কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২০

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২০
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

মানুষে পূর্ণ কেবিন নিশ্চুপ আপাতত। উপস্থিত সবার চোখেমুখের এক পশলা বিভ্রান্তির মাঝে অয়ন সোজা তুশিকে কোলে নিয়ে ঢুকল। সামনে থাকা এত এত গুরুজন, বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলল না স্নায়ুতে। বেডের পাশে একদম যে ছোট্ট টুলটা থাকে? তুশিকে সেখানে এনে বসাল অয়ন। অমনি রেহনূমা কপাল কুঁচকে ফেললেন। কী আশ্চর্য, অয়ন এ মেয়েকে কোলে নিয়েছে কেন? ভদ্রমহিলা এক পল বাকিদের দেখলেন। নাহ,উনি ছাড়া ব্যাপারটা নিয়ে কারোর তেমন বিশেষ মাথাব্যথা নেই। সাইফুল থেকে শওকত প্রত্যেকেই স্বাভাবিক। রেহণুমাও তাই কথা তুলতে গেলেন না। ভাবলেন,বোধ হয় পায়ে ব্যথা,সার্থ ধরেনি বলে অয়ন নিয়ে এসেছে। আসুক,ক্ষতি কী! মানুষের উপকার করা তো খারাপ কিছু নয়।

অন্যদিকে চিন্তায় ভুগছেন তনিমা। শওকত হঠাৎ তুশিকে কেন ডাকল? অন্তত মানুষটার ভেতরে মেয়েটাকে নিয়ে যে কত তিক্ততা জমানো,ওনার চেয়ে ভালো কে জানে ! তুশির মতিভ্রম তখনো কাটেনি৷ অয়ন আচমকা এমন করে ছোঁয়ায় মুখশ্রীতে হকচকানোর ছাপ স্পষ্ট। ওকে বসিয়ে দিয়ে ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। কেবিনের এ মাথা হতে ও মাথায় বইতে থাকা হাওয়ার নিশ্চুপতার মাঝে,কতগুলো নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া এখানে তেমন কিছু নেই। তুশির প্রশ্নবিদ্ধ চাউনি যখন অয়নের ফরসা মুখে,তক্ষুনি মাথায় একটা কোমল হাত পড়ল। মেয়েটা ঘাড় ফেরাল চকিতে। শওকত মাথায় রাখা হাতটা চুলে বোলালেন। বড়ো নিবিড় এই ছোঁয়ায় চমকে গেল তুশি। দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নিয়ে হাঁ করে ফেলল। এক পল হাতটা দেখল,এক পল শওকতের রুগ্ন মুখ। কেমন জলের মতো নরম লোকটার দৃষ্টি। বহুদিনের জমানো রাগ,ক্ষোভ সব যেন মোম হয়ে গলছে। শুধু তুশি একা? বিস্ময় তখন কেবিনের প্রতিটা মানুষের মাঝে। তনিমা ঠোঁট ফাঁকা করে ফেলেছেন। তাজ্জব চোখ মেলে দেখছেন স্বামীকে। রেহনূমা থেকে সাইফুলও একইরকম স্তম্ভিত,বিহ্বল।
শওকত ভেজা গলায় বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ তুই না থাকলে আজ হয়ত বাঁচতাম না রে মা! একটা মৃত্যুর পথে রওনা করা মানুষকে কেমন আল্লাহর দূত হয়ে এসে বাঁচিয়ে দিলি। খুব ঋণী করে ফেললি আমায়। খুব ঋনী!”
তুশির শব্দ ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেল। ভুলে বসল চোখের পাতা ফেলার কথা । রেহনূমার পর এই বাড়িতে ওর সাথে রুক্ষ ছিলেন শওকত। দেখলেই নাক কুঁচকে তাকানো,কিংবা বিরক্ত চিত্তে মুখ ঘুরিয়ে রাখা! কখনো সামনে পড়লে কর্কশ স্বরে কিছু একটা বলা,এসব তো তুশির কাছে কদিনেই ডালভাতের মতো হয়ে গেছে। অথচ আজ!
আজকের এই মানুষটা, বা এই স্বর ও মেলাতেই পারল না। মেয়েটা চোখেমুখে ফ্যালফ্যালে বিস্ময় মেখে চেয়ে রইল শুধু।
শওকত ফোস করে শ্বাস ফেলে বললেন,

“ এতদিন বস্তির মেয়ে বলে বলে তোকে অপমান করতাম। অথচ দ্যাখ,জীবন বাঁচানোর বেলায় বস্তির মেয়েটাই এগিয়ে এলো। এলো তো এলো,নিজের পায়ের কথাও ভাবল না। আচ্ছা, এত উদার মন,এত পরিষ্কার মানসিকতা কোথায় পেলি তুই? এই যুগে এসেও এসব কারো থাকে?”
রেহনূমা চোখ ঝাপটালেন দু একবার। ইয়াসির জানিয়েছিল,শওকত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তুশি ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। এর বেশি কিছু ওনার জানা নেই। কিন্তু তাতেই ভাইজান এত গদগদ হয়ে কথা বলছে, মাথায় হাত বোলাচ্ছে কেন? প্রশ্নটা বেশিক্ষণ মনে চেপে রাখা গেল না। করেই ফেললেন রমণী,
“ ভাইজান, কী হয়েছিল একটু বলবেন? না মানে আমাদের মফিজ ভাই তেমন কিছু বলেননি। উনি সার্থকে ফোনে বললেন আপনি হাসপাতালে। সেটা শুনেই সবাই গোরস্থান থেকে সোজা এখানে ছুটে এলাম। মেয়েটা কী করেছে বলুন তো!”

