কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২২

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২২
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

❝ বেশ কিছু দিন পর……❞
এর মাঝে কালের গতিতে দুটো সপ্তাহ কেটেছে। তুশির পায়ের অবস্থা এখন ভালো। হাঁটাচলায় খুব একটা অসুবিধে হয় না। তবে, পায়ের পাতায় বেশি জোর দেয়া নিষেধ।
ঘটনা সন্ধ্যেবেলার।

তুশিকে পড়তে বসিয়েছে ইউশা। স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই এটা এখন ওদের দৈনিক রুটিন। মেয়েটা অবশ্য পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী। বলতে হয় না, মাগরিবের আযান শেষে নিজেই রুমে আসে। ঈদের পরপরই ইউশার পরীক্ষা শুরুর তারিখ। সামনে বই মেলে রেখে, তুশিকে অংক করতে দিয়েছে ও। কিন্তু এই মূহুর্তে তুশির ভেতর আদৌ মনোনিবেশের ছিটেফোঁটাও নেই। মেয়েটার নজর অদূরের কোথাও একটা আটকে। ইউশা পড়ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখল ওকে। গালে হাত দিয়ে বসে থাকা তুশির দৃষ্টি মেপে নিজেও ফিরল সেদিক৷ সফেদ দেওয়ালে একটা ফটোফ্রেম টাঙানো। গোটা সৈয়দ পরিবারের একমাত্র ছবিটা ঝুলছে সেথায় । তবে ইউশা, মিন্তু কেউ নেই ছবিতে। ওদের জন্মের আগে তোলা এটা। কিশোর ইয়াসির,অয়নের সাথে মিল থাকা আদলের আরেক কিশোর সায়নই তার পরিষ্কার প্রমাণ। কিন্তু তুশির চোখ কার ওপর? ইউশার বুঝতে খুব একটা দেরি হোলো না! ঠোঁট চেপে হাসল সে। গলা খাকারি দিতেই তুশি নড়েচড়ে তাকাল। ও গম্ভীর গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ অংকটা শেষ করো,তুশি। পড়ার সময় ওদিকে কী?”
তুশি মাথা চুলকাল। প্রশ্ন করল পরপরই,
“ আচ্ছা,ছবিতে বিটকেলটা এত হাসছে! তাহলে এমনি হাসে না কেন?”
ইউশা নাক-চোখ কুঁচকে বলল,
“ ভাইয়াকে নিয়ে খুউউব আগ্রহ তাই না? এইত বলছো প্রেমে পড়োনি,বুক কাঁপা-কাঁপি হয় না,তাহলে ভাইয়ার হাসি নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কীসের?”
তুশির উত্তর তৈরি,

“ ওমা,আমি তো এমনি জানতে চাইলাম। যে মানুষ আমাকে পড়াচ্ছে,বই খাতা কিনে দিচ্ছে তার একটু খোঁজ খবর রাখব না?”
“ এত খোঁজ রাখতে হবে না। যেটা করতে দিলাম,করো। পড়তে এসে এমন করলে আমি কিন্তু আর কক্ষনো পড়াব না বলে দিলাম!”
ইউশার স্বর ভারি। রেগে যাচ্ছে বোধ হয়। তুশি শশব্যস্ত খাতায় মাথা নুইয়ে বলল,
“ পড়ছি,পড়ছি।”
মেয়েটা আলগোছে হাসল। তুশির এখন যেই অবস্থা,ঠিক এমনটা ইউশার হয়েছিল শুরুর দিকে। যখন প্রথম প্রথম অয়ন ভাইকে মনে ধরল ওর। কত রাত ইউশার নির্ঘুম কেটেছে,কত রাত কেটেছে ওনার স্বপ্ন দেখে! সেসবের হিসেব মেলাতে গেলে,ক্যালেন্ডারের পাতা ফুরিয়ে যাবে হয়ত। তুশির সামনে ক্লাস ফোরের বই। গোটা গোটা বাংলায় লেখা,
“ বিশ টাকা নিয়ে বাজারে গেল করিম…”
ইউশার চোখ তুশির খাতাতেই ছিল। অথচ
মেয়েটা কোন খেয়ালে কে জানে! কিছু একটা লিখতেই,আর্তনাদ করে উঠল ও,

