কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৫
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
হুট করে মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে গেলে, ওই পাওয়ার ভেতর খুশির চেয়েও বিস্ময় থাকে বেশি। তুশিরও বোধ হয় তাই হলো। ইয়াসিরের ওই এক ঘোষণায়, বিহ্বলতায় পাথর হলো মেয়েটা। স্নিগ্ধ,সিক্ত মুখখানায় জড়বুদ্ধিতার লম্বা একটা দাগ ছাপ ফেলল স্পষ্ট। মূঢ় বনে মানুষটার পানে চেয়ে রইল তুশি। এসব কি সত্যি,না স্বপ্ন! ইয়াসির ওকে বিশ্বাস করেছে? যার সাথে ওর কোনো হৃদ্যতা নেই,না আছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বায়ভার,সেই মানুষ এক ঝলকে কী করে বুঝে গেল সত্যিটা? কী করে মেনে নিলো,ও চুরি করেনি! তুশির মতোই আশ্চর্য বাড়ির বাকিরাও। প্রত্যেকে হতবুদ্ধি বনে এক পল মুখ দেখলেন নিজেদের। রেহনূমা বললেন,
“ করেনি,মানে! তুই কী বলতে চাইছিস?”
ইয়াসির সোজাসাপটা বলল,
“ যেটা বললাম,যেটা শুনলে সেটাই।”
রেহনূমা ফের কিছু বলবেন, হাত তুলে থামাল সে। রুঢ় স্বরে বলল,
“ সব কথা পরে হবে, আগে আমি জানতে চাই আইরিন তুশির গায়ে হাত তুলেছে কেন?”
উত্তরটা জয়নব দিলেন,
“ তো কী করবে বলো দাদুভাই! এই মেয়ে বয়সে ছোটো হয়েও আইরিনকে মারার কথা বলে। তাও আবার এমন একটা কাজ করার পরেও। অন্যায় করলে শাস্তি দেবে না?”
ইয়াসিরের চোয়াল কাঠিন্যের মাত্রা ছাড়াল এবার। পৃথিবীর সবটুকু প্রতাপ কণ্ঠে ঢেলে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ না। তুশি আমার স্ত্রী! আমার স্ত্রীকে যা বলতে হয়,যা করতে হয় আমি করব, আমি বলব। আইরিন ওর গায়ে হাত তুলল কোন সাহসে?” এই কথা কোনো কথা হয়ত ছিল না! ছিল বসার ঘরের বাতাসটাকেও থমকে দেয়া মূহুর্ত। পুরন্ত ঠোঁটজোড়া তুশি হাঁ করে ফেলল । অবিশ্বাসের তোড়ে রক্তজবার ন্যায় ওষ্ঠপুট কেঁপে উঠল অল্প। বিদীর্ণ মরুকে ছাপিয়ে এক সুপ্ত আঁচের ঘূর্নিঝড় মাথা তুলল বুকে। নিভন্ত দৃষ্টিদের এক করে চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেল সে। এমন করে তো তুশির পাশে কেউ কখনো দাঁড়ায়নি। কেউ ভরসা দেয়নি ওকে। কেউ ওর হয়ে কোনোদিন কথা বলেনি। আচমকা মনে হলো অক্ষিকূট জ্বলছে। টলমল করতে করতে আস্তেধীরে ঝাপসা হয়েছে ইয়াসিরের ফরসা মুখ। তুশি চট করে চোখে হাত দিলো। কার্নিশ গড়িয়ে দুফোঁটা নোনতা জল কপোলে এসে পড়েছে। মেয়েটা হতবাক হয়। বুঝতে শেখার পর এই প্রথম, এই প্রথম বার চোখে পানি এলো ওর। আশ্চর্য! এতক্ষণ এতগুলো মানুষ ওকে যা নয় তাই বলেছে,ওর কষ্ট হলেও চোখে জল তো আসেনি। তুশি তো কখনো কাঁদে না। ও শক্ত! দূর্বার! তাহলে আজ কী হলো? ইয়াসিরের স্ত্রী বলাতে কী এমন ছিল যে চোখ ভরে এসেছে? মেয়েটার ঘোর ভাঙল আইরিনের আওয়াজে। বিস্মায়বহ হয়ে বলছে,
“ ভাইয়া আপনার কি মাথা ঠিক আছে? আপনি এই চোর মেয়েটাকে এখনো নিজের স্ত্রী বলছেন!”
