কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২১

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২১
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

সাত সকালে ঘরের ভেতর হুইলচেয়ার দেখেই আঁতকে উঠল তুশি। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখজোড়া হকচকাল খুব। আর্তনাদ করে বলল,
“ এ কী.. হট ইচ দিস? এ চেয়ার কার? দাদি গো, আমার লেগ কি কেউ কেটে নিয়ে গেল?”
তুশি ধড়ফড় করে গায়ের কাঁথা সরাল। নাহ, পা জোড়া দিব্যি মিশে আছে খাটে। বুকে হাত দিয়ে শ্বাস ফেলল বেচারি।
“ নাহ,পা কোথাও যায়নি।
তাহলে এটা কার?” উত্তর এলো ওপাশ থেকে,
“ কার আবার,তোমার।”
তুশি আকাশ থেকে পড়ল। অবাক চোখে বলল,
“ আমার! আমার কেন? আমি এটাতে কেন বসব? এতে তো যাদের পা থাকে না,ওরা বসে। আমার তো পা আছে। আই হ্যাভিং মাই লেগ।”

ইউশা মাথা নাড়ল দুপাশে। দু পা ফেলে এসে বসল ওর সামনে। হাত নেড়ে নেড়ে বোঝাল,
“ শোনো,এটা হলো একটা সামান্য চেয়ার। রোগীর পা থাক বা পায়ে কোনো অসুবিধে,এটাতে আরামসে তাকে নিয়ে যাতায়াত করা যায়। আজকে তোমার স্কুলে যাওয়ার দিন না? ভুলে গেছো?”
তুশির মাথায় এলো তখনই। মনে পড়ল রাতের কথা। বিটকেলটা যে বলে গেছিল যেতে হবে! জিজ্ঞেস করল ত্রস্ত,
“ এটা বুঝি উনি পাঠালেন?”
ইউশা ঘাড় নাড়ল। উত্তর হ্যাঁ! অথচ কেন যেন তুশির মুখ কালো হয়ে গেল। আহত চোখে হুইলচেয়ারটা দেখল আরেকবার। ভাবল,
“ এটার কী দরকার ছিল? ওইদিনের মতো একটু কোলে নিলেই তো যেতে পারতাম।”
তার মনের কথা ইউশার কানে এলো বোধ হয়। কেমন ফট করে বলে দিলো,
“ কী,ভাইয়ার কোলে উঠতে পারবে না বলে মন খারাপ হয়েছে?”
চোখ বেরিয়ে এলো তুশির। মুখশ্রীতে ভ্যাবাচ্যাকার ছাপ দেখে দুষ্টু হাসল ইউশা। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“ ধরে ফেলেছি তাই না? বুঝি বুঝি,সব বুঝি!”
বড়ো নিষ্পাপ চোখে প্রশ্ন করল তুশি,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ কী বুঝেছ?”
ইউশার বুকে লম্বা শ্বাস। টেনে টেনে বলল,
“ এটাই যে, তুশি এখন ভাইয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”
মেয়েটা নাক সিটকাল। প্রতিবাদ করল সহসা,
“ ছিহ না,একদম না।”
“ এখন ছি বলছো তো? পরে ঠিক টের পাবে। এবার নাও, তাড়াতাড়ি ওঠো। কত কাজ বাকি জানো? তোমাকে রেডি করতে হবে। ফ্রেশ করাতে হবে। এরপর আমরা আস্তেধীরে বেরোবো।”
“ আমরা? তুমিও যাচ্ছো?”
তুশির কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। ইউশা বলল,
“ হ্যাঁ, যাচ্ছি তো। ভাইয়াই কাল রাতে বলল যাওয়ার কথা। সেজন্যেই তো আজ কলেজে গেলাম না। ওসব বাদ, ভাইয়া লিভিংরুমে বসে আছেন। স্কুলের কাজবাজ শেষ করে থানায় যাবেন ওখান থেকে । তুমি প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি উঠবে?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, ধরো আমায়।”