“ এটা কী লিখেছ?”
তুশি চমকে উঠল। ধড়ফড়ে গতিতে খাতার পানে চাইল ভালো করে। বিশ টাকার জায়গায়,বিটকেল লেখা দেখে জিভ বেরিয়ে এলো এক হাত। আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ এমা,এটা কী করে হলো? আমি তো এসব লিখিনি।”
ইউশা মাথায় চাটি মেরে বলল,
“ তুমি লেখোনি, তো কী ভূতে এসে লিখে দিয়ে গেছে? মাথার মধ্যে সারাক্ষণ বিটকেল ঘুরছে তাই না?”
“ না না..”
ইউশা কথা কেড়ে নিলো,
“ নানাকে ডাকতে হবে না। আপাতত পড়াশোনা বন্ধ। আগে মাথা ঠিক করো,তারপর পড়বে।”
“ আমি বলছিলাম কী…”

“ কিছু বলতে হবে না। তোমার এখন পড়ায় মন নেই তুশি। আর জোর করে পড়াশোনা হয় না। অংক গুলো থাকল,করে রেখ,কাল দেখে নেবো আমি।”
তুশি ঠোঁট উল্টায়। কী মুসিবত যে নেমে এলো ঘাড়ে! খাতায়ও কিনা বিটকেল লিখে ফেলেছে? মেয়েটা মন খারাপ করে বইখাতা গোছাল। বুকের সাথে ঠেসেঠুসে সব নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ইউশা সেদিক চেয়ে ফিক করে হেসে ফেলল এবার। বিড়বিড় করে বলল,
“ পাগল একটা!”

তুশি নিচে নেমে দেখল,খেতে বসেছে সবাই। শওকত নেই। বুকের ব্যামোতে তার কমপ্লিট বেড রেস্ট। তুশির নজর পড়ল সোজা ইয়াসিরের ওপর। মানুষটার পিঠ ফেরানো এদিকে। অয়নের সাথে কথা বলতে বলতে খাবার মুখে তুলছে। চওড়া পিঠের দিকে চেয়ে পোড়া শ্বাস ফেলল তুশি। বেখেয়ালে এক পা বাড়াতে গেলে, হোচট খেয়ে থুবড়ে পড়ল অমনি। ধপাস শব্দে চকিতে ফিরে চাইল সবাই। তনিমা হায়হায় করে উঠলেন। ছুটে এসে বললেন,
“ এ কী,পড়লে কী করে? ওঠো ওঠো।”

তুশির মেজাজ খারাপ! মাথাটাও গরম হয়ে গেছে। ইয়াসির আসলেই কুফার চূড়ান্ত একটা মানুষ। একে দেখলেই তুশি পড়ে যায়,কখনো আবার মনে মনে মরে যায়। মেয়েটা মুখ গোজ করে তনিমার হাত ধরে দাঁড়াল। অয়ন খাবার রেখে উঠে এসেছে। উদ্বীগ্ন চোখে পায়ের দিকে দেখল একবার। কণ্ঠে বিশদ চিন্তা নিয়ে বলল,
“ ব্যথা পেয়েছ? আবার ঐ পায়েই লাগেনিতো?”
তুশি মাথা নাড়ল দুপাশে। বোঝাল,লাগেনি। ইয়াসির সাথে সাথেই বলল,
“ ব্যথা পাবে কেন? এই চোরের ধুপধাপ পড়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে। তুই খেতে বোস।”
তুশি খুব দুঃখ পেলো। রীতিমতো বুকটা দুভাগ হলো বেদনায়। অয়ন যেভাবে উঠে এসেছে,সেভাবে তো বিটকেলটা এলেও পারতো! তা না, কথার কী ছিড়ি!
ইয়াসিরকে মনে মনে ভেংচি কাটল ও। রেগেমেগে ভাবল,

“ ভাবটা দেখো! মন চাইছে কষিয়ে এক ঘা দেই ঠোঁটের ওপর। যে ঠোঁট থেকে শুধু তেতো কথা বের হয়,ওই ঠোঁট খোলার কোনো অধিকার নেই। তোর থোবড়া দেখতে গিয়েই তো তুশি পড়ে গেল রে বিটকেল! একটু মায়া কর! এসে কোলে নিয়ে….”
পরপরই বিদ্যুতের শকের মতো জোরসে মাথা ঝাঁকাল তুশি। ছি ছি,আবার ও ইয়াসিরের কোলে ওঠার কথা ভাবছে? লজ্জা শরম তো আগেই কম ছিল, এখন তো মনে হচ্ছে একটুও নেই।
তনিমা হাত ধরে ঝাঁকালেন,
“ কী হলো তোমার? এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
অয়ন বলল,
“ তোমাকে কি ঘরে দিয়ে আসব, তুশি?”
“ হু? না না আমি পারব। সবাইকে ধন্যবাদ!”
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বিদেয় নিলো সে। তনিমা তাজ্জব হয়ে বললেন,
“ ধন্যবাদ দিলো কেন?”

