হয়! তবে এতে তুশির বিশেষ দুঃখ নেই। সে তো আরামেই আছে। কোনো কাজ করতে হচ্ছে না। খাবারটা অবধি ইউশা নিয়ে আসে ঘরে। এতদিন তো ওকে ধরে ধরে ওয়াশরুমেও নিয়ে যেতে হয়েছে।
মেয়েটার কাছে তুশি বড্ড কৃতজ্ঞ। এতটা খেয়াল তো ওর দাদি ছাড়া কেউ কখনো রাখেনি। কিন্তু দাদির নাহয় ও নিজের কেউ, তাই ভালোবাসেন তিনি। অথচ ইউশা,ও তো তুশির কেউ নয়। তাহলে এত ভালোবাসা কীসের? একদিন একটা সুযোগ আসুক, এই ভালোবাসার সমস্ত ঋণ ভালোবেসেই চুকিয়ে দেবে তুশি।
ও মন মরা হয়ে পায়ের প্লাস্টারটা দেখল। আরো কদিন পর খুলবে এটা৷ খুললেই বাঁচে। এসব পরে হাঁটতে ভালো লাগে? এর মাঝেই ইউশা এলো ঘরে৷ হাবভাবে তাড়াহুড়ো তার। বলল,
“ এখনো ঘুমাওনি। শুয়ে পড়ো,শুয়ে পড়ো। আমাকে কাল অনেক তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।”
“ কেন? কী আছে কাল?”
ইউশা মলিন মুখে বলল,
“ কাল সায়ন ভাইয়ার মৃত্যু বার্ষিকী। প্রতি বছর এই দিনে এতিমখানায় খাবার দেয়া হয়। ত্রাণ দেয়া হয়৷ আর বাড়ির সবাই মিলে ভাইয়ার কবর জিয়ারতে যায়। বড়ো মা এত কাঁদে না এদিন!”
তুশিরও মন খারাপ হোলো।
“ ওহ।”
ইউশা আর কথা বাড়াল না। বালিশ ঠিকঠাক করে বলল,
“ কাল আম্মু আসবে। তারপর তোমার কাছে শুতে দেবে কীনা চিন্তায় আছি আমি। আমি না থাকলে তো কিছু করতেও পারবে না। ভাইয়ার সাথে কথা বলতে হবে,বুঝেছ।”
তুশি বলল,
“ কী হবে কথা বলে? উনিও দেবেন না আমি জানি।”
“ ঘোড়ার ডিম জানো তুমি। ভাইয়াই তো আমাকে বলেছিল,তোমার সাথে ঘুমোতে। তোমার কী লাগে না লাগে দেখতে।”
খুব অবাক হয়ে চাইল তুশি। হেসে ফেলল ইউশা।
ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“ ভাইয়া অনেক ভালো বুঝলে! দেখতে একটু মেজাজি হলেও,ভাইয়া কত দায়িত্ববান তুমি নিজেও জানো না। আচ্ছা অনেক রাত হোলো, ঘুমাই। গুড নাইট! স্বপ্নেও আমার অনেক কাজ। অয়ন ভাই আসেন তো।”
তুশি হেসে উঠল। লজ্জা লজ্জা ভাব করে গায়ে কাঁথা টেনে শুয়ে পড়ল ইউশা। আলো নেভাতেই, তুশির জ্বলজ্বলে নেত্রমণি তাক হলো অদূরের জানলায়। কোথাও না কোথাও গিয়ে ইউশার কথাতে আটকে রইল মনটা। মনে হলো, ইয়াসির ভালো। সত্যিই ভালো। নাহলে একটা বস্তির চোর মেয়ের জন্যে কেউ এত কিছু করে?
বাইরে প্রচণ্ড কোলাহলের শব্দে ঘুম ভাঙল তুশির। পাশটা খালি। ইউশা নেই,দরজা ভেজানো। তুশি প্রকৃতি দেখে বুঝল,বেলা হয়েছে অনেক।
ও কোনোরকম সাবধানে পা ফেলে খাট থেকে নামল। খুড়িয়ে খুড়িয়ে এসে দাঁড়াল চৌকাঠে। বসার ঘরে তখন মানুষের ভীড়।
পুরুষ প্রত্যেকের পরনে সাদা রঙের পোশাক। মাথায় টুপি। একেকটি চেহারা যেন নূরের মতো প্রজ্জ্বল।
এদের কাউকে তুশি চেনে,কাউকে চেনে না। সায়নের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সে উপলক্ষ্যেই কি এসেছে সবাই?ও আশেপাশে চাইল। খাবার টেবিলের এক কোণে বসে আইরিন, ইউশা প্যাকেট করছে কিছু। দুজনের মাথাতেই বড়ো করে ঘোমটা টেনে রাখা। হঠাৎ সামনে থেকে ছুটে এলো মিন্তু। আগ বাড়িয়ে হাত পাতল সামনে,
“ উঠেছো তুমি? এসো,আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
হাসল তুশি। ইউশার ভাই ঠিক ওরই মতো মিশুক,ভালো। এরা যে কী করে ঐ জল্লাদ মহিলার পেট থেকে বের হোলো!