ঘড়িতে ঠিক দশটা বাজে। ঘরে নাস্তার আয়োজন চলছে এখনো। তবে আপাতত বাড়িতে লোকজন কম। তনিমা-শওকত হসপিটালে। আর সকাল সকাল সেখানে গিয়েছেন সাইফুল। বাড়ির এদিকটা সামলানোর দরুন রেহনূমার যাওয়া হোলো না। টেবিলে আইরিন একাই খাচ্ছিল । মেয়েটাকে এটা-সেটা বেড়ে দিচ্ছিলেন তিনি। ইয়াসির তখন সোফায় বসে। তার মনোযোগী চোখ ফিনফিনে পত্রিকায় আটকে। খেতে খেতে বারবার চোখের কোণ তুলে ওকে দেখছে আইরিন। পুলিশি পোশাক জড়ানো মানুষটাকে দেখলে মেয়েটা আর নিজের মাঝে থাকে না। বুকের গতি চঞ্চল হয়। হাত-পা শিরশির করে। ইস,
কবে যে বস্তির ঐ আপদটা বিদেয় হবে! আর কবে যে ইয়াসিরের বউ হবে ও!

বড়ো মামি সহ প্রত্যেকে তুশির নামে গদগদ এখন। নানুও স্বায় মেলাচ্ছেন। এই মুহূর্তে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করা মুশকিল। একমাত্র ইয়াসির ভাই যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন তো! কিন্তু কী করবি তুই আইরিন? একটু কিছু করতে গেলেই তো ইয়াসির ভাই ধরে ফেলছেন। নাহ,এমন পাতি বুদ্ধি দিয়ে চলবে না। তোকে এমন কিছু ভাবতে হবে , যাতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।
তুশিকে নিয়ে ইউশা হাজির হলো তখনই। হুইলচেয়ার ঠেলেঠুলে এসে দাঁড়াল সে। মেয়েটার গায়ে সাদা জামা। গায়ের ত্বকে মিশে গেছে প্রায়। শুভ্র শালুকের মতো তুশির
দৃষ্টি,প্রথমেই অদূরের মানুষটায় বর্তাল। আড়চোখে তাকাল সে। ঘুরেফিরে বহুবার ইয়াসিরকে দেখল শুধু। জীবনের একটা সময়,পুলিশের সাথে তুশির যোজন যোজন দুরুত্ব ছিল। পুলিশের জিপ,বা এই পোশাক? কোথাও একটু দেখা মানে পকেটমার তুশিকে ভাগিয়ে দিতে যথেষ্ট। অথচ আজ,আজ এক পুলিশ অফিসারকেই মেয়েটা এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে?

শুধু দেখছেই না। যতবার তাকায়,ততবার খেই হারায় বিমোহে। একজন পুরুষ মানুষ কেন এত সুন্দর হবে? আর এই পুরুষালি সৌন্দর্যটা যেন গায়েবি ভাবে হঠাৎ ইয়াসিরের ওপর ভর করেছে। নাহলে আগে তো একে তুশির এতটা সুন্দর লাগেনি, ইদানীং যতটা লাগছে। বিটকেলটা কী মাখছে মুখে?
ইউশা গলা খাকারি দিলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ হাঁ টা বন্ধ করো তুশি! ভাইয়াকে দেখার আরো অনেক সময় পাবে।”
মেয়েটা নড়ে উঠল। থতমত খেয়ে বলল,
“ কই আমি তো…”
ইউশা কথা টেনে নেয়,
“ মিথ্যে বলতে যেও না। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি ভাইয়ার প্রতি কী মারাত্মক অবসেসড হয়ে যাচ্ছো।”
কঠিন ইংরেজি! মানেটা তুশি বুঝল না। তাও বাকবিতণ্ডায় না গিয়ে চোখ নামাল উরুর ওপর। ইউশা যখন বলছে,তখন ভালো কিছুই বলেছে হয়ত। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার,
ইয়াসিরকে আজকাল দেখতে তুশির এত ভালো লাগে কেন? মনে হয়, হাঁ করে সারাদিন চেয়ে থাকলেও চোখের ক্লান্তি হবে না।
ইউশা ডাকল,