পরদিন দুপুর বেলা!
অয়ন,ইউশা,সাইফুল সবাই যে যার কাজে থাকলেও ইয়াসির আজ বাড়িতেই। রাতে খুব জরুরি কাজে থানায় থাকতে হয়েছিল। সকাল বেলা ফিরে সেই যে রুমে ঢুকেছে, এখন অবধি বাইরে আসেনি। শওকতের এক্ষুনি কাজের প্রেসার নেওয়া বারণ। তার দিকভালে সব সময় নিয়োজিত তনিমা। তাই ঘরের কাজবাজ একা করতে করতে রেহণুমা প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছেন। সামনে ইদ। রেশমীটাও ছুটি নিয়েছে। তনিমা এলেও শওকতের কাছে আবার ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেন রেহনূমা। ভাইজানের যদি কিছু লাগে!
সকালে নাস্তার পাঠ চুকেছে মাত্র। এখনো ঝাট পড়েনি ঘরে। মোছামুছিও বাকি। রেহনূমা বসার ঘরে এসে দেখলেন সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে আইরিন। চোখের সামনে মেলে ধরা ফোন!

নরম স্বরে ডাকলেন তিনি,
“ আইরিন!”
আইরিন তাকাল। কান থেকে হেডফোনের এক মাথা সরিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ ছোটো মামি,কিছু বলবে?”
ভদ্রমহিলা রয়েসয়ে বললেন,
“ ঘরটা একটু মুছে দেবে, মা? বেসিনে এত এঁটো থালাবাসন না! আমি তাহলে সেই ফাঁকে ওগুলো ধুতাম।”
মেয়েটা তাজ্জব হয়ে বলল,
“ আমি! আমি কেন? তুশিকে বলো না। ও মহারাণী কী করছে?”
“ ওকে বলব? যতই হোক,পা টা সবে সবে ঠিক হলো। তাই চাইছিলাম না মেয়েটাকে এক্ষুনি কাজে দিতে। তুমি করে…”
আইরিন মুখের ওপর বলল,

“ আমি পারব না ছোটো মামি। সিরিজ দেখছি,মিস করা যাবে না। তুমি আস্তেধীরে করে ফেলো।”
রেহনূমা নিরাশ হলেন।
কিন্তু বললেন না কিছু। শরীরটা ভালো নেই। ঝুঁকতে গেলে পিঠের হাড় টনটনিয়ে ওঠে। তুশিকে আনার পর ছুটা বুয়াটাকে ছাড়িয়ে দেয়ায়,বেশ বিপাকে পড়েছেন এখন। এদিকে মেঝের রং ধবধবে সাদা। একদিন না মুছলেই আর তাকানো যায় না। উপায়ন্তর না পেয়ে স্টোর রুমের দিকে এগোলেন তিনি। আইরিন বাঁকা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখল সেটা। ভেংচি কেটে বলল,
“ কত শখ,আমাকে দিয়ে ঘর মোছাবে! আমি এ বাড়ির রাজরানি হব ছোটো মামি,চাকরানি নয়।”
স্টোর রুমের চৌকাঠে এসে থামলেন রেহনূমা। পর্দা সরিয়ে দেখলেন, তুশি টেবিলে বসে পড়ছে। খুব আস্তে আস্তে,ভেঙে ভেঙে একেকটা শব্দ উচ্চারণ করছে। ঠিক প্রাইমারিতে পড়া বাচ্চাদের মতো। হেসে ফেললেন তিনি। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেন ওর পাশে। পড়তে ব্যস্ত তুশি টেরই পেলো না। আঙুল দিয়ে ধরে ধরে পড়ছিল,