ইয়াসিরের স্বর তরঙ্গের ন্যায় স্থির। জবাব দিলো ভণিতাহীন,
“ তোমার কানে কোনো সমস্যা আছে? শুনতে পাওনি কী বললাম? তুশি চুরি করেনি। ও চোর নয়!”
জয়নব ব্যর্থ শ্বাস ঝাড়লেন। বললেন,
“ দাদুভাই আমরা নিজের চোখে দেখেছি,ছোটো বউমা ওর ঘর থেকেই হার পেয়েছে।”
“ সব সময় চোখের দেখা সত্যি হয় না। আমরা এমন অনেক কিছু দেখি যা ঘটেনি। আবার এমন অনেক কিছু দেখি না যা ঘটেছিল। অন্তত এসবের অভিজ্ঞতা আমার থেকে তোমাদের বেশি হওয়ার কথা নয়!”
আইরিন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল এবার,
“ এটা কি নাটক হচ্ছে নাকি! যেখানে ওর বিছানার নিচ থেকে মামি নিজ হাতে হারটা বের করে আনলেন,সেখানে আপনি এসে দুম করে বলে দিলেন ও চুরি করেনি। আপনি তো বাড়িতে ছিলেন না ভাইয়া। আমরা ছিলাম,আমরা দেখেছি। তার মানে আপনি আমাদের বিশ্বাস করছেন না! তাহলে তো ছোটো মামি,ছোটো মামিকেও আপনি অবিশ্বাস করছেন, ভাইয়া।”
রেহনূমা মুখ কালো করে বললেন,
“ তুই সত্যিই আমাকে অবিশ্বাস করছিস সার্থ? বেশ কর, কিন্তু তোর মা? তোর ভাই! ভাইজান, এরা সবাই তো এখানেই ছিল। এদের অন্তত জিজ্ঞেস করে দ্যাখ,আমরা মিথ্যে বলছি কি না!”
“ আমার কাউকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার নেই ছোটো মা। আমি যখন বললাম,তুশি চোর নয়। তখন ওকে চোর বানাবে কার ক্ষমতা!”
শওকত ত্যক্তবিরক্ত হলেন৷ ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন,
“ তনিমা,আমি ঘরে যাচ্ছি। আমার আর ভালো লাগছে না এসব।”
ভদ্রলোক উঠতে নিলেই বাধ সাধল ইয়াসির। কড়া কণ্ঠে বলল,
“ না।”
থামলেন শওকত। প্রশ্ন ছুড়লেন সহসা,
“ না মানে?”
ইয়াসির কাঁধ উঁচাল,
“ না মানে না। এতক্ষণ তো আপনি এখানেই ছিলেন। সব কথা যখন আপনার সামনেই হয়েছে,তুশির ওপর চোরের দ্বায়ও যখন আপনার সামনেই পড়েছে,তখন বাকিটাও আপনার সামনেই হবে। বসুন!”
শওকত তাজ্জব চোখে বললেন,
“ বসুন? তুমি কি আমাকে আদেশ করছো?”
কাঠখোট্টা উত্তর দিলো সে,
“ না। তবে অনুরোধও করছি না। একজন পুলিশ অফিসার তদন্ত করতে এলে যেভাবে কথা বলে,সেভাবেই বলছি। নাহলে আপনার সাথে কথা বলার রুচি তো আমার কোনোদিন ছিল না।”
শওকত চ্যাঁচিয়ে উঠলেন,
“ সার্থ!”
তনিমা মৃদূ কণ্ঠে বললেন,
“ আহ,সার্থ! তোর বাবা অসুস্থ।”
ইয়াসির আরেকদিক চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল।
কণ্ঠস্বর নরম হলো একটু,
“ ওনাকে বসতে বলো,মা। কিছু কথা বাকি এখনো!”
তনিমা স্বামীর দিকে চাইলেন। চোখ-মাথা নেড়ে অনুনয়ে বোঝালেন বসতে। হার মেনে বসলেন শওকত । কিন্তু সবেতে অতিথু লাগছে তার। একে তুশির থেকে এই অপ্রত্যাশিত আঘাত,অন্যদিকে আবার ইয়াসিরের কথার ঘা। একটা মানুষ আর কত নিতে পারে! ইয়াসির এসে সিঙ্গেল সোফাটায় পায়ের ওপর পা তুলে বসল। এক হাত হাতলে রেখে,অন্য হাতে কপাল ঘষতে ঘষতে শুধাল,
“ হার কোথায় পেয়েছ ছোটো মা?”