“ ভাইয়া!” এতক্ষণে পত্রিকার ওপর থেকে চোখ তুলল ইয়াসির। ঠাড় দৃষ্টি ঠিক যেন তুশির বুকে এসে বিধল! উফ,এমন করে কেউ তাকায়?
ইয়াসির উঠে এলো।
জিজ্ঞেস করল গভীর স্বরে
“ এত সময় লাগল কেন?”
তুশি ঘাবড়ে গেল। প্রশ্নটা ওকেই করেছে ইয়াসির। জিভ নাড়ল এলোমেলো ভাবে,
“ আমি মানে তৈরি হতে…”
তার পুরোটা শোনার ধৈর্য নেই। জ্ঞান ছুড়ল কর্কশ গলায়,
“ সময়ের কাজ সময়ে করতে শেখ। আমি নিজেও দেরি করি না,কারো দেরি করা পছন্দও করি না। ইউ আর টু মিনিটস লেইট। চুরিটা যেমন নিখুঁত ভাবে করতে,জীবনের বাকি কাজ গুলোও অমন নিখুঁত হতে হবে। বোঝা গেল?”
তুশি প্রথমটুকু মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। ভেবেছিল, গতকালকের মতোই কিছু চমৎকার কথা বলবে ইয়াসির। অথচ চোর শব্দ তুলেই, তার সম্মোহের শিখায় ভকভক করে এক বালতি জল ঢেলে দিলো সে। মেয়েটার মেজাজ খিচড়ে যায়! তিতিবিরক্ত ভাঁজ বসে কপালে। মন চাইল, ইয়াসিরের ঘাড় ধরে মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দিতে। চোর বলে খালি খোঁচা আর খোঁচা! কেন রে বিটকেল,তোর কী চুরি করেছে তুশি? শুধু তো দুবার পকেট কাটতে গেছিল,তাও ধরে ফেললি। দয়ামায়া করেও এক আনা দিসনি। তারপরেও আবার চোর চোর গীত গাইছিস কোন মুখে? ওসব চুরি তো তুশি আগে করত। এই এক মাস ধরে কি চুরির ধারেকাছে গিয়েছে? তাও এমন কথায় কথায় খোটা দিতে হবে?
ইয়াসির হাত ঘড়ি দেখল। ইউশাকে বলল,

“ তোরা গাড়ির কাছে যা। আমি আসছি।”
মেয়েটা মাথা নাড়ল সবেগে। এগোতে নিলেই থামালেন রেহনূমা।
“ দাঁড়া।” ওরা দাঁড়াল। ইয়াসির বলল,
“ কী হয়েছে?”
তুশির কপাল কুঁচকে গেছে। এই মহিলা তো সুবিধের নয়। নিশ্চয়ই ওকে নতুন কাজ দেয়ার ফন্দি আঁটছে মাথায়!
রেহণুমার চেহারায় হাসি নেই। অমন থমথম করে বললেন,
“ এ মেয়ে তো এখনো নাস্তা-টাস্তা করল না। একে অসুস্থ, আবার খালি পেটে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? একটু বোস,নাস্তা সেরে তারপর না হয় যাবে।”
তুশি বিস্মিত,স্তব্ধ। পুরন্ত ঠোঁট জোড়া হাঁ করে ইউশার দিকে চাইল। সে মেয়েও একইরকম চমকেছে। মায়ের মুখে এই কথা! তাও তুশিকে নিয়ে? ফ্যালফ্যালে চোখে দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল একবার। ততোধিক মহাবিরক্ত শ্বাস ফেলল আইরিন। একে গা জ্বলছে ইয়াসির তুশিকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে বলে। তারওপর এসব আদিখ্যেতা। কাটাচামচটা আরো শক্ত করে ডিম পোচের গায়ে চেপে ধরল সে। এত বাড়াবাড়ি আর নেয়া যাচ্ছে না। কী একটু বড়ো মামাকে হাসপাতালে নিয়েছে,তাতে সবার ধন্যি ধন্যি শুরু৷ এখন যদি ছোটো মামিও উলটে যান,তাহলে তো আইরিনের কাজটাই হবে না।
ইয়াসির বলল,

“ লাগবে না। বাইরে নাস্তা করিয়ে নেবো। অলরেডি এই চোরের জন্যে আমার অনেক দেরি হয়েছে। এখন খেতে বসলে আর পৌঁছোতে হবে না।”
তুশির বিস্ময় শেষ। পানসে মুখে শ্বাস ফেলল। বিড়বিড় করল,
“ আবার চোর!”
ইউশা বলল,
“ তাহলে এখন যাই, আম্মু।”
রেহনূমা ঘাড় নাড়লেন। বললেন,
“ সাবধানে যাস।”
তুশিকে নিয়ে দু পা এগোনোর আগেই,ওপর থেকে ধুপধাপ কদমে নেমে এলো অয়ন।
আজ ওর কাজ নেই। ঘুমোচ্ছিল! পরিপাটি ছেলেটার চুলের দশা রফাদফা। তাড়াহুড়োতে ফ্রেশ হওয়ার চিহ্নটা স্পষ্ট মুখে। সিঁড়ি থেকেই বলল,