“ বাংলা দয়ে কারে দে,শ একারে সে র, বাংলাদেশের। আবহাওয়া নয়ে আ কারে না,তয়ে ইকারে তি… তুশি আটকে গেল এখান এসে। এত শক্ত বানান! হাবুডুবু খাওয়ার মাঝে,পাশ থেকে রেহনূমা বলে দিলেন,
“ নাতিশীতোষ্ণ!”
তুশি ঝট করে ফিরল। অবাক চোখ কপালে তুলে বলল,
“ আপনি?”
রেহনূমার হাসিটা এখন নেই। খুব স্বাভাবিক মুখচোখ। বললেন,
“ নাতিশীতোষ্ণ মানে কী জানো?”
তুশি মাথা নাড়ল দুপাশে। জানে না।
“ না শীত,না গরম। দুটো মাঝামাঝি। মনে থাকবে?”
“ জি।”
“ খুব জরুরি পড়া করছো?”

রেহনূমার স্বর কোমল! এমনটা তুশি এর আগে শোনেনি। আসার পর থেকেই যা জ্বালিয়েছে ওকে! বিভ্রান্ত নজরে মেয়েটা চেয়ে রইল কিছু পল। উত্তর দিলো থেমে থেমে,
“ মা মানে,ইউশা এগুলো করে রাখতে বলেছে। বিকেলে এসে ধরবে।”
রেহনূমা পরের প্রশ্ন করলেন,
“তোমার পায়ের কী অবস্থা? ব্যথা করে?”
“ এমনিতে করে না। পা চেপে বেশিক্ষণ বসে থাকলে অল্প অল্প করে।”
রেহনূমা জিভে ঠোঁট ভেজালেন। চেহারায় বিস্তর দ্বিধাদ্বন্দ্ব! তুশি নিজেই শুধাল,
“ আপনি কি কিছু বলবেন?”

“ না আসলে, রেশমী ছুটিতে জানোই তো। আপা ভাইজানের দেখাশোনা করছে। চাইছি না ওসব রেখে আসুক। এদিকে রান্নাঘরেও অনেক কাজ! ঘরটা একটু মুছতে হোতো! কী করব ভাবছি।”
তুশি প্রচণ্ড কাজচোর। কাজের নাম শুনলেও গায়ে জ্বর আসে। অথচ আজ এক কথায় বইটা বন্ধ করে বলল,
“ ঠিক আছে,আমি মুছে দিচ্ছি।”
“ তোমার সমস্যা হবে না? পা ভাঁজ করলে ব্যথা লাগে বললে।”
“ ওতে কিছু হবে না। আপনি চলুন!”
রেহনূমার মন জুড়িয়ে গেল। ভীষণ প্রসন্ন হলেন আজ। নাহ,মেয়েটা এমনিতে মন্দ নয়। কিন্তু খুশিটুকু চেহারায় ফুটে উঠতে দিলেন না। চুপচাপ হেঁটে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

তুশি হাতে ঝাড়ু নিয়ে লিভিংরুমে এসেছে। গায়ের ওড়না ভীষণ জ্বালায়। এই জিনিস যেভাবেই রাখো কোনোভাবেই ওর শরীরে থাকতে চায় না। ওড়নাটাকে গালাগাল দিতে দিতে কোনোরকম কোমরে প্যাঁচাল ও। এ বাড়িতে ওড়না ছাড়া দেখলে সবাই বকে। ইউশা,তনিমা, রেহনূমা সবাই! ইস,কী দিন ছিল রে তোর তুশি! একটা শার্ট পরলেই কাজ শেষ হয়ে যেত। এত কাপড়-চোপড় পরতে হতো না। কে যেন তোর সুদিনের পেছন বরাবর লাথি মারল,আর তুই সোজা ইয়াসিরের সামনে এসে পড়লি। তুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ নজর পড়ল আইরিনের ওপর। সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সে। পাশে চিপ্স,হাতে ফোন। ছড়িয়ে রাখা পা নাড়তে নাড়তে একটা একটা চিপ্স তুলছে মুখে। অমনি দাঁত খিচে ভেংচি কাটল তুশি। এই কালনাগিনীর একটা হেস্তনেস্ত করা বাকি! কত্তদিন পা-টা নিয়ে ভুগতে হলো ওকে! মেয়েটা কটমট করতে করতে ঘর ঝাড়ু দিতে নেয়, আচমকা চোখ যায় সোফার পাশের দেওয়ালে। বাল্বের নিচে একটা বড়োসড়ো টিকটিকি ঝুলে আছে ! তুশির মাথায় চট করে দুষ্টু বুদ্ধি এলো। পা টিপে টিপে আইরিনের মাথার কাছে দাঁড়াল এসে। ঝাড়ুটা তুলে টিকটিকির লেজে বাড়ি দিতেই,ঝুপ করে আইরিনের পেটের ওপর পড়ল সেটা। ধড়ফড় করে নড়ে উঠল আইরিন। পেটের ওপর জ্যান্ত টিকটিকি দেখেই,ভয়ে মুখের রক্ত সরে গেল। গগনবিদারী চিৎকার ছুড়ল অমনি,