প্রত্যেকের প্রশ্নবিদ্ধ চাউনি তার গৌড় মুখে আটকে। রেহনূমা সাথে সাথে বললেন,
“ তোশকের নিচে।”
আইরিন লাফিয়ে বলল,
“ এবার আপনিই বলুন,চুরি না করলে হারটা ওখানে কী করে গেল? হারের তো আর হাত পা নেই।”
ইয়াসির সেই প্রশ্নের জবাব দিলো না। এমন ভান করল যেন শুনতেই পায়নি।সোজাসুজি জয়নবকে বলল,
“ তুমি হঠাৎ তোমার হারের খোঁজ করছিলে কেন?” প্রৌঢ়া একটু নড়েচড়ে উঠলেন।
“ আমি মানে…আইরিন গয়না দেখতে এসেছিল। ওকে দেখাতে গিয়েই খেয়াল পড়ল হারটা নেই। কিন্তু কেন দাদুভাই?”
এবারেও উত্তর দেয়নি ছেলেটা৷ ঘাড় বাঁকা করে আইরিনের দিকে চাইল সে৷ সরু চোখে বলল,
“ এই সকালবেলা তোমার গয়না দেখতে ইচ্ছে হওয়ার কারণ?”
আইরিনের উত্তর তৈরি। ফটাফট বলল,
“ কাল তো মাম্মা আসছেন। এলেই আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে । এতদিন নানু কতবার ডেকেছিল গয়না দেখানোর জন্যে,আমিই যাইনি। তাই ভাবলাম যাওয়ার আগে একবার দেখে যাই। আবার কবে আসা হয় না হয়! কেন? এখন বুঝি দেখতে যাওয়াটাও আমার দোষ হয়ে গেল! কী নানু,কিছু বলছো না যে!”
জয়নব বললেন,
“ আহা,দাদুভাই তুমি এসব কেন জিজ্ঞেস করছো বলোতো!”
অয়ন মন দিয়ে ইয়াসিরের চেহারাটা দেখল। এখনও কব্জিতে মাথা নুইয়ে কপালে আঙুল ডলছে সে। সন্দেহ হলো ওর। দু কদম এগিয়ে এসে বলল,
“ কী হয়েছে বলো তো ভাইয়া! তুমি কি কোনো ক্লু…”
মাঝপথেই হাত তুলল ইয়াসির।
“ লেট মি ফিনিশ অয়ন।”
ছেলেটা থামল। ইয়াসির প্রশ্ন ছুড়ল দ্বিতীয় দফায়,
“ যখন হারের খোঁজ পড়েছে,তুশি কোথায় ছিল”
তনিমা বললেন,
“ এখানেই। তোর বাবার জন্যে চা পাঠিয়েছিলাম।”
রেহনূমা খেই হারালেন ধৈর্যের। রুক্ষ গলায় বললেন,
“ এখন এসব শুনে কী হবে সার্থ! এ বাড়িতে কার এরকম হাত সাফাইয়ের অভ্যেস আছে আমাকে একটু বল! ও যে চোর সেটা তো মিথ্যে নয়। সবাই জানে এ কথা। তাহলে চোর চুরি করবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? এখানে তোর এত তদন্তের কী আছে?”
ইয়াসিরের ঠোঁটে ফিচেল হাসি। বলল,
“ সামান্য কটা প্রশ্নকে তুমি তদন্ত বলছো ছোটো মা? যেখানে আমি নিশ্চিত হয়ে বলে দিলাম, তুশি চুরি করেনি। সেখানে তো তদন্তের কোনো প্রশ্নই আসছে না।”
“ তাই নাকি! তা ও চুরি না করলে বিছানার নিচে হার কী করে গেল? কে রেখেছে বল আমায়,কে রেখেছে?”
ইয়াসির বুক টানটান করে বলল,
“ আমি।”
একটা বড়োসড়ো বোম যেন ঠিক বসার ঘরের মাঝ বরাবর ছুড়ে ফেলল কেউ। বিস্ফোরনের বিকট শব্দটা নীরবে ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। ফের চমকে উঠল তুশি। শওকত বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তনিমার কণ্ঠে আর্তনাদ,
“ কী! কী বলছিস কী তুই?”
তুশির ঠোঁট নড়ল জড়ের ন্যায়,
“ আপনি রেখেছিলেন! কিন্তু কেন?”