“ দাঁড়া,ইউশা!”
মেয়েটা ফের থামে। ফিরে চায়। ফরসা যুবকের অগোছালো বেশভূষায় নজর পড়ল সোজা। এক চোট শিহরণে বক্ষস্থল কেঁপে উঠল অমনি। চোখদুটো জোরে খিচে নিলো ইউশা। ইস রে! এত কিউট কেন অয়ন ভাই? একেবারে সদ্য পাকা আমের মতো লাগছে।
অয়ন দ্রুত হেঁটে এলো। চোখ নামিয়ে একবার দেখল তুশিকে। প্রশ্ন করল ছটফটে গলায়,
“ কোথায় যাচ্ছিস?”
ইউশার কণ্ঠ জড়ানো,
“ হুঁ?”
“ কী হু? কোথায় যাচ্ছিস?”
স্বর নেমে এলো পরপরই। তুলোর মতো কোমল গলায় শুধাল,
“ তুশি,কোথায় যাচ্ছো?”
তার জবাব এলো তৎক্ষনাৎ,
“ স্কুলে যাচ্ছি, ভর্তি হতে।”
অয়নের কপাল বেঁকে গেল,
“ স্কুলে? কে নিচ্ছে?”
তুশি মুখে বলল না। একটা আঙুল দুবার চালিয়ে ইয়াসিরকে দেখাল। ইয়াসির তখন ব্যস্ত! টেবিলে ছড়ানো বাইকের চাবি,টুপি আর ফোন তুলছিল হাতে।
অয়ন বলল,

“ ওহ ভাইয়া! তুমিও যাচ্ছো?”
“ হ্যাঁ।”
“ কিন্তু, তোমার তো ডিউটি আছে। ব্যস্ততায় সামলাতে পারবে এত কিছু? এর থেকে আমি যাই?”
ইউশার চেহারা ঝলমল করে উঠল। খুশিতে বাকবাকুম করে শুধাল,
“ তুমি যাবে,সত্যি?”
ভ্রু কুঁচকে ফিরল ইয়াসির।
“ তুই যাবি?”
অয়ন বলল,
“ হ্যাঁ, যেতাম। যদি না তোমাদের আপত্তি থাকে আরকি!”
রেহনূমা অবাক চোখে বললেন,
“ কী ব্যাপার বল তো অয়ন! তোকে তো ছুটির দিনে বারোটার আগে নিচেই পাওয়া যায় না। বেরও হতে চাস না কোথাও। আজ কী মনে করে এত আগে উঠেছিস? আবার নিজে থেকে যেতেও চাইছিস বাইরে।”
অয়ন হাসল। উত্তর দিলো গুছিয়ে,

“ মন কি পাল্টাতে পারে না ছোটো মা? আমারো মন পাল্টেছে। ইচ্ছে করছে, তাই যাচ্ছি।”
ইউশা ঠোঁট টিপে মাথা নোয়াল। লজ্জায় লাল সারামুখ। অয়ন ভাই নিশ্চিত ওর জন্যে যাচ্ছেন! ইয়াসির মানা করল না। নিসঙ্কোচে বলল,
“ ঠিক আছে, যা। আমি তাহলে ডিরেক্ট থানায় যাচ্ছি।”
তুশি হাতের নখ খুটছিল। কথাটায় তড়াক করে মুখ তুলল অমনি। উত্তেজনায় জিভ ফস্কে বেরিয়ে গেল,
“ কেন,আপনি যাবেন না আমার সাথে?”
জবাব দিলো অয়ন,
“ ভাইয়াকে কী দরকার তুশি,আমি আছি তো!”
পকেটে ফোন ভরতে থাকা ইয়াসিরের হাতটা থামল অচিরাৎ। সরু চোখে চাইল ফিরে। অয়নের কথা কেমন শোনাল না? পরপরই দুপাশে মাথা নাড়ল ইয়াসির। উড়িয়ে দিলো ভাবনা।
তুশির মুখ কালো। ভাবল,