“ আয়ায়ায়ায়ায়া….”
মেয়েটা শোয়া থেকে উঠতে গিয়ে হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। টিকটিকিটা ঝুপ করে পায়ের কাছে পড়েই,ছুটে ঢুকে গেল সোফার নিচে। অথচ ওর চ্যাঁচানো থামল না। এক চিৎকারে সৈয়দ ভবন মাথায় তুলল সে। তুশি মুখ চেপে হাসছে। ওর ভয় বাড়াতে আঙুল দেখিয়ে বলল,
“ ওই যে তোমার পায়ের ওপর। ওই যে কামড়ে ধরল। আল্লাহ কত্ত বড়ো টিকটিকি! কামড় দিলো,দিলো কামড়।”
আইরিনের অবস্থা গুরুতর। আতঙ্কে চোখমুখ ফ্যাকাশে। হাত পা দাপাতে দাপাতে চ্যাঁচাল,
“ বাঁচাও বাঁচাও। মামা,মামি টিকটিকি খেয়ে ফেলল আমাকে। বাঁচাও বাঁচাও,কেউ বাঁচাও।”
তুশির পেট ফেটে আসছে হাসিতে। একটু গলা ফাটিয়ে হাসতে পারলে হতো! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখার মাঝেই ছুটে হাজির হলেন রেহনূমা। ওপর থেকে ধুপধাপ পায়ে নেমে এলেন তনিমাও। দুজনেই উৎকণ্ঠায় একাকার হয়ে শুধালেন,

“ আইরিন কী হয়েছে? ও এরকম লাফাচ্ছে কেন? কী হয়েছে এখানে?”
প্রশ্নের তির ঘুরতেই,তুশি সোজা হয়ে দাঁড়াল। বড়ো অবোধ কণ্ঠে বলল,
“ আমি জানি না। মনে হয় জামার ভেতর তেলাপোকা ঢুকেছে।”
“ হায় হায় কী সর্বনাশের কথা। মেয়েটাতো এসব ভয় পায়। দেখি দেখি,আইরিন একটু শান্ত হয়ে দাঁড়া আমি দেখছি।”
আইরিন বড়ো মামির কথা শুনল না। গলার জোর বাড়াল। হাত-পা আরো বেশি করে দাপাল। একইরকম চ্যাঁচাল,
“ টিকটিকি,পায়ের ওপর আমার পায়ের ওপর। কামড়ে দিলো, আমাকে বাঁচাও।”
ইয়াসির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো তখনই। চিকণ চোখ দুটোতে সদ্য ঘুম ভাঙার ছাপ। কপালের শক্ত পাটায় গুটিকতক ভাঁজ নিয়ে লম্বা পায়ে নেমে এলো সে। মানুষটাকে দেখেই তৎপর কেমন গুটিয়ে গেল তুশি। ফরসা মুখখানায় অহেতুক গোধূলীর লগ্ন এসে বসল। ইয়াসিরের চেহারায় বিভ্রান্তি। আইরিনের এমন লাফ-ঝাপ দেখে বলল,
“ কী হয়েছে এখানে?”
ব্যস,জলদগম্ভীর স্বর শুনে থেমে গেল আইরিন। ইয়াসিরকে দেখা মাত্রই ঝড়ের মতো ছুটে গিয়েই জাপটে ধরল ওকে।
হড়বড় করে বলল,