ইয়াসিরের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি,
“ তোমাকে পরীক্ষা করতে। দেখছিলাম চোর স্বভাব থেকে তুমি কতটা শুধরেছো। এ্যাজ সিম্পল এ্যাজ ইট ইজ! কিন্তু এই সামান্য কারণ নিয়ে বাড়িতে এত হাঙ্গামা হবে সেটা কে জানতো!”
শওকত চটে বললেন,
“ সামান্য কারণ? এটাকে তোমার সামান্য কারণ মনে হচ্ছে? এই একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেয়েটাকে এতক্ষণ যা নয় তাই বলেছি আমরা। সেখানে তুমি এত স্বাভাবিক ভাবে এসব বলছো কোন মুখে?”
অয়নেরও মেজাজ বিগড়ে গেল। দাঁত-মুখ খিচে চ সূচক শব্দ করল সে। বলেই ফেলল রেগেমেগে,
“ এটা তুমি ঠিক করোনি, ভাইয়া। বাড়ির সবাই, ইভেন আমিও ভেবে নিয়েছিলাম চুরিটা তুশি করেছে। অথচ যেখানে ও কিছু জানেই না সেখানে এতটা অপমান কি ওর প্রাপ্য ছিল? ওকে পরীক্ষা করার নিশ্চয়ই আরও অন্য উপায় আছে!”
ইয়াসির চুপ করে রইল। তার ভাবমূর্তি এমন,যেন গায়েই লাগছে না কিছু। রেহনূমার চোটপাট শেষ। এমন মারাত্মক একটা ভুল করায়,জিভে আর কথা নেই। কিছুক্ষণ হতবিহ্বল চেয়ে রইলেন তিনিও।
থেমে থেমে ঠোঁট জোড়া নাড়লেন,
“ তুই কি সত্যি বলছিস সার্থ? হারটা সত্যিই তুই ওখানে রেখেছিলি?”
তার জবাবের আগেই,সবার মধ্য হতে চ্যাঁচিয়ে উঠল আইরিন,
“ না। মিথ্যে কথা। ভাইয়া মিথ্যে বলছেন মামি। ওই হার উনি রাখেননি।”
ইয়াসির ওর দিকে ফিরল না। চোখের খাঁজে স্বচ্ছ এক কৌতুক নিয়ে ওপরের পা-টা নাড়তে নাড়তে বলল,
“ তাই নাকি! তা তোমাকে কে বলল?”
“ আমি জানি আপনি মিথ্যে বলছেন । এই বস্তির মেয়েটাকে বাঁচাতে চাইছেন তাই না! মিথ্যে বলে কোনো লাভ হবে না, ভাইয়া। তুশি চুরি করেছে,আর চুরির শাস্তি ওকে পেতেই হবে। আপনি না সৎ পুলিশ অফিসার বলেন নিজেকে? তাহলে এই চোরটাকে সাপোর্ট করছেন কেন?”
ইয়াসির ভ্রু গোছাল,
“ তুমি এত শিয়র কী করে, আইরিন?”
এ যাত্রায় নিভে গেল মেয়েটা। আচমকা উঠে দাঁড়াল ইয়াসির। ওকে নিজের দিকে এগোতে দেখেই,একটু গুটিয়ে এলো আইরিন। ঠিক মুখোমুখি এসে থামল ইয়াসির। খুব নম্রতার মাঝেও কেমন দগদগ করল কণ্ঠস্বর,
“ বলো আইরিন,তোমার এই আত্মবিশ্বাস এই নিশ্চয়তার কারণ কী? কীভাবেই বা বুঝলে হার আমি রাখিনি?”
তুশি একবার আইরিন কে দেখছে, একবার ওকে। সব তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বাকিদেরও একই দশা। ইয়াসিরের দূর্বোধ্য মতিগতি ঠাওর করার জো নেই। কিন্তু আইরিন,ওর গলায় এত জোর কীসের? মেয়েটার কপালে ঘামের কণা জমেছে। হাত তুলে একবার নাকমুখের ফ্যাচফ্যাচে ভাবটা মুছল। থেমে থেমে বলল,
“ আমি,আমি জানি কে কেমন! তাই এত নিশ্চিত। তুশি চুরি না করলে এত শক্ত হয়ে আছে কী করে বলুন! অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যেত। অথচ ওর চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই।”
ইয়াসির ভ্রু নাঁচাল,
“ ব্যাস? এইটুকু? এই এতটুকু কারণেই তুমি এত জোর দিয়ে বললে চুরি তুশি করেছে?”