“ আপনি তো ইউশার জন্যে আছেন ডাক্তার মশাই। আমার মতো চোরের তো অন্য কিছু দরকার।”
রেহনূমা অধৈর্য হয়ে বললেন,
“ আরেহ, তোরা এখানে দাঁড়িয়ে সময় কাটিয়ে দিবি, নাকি যাবিও? যে যাওয়ার যা তো বাপু। কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি কর। ভাইজানরা চলে আসবেন তো।”
ইয়াসির থানার উদ্দেশ্যে বের হবে। তুশি বুঝল সেটা। ব্যাকুল স্বরে মিনমিন করল,
“ বলছিলাম যে,আপনিও চলুন না।”
মানুষটা সরাসরি চোখের দিকে তাকায়। সব সময়, প্রতিবার। তার চাউনিতে রাখ-ঢাক থাকে না। তুশির
দৃষ্টি ছাপানো অনুনয়। পাষণ্ড পুরুষের একটু মায়া হলো বোধ হয়। বলল,
“ ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল।”
“ তুমি যাবে?”
“ হ্যাঁ।”
অয়ন ঘাড় নাড়ে। ইয়াসির গেলেও ওর সমস্যা নেই। ও তো যাচ্ছে নিশ্চিত। ভাইয়ের এক কথায় শশব্যস্ত রওনা করল সে। পেছনে ফেলে যাওয়া ইউশার চন্দ্রমুখী আদলে ধ্যান-জ্ঞান দিলো না। ইয়াসির যাচ্ছে শুনেই তুশির বুক ফুরফুরে বাতাসে ভরে গেল। অথচ এত খুশির কারণ কী,বোকা মেয়েটা বুঝলই না।

চার চাকার এই গাড়িটা সাইফুলের নিজের কেনা। অয়ন বাপ-চাচার গাড়ি সমানে ব্যবহার করলেও,ইয়াসির স্বীয় বাইক ছাড়া চলে না। খুব দরকার পড়লে তবেই চাচার গাড়ি নিয়ে যায়। বাবার টাকায় তার বিস্তর আপত্তি কি না! বাকি তিনজনকে ড্রাইভারের জিম্মায় পাঠিয়ে গাড়ির সামনে সামনে বাইক নিয়ে ছুটছে ইয়াসির।
অয়ন ড্রাইভারের পাশে বসেছে। পেছনে,ইউশা আর তুশি। তুশির মাথার অর্ধেক জানলার বাইরে। অভিভূতের ন্যায় গাছপালার ছুটন্ত গতি দেখছে সে। ইয়াসির বাইকের ভিউ মিররে দেখল সেটা। চাকার গতি কমাল একটু! গাড়িটা ছুঁইছুই হতেই ধমক দিলো জোরে,
“ অ্যাই চোর, মাথা ভেতরে নাও!”
তুশির বুক ছ্যাৎ করে উঠল। মাথা ঢুকিয়ে নিলো ত্রস্ত। ভড়কানো ভাব সামলে ওঠার মাঝে,ফের সাই সাই বেগে চলে গেল ইয়াসির। ইউশা ফিক করে হাসে। ফিসফিস করে বলে,
“ ভাইয়া কত কেয়ারিং দেখলে? ঠিক খেয়াল রাখে বউয়ের।”
তুশি চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। সতর্ক কণ্ঠে বলল,
“ বউ!”
“ তো? তুমি ভাইয়ার বউ নও?”
তুশি জবাব দিলো না। বুকের ভেতর একটা টালমাটাল ভাব চেপে চুপ করে রইল। উদাস চোখজোড়া নিয়ে ফেলল রাস্তার বুকে ছুটে যাওয়া এক বাইক আরোহীর দিকে। ওই যে মানুষটা বাইকে বসে,গায়ে পুলিশের পোশাক, ও তার বউ?