মিন্তু ধরে ধরে বসার ঘরে নিয়ে এলো তুশিকে। অয়ন কাজ করছিল। ওকে দেখেই ফেলে এলো সেসব। নিজ দায়িত্বে সোফার ওপরে রাখা প্যাকেট গুলো নামিয়ে দিয়ে বলল,
“ বোসো।”
তুশি শঙ্কিত একটু! ওইদিন অহেতুক যা একটা ধমক দিলো লোকটা। বসল ভয়ে ভয়ে। অয়ন বলল,
“ বাড়িতে কোরআন পাঠ হচ্ছে। এ সময় মাথায় কাপড় দিতে হয়।”
তুশি বাধ্যের ন্যায় বলল,
“ আচ্ছা।”
তারপর হাতটা তুলে চুল ঢাকল সে। অয়নের ডাক পড়ল বাইরে। ততড়িঘড়ি করে বিদেয় নিলো সে। তুশির সোজাসুজি সোফায় জয়নব বসে ছিলেন। বিমর্ষ আদলের প্রৌঢ়া চোখ বন্ধ করে ফোঁপাচ্ছেন শুধু। পাশে বসা তনিমা আঁচলে মুখ চেপে রেখেছেন। চোখে ঝুপঝুপ করছে জলের কণা। একইরকম কাঁদছেন তিনিও। বাড়িতে এতগুলো মানুষ, অথচ কারো ঠোঁটে হাসি নেই। এতটা নিস্তব্ধ,আর নিশ্চুপতা তুশি আগে কোথাও দেখেনি। ও বুঝল, সবার এই কান্না, এই বিষন্নতা সায়নের জন্যে। আহারে,কত ছোটো বয়সে মরে গেল ছেলেটা! বেঁচে থাকলে দুই ভাইয়ের মতো বড়ো হতো নিশ্চয়ই। তনিমার কান্নায় এত কষ্ট হোলো তুশির! মন চাইল,উঠে গিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আসতে। আচ্ছা,তুশি তো বেঁচে থেকে কিছু করতে পারল না। লোকের পকেট মারা ছাড়া ওর কোনো যোগ্যতাই নেই।
ওর আয়ুটা সায়ন ছেলেটাকে দিলেও তো পারতো। অন্তত বড়ো হবার পর সফল হয়ে,দেশের জন্যে কিছু করত সে! তুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
হঠাৎ চোখ পড়ল রেহনূমার দিকে। মুখ কালো করে দুহাতে দুটো বড়ো সাইজের গামলা নিয়ে আসছিলেন তিনি। ওতে ভরতি পায়েস।
তুশি মুখ ঘুরিয়ে নেবে ভাবলেও,কেন যেন তাকাল। মনে হলো,দুটো সামলাতে কষ্ট হচ্ছে ওনার। শরীরটা টেনেটুনে উঠে দাঁড়াল তাই। যেচে বলল,
“ আমাকে দিন। আমি নিয়ে যাই।”
রেহনূমা থামলেন। একটু অবাক হলেন ব্যাপারটায়। পরপর গম্ভীর মুখে বললেন,
“ থাক,পা ভেঙেছ না? কাজের দরকার নেই। বসে থাকো।”
তুশির ভ্রু কপালে চলে এলো। কণ্ঠ শৃঙ্গে,
“ হ্যাঁ?”
“ কী হ্যাঁ, সরো।”
পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। কিন্তু তুশি তাজ্জব চোখে হাঁ করে রইল। ঠিক শুনেছে ও? এই মহিলা সত্যিই এসব বলেছে? বাবা! যে পারে না তুশিকে সারাক্ষণ রান্নাঘরে বসিয়ে রাখতে,সে বলছে বসে থাকো ?
তুশির ওঠাবসা একটু কষ্টের। পাছে পায়ে ব্যথা লাগে!