“ কী করেছে? ওর পা ভাঙা।,হাটাচলা বন্ধ। এই অবস্থায় ও একা আমাকে হাসপাতালে আনল, এটুকুই কি ওর করার মধ্যে অনেক কিছু নয়?”
“ জি মানে সেতো অবশ্যই। আসলে আমি একটু ঘটনাটা জানতে চাচ্ছিলাম আরকি। এছাড়া তেমন কিছু না।”
শওকত একটু চুপ থেকে বললেন,
“ বারান্দায় বসেছিলাম। হুট করে বুকে এত ব্যথা উঠল! ঘরে দেখলাম পানি নেই। ভাবলাম নিচে গিয়ে খেয়ে আসি। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই ব্যথাটা খুব বাড়ল। হাতে জগ নিতেই এমন করে কেঁপে উঠল সবকিছু! শ্বাস আটকে আসায় জগটা হাত খসে মাটিতে পড়ে যায়। চোখের সামনে নেমে আসা অন্ধকারে শুধু দেখলাম, একটা মেয়ে নিজের ভাঙা পা-টা নিয়ে কীভাবে খোড়াতে খোড়াতে ছুটছে আমার জন্যে।”
তারপর থামলেন শওকত। ফের তাকালেন তুশির পানে। মৃদূ হেসে বললেন,

“ আল্লাহ তোর ভালো করুক,মা। খুব সুখী হ তুই!” তুশি চুপ করে রইল। তার হতবাক চাউনি এখনো ভদ্রলোকের ওপর। আবার বললেন তিনি,
“ এই কৃতজ্ঞতাটুকু থেকে আমি তোকে একটা উপহার দিতে চাই। বল মা,তোর কী চাই! যা চাইবি, আজ তোকে তাই দেবো।”
তুশি ঢোক গিলল। বারবার চোখ তুলে স্বীয় মাথায় ভদ্রলোকের হাতটাকে দেখছে সে। মেয়েটা জন্মের পর বাবাকে দেখেনি। বাবারা কেমন হয়, কীভাবে কথা বলে, কী বলে ডাকে, সেই অভিজ্ঞতা ওর শূন্যের কোঠায়! সেখানে মাথায় এভাবে কেউ হাত বুলিয়েছে কখনো? তুশির বুকের ভেতরটা টলমল করে উঠল।
হুট করে শূন্য মেয়েটার নিজেকে মনে হলো পূর্ণ,খুব পরিপূর্ণ!
শওকত তাগিদ দিলেন,
“ কী হোলো বল,কী চাই তোর?”
তুশি কথা বলতে চাইছে,অথচ গলবিলে প্রখর চাপের দরুণ বের হচ্ছে না ওসব। বুকের কোথাও তপ্ত লাভার মতো গোল হয়ে ঘুরছে কিছু একটা। অথচ ভেতরের এত উত্তালতা মেয়েটা বুঝতেই দিলো না। স্বভাবসুলভ একইরকম বলল ,

“ কী চাইব? আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করেছেন তাতেই হবে।”
শওকত জেদ ধরলেন। ওর হাতটা আকড়ে ধরে বললেন,
“ না। কিছু একটা অন্তত তোকে নিতেই হবে। যা মনে আসে তাই চা। দেয়ার দায়িত্ব তো আমার, তাই না?”
রেহনূমা ফোস করে শ্বাস ফেললেন। ভাইজান বলে তো দিলেন, যা চাইবে তাই দেবেন। এখন মেয়েটা যদি বাড়ি থেকে চলে যেতে চায়! সার্থ কি তা দেবে? তখন কী হবে? কথা রাখতে গিয়ে ছেলের সঙ্গে আবার ভাইজানের একটা দ্বন্দ্ব বাধবে না?
এরপর কিছু সময় কাটল। সবার দৃষ্টি তুশির চেহারায় বন্দি। শওকত উত্তর জানতে চাইছেন। অথচ মেয়েটা চোখের পাতা ফেলল না। মুখের চামড়াও সরল না একটু। কেমন জড়ের ন্যায় ঠোঁট নেড়ে বলল,
“ আপনাকে বাবা ডাকতে দেবেন?”
কথাটায় কী ছিল জানা নেই। তবে শান্ত পরিবেশে যেন দুম করে পড়ল কিছু একটা। হতবিহ্বলতায় প্রত্যেকে হোচট খেল এক চোট। মোটা ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলল অয়ন। শওকত আশ্চর্য বনে স্ত্রীর পানে চাইলেন। হাসছেন তনিমা। ভদ্রলোক বিমূর্ত আড়ালেন,