আইরিনের সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ইয়াসিরের চাউনি বাজপাখির মতো। যেন শুধু তাকিয়েই পেটের নাড়ির প্যাঁচ খুলতে পারবে। আইরিন শুকনো ঠোঁটটা জিভ দিয়ে ভেজাল একবার। বলল,
“ দে দেখুন ভাইয়া,আমি জানি তুশির ওপরে আপনার সিম্প্যাথি আছে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, আপনি ওর সব অন্যায়কে সাপোর্ট করবেন। আমি বলছি শুনুন,ওই হার তুশিই নানুর ঘর থেকে নিয়েছে।”
ইয়াসিরের ফিচেল, জ্বলন্ত চাউনিটা পালটে গেল আচমকা। তুষারের ন্যায় শীতল স্বরে বলল,
“ আমি তো বললাম হার আমি রেখেছি। ”
আইরিন এবারেও মানল না। জবাব ছুড়ল সহসা,
“ না,আপনি রাখেননি। মিথ্যে বলছেন আপনি।”
“ আমি রেখেছি,আইরিন।”
“ না আপনি রাখেননি।
“ আমি রেখেছি।” মূহুর্তেই একটা তর্কের ঝড় উঠল। ইয়াসিরকে খণ্ডাতে একের পর এক বাক্য ছুড়ছে আইরিন। কথায় তার অদম্য জেদ,
“ আমি তো বললাম,আপনি মিথ্যে বলছেন।”
ইয়াসিরের স্বর লঘু। ক্রমে আরো শক্ত হচ্ছে তা।
“ হার আমি রেখেছি।”
“ আপনি রাখেননি।”
ইয়াসির চ্যাঁচিয়ে উঠল হঠাৎই,
“ আমি তো বললাম,আমি রেখেছি।”
আইরিন মিইয়ে গেল না। পালটা চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ মিথ্যে কথা। আপনি রাখেননি। ঐ হার আমি রেখেছি।” ব্যস! মূহুর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল ঘরদোর। উপস্থিত প্রত্যেকে আকাশ ফেটে মাটিতে আছড়ে পড়ল । এক চোট হতভম্বতায় দুলে উঠল তুশি। অথচ হেসে ফেলল ইয়াসির। ঘাড় নেড়ে বলল,
“ গুড! এটাই শুনতে চেয়েছিলাম।”
আইরিনের হুশ ফিরল। মাথায় এলো উত্তেজনায় মুখ ফস্কে কী বলে বসেছে! রেহণূমা স্তম্ভিত আওড়ালেন,
“ আইরিন, এর মানে এসব তোমার কাজ? তুশি তার মানে সত্যিই কিছু করেনি?”
আইরিনের মুখচোখ ফ্যাকাশে। আতঙ্কে কাঁপছে সারা শরীর। অগোছাল চিত্তে মেঝেতে চোখের পাতা এলোমেলো ফেলল সে। তখনই ইয়াসির ঝুঁকে এলো একটু। খসখসে, শক্ত স্বরে বলল,
“ কার মুখ থেকে কথা কীভাবে বের করতে হয় সেটা আমি খুব ভালো করে জানি,আইরিন। নিজেকে চালাক ভাবছিলে ভাবতে। কিন্তু বাকি সবাইকে বোকা ভেবেছ এটাই তোমার সবথেকে বড়ো মূর্খামি হয়ে গেল।”
তারপর একপেশে হাসল সে। কথার মাঝে পৈশাচিক আনন্দ,
“ আমি চাইলে ফরেনসিক ল্যাব থেকে লোক ডাকতে পারতাম। হারের ওপর আঙুলের ছাপ মেলালেই আসল চোর বের হয়ে আসতো। কিন্তু কী জানো তো, অপরাধীর নিজের মুখ থেকে স্বীকার করানোর মধ্যে যে আনন্দ,সেটা আর অন্যকিছুতে নেই।”
আইরিনের কপালের ঘাম গলায় গিয়ে নামছে। স্রোতের মত কলকলে সেই বেগ! নিজের হয়ে সাফাই দেবে কি,চিন্তায়- অস্থিরতায় শব্দভাণ্ডার শূন্য তার৷ আচমকা কনুই টেনে ওকে নিজের দিকে ফেরালেন জয়নব৷ মেয়েটা ভালো করে চাইতেও পারল না, সপাটে এক চড় মারলেন গালে। রুগ্ন হাতের প্রহারেও আইরিন পড়তে নেয়। ইয়াসির সামনেই ছিল। অথচ ধরল না ওকে। আলগোছে সরে যেতেই, সোজা রেহনূমার গায়ের ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আইরিন। মিন্তু চোখ কপালে তুলে বলল,
“ হোয়াট আ শট! দাদুর হাতে এত জোর?”