বসতে গেল, আচমকা নজর পড়ল সিঁডিতে। ধবধবে,সফেদ পাঞ্জাবি পড়ে নামছে ইয়াসির। মাথায় টুপি। চোখমুখের দীপ্ত এক আভিজাত্য তার! তুশি আর বসল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সে পথে। ইয়াসিরকে এই পোশাকে আগে দেখেনি ও। হয় ইউনিফর্ম, নয় টিশার্ট! পাঞ্জাবি পরলে কাউকে এত সুন্দর লাগে? কী চোখ,কী নাক,চিবুকের কী তীক্ষ্ণ কাঠামো! তুশি খেই হারাতে গিয়েও পিঠ সোজা করল। হকচকাল স্বীয় চিন্তার বহরে। চোখ সরিয়ে গলা ঝাড়ল। তাকাবে না তাকাবে না করেও, তাকাল আবার। আবার মাথা নোয়াল। দৃষ্টির এই লুকোচুরির মাঝেই,
হুট করে ফিরল ইয়াসির। সোজাসুজি, ঠাড় ওই চাউনিতে ভড়কে গেল মেয়েটা। অপ্রস্তুতিতে ধপ করে বসে পড়ল জায়গায়।
পাটায় লাগল খুব! যন্ত্রণায় চোখ খিচে নিলো তুশি। অথচ মুখ থেকে টু শব্দও এলো না বাইরে। উঠোনে রান্নাবান্নার আয়োজন বসেছে। যে পদ শেষ হয়,সেটাই বিশাল ড্যাকে ঢেলে তোলা হচ্ছে পিক্যাপে।
সাইফুল ব্যস্ত সে নিয়ে। ইয়াসির নিচে নামতেই এগিয়ে এলেন। একটা ফর্দ মেলে বললেন,
“ এখানে এতিমখানার লিস্ট করেছি। তুই একবার দেখে নে তো।”
ইয়াসির ফর্দটা ধরল। তবে তার নজর অন্য কোথাও। শওকতকে দেখিয়ে বলল,
“ উনি এখানে কী করছেন?”
নিজের দিকে আঙুল দেখে,কাজ থামিয়ে চাইলেন শওকত। পরিস্থিতি বিগড়ে যাওয়ার একটা স্বল্প আঁচ পেয়ে গেলেন সাইফুল। কাঁধে হাত রেখে, স্বর নামিয়ে বললেন,
“ দ্যাখ বাবা,আজকের দিনে আর এসব…”
ইয়াসির পুরোটা বলতে দিলো না। চাচাকে এড়িয়ে সরাসরি বাবার দিকে চাইল সে। বললও সোজাসুজি,
“ মেজর শওকত আলী, দয়া করে আপনি আমার ভাইয়ের কোনো কিছুতে হাত দেবেন না।”
তার উঁচু কণ্ঠ পৌঁছে গেল বাড়ির কোনাকুনিতে। সরব ঘর নীরব হোলো। কাজে বহাল মানুষগুলো চাইল ফিরে। ইউশা,আইরিন মুখ দেখল নিজেদের। শওকতের চেহারা থমথমে হয়। এক পল স্ত্রীর পানে চাইলেন তিনি৷ জয়নব বললেন,
“ দাদুভাই! আজ তো সায়ন দাদুভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের দিনে অন্তত এসব রাগারাগি ছেড়ে দাও।”
ইয়াসির চড়া গলায় বলল,
“ না। আজ-কাল বলে কিছু নেই দিদুন। উনি আমার ভাইয়ের কোনো কাজে নিজেকে জড়াবেন না। না মানে, না।”
সাইফুল অতীষ্ঠ গলায় বললেন,
“ কেন এমন করছিস সার্থ? এমনি সময় যেমন তেমন হলেও, বাড়িতে আজ এত লোক! এর মধ্যে তোর এসব সিনক্রিয়েট না করলেই নয়?”
“ আমি কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না বলেই, এত শান্ত ভাবে বললাম ওনাকে। তুমি তোমার ভাইকে এসব থেকে দূরে থাকতে বলো,ব্যস! তাহলেই তো মিটে যাচ্ছে সব।”
শওকত মুখ খুললেন এবার। নরম কণ্ঠে বললেন,
“ আমি কেন দূরে থাকব সার্থ? কেন আমি ওর কিছুতে হাত দেবো না? তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি ওর বাবা। ও আমার সন্তান। ওর সব কিছুতে তোমার আগে আমার অধিকার আছে।”
ইয়াসির হেসে ফেলল। বিদ্রুপের হাসি। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“ তাই নাকি!
আপনি ওর বাবা? তা যেদিন ঐ প্রচণ্ড শীতের মধ্যে আমি আর আমার মা, আমার ভাইয়ের লাশ নিয়ে হাসপাতালে বসেছিলাম,সেদিন আপনার এই পিতৃত্ব কোথায় ছিল?