এই শব্দ তো তুশি হাজারবার শুনেছে। কখনো এমন শিউরে ওঠেনি। আজ তাহলে বুকের ভেতরটা এত দুরুদুরু করছে কেন? তুশির হাবভাব দেখে ফের ঠোঁট চেপে হাসল ইউশা। মেয়েটা প্রেমে পড়েছে,অথচ বুঝতেও পারছে না। এমন হতভাগা কি দুনিয়াতে হয়? ও চোখ ফেরাল। তাকাল সামনে বসা অয়নের দিকে। ফোনে ব্যস্ত সে! কিন্তু বুক ভরে শ্বাস নিলো ইউশা। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করছে মেয়েটা, অয়ন ভাই শুধু ওর জন্যে যাচ্ছেন। নাহলে যাকে অবসরের দিনে ঘর থেকে টেনেও বের করা যায় না,সেই মানুষ আজ রোদে তেতেপুড়ে তুশির স্কুলের কাজে আসবে কেন? ইউশা রে,অয়ন ভাই তোকে ঠিকই ভালোবাসেন। তুই-ই বুঝতে দেরি করে ফেললি। এখন এত ভালোবাসা কোথায় রাখবি বল তো! তোর অত ছোট্ট হৃদয়ে রাখার জায়গা হবে আদৌ?
ইয়াসির বাইক থামাতেই,পেছনে ব্রেক কষল গাড়ি। বড়ো বড়ো সাইনবোর্ডের লেখা বিড়বিড় করে পড়ল তুশি। খুব শক্ত বানান! অর্ধেক পারল,বাকিটা রেখে দিলো ব্যর্থতায়। ততক্ষণে ইউশা,অয়ন বেরিয়ে গেছে। ইয়াসির বাইক রেখে এগিয়ে এলো। তুশির পাশের দরজাটা খুলতে যাবে,থেমে গেল হাতলের ওপর আরেকটা হাত পড়তে দেখে। ঘাড় ফেরাতেই হাসল অয়ন। সেই আগের মতো বলল,

“ আমি দেখছি।”
ইয়াসির কিছু বলল না। তার এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়েছে। কোনোরকম ভর্তির নিয়ম গুলো শেষ করে যেতে পারলে হয়। অমন ব্যস্ত গলায় বলল,
“ আমি যাচ্ছি। তুই ওদের নিয়ে আয়।”
অয়ন রাজি। ইয়াসির যেতেই দরজা খুলল গাড়ির। হাত বাড়িয়ে বলল,
“ এসো।”
তুশির ফের মন খারাপ হোলো। অয়নের চওড়া কাঁধের ওপর থেকে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করল দুবার। চলে যাচ্ছে ইয়াসির। কত খারাপ লোক! ওকে বের করে দিয়ে গেলে কী হোতো?
অয়ন বলল,
“ কী হোলো? এসো।”
মেয়েটা কথা বাড়াল না। হাতটা ধরল চুপচাপ। বের হতেই তাকে ধরে ধরে হুইল চেয়ারে বসাল অয়ন। ইউশার নজর তখন চারপাশে। এত বড়ো স্কুল! তাও বাড়ির এত কাছে! অথচ ও আজকেই প্রথম দেখেছে। গলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশপাশ দেখতে দেখতে এপাশে এলো ইউশা। জিজ্ঞেস করল,

“ অয়ন ভাই, তুমি আগে কখনো এসেছ এখানে?”
“ না। আজই প্রথম।”
ইউশা দাঁত বের করে হাসল। বলল ,
“ আমিও তাই। কত মিল আমাদের তাই না?”
জবাবের আগেই অয়নের মুঠোফোন বাজল। স্ক্রিনে প্রফেসর লেখা জ্বলজ্বল করে ভাসছে। বলল,
“ তোরা এখানেই দাঁড়া। আমি কথা বলে আসছি!”
ইউশা মাথা নাড়লেও, দীর্ঘশ্বাস ফেলল । কলটা এখনই আসতে হলো ওনার? মেয়েটার চেয়ে থাকার মাঝেই, কব্জিতে টান বসাল তুশি।
“ এই ইউশা,শুনছো?
নড়েচড়ে ফিরল সে,
“ হ্যাঁ?
“ কী হ্যাঁ, কতক্ষণ ধর ডাকছি! একটা মানুষকে এত হাঁ করে কী দেখো?”
ইউশা দুষ্টুমি করে বলল,
“ তুমি ভাইয়ার দিকে যা দেখো,তাই।”
তুশি তব্দা খেয়ে বলল,
“ আমি? আমি তো শুধু… ঐ একটু…”
“ থাক, এত আমতাআমতা করতে হবে না। তুমি নিজেও জানো না তুমি ভাইয়ার প্রতি কী বাজে ভাবে মজে যাচ্ছো,তুশি।”
তুশি বিরোধিতা করল,