ইউশা বিড়বিড় করল দাঁত পিষে,
“ একদম ঠিক হয়েছে। বয়সে বড়ো নাহলে আমিও একটা দিতাম।”
গাল চেপে হুহু করে কেঁদে উঠল আইরিন। জীবনে এই প্রথম মার খেল সে। রেহনূমা দিগভ্রান্তের ন্যায় ওকে আকড়ে ধরে বললেন,
“ এত বড়ো মেয়ের গায়ে হাত তুললেন আম্মা!”
জয়নব রাগে থরথর করে উঠলেন,
“ তুমি চুপ করো! আমার ভাবতেও ঘেন্না করছে ও এই সৈয়দ বংশের নাতনি। ছি! ছি! নিজে গয়না রেখে এসে, নিজেই একটা নির্দোষ মেয়ের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছিল? এত নিচে তুই কবে নেমেছিস আইরিন? এই শিক্ষা পেয়েছিস তোর বাবা-মায়ের থেকে?”
বৃদ্ধার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নড়বড়ে। তনিমা ছুটে এসে আগলে ধরলেন ওনাকে। রেহনূমা বললেন,
“ আম্মা, আম্মা আপনি শান্ত হন। বাচ্চা মানুষ, না বুঝে করে ফেলেছে হয়ত। আপনি একটু ঠান্ডা করুন মাথাটা।”
অয়ন দুই ভ্রু তুলে বলল,
“ বাচ্চা? সিরিয়াসলি ছোটো মা, যে কাজের জন্যে এতক্ষণ তুশিকে তুমি যা নয় তাই শোনাচ্ছিলে, সেই একই ব্যাপার আইরিনের জন্য বাচ্চামো হয়ে গেল? ইটস অল এবাউট নেপোটিজম,তাই না? আইরিন আমাদের বাড়ির মেয়ে তাই ওর অন্যায়টা বাচ্চামো। আর তুশি তোমার চোখে রাস্তার মেয়ে,তাই ও চোর। বাহ, দারুণ!” রেহনূমার সংকীর্ণ আদল আরো ছোটো হয়ে গেল। উত্তর নেই, মাথা নুইয়ে নিলেন আস্তে।
তনিমা রেগে রেগে বললেন,
“ এটা তুই কেন করলি, আইরিন? এর আগে একবার ওয়াশরুমে সাবান ঘষে রেখে এলি। তাতে পিছলে পড়ে প্রায় মাসখানেক মেয়েটা পা নিয়ে ভুগলো। সেই কথা আমি কাউকে বলিনি। কিন্তু আজ,আজ আবার হার রেখে এসেছিস ওর ঘরে। তুশি তো তোকে কখনো একটা বাজে কথাও বলেনি। তাহলে শুধু শুধু ঐ মেয়েটার পেছনে লেগে কী মজা পাস তুই?” আইরিন কাঁদছে। চোখের পানি,নাকের পানি সব মিলেমিশে একাকার। এভাবে নিজের জালে নিজেই ফেঁসে যাবে যদি জানতো আগে! শওকত অবাক হয়ে বললেন,
“ কী? তুশির পা ওর জন্যে ভেঙেছিল?”
ইউশা বলল,
“ তুশি তোমার চক্ষুশূল তাই না আপু? যাতে সবাই মিলে ওকে বাড়ি থেকে বের করে সেজন্যেই এসব করেছ। ছি,কত খারাপ হলে একটা মানুষ এরকম করতে পারে। তোমাকে নিজের কাজিন ভাবতেও তো লজ্জা করছে আমার।”
আইরিন ফুঁসে উঠল মৃদূ স্বরে,
“ ইউশা!”
পালটা তেতে ওঠে সেও,
“ চোখ পাকাচ্ছো কাকে?
আমি তোমাকে ভয় পাই নাকি! তুমি আর তোমার মন যে কতটা বিকৃত, সে তো সবার কাছে প্রমাণ হয়েই গেছে। শুধু শুধু সবাই মিলে এতক্ষণ তুশিটাকে যাতা শোনাচ্ছিল। আর আমার আম্মু, সেতো এক কাঠি ওপরে। যে যা বলে,তাই শোনে। একবারে তুশির জন্মপরিচয় নিয়েও বলে ফেলেছে আজকে। অথচ যে সত্যিকারের খারাপ,তাকে কেমন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখো। আমার মা যে কেন বড়ো মা হলো না!”