যখন সায়নের চিকিৎসার জন্যে আপনাকে বারবার ফোন করা হচ্ছিল,আর আপনি মুখের ওপর লাইন কেটে দিচ্ছিলেন,তখন আপনার পিতৃত্ব কোথায় ছিল? তখন আপনার মনে হয়নি,আপনার সন্তান আছে? আপনি কারো বাবা! আজ খুব অধিকার দেখাচ্ছেন তাই না?”
পরপরই কঠিন চোখে চাইল ইয়াসির। দাঁত চেপে বলল,
“ আমার মাকে মানসিক ভাবে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে, আপনার শান্তি হয়নি? অধিকার ফলাতে এসে নতুন অশান্তি চাইছেন এখন!”
শওকত হতবাক হয়ে বললেন,
“ সার্থ,তুমি আমার সাথে কীভাবে কথা বলছো? হ্যাঁ মানছি আমার ভুল ছিল। সেজন্যে আর কতবার ক্ষমা চাইব আমি? ঐ একটা ভুলের জন্যে,আর কতভাবে কথা শোনাবে তোমরা আমাকে?”
ফুঁসে উঠল ইয়াসির,
“ কীসের ভুল? অন্যায়টাকে ভুল বলে চালিয়ে দেবেন না মেজর।
ঘরে স্ত্রী রেখে অন্য নারীতে আসক্ত হওয়া ভুল? সন্তান ফেলে, সংসার ফেলে ,সেই নারীকে বিয়ে করতে যাওয়া ভুল?”
তনিমা ভেজা কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলেন,
“ চুপ কর সার্থ! আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ কর তুই।”
ইয়াসির চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। মাথা ঠান্ডা করে বলল,
“ ওনাকে এখান যেতে বলো,মা। আমাদের ওনাকে দরকার নেই। ফর গড শেইক ওনাকে যেতে বলো এখান থেকে। আমি যাস্ট ওনাকে নিতে পারছি না।”
শওকতের চোখ ছলছল করে উঠল। বড্ড মায়া হোলো সাইফুলের।
বললেন,
“ সার্থ,ছাড় না এসব। যা হবার তাতো হয়ে গিয়েছে। অনেক বছর তো হোলো। সায়ন কি ফিরে আসবে বল! জন্ম মৃত্যু এসবে তো মানুষের হাত নেই। এই একটা ব্যাপার নিয়ে তুই ভাইজানের সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিস। মানুষটা ভেতর ভেতর কত কষ্ট পায় তুই জানিস না! এবার অন্তত ভুলে যা ওসব।”
ইয়াসিরের কণ্ঠ নেমে আসে। গাঢ় হয়। বলে,
“ না চাচ্চু। চাইলেও পারব না আমি। আর শুধু একটা ব্যাপার তো নয়। ওনার ওই অপরাধ,শুধু আমার মায়ের বুকই খালি করেনি। আরো অনেকে অনেক কিছু হারিয়েছে। হতে পারে সেই অনেকের মধ্যে তুমিও আছো!
সাইফুল কপাল গোছালেন,
“ আমি! আমি আবার কী হারালাম?”
ঢোক গিলল ইয়াসির। একপল চাইল বাবার দিকে। কপালে জমে থাকা ঘাম হাত তুলে মুছলেন শওকত। ইয়াসির আর বলল না সেসব। প্রসঙ্গ পাল্টাল কড়া ভাষায়,
“ আপনি প্লিজ এখান থেকে যান। আপনাকে আমার সহ্য হয় না। বাবা হিসেবে আপনি যেমন কলঙ্ক,তেমনি কলঙ্কের আমার মায়ের স্বামী হিসেবে। আমি চাই না,সেই কলঙ্ক আমার ভাইয়ের কোনো পবিত্র কাজে সামিল হোক।”
শওকত নিস্তব্ধ হয়ে পড়লেন। মুখখানা ফ্যাকাশে হলো অপমান আর ,অসম্মানের তোড়ে। ব্যথিত চোখে স্ত্রীর পানে ফের চাইলেন তিনি। জয়নব কিছু বলতে চাইলেন,দিলো না ইয়াসির। ঘোষণা করল মাঝপথে,
“ আচ্ছা বেশ! আপনি থাকতে চাইছেন যখন,থাকুন। আমি চলে যাচ্ছি।”
ইয়াসির যেতে নিলে,থামালেন শওকত। আর্দ্র গলায় বললেন,
“ না না। তুমি কেন যাবে? আমিই যাচ্ছি। সত্যিই তো,বাবা হিসেবে আমি কী করতে পারলাম? আমার জন্যেই তো…”
কথা কেড়ে নিলো ও। খুব শক্ত গলায় বলল,
“ এসব অতীত আমি শুনতে চাই না। দেরি হচ্ছে,গেলে যান এক্ষুনি।”
শওকত শ্বাস ফেললেন। কথা বাড়ালেন না আর।চাইলে পারতেন হয়ত, কিন্তু তর্কযুদ্ধের শক্তি যেন নেই। অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে চলে গেলেন ঘরে। তনিমার চোখে এক প্রস্থ জল টলমল করে উঠল। ভেজা কণ্ঠে বললেন,
“ কেন এমন করলি বাবা? মানুষটা কত কষ্ট পেয়েছে বল তো!”