“ আর কিছু চাই না?”
দুপাশে মাথা নাড়ল তুশি। মৃগনয়নের কোটর দুটো শুষ্ক তার। অথচ কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ভিজে গেল,
“ না। আমার শুধু একটা বাবা চাই। যে বাবা আপনার মতো করে আমার মাথায় হাত রাখবে। আপনার মতো করে আমাকে মা বলে ডাকবে। আর কিচ্ছু না।”
শওকতের মন জুড়িয়ে গেল। এক ফালি শীতলতায় ছেঁয়ে এলো দৃষ্টি। ওনার তো নিজের মেয়ে নেই। বাড়িতে মেয়ে বলতে ইউশাই শুধু । তাও সে চাচার অত ধারে-কাছে আসে না। হাসলেন তিনি। বললেন,
“ আচ্ছা বেশ,ডাকিস।”
তুশি এই এতক্ষণে হাসল। শুকিয়ে আসা নদীতে হুট করে জোয়ার আসার মতো আনন্দের হাসি। বুক ফুলিয়ে ভীষণ সুখের শ্বাস টানল সাথে।
তনিমা এগিয়ে এলেন। দাঁড়ালেন ওর পাশে। মেকি অভিমান নিয়ে বললেন,

“ তুমি তো এতদিনে আমাকে একবারও মা বলে ডাকতে চাইলে না। অথচ আজ উনি একটু মাথায় হাত রাখতেই,বাবা বানিয়ে ফেললে?”
তুশির কণ্ঠে বিব্রতভাব,
“ আপনারা এত উঁচুমাপের মানুষ। আমার কি ওই যোগ্যতা আছে আপনাদের সাথে সম্পর্ক পাতাব? আজ যে কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। বোধ হয় জন্মের পর বাবার মতো কোনো পুরুষ মানুষ আমাকে এমন করে ডাকেনি তাই…”
তনিমা বললেন,

“ থাক থাক বাবা, এত ব্যাখা দিতে হবে না। আমি তো মজা করছিলাম।”
তারপর ওর গাল ছুঁয়ে বললেন,
“ তুমি একদম আলাদা তুশি। ভীষণ আলাদা। তাই হয়ত তোমাকে প্রথম থেকেই আমার এত ভালো লাগতো! আজ তো বাড়ির প্রত্যেকে বুঝল তুমি কেমন!
এখন শুধু আমার ছেলেটা বুঝলেই হয়!”
শেষটুকু মনে মনে বললেন তিনি।
অয়ন আড়চোখে তুশিকেই দেখছিল। মায়ের কথায় মাথা নুইয়ে হাসল সে। সত্যিই
মেয়েটা আলাদা,বিশেষ খুব। এত বিশেষ হওয়া হয়ত উচিত হয়নি ওর। এই যে অয়ন একটু একটু করে মুগ্ধতায় মরবে,এসব থেকে ওকে বাঁচানোর দ্বায় কে নেবে এখন?
সেসময় কেবিনের ভেতরে এসে দাঁড়াল ইউশা। তার চোখ ইয়াসিরের দিকে। মানুষটা কেবিনে ঢুকছে না। বাইরেই দাঁড়িয়ে,কথা বলছে ফোনে। ইউশা এতটা সময় বোঝার চেষ্টা করছিল,ভাইয়ের মনে কী চলছে! কিন্তু না! এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হলেও ও কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। ওর সাথে একটা কথাও বলেনি ইয়াসির। উফ,ভাইয়া এত শক্ত কেন? চোখের সামনে থেকে ওনার বউকে অয়ন ভাই তুলে নিয়ে এলেন,তাও একটু টা-টু নেই?

ইউশা ফোস করে শ্বাস ফেলে অয়নের দিক চাইল। ছেলেটার দাড়ি ভরতি চিবুকের একপাশ দেখে গাল ভরে হাসল সে। অয়ন ভাই কত উপকারী! কত ভালো মানুষ! কারো কষ্ট দেখতেই পারেন না। আর মন! মনটা ঠিক কাগজের মতো ধবধবে সাদা। এই যে তুশিকে ও আর বড়ো মা ছাড়া বাকি সবাই দূরছাই করে, মেজ ভাইয়া অবধি পছন্দ করেন না, সেখানে অয়ন ভাইয়ের একটু অহংকারও নেই। তুশির পায়ে ব্যথা বলে কী সুন্দর গিয়ে কোলে তুলে ফেললেন। না রে ইউশা! তুই একদম খাটি স্বর্ণ বেছে নিয়েছিস। এখন শুধু এই স্বর্ণ তোর শরীর ছাপিয়ে মনেরও অলংকার হলে হয়!
এতক্ষণে মুখ খুললেন সাইফুল। বললেন,
“ ভাইজান,তুমি বিশ্রাম নাও বুঝলে। আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি। কবে কী ছাড়বে শুনতে হবে তো।”
ভদ্রলোক যেতে নিলেই থামাল ইউশা। বলল,