রেহণুমা হতবুদ্ধি হয়ে বললেন,
“ ইউশা,এত বড়ো একটা কথা তুই আমাকে বলতে পারলি?”
মেয়েটা উত্তর করল না। অভিমানে টলটলে চোখ নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। আইরিনের ক্ষুব্ধ নজর পড়ল তুশির দিকে। কেমন হাঁ করে মেয়েটা শুধু ইয়াসিরকেই দেখছে। ওই চাউনি,ওই তাকানোর মানে আইরিন বোঝে। ফুটন্ত জল গায়ে পড়ার মতো অনুভূতিতে ক্ষেপে গেল সে। দিক-কাল ভুলে হুমকি ছুড়ল অমনি,
“ সবাই মিলে আমাকে কথা শোনাচ্ছে দেখে
খুব মজা পাচ্ছো তাই না? তোমাকে আমি দেখে নেবো তুশি। আমি…”
তার কথার মাঝেই গর্জে উঠলেন শওকত,
“ আইরিন!”
মেয়েটা কেঁপে ওঠে। তুশির দিকে তাক করা আঙুলটা ভেঙে আসে নিচে। শওকত রাগে একশেষ হয়ে বললেন,
“ বেয়াদব মেয়ে, অন্যায় করে আবার বড়ো গলায় কথা বলা হচ্ছে? এক থাপ্পড়ে তোমার সব দাঁত আমি ফেলে দেবো। আসুক তোমার মা,তুশিকে ঘাড় ধরে বের করার কথা বলছিলে না? এবার তোমার মাকে বলব, তোমাকে কান ধরে এ বাড়ি থেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে।”
লজ্জায়,অপমানে জর্জরিত আইরিনের মাটিতে মিশে যাওয়ার দশা হলো। শওকত ধমকে বললেন,
“ যাও ঘরে যাও। আর এক মূহুর্তও তোমাকে চোখের সামনে দেখতে চাই না আমি।”
আইরিন সত্যিই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটতে নিলো ঝড়ের বেগে,সহসা নির্দেশ ছুড়ল ইয়াসির,
“ দাঁড়াও।”
মেয়েটা থামল। সকলের উৎসুক চাউনির সাথে নিজেও ঘুরে চাইল পেছনে। ইয়াসির ফের তার জায়গায় গিয়ে বসেছে। নিরেট আওয়াজ স্বাভাবিক খুব। সুস্থির বলল,
“ তুশির গায়ে হাত তুলেছিলে না তুমি? এবার ক্ষমা চাও ওর কাছে।”
আইরিন বিমূর্ত বনে বলল,
“ তুশির কাছে ক্ষমা চাইব,আমি?
অয়ন বলল,
“ হ্যাঁ চাইবি। তুই বড্ড বাড়াবাড়ি করেছিস আইরিন। আমরা সবাই থাকা সত্ত্বেও ওর গায়ে হাত তুলতে তোকে কে বলেছিল? যা সরি বল।”
ইয়াসির কপাল কুঁচকে বলল,
“ হোয়াট সরি অয়ন? এটা ফ্রেন্ড সার্কেলের টিপিক্যাল ভুল বোঝাবুঝি হয়নি যে একটা সরিতে সব মিটে যাবে। আইরিন,তুশির পা ধরে ক্ষমা চাও।”
মেয়েটার মাথায় বাঁজ পড়ল। তুশির জিভ বেরিয়ে এলো এক হাত। এই রে, একদম পা ধরে? আইরিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় বনে বলল,
“ আমি ওই বস্তির মেয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইব? আমি!”
ইয়াসির দাঁত খিচে বলল,
“ যাস্ট শাট আপ আইরিন। ও বস্তিতে বড়ো হলেও মানুষকে ততটা সম্মান করতে জানে, যতটা একটা ভদ্র ঘরের সন্তান হয়েও তুমি শিখতে পারোনি। এত কথা বলতে ভালো লাগছে না। যা বললাম,করো!”
আইরিন জায়গা ছেড়ে নড়ল না। ওই দাঁড়িয়ে থাকায় ভীষণ জেদ। তুরন্ত দুম করে উঠে দাঁড়াল ইয়াসির। সেই তোড়ে পেছন দিকে পড়ে গেল সোফাটাও। হুঙ্কার ছুড়ল স্থূল স্বরে,
“ আই সেইড অ্যাপোলোজাইস টু হার!”