ইয়াসির কাছে এগিয়ে এলো। হাঁটুমুড়ে বসল মায়ের কাছে। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
“ তুমি আজ আর কিছু বোলো না। অন্যের কষ্ট দেখতে দেখতে নিজের অনুভূতি এমন শূন্যে নামিয়ে এনেছ,তাই আজকাল কেউ তোমার কষ্ট নিয়ে ভাবছেই না। এবার অন্তত একটু নিজেকে নিয়ে ভাবো,মা। তোমার ছেলে বড়ো হয়েছে। সে আগের মতো ছোটো আর অসহায় নেই যে,সব জেনেও চুপ করে থাকবে। যে যা করেছে তোমার সাথে,তাকে ঠিক ততটুকু ফেরত দেবো আমি। দেবোই!”
ছেলের হাতটা ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন রমণী। সবার হতাশার মাঝে কেবল বাকরুদ্ধ হয়ে রইল তুশি। ঘটনার সবটা তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
অয়ন উঠোনে ছিল। রেহনূমাও সেখানে। দুজন একইসঙ্গে ভেতরে এলেন। একটু আগে দেখে যাওয়া গমগমে বসার ঘরের, নিশ্চুপতার এই ভয়ানক মোড় দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন তারা।অবসন্ন,মলিন চেহারাগুলো অয়ন একবার একবার দেখল। জিজ্ঞেস করল বিভ্রম নিয়ে,
“ কিছু হয়েছে?”
সাইফুল উল্টোঘুরে চোখের পানি মুছলেন। স্বাভাবিক থাকার প্রয়াস করে বললেন,
“ না না কী হবে? ওই সায়নের জন্যে একটু… আব,সবাই দাঁড়িয়ে কেন?
সময় নেই। হাত চালাও, হাত চালাও। অয়ন,গাডিতে খাবার উঠেছে?”
“ হ্যাঁ, আমি মাত্র উঠিয়ে দিয়ে এলাম।”
“ আচ্ছা,তাহলে আস্তেধীরে বের হই সবাই। কী বলিস সার্থ?”
নিশ্চুপ ইয়াসির মাথা নাড়ল। এক হাত ধরে দাঁড় করাল মাকে। পেশীবহুল বাহুতে আগলে নিয়ে চলল তারপর।
ইউশা এসে দিদুনকে তুলল। আইরিনও ধরল অন্যপাশ থেকে। পায়ের ব্যথায় খুব একটা হাঁটতে পারেন না প্রৌঢ়া। আস্তেধীরে সবাই বেরিয়ে গেলেও, একই জায়গায় শান্ত নদীর মতো বসেছিল তুশি।
দু চোখ জুড়ে প্রশ্ন,আর বিস্ময়ের ভেলকী নিয়ে মেয়েটা চুপ করে আছে।
রেহনূমা যেতে নিয়েও থামলেন। কিছু একটা ভাবলেন ওকে দেখে। ছুড়ে ছুড়ে বললেন,
“ অ্যাই মেয়ে,বাড়ি কিন্তু ফাঁকা। আবার চুরি করে পালিও না। অবশ্য পা তো ভাঙা। পালাবে কী করে! যাক গে,সাবধানে থেকো। রেশমী আছে,কিছু লাগলে ডেকো ওকে। গেলাম,যত্তসব।”
তুশি হুহা করল না। ঠিক করে শুনেছে কিনা কে জানে!
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৭ (২)
ইয়াসিরের প্রতিটা কথা কানে বাজছে তার। বাবার প্রতি এত রাগ কেন মানুষটার? কেন বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য বাবাকে দ্বায়ী করছিলেন উনি? এমন সহজ একটা বাড়িতে,রহস্যের এত প্যাঁচ থাকতে পারে!
এই বাড়ি না এলে তুশি কোনোদিন জানতেই পারত না।