“ লাগবে না আব্বু। মেজো ভাইয়া কথা বলে এসেছে। আজকের রাতটা চাচ্চুকে হাসপাতালেই থাকতে হবে।”
সাইফুল মাথা নাড়লেও,অবাক হলেন শওকত।
“ সার্থ! এসেছে ও?”
অয়ন বলল,
“ হ্যাঁ। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”
“ ভেতরে আসবে না,তাই না?”
এত সময়ের হাস্যোজ্জ্বল আননগুলোয় কালো মেঘ নামল। কেউ কোনো উত্তর দিতে পারল না। প্রসঙ্গ কাটাতে তনিমা বললেন,
“ ইয়ে, অয়ন,তুই একটা ডাক্তারের ব্যবস্থা কর তো। এই হাসপাতালে ভালো অর্থোপেডিক্স কে আছে দ্যাখ। তুশির পা দেখেছিস,ফুলে তো একদম যা তা অবস্থা।”

অয়ন ঘাড় নাড়ল।
একবার তুশিকে দেখে বেরিয়ে এলো বাইরে। কয়েক কদম এগিয়ে পেছনে শব্দ পেলো পায়ের। ত্রস্ত ফিরল সে।
অমনি থমকে দাঁড়াল ইউশা। একটা চোর চোর ভাব করে গুটিয়ে ফেলল শরীর। অয়ন কপাল কুঁচকে বলল,
“ তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
মেয়েটার মিনসে জবাব,
“ ইয়ে মানে,তোমার সাথে।”
“ কেন?”
ইউশার কণ্ঠ আরো ছোটো হয়ে এলো। আমতাআমতা করে বলল,
“ যদি হারিয়ে যাও। আসলে এত বড়ো হাসপাতাল তো,তাই আরকি!”
অয়ন তব্দা খায়,তাজ্জব হয়। পরপর হাসে মাথা নেড়ে। বলে,
“ এখানে আমি কতবার এসেছি তুই জানিস? আসতে হবে না, যা।”
ফের ঘুরে হাঁটা ধরল সে। কিন্তু ইউশা গেল না। একইরকম এগোলো তার পেছনে। অয়ন আবার দাঁড়াল। ফিরে চেয়ে বলল,

“ কী হলো? তোকে না যেতে বললাম!”
ইউশা কিছু বলল না। তার কাছে দেয়ার মতো উত্তর নেই। ঠোঁট উলটে মাথা নোয়াতেই,
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অয়ন। বিফল কণ্ঠে বলল,
“ আচ্ছা, আয়।”
মেয়েটা খুশি হয়ে যায়। ফুরফুরে হাওয়ার ন্যায় হাসে। দুরন্ত কদমে এসে দাঁড়ায় পাশাপাশি।
ঠোঁটজোড়ায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল হাসিটা দেখে,মুচকি হাসল অয়ন। কথা না বাড়িয়ে সামনে এগোলো। একইসাথে পা মেলায় ইউশা। কেবিন পেরিয়ে করিডোরে আসতেই, একটা বড়ো জটলা পড়ল সামনে। কোনো এক মৃত রোগীর লাশ নিয়ে বিদায় নিচ্ছে পরিবার।
অত অত মানুষ দেখেই সহসা ইউশার হাতটা চেপে ধরল অয়ন। মেয়েটা চমকে যায়। মুখ তোলে বিমূঢ় চোখে। অয়নের দৃষ্টি ব্যস্ত। চারপাশ দেখতে দেখতে বলল,
“ এত ভিড়! হাত ছাড়িস না,সাথে সাথে থাক।”
ইউশা হু-হা করল না। শুধু বুঝল,হিমালয় থেকে তুলতুলে শীতের মতো কিছু একটা ছুটে এসে হামলা করেছে বুকে।
হাতটা দেখল সে,একবার- দুবার- বারবার। অয়ন ওর চেয়ে ফরসা। ইউশার উজ্জ্বল ফরসা কব্জিতে সেই গৌড় রং বড্ড কড়কড়ে লাগছে। মেয়েটা লাজুক হাসে। আদুরে বিড়ালের মতো হাঁটে আস্তেধীরে। মনে মনে ভাবে,
“ আপনার হাত আমি ছাড়ব অয়ন ভাই? এজন্মে তা সম্ভব কখনো! যদি কোনোদিন এমন হয় যে আপনি আমাকে ছাড়তে চাইছেন,তাও এই ইউশা আপনাকে ছাড়বে না।”

শওকত মোটামুটি সুস্থ। উঠে বসতে পারলেও,বুকে এই মূহুর্তে প্রেসার দেয়া নিষেধ। পরিবারের সবাইকে চিকিৎসক কড়া করে বলে দিয়েছেন, কিছুতেই ওনাকে উত্তেজিত করা যাবে না। আজকের রাতটা হাসপাতালেই থাকার কথা ওনার। সেজন্যে বাকিদের বাড়ি পাঠিয়ে তনিমা থেকে গেলেন সাথে। এদিকে,
তুশিকে একজন ভালো ডাক্তার দেখানো হয়েছে। মেয়েটার পায়ের অবস্থা দুরূহ। একেবারে সপ্তাহখানেক পুরো বেড রেস্টের আজ্ঞা দিয়েছেন চিকিৎসক।
তবে তুশির কদর বাড়িতে একটু বেড়েছে আজ। মুখে কিছু না বললেও,রেহনূমা আগের মতো খেইখেই করছেন না। নিয়ম করে ঘড়ি ধরে খাবার-দাবার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ইউশা এ ঘরে এতবার এলো,আজ একবারও ধমকাননি তিনি।