“ এক দম না। একটু তাকালেই কি মজে যাওয়া হয়?”
“ হয় না?”
“ না।”
“ আচ্ছা, তাহলে আমাকে একটা কথা বলো তো, ভাইয়াকে দেখলেই তোমার বুক ধুকপুক করে?”
তুশির ভাবতে হয়নি। শশব্যস্ত জবাব দিলো,
“ একটুও না।”
“ সত্যি হয় না?”
“ উহু!”
ইউশা হতাশ কণ্ঠে বলল,
“ তাহলে বোধ হয় তুমিই ঠিক। প্রেমে এখনো পড়োনি। কিন্তু পড়বে শীঘ্রই। আমার মন বলছে বুঝলে! আর আমার আবার সিক্সথ সেন্স এত প্রখর না! প্রায়ই আন্দাজ ফলে যায়।”
“ তাই? তা তোমার অয়ন ভাইয়ের বেলায় তোমার আন্দাজ কী বলে?”
ইউশার কণ্ঠ নিভে এলো। নিস্পন্দ চোখে ফিরল পেছনে। অয়ন এখনো কথা বলছে। এই মানুষটার প্রতি তার আন্দাজ একেক সময় একেক রকম হয়। এই যে, আজ মনে হচ্ছে অয়ন ভাই ওকে পছন্দ করেন। ওর জন্যেই ওনার এখানে আসা। কাল হয়ত আবার মনে হবে,অয়ন ভাই ওকে নিয়ে ভাবেনই না। ইউশার যারপরনাই অভ্যেস আছে এসবে।
তার ভাবনার মাঝেই, কোত্থেকে সিটির শব্দ ভেসে এলো। পাশ ফিরে চাইল ইউশা। তিনটে ছেলে একজায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের নজর এদিকেই। ইউশা তাকাতেই ফের সিটি বাজায় একজন। টেনে টেনে জিজ্ঞেস করে,

“ কী আপু, একা নাকি?”
বেশভূষায় বখাটে মনে হলো। ইউশা কথা বাড়াল না। বিরক্ত চিত্তে সরিয়ে আনল চোখ। অথচ ফট করে বলে দিলো তুশি,
“ একা না দোকা,তা দিয়ে তোর বাপের কী রে?”
ছেলেগুলো হাঁটা দিয়েছিল,থামল কথাটায়। এক পল একে অন্যকে দেখে বলল,
“ তুই করে বলল না?”
“ হ্যাঁ, স্পষ্ট শুনলাম।”
“ আয় তো!”
ওদের হনহনে গতি দেখেই,ঘাবড়ে গেল ইউশা। চাপা কণ্ঠে বলল,
“ তুশিইইই কেন কথা বলতে গেলে? এরা ভালো ছেলে নয়।”
“ চুপ থাকো তো। এসব ছেলেপেলে তুশির খুব ভালো করে চেনা আছে। আসতে দাও না!”
ইউশা ঘনঘন অয়নের দিকে দেখছে। এ পর্যায়ে বীতস্পৃহ মেয়েটা। এত কী কথা বলছেন উনি? বলছেন তো বলছেন, দিন-দুনিয়ার কিচ্ছুতে খেয়াল নেই? ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। চোখমুখ পাথর করে শুধাল,
“ তুমি আমাদের বাপ তুলে কথা বলেছ? সাহস তো দেখছি কম না।”
ইউশার মুখ শুকিয়ে গেছে। কী বলবে জানে না। ঘামছে কপালটা। তুঁতলে বলতে গেল,

“ আসলে আমি….”
তৎক্ষনাৎ ওকে সামনে থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলো তুশি। চেয়ারের হুইল ঘুরিয়ে নিজে এসে থামল। মেয়েলি কণ্ঠে প্রতাপ নিয়ে শুধাল,
“ ও কিছু বলেনি। যা বলার আমি বলেছি। বেশ করেছি বলে,কী করবি এখন?”
ইউশার মুখ হতে দৃষ্টি কয়েক হাত নিচে নামল ওদের। তুশির আপাদমস্তক দেখেই হেসে উঠল পরপর। বিদ্রুপ করে বলল,
“ কী রে ভাই, এতো দেখি লুলা! হাঁটতে পারে না,অথচ গলায় এত তেজ কেন আপু? চেনো আমাদের? জানো আমরা কারা? মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষের মতো থাকো। বেশি তিড়িংবিড়িং করলে একদম বুঝিয়ে দেবো ওসমানের দলবল কী জিনিস!”
তুশি পালটা জবাব দিলো না। হাত ইশারা করে কাছে ডাকল শুধু। ফটরফটর করা ছেলেটা কিছু হতভম্ব হয়! ফের মুখ দেখাদেখি করে বন্ধুদের সাথে। দেখতে সুন্দরী, তারওপর মেয়ে! ডাকছে যখন দোনামনা করে এগোলো। কাছে আসতেই তুশি বলল,
“ নিচু হ।”
ছেলেটা গলা নামিয়ে ঝুঁকল একটু,তুরন্ত গালে ঠাস করে এক চড় মারল তুশি। ছেলেটা চমকাল,থমকে গেল। এমন দাবাং চড়ের সাথে বিস্ময় দলা পাঁকিয়ে চক্কর দিলো মাথায়। ইউশা আঁতকে ওঠে। হাত দিয়ে চেপে ধরে মুখটা। বাকি ছেলে দুটো হতবাক,স্তব্ধ। তুশি খুব স্বাভাবিক। যেন চড় মারাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ওভাবেই বলল,
“ শুধু গলায় তেজ না,মেয়ে মানুষের হাতেও হেব্বি জোর থাকে। টেস্ট কেমন লাগল?”
ছেলেটার হুশ ফিরল যেন। কটমটিয়ে উঠল,