“ আমাকে বাঁচান,আমাকে বাঁচান। টিকটিকি,টিকটিকি আমি ভয় পাই।”
ইয়াসির একটু ভড়কেছে। কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়েছে আরো। আইরিন এমন আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরেছে,যেন আজন্ম ছাড়ানো যাবে না। একবার ওকে বুক থেকে সরাতে চেষ্টা করল ইয়াসির। শান্ত স্বরে বলল,
“ আইরিন রিল্যাক্স! টিকটিকি তোমাকে খেয়ে ফেলবে না। রিল্যাক্স আইরিন।”
মেয়েটা শুনল না। উলটে আরো শক্ত করে প্যাঁচিয়ে ধরল দুহাতে। নাছোড়বান্দা হয়ে বলল,
“ না আমি ভয় পাই,টিকটিকি তাড়িয়ে দিন। আমার ভয় লাগছে।”
রেহনূমা-তনিমা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। কী ঘটছে এখানে সেটাই বুঝতে পারছেন না। কিন্তু দপ করে ঠোঁটের হাসি মুছে গেল তুশির। উজ্জ্বল মুখশ্রী ডুবে এলো আঁধারে। কী চালাক মেয়ে! বিটকেলটা আসতেই জড়িয়ে ধরল? নাহ, বেঁচে থাকতে এই দৃশ্য সে সহ্য করতে পারবে না। তুশি কি চালাক কম? তুরন্ত ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল মেয়েটা। পা চেপে আর্তনাদ করে উঠল,

“ ও মাগো, পায়ে কি ব্যথা! মরে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি। মাগো,বাবাগো,দাদিগো।”
সকলে ভড়কে গেল। হতভম্ব হয়ে ফিরল ওর দিক। ঝট করে আইরিনকে বুক থেকে সরিয়ে দিলো ইয়াসির। উদ্বেগ নিয়ে এসে বসল তুশির কাছে। তনিমা,রেহনূমা কেউ থেমে নেই। সবার সব মনোযোগ আইরিন থেকে তুশির ওপর ঘুরে এলো মুহূর্তে।
তনিমা বললেন,
“ কী হলো আবার? ব্যথা করছে কেন?”
রেহনূমা বললেন,
“ মনে হয় ঝুঁকে ঝাড়ু দেয়াতে লেগেছে।”

তুশি চেহারা এমন,যেন ব্যথায় জীবন ধ্বংস। পায়ে হাত রেখে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। মিহি আর্তনাদ করে বলল,
“ এত ব্যথা! খুব ব্যথা! পা-টা মনে হয় আর ঠিক হবে না। উফ,মরে গেলাম বাবা রে মরে গেলাম!”
বলতে বলতে চোখের কোণ তুলে ইয়াসিরকে দেখল একবার। মানুষটা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ কিন্তু ব্যথা তো তোমার ডান পায়ে ছিল।”
তুশির হা-হুতাশ শেষ। চোখ বিকট করে ফেলল। এইরে,উত্তেজনায় ভুল হয়ে গেছে? ঝড়ের বেগে বাম পা থেকে হাতটা ডান পায়ে এনে বলল,
“ হ্যাঁ, তাই তো। ডান পায়েই তো ব্যথা। আসলে দুটো পা একসাথে থাকে তো,মনে হয় একজনের কষ্ট আরেকজন মেনে নিতে পারেনি। ব্যথাটা তাই ডান থেকে বাম পায়ে চলে এসেছে। আমি কী করব বলুন,ব্যথা করছে দেখেই না বললাম। এসব নিয়ে আমি কেন শুধু শুধু মিথ্যে বলব?”
ইয়াসির সরু চোখে বলল,

“ আমি কখন বললাম,তুমি মিথ্যে বলছো?”
তুশি থতমত খেলো।
চোরের ছাপ ফুটে উঠল মুখে। কিন্তু দমে গেলে তো চলবে না। অসহায় চোখে বলল,
“ এমন করছেন কেন আপনি? একটা মানুষ ব্যথায় মরে যাচ্ছে আর আপনি পুলিশের মতো জেরা করে যাচ্ছেন?”
তনিমা সুর মিলিয়ে বললেন,
“ একদমই তাই। তুই এমন কেন রে সার্থ! দেখছিস মেয়েটা কেমন করছে,কোথায় একটু সাহায্য করবি,তা না!”
“ আমি কি সাহায্য করব? তোমরা একে ঘরে দিয়ে এসো।”
রেহনূমা হাত পাতলেন,
“ এসো। দেখি ওঠো। আমারই ভুল,কেন যে তোমায় কাজে বলতে গেলাম!”
তুশি সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
“ না না। আমি পারবই না। পা টনটন করছে ব্যথায়। এত ব্যথা নিয়ে দাঁড়াতে গেলে হাঁটু থেকে বাকিটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। আমি পারব না দাঁড়াতে।”
তনিমা চিন্তিত হয়ে বললেন,