তবে তুশির মন ভালো অন্য কারণে। এ বাড়ির সবচেয়ে বয়ষ্ক মানুষ হলেন জয়নব। বলতে গেলে সৈয়দ পরিবারের সবার মাথার ওপর এক মাত্র ছাতা। সেই যে তুশি বিয়ের দিন এখানে এসে ঢুকল, তখন জয়নব যেটুকু কথা বললেন, তারপর আর ওদের কোনো কথা হয়নি। প্রৌঢ়া সহজে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন না। তবে আজ ছেলের চিন্তায় ঘরে বসে থাকতে পারেননি। খোঁজ পেতে নিচে নেমে এলেন। অয়ন যখন বলল সবটা,দুহাত ভরে তুশিকে দোয়া করেছেন তিনি। ঠোঁট বাড়িয়ে চুমুও খেয়েছেন কপালে! তুশির তখন হৃদয় ভরে গিয়েছিল। সাথে খুব করে মনে পড়ল দাদিকে। কতদিন ওই চেনা মুখটা দেখেনি! আচ্ছা,ইয়াসিরকে যদি একবার বলে দাদির সাথে দেখা করার কথা,বিটকেলটা কি শুনবে? ও নাহয় শুধু একবার দূর থেকে দেখতো। ধারেকাছে যাবে না। পালাবেও না কোথাও। বলে দেখবে একবার?
পরপর ভাবল,

“ না থাক। বলে লাভ নেই। বিটকেলটা মুখের ওপর মানা করবে,এ তো জানা কথাই।” তুশি পাশে রাখা ফোনের দিকে চাইল। একটা আঙুল ছোঁয়াতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইউশার ছবি। মেয়েটা এত সুন্দর! ফাঁপা গালজোড়া রোদে দুলতে থাকা সরষে ফুলের মতো মনোরম।
ছবিটা দেখে মৃদূ হাসল তুশি। স্ক্রিনের একদম ওপরে ছোটো ফন্টে লেখা সময়টায় দৃষ্টি ফেলল তারপর। ১টা বাজে প্রায়। অনেক রাত হয়েছে। ইউশার কাল ক্লাস টেস্ট আছে। সকালে উঠে সময় পাবে না বলে, আগেভাগে খাতাপত্র গুছিয়ে রাখতে গিয়েছে। তুশির ঘুম পাচ্ছে। হাই তুলে শুতে যাবে, দরজায় টোকা পড়ল অমনি। চকিতে ফিরে চাইল সে।
ঠোঁটে সুমিষ্ট হাসি মেখে দাঁড়িয়ে অয়ন। ও তাকাতেই, প্রশ্ন করল ভ্রু নাঁচিয়ে,
“ আসব?”
তুশি নড়েচড়ে বসে। কণ্ঠে উদ্বেগ,

“ আপনাদের বাড়ি,আর আমার কাছে অনুমতি নিচ্ছেন? আসুন আসুন।”
অয়নের দুহাত বই দিয়ে ভরতি। সব সমেত ভেতরে এলো। বলল বেশ চমৎকার করে,
“ বাড়ি আমাদের, কিন্তু রুমটা তোমার। আর অনুমতি সেজন্যে নেয়া। ইটস এবাউট মাই পলাইটনেস!”
তুশি ওসব শুনল না। তার নজর অয়নের হাতের দিকে। জিজ্ঞেস করল,
“ এগুলো কীসের বই?”
“ উপন্যাসের। তোমার পছন্দের লেখকের। দিতে এলাম তোমাকে।”
তুশি মুখ কালো করে বলল,
“ কিন্তু আমি তো পড়তে…”
মাঝপথে থামাল অয়ন। বলল,
“ চিন্তা নেই। আপাতত ইউশা পড়ে পড়ে শোনাবে। আমার ক্যাম্পেইন শেষ হোক। এরপর নাহয় আমি পড়ে শোনাব। এখন যেহেতু তোমার হাঁটাহাঁটি একদমই বন্ধ,তাই সময় কাটাতে কাজে লাগবে এসব। সেজন্যে দিয়ে যাওয়া!”
তুশি খুব খুশি হলো। চকচক করে উঠল চোখমুখের ধার। প্রফুল্লচিত্তে বলল,