“ তুমি আমাকে মারলে? তোমার এত…”
বাকিটা বলার আগেই,আবার একটা থাপ্পড় মারল তুশি। ছেলেটার গাল পুড়ে গেল বোধ হয়। হকচকিয়ে তাকাতেই ও বলল,
“ শালা তোর ভাগ্য ভালো আমার পা ভালো নেই। নাহলে এমন লাথি দিতাম,পুরো নাক ভচকে যেত। যা ফোট, নাহলে কিন্তু আরেকটা দেবো!”
স্তম্ভিতের ন্যায় চেয়ে রইল ইউশা। চোখের পাতা পড়ছে না। মুখের চামড়া নড়ছে না। বাকি ছেলে দুটো ফুঁসে উঠল তখনই।
“ আমাদের বন্ধুর গায়ে হাত। এই আব্বাস,ছুরিটা বার কর তো।”
আব্বাস ছুরি বার করল না। তার চোখ অন্য কোথাও। বাহুতে গুতো মেরে চাপা কণ্ঠে চ্যাঁচাল,
“ ভাই পুলিশ! পুলিশ!”
“ কই?”
“ ওই যে, এদিকেই আসছে।”
অদূরে ইয়াসিরকে দেখেই ভয় পেলো ওরা। দ্বিতীয় জন বলল,
“ আরে, এটা ওই পুলিশ না? ওই যে এমপির ছেলের কেসের?”
প্রথম জন বলল,

“ ওরে ভাই, জাদ্রেল এ ব্যাটা। পালা, পালা।”
মূহুর্তে ঝড়ের বেগে ছুটল সবাই। ইউশা, তুশি বোঝেনি। দুজনেই তাজ্জব বনে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।
ইয়াসির দূর থেকে ব্যাপারটা দেখলেও,শুনতে পায়নি কিছু। তার চোখ ছেলেগুলোর ছুটে যাওয়ার দিকে। জিজ্ঞেস করল এসে,
“ ওরা কারা?”
ইউশার বুকে বল ফিরেছে। হড়বড়িয়ে বলল,
“ আর বোলো না, ভাইয়া! বখাটেপনা করছিল। কিন্তু লাভের লাভ হয়নি। তুশি এমন ঘা দিয়েছে না! একেবারে গাল ব্যথায় দুদিন শুতে পারবে না।”
সাথে গর্বের হাসি হাসল সে। ইয়াসিরের চোখে সানগ্লাস। অথচ তার সোজাসাপটা তাকানো স্পষ্ট বুঝে ফেলল তুশি। সুশ্রী আদল মিইয়ে এলো । ইয়াসিরের স্বর ভারি,
“ মেরেছ ওদের?”
মেয়েটার মিনসে জবাব,
“ না মানে ইচ্ছে করে মারিনি। হয়ে গেছে।”
ইয়াসির বিরক্ত গলায় বলল,

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২০

“ পায়ের এই অবস্থা! ঠিক করে দাঁড়াতে পারছো না, অথচ খুব হাত চলছে আজকাল! গতকাল ভ্যানচালককে মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছ। আঙুলে খুব জোর তাই না? এত মারপিট করার ইচ্ছে থাকলে, সভ্য সমাজে কী করছো? জঙ্গলে গেলেই হয়।”
তুশি উত্তর দিতে চায়নি। কিন্তু বেহায়া মনের কথা, খসে পড়ল জিভ থেকে,
“ আপনি চাইলে অবশ্যই যাব।”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২২