“ এমা,হঠাৎ এত ব্যথা কেন করছে? ও সার্থ,
কী হবেরে এখন? ডাক্তার ডাক না।”
ইয়াসিরের জবাব এলো না। সে কিছু ভাবছে।
তুশি উশখুশে কণ্ঠে বলল,
“ ইয়ে, আপনি একটু আমাকে ঘরে দিয়ে আসুন না,পিলিচ!”
ইয়াসিরের চাউনি সন্দিহান। কণ্ঠ পুরু করে বলল,
“ অ্যাই চোর,তুমি নাটক কোরছো না তো?”
মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতোন চাই

আপনার চোখে আমি চোর হতে পারি,কিন্তু মিথ্যেবাদী নই। জীবনে শেষ কবে মিথ্যে বলেছি সেটাই মনে নেই আমার। থাক,কাউকে আমায় ঘরে দিয়ে আসতে হবে না। আমি একাই খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে যাব। পা খুলে যদি পড়েও যায়,তাও কারো কোলে উঠব না। তুশির পা ভাঙলেও, ওর আত্মসম্মান তো আর ভাঙেনি।”
তনিমার নরম মন হুহু করে উঠল। বললেন,
“ না না তুমি এই অবস্থায় একা কেন যাবে?”
পরপরই রুষ্ট চোখে চাইলেন ছেলের পানে।

“ তুই কি রে সার্থ,দেখছিস মেয়েটা ব্যথায় কাতরাচ্ছে আর এই সময়েও তোর সন্দেহ করতে হবে? আসামি ধরতে ধরতে মাথাটা গেছে তাই না? যা না বাবা, ওকে একটু রেখে আয় না ঘরে।”
ইয়াসির ফোস করে শ্বাস ফেলল। তর্ক-বিতর্ক তার ধাতে নেই। নিশ্চুপ কোলে তুলল তুশিকে। অমনি পেলব দুহাত বাড়িয়ে ঘাড় জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। একটু থমকাল ইয়াসির। জোনাকির মতো টিমটিমে মুখ পানে ভ্রু কুঁচকে চাইল। পরপর গলায় জড়িয়ে থাকা হাতদুটো দেখল এক পল৷ সঙ্গে সঙ্গে থতমত ভাব করে হাত সরিয়ে নিলো তুশি। ইয়াসির আর কিছু বলল না। চুপচাপ হাঁটা ধরল সামনে। আইরিন ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল এতক্ষণ। তাকে ছেড়ে সবাই তুশিকে নিয়ে পড়েছে,গোটা ব্যাপারটাতেই মেয়েটা বোকা বনে গেছিল।

হুস এলো এতক্ষণে। ইয়াসিরের প্রস্থান পথে বিমর্ষ চোখে চেয়ে রইল মেয়েটা। ইয়াসির ভাই অমন করে ওকে বুক থেকে সরিয়ে ওই বস্তির মেয়েটাকে কোলে তুলতে পারল? তার ভাবনার মাঝেই মাথা ঘুরিয়ে ফিরল তুশি। দুজনের চোখাচোখি হলো। তুশির ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। ইয়াসিরের কোলে ওঠা যেন শিরোপা জেতার মতোন। হুট করে জিভ বার করে ভ্যাঙাল ওকে। হতভম্ব আইরিন মুখ হাঁ করে ফেলল। সব বিষণ্ণতা এবার পালটে এলো রাগে। এর মানে এই মেয়ে সত্যি নাটক করছিল? সহসা দাঁত কপাটি পিষে ধরল আইরিন। বিড়বিড় করে বলল,

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২১

“ আমার সাথে পাঙ্গা নিলে তুশি? বেশ,এর মজা কাল টের পাবে তুমি। কালই বুঝবে আমি কী জিনিস! আজ সবাই গদগদ করছে তো,কাল যদি এরাই তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে না বার করে তো আমার নামও আইরিন জামান নয়।”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৩