“ মাই প্লাইজার,মাই প্লাইজার।”
দু সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে রেখে,শব্দ করে
হেসে ফেলল অয়ন। কিন্তু ভুলটা শুধরে দিলো না আজ। ঘাড় নেড়ে বলল,
“ মি ঠু। আসি,গুড নাইট।”
তুশি মাথা ঝাঁকায়। তার চেহারায় জ্বলজ্বল করছে আনন্দ। বইগুলো টেবিলে রাখল অয়ন । ওকে বের হতে দেখেই, শুয়ে পড়ল তুশি। তার চোখে ছটফট করছে ঘুম। অথচ ক পা গিয়েই থামল অয়ন। ঘাড় কাত করে পিছু ফিরে মেয়েটাকে দেখল এক পল। জোরালো এক নিঃশ্বাস বুকে দমিয়ে ঘর ছাড়ল আস্তে।
তারপর কিছু সময় কাটল। ইউশা এখনো আসেনি। ঘরের আলোটাও জ্বলছে। তুশির সদ্য জেঁকে বসা ভারি ঘুম ছোটাতে, দরজায় টোকা পড়ল ফের। এক দুবার করে বেশ কবার কড়া নাড়ল কেউ একজন। নিদ্রিত মেয়েটা বিরক্ত হলো। মসৃণ ভ্রুজোড়া বেঁকে এলো একটু। থেমে থেমে বলল,
“ বই নিয়ে পড়ে আসুন না অয়ন ভাই। ঘুমাই এখন।”

চৌকাঠে দাঁড়ানো ইয়াসিরের সজাগ চোখ দপ করে উঠল। খুব দ্রুত ছুটে আসা বাতাস যখন কোনো জ্বলন্ত নিভু মোমের পাশ কাটিয়ে যায়,ঠিক তেমন দেখাল মণিজোড়া৷ অয়ন ভাই শব্দ দুটো ও পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে। কিন্তু এই মেয়ে ঘুমের মধ্যেও ওর নাম বলছে! আশ্চর্য!
সূক্ষ্ণ চাউনির পরিধিটা পরপরই স্বাভাবিক করল ইয়াসির। বলেছে, বলেছে। ওর কী?
মূহুর্তেই বরাবরের ন্যায় চিবুক কঠিন করল সে৷ পুরু গলায় খাকারি দিতেই,ঘুম উবে গেল তুশির।
চট করে চোখ মেলে চাইল। চাউনিজোড়া তিরের মতো সোজা গিয়ে বিঁধল লম্বা সেই দীর্ঘমানব পানে। ইয়াসির!

অমনি তড়াক করে উঠতে চাইল তুশি। গোড়ালিতে টান পড়ল,ব্যথা পেলো,কুঁচকে ফেলল নাক-মুখ। অথচ একটুখানি শব্দও জিভ খসে বাইরে এলো না। ইয়াসির বুঝেছে ঠিকই , তবে উদ্বেগ দেখায়নি এবার। ফোস করে শ্বাস ফেলল শুধু। এগিয়ে এলো ধীর পায়ে। মেঝের বুকে ফেলে আসা তার একেকটি কদমের পুরোটা সময়, এক যোগে চেয়ে রইল তুশি।
ইয়াসিরের পরনে ট্রাউজার। আঁটোসাঁটো টি শার্ট হতে বেরিয়ে আছে বাহু৷
অথচ তুশির মানস্পটে ভেসে উঠল ভিন্ন কোনো কিছু। চোখের সামনে সফেদ পাঞ্জাবি-টুপি পরা এক সুতনু মানুষ। নিটোল ওষ্ঠপুটে ধারালো স্বচ্ছ হাসি মেখে এগিয়ে আসছে সে। এক পা,দু পা করতে করতে এসে থেমেছে তুশির সামনে। বেহালার ন্যায় মধুর সুরে ডাকছে,

“ অ্যাই চোর!”
তুশি ছলকে উঠল। ছিটকে এলো বাস্তবতায়। হকচকিয়ে তাকাল ভালো করে। কোথায় পাঞ্জাবি,কোথায় হাসি? ইয়াসির কটমট করে চেয়ে তার দিকে। অমন তিতিবিরক্ত বলল,
“ কানে খাটো? কত বার ডাকতে হয়?”
তুশি উত্তর দেয় না। চুপচাপ মাথা নুইয়ে নেয়। ধ্যাত, দিয়েছে ওর কল্পনার দফারফা করে। অনীহায় আওড়াল,
“ আমি চোর নই।”
“ তুমি যে কী,সেটা আমার চেয়ে ভালো কে জানে!”
তুশি তর্কে গেল না। গাল ফোলাল শিশুর ন্যায়। ইয়াসির একটা কাগজ মতো কিছু রাখল ওর সামনে। ফ্যানের বাতাসে উড়ে যেতে ধরলে,ত্রস্ত পাতাটা চেপে ধরল তুশি। প্রশ্ন করল মাথা তুলে,

“ এটা কী?”
“ ফর্ম।
“ কীসের ফার্ম?”
ইয়াসির চোখ বুজে রাগ ঝাড়ল। বীতস্পৃহ আওড়াল,
“ ফার্ম নয়,ফর্ম। স্কুল এডমিশান ফর্ম।”
তুশি বোকার মতো চেয়ে রইল তাও।
ও বলল,
“ ইউশাকে তো সেদিন বলছিলে,পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে। তাই এখানকার একটা স্কুলে তোমার ভর্তির ব্যবস্থা করেছি।”
মেয়েটা বিমূঢ় হলো। থমকে গেল। হতবুদ্ধি বনে রইল কিছু সময়। সেদিন ইউশাকে বলা কথাটা উনি শুনতে পেয়েছিলেন? শুনে আবার ওর পড়ার ব্যবস্থাও করেছে?

এই হতবাক চাউনিতে ইয়াসির বিব্রত হয়। থমথম করে বলে,
“ এমন হাঁ করে থাকার কী আছে?”
নড়ে উঠল তুশি। চোখ নামাল চটপট।
সে বলল,
“ ফর্মে তোমার সই লাগবে। বাকিসব আমি ফিল আপ করে দিয়েছি। ওহ,তোমার বার্থ ডেইট কবে?”
তুশির চট করে মনে পড়ল না। ভাবল একটু। বলল তারপর,
“ এ মাসের ২৮ তারিখ।”
অমনি চোখ ছোটো করে ফেলল ইয়াসির।
ঠোঁট কামড়ে ভাবল কিছু একটা। কিন্তু বলল না ওসব।
হুকুম ছুড়ল গভীর স্বরে,
“ সই করো।”
সাথে একটা কলম বাড়িয়ে দিলো সামনে। তুশি হাতে নিলেও চুপ করে থাকে। আঙুল নড়ছে না দেখে জিজ্ঞেস করল ইয়াসির,
“ কোনো সমস্যা?”
মিনমিন করে জবাব দিলো ও,
“ না মানে,আসলে আমি পড়তে চাই না।”
ইয়াসির ভ্রু গোটাল। তাজ্জব বনে বলল,

“ চাও না! চাও না মানে? এই যে সেদিন বললে পড়ার খুব ইচ্ছে! সেসব শুনেই তো আমি ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলাম। আর এখন দুম করে বলে দিলে,পড়তে চাও না!
তুমি জানো, এসব প্রতিষ্ঠানে বার্থ সার্টিফিকেট ছাড়া কাউকে ভর্তি করানো ঠিক কতটা ঝামেলার? এই প্রথম বার নিজের পাওয়ারের অপব্যবহার করে সেটা করতে হয়েছে আমাকে। তাও শুধু তোমার জন্যে। তাহলে পড়বে না কেন?
পড়তে ভালো লাগে না? কেন,শুধু চুরি করতে ভালো লাগে? সারাদিন
এর-ওর পকেট কেটে বেড়াবে,অন্যের কষ্ট করে রোজগার করা টাকা নিয়ে পালাবে, এসবে খুব আনন্দ হয় তাই না!
কখনো ভেবেছ,যে টাকাটা তুমি চুরি করে নিতে,সেটা দিয়ে একটা মানুষের পুরো সংসার চলতে পারে। কিংবা টাকাটা ওই মানুষের সারা মাসের বেতন হতে পারে! আদৌ ভাবো এসব?”
তুশি আর্ত চোখে চেয়ে রইল কিছু পল। পরপর চিবুক নামিয়ে আনল বুকে। নিভু স্বরে বলল,
“ আমি কি ওইজন্য বলেছি নাকি! আমি তো অন্য কারণে বললাম।”
তারপর একটু দম নিলো সে।
থেমে থেমে বলল,

“ পড়ার ইচ্ছে তো আমার আছেই। তখনো ছিল,এখনো আছে। কিন্তু সব কিছুর তো একটা সময় আছে তাই না! এখন আমি কত বড়ো হয়ে গেছি। মি ভেরি বিগ সাইজ!
এখন কি ওসব স্কুলে আমাকে মানায়? ওই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের সাথে গিয়ে এক বেঞ্চে বসলে মানুষ হাসবে না? ইস,আমাকে সারকাসের জোকার লাগবে পুরো।”
কথায় দাড়ি দিতেই, কষে ধমক ছুড়ল ইয়াসির,
“ চুপ!”
হকচকিয়ে মাথা তুলল তুশি। ভড়কে বলল,
“ ধমকাচ্ছেন কেন? কী করেছি!”
ইয়াসির দাঁত-মুখ খিচে বলল,
“ শুধু তো ধমকাচ্ছি। ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে তোমাকে চৌদ্দ শিকের ভেতরে ভরে দিয়ে আসতে। চুরির হাত পাকা হলে কী হবে,মাথায় গোবর ছাড়া কিচ্ছু নেই। এসব উদ্ভট কথা কোথায় শিখেছ তুমি? আর মানুষের হাসাহাসি নিয়ে আজকাল চোরেরাও ভাবছে? বাহ,ইম্প্রেসিভ!”

তুশির মাথার তালু জ্বলছে। ইয়াসিরের ফুলতে থাকা নাকের ডগায় আচ্ছা করে এক ঘা দিতে পারলে বেশ ভালো লাগতো! শুধু চোর চোর আর চোর! কেন রে,একটু সুন্দর করে তুশি ডাকতে পারিস না? নামটা মুখে নিলে কি তোর ওই পাতলা ঠোঁট ধ্বসে পড়ে যাবে? ছাগল মার্কা পুলিশ একটা!
মেয়ের ধ্যান ছুটল ইয়াসিরের পরের কথায়। এতক্ষণের হম্বিতম্বি করা স্বর নেমেছে এবার। বলল বেশ গুছিয়ে,
“ তোমাকে এত চিন্তা করতে হবে না। এটা অন্য সব স্কুলের মতো নয়। এখানে তোমার মতো একজন নয়, শয়ে শয়ে মানুষ পড়তে আসে। যারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সময় মতো পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি,এই স্কুল কেবল তাদের জন্যে। আমি নিশ্চয়ই জেনেবুঝে এমন কিছু করব না, যাতে তুমি বিড়ম্বনায় পড়ো। ”
শেষ কথাটা তুশির হৃদয় ছুঁয়ে গেল। কথা তো নয়,যেন বুকের বাপাশ নিশানা করে ছুড়ে দেয়া গুলি। এফোড়-ওফোড় করে কেমন ছুটে গেল দেখো! তার বিমুগ্ধ নয়নতারায় স্পষ্ট চোখে চাইল ইয়াসির। অথচ নির্জীব দৃষ্টিতে একটু বদলও এলো না। রোবটের মতো বলে গেল,

“ লিসেন তুশি, পড়াশোনা মানে শুধুমাত্র বই পড়া নয়। এর মানে অনেক গভীর,ভীষণ ভারি! তুমি প্রতিদিন নতুন কিছু শিখবে,জানবে,দেখবে। এই জানা,শেখার বয়স একজন মানুষের সারাজীবন থাকে। সব সময় মনে রাখবে,গাছ যত বড়োই হোক ডালে প্রাণ আনতে নতুন পাতা গজাতেই হয়। পড়াশোনাটা ঠিক সেরকম একটা ব্যাপার। আর তোমার তো অস্বস্তি হওয়ার কথা নয়৷ বরং তোমার গর্ব করা উচিত। কারণ তুমি নিজের জন্যে কিছু করতে যাচ্ছো। জিততে চাইছো ভালো কিছু। আর যে শিখতে চায়, সে কখনো হারে না। বইয়ের পাতায় কিন্তু তোমার বয়স লেখা থাকবে না। এখানে শুধু আগ্রহের জায়গা থাকবে। সাথে লেখা থাকবে, তুমি কতটা জানলে,কতটা শিখলে তোমার সেই এচিভমেন্টটুকু।”
কথা শেষ করে থামল ইয়াসির। নিঃশব্দে বসে থাকা তুশি তখনো হাঁ করে চেয়ে। দুচোখ ছাপানো মুগ্ধতা তার। প্রথমবার ইয়াসির ওকে তুশি বলে ডাকল। এত চমৎকার করে এই নাম আগে কেউ উচ্চারণ করেনি তো! এই যে কেমন ছন্দের মতো কানের পাশে বাজছে। যেন বারবার ডাকছে ইয়াসির,

“ তুশি,তুশি, তুশি।”
ইয়াসির তুড়ি বাজাতেই নড়ে উঠল মেয়েটা। শশব্যস্ত সোজা হয়ে বসল। মানুষটা তর্জন দিলো গম্ভীর গলায়,
“ ফর্মটা কাল সকালে এসে নিয়ে যাব। সই করে রেখো। আর হ্যাঁ, স্কুলে প্রতিদিন যেতে হয় না। শুধু গিয়ে গিয়ে এক্সাম দিলেও চলবে। তবে কাল একবার তোমাকে যেতে হবে ওখানে। আরো কিছু ফর্মালিটিস আছে,সেসবের জন্যে।”
তুশি মুখ খুলল।
বলতে গেল,
“ আমার পা…”
শব্দবাক্য কেড়ে নিলো সে। বলল,

“ সেটা আমার মাথায় আছে। গাড়িতে যাবে,গাড়িতে আসবে। আর সাথে আমি থাকব। চিন্তা নেই!’’
এরপর তুশির আর বলার কিছু রইল না। কিংবা হয়ত আছে,এই মূহুর্তে জিভ হাতিয়ে শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। কিছু বিস্ময়ের তাণ্ডবে এখনো মেয়েটা ধাতস্থ হতে পারেনি। একদিনেই ওর সাথে এত ভালো ভালো ঘটনা ঘটছে কেন?
ইয়াসির চলে যেতে এক পা বাড়াল। থামল হঠাৎ। ফিরে ডাকল,
“ শোনো!”
তুশি মুখ তুলে চাইল,,
“ জি?”
ইয়াসির কিছু বলতে চাইল। চোখেমুখে স্পষ্ট সেই ছাপ। অথচ সেকেন্ড কয়েক থমকে থেকে বলল,
“ কিছু না।”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১৯

তুশি কপাল কুঁচকায়। ও আশায় ছিল কিছু অন্তত বলবে বিটকেলটা। এই যে শওকতের ব্যাপার নিয়ে বাড়ি সুদ্ধ সবাই ওকে এত ভালোবাসল,দোয়া করল,শুধু ওই একজনের মুখ থেকে তুশি এখনো টু শব্দ শোনেনি। মেয়েটার হতাশা হ্রাসের দ্বায় ইয়াসিরের নেই। সামনে ফিরে বুক ফুলিয়ে দম ফেলল সে। বিড়বিড় করল মনে মনে,
“ থ্যাংক ইউ!”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২১