সিংহের ন্যায় গর্জনে পিলে সুদ্ধ চমকে ওঠে তরুণীর। দুটো লাল চোখ দেখে মুখখানা সাদা হয়ে যায়। পরপর জলে ভেজা দৃষ্টি নিয়ে শওকতকে ডাকল সে,
“ মামা!”
ভদ্রলোক নিরুত্তর।যতটা অবজ্ঞা নিয়ে তুশির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন,ততোধিক ঘৃণায় চোখ জোড়া সরিয়ে নিলেন এবারেও। প্রত্যেকে নিশ্চুপ। যেন মৌনতায় সকলেই একমত তারা। এমনকি চামড়া ঝুলে পড়া জয়নবের বৃদ্ধ চিবুকও কেমন শক্ত হয়ে বসেছে। আইরিনের বুক ভেঙে এলো দুঃখে। বুঝে নিলো,তার কাছে আর কোনো উপায় নেই। ইয়াসির যখন বলেছে,ক্ষমা চাইতে হবেই। ধীর পায়ে এসে তুশির সামনে দাঁড়াল সে। অথচ অবস্থা দুরূহ তুশির। বিচলিত চোখে বারবার দেখছে সবাইকে। ও কী করবে বুঝতে পারছে না। আইরিন সিক্ত নয়নে ঠিক ওর মুখের দিকে চাইল। অক্ষিকূটের আনাচে-কানাচে আগুনের ফুলকি ছুটে এলো সবেগে। যার সবটুকু উষ্ণতা তুশির ওপর ঢেলে দিতে,ভেতরটা রোষে চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ এই অপমান আমি কোনোদিন ভুলব না তুশি! কোনোদিন না।”
ও নিচু হতে গেলেই দুবাহু ধরে ফেলল তুশি।
“ খ ক্ষমা চাইতে হবে না। যাও তুমি,যাও।”
ইয়াসির ধমকে উঠল কর্কশ কণ্ঠে,
“ চুপ করে দাঁড়াও। তোমাকে এখানে কেউ কথা বলতে বলেনি।”
তুশি মিইয়ে এলো। আচ্ছা বিপাকে পড়েছে সে। আইরিন বয়সে ওর বড়ো। এত পড়াশোনা জানা,ভালো ঘরের মেয়েটা ওর মতো মানুষের পা ছোঁবে? কিন্তু ইয়াসিরের কাঠ স্বরের বিপরীতে উচ্চবাচ্য করতে পারল না। আইরিন দুই হাঁটুগেড়ে মেঝেতে বসল। এক হাত বাড়িয়ে পা ধরতেই, আরো শক্ত হয়ে গেল তুশি। মুঠোতে খামচে ধরল কামিজ। আইরিন কটমট করে বলল,
“ সরি!”
ইয়াসিরের কণ্ঠে অসন্তোষ,
“ বাংলা জানো না? বাংলায় বলো।”
আইরিন চোখ বুজে দম নিলো। অনিচ্ছায়, অনীহায় থেমে থেমে বলল,
“ আমাকে মাফ করে দাও।”
কথা শেষ হতেই তুশি পিছিয়ে গেল দু পা। ব্যাগ্র হয়ে বলল,
“ দিয়েছি, দিয়েছি। ওঠো পিলিচ!”
ইয়াসির সদর্পে বলল,
“ এরপর থেকে কাউকে অসম্মান করার আগে,আজকে নিজের এই অসম্মানটা মনে রেখ আইরিন। কুকুরের লেজ নাহলে,আই থিংক তুমি ঠিক শুধরে যাবে।”
আইরিনের চোখে আগুন। দাঁতে দাঁত চেপে গিলে নিলো সবটা। তারপর আস্তেধীরে উঠে ঘরের পথ ধরল। শওকত আক্ষেপ করে বললেন,
“ কত বড়ো ভুল হয়ে গেল! না জেনে বুঝে তুশিক কত ছোটো- বড়ো ক…”
ইয়াসিরের পুরোটা শোনার ধৈর্য নেই। কথার মাঝেই সোজা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। তক্ষুনি,ওপাশ থেকে বিদ্যুৎ-এর মতো ছুটে এলো ইউশা। দুহাতে তুশিকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার আর্দ্র স্বরেও প্রফুল্লতা মিশে,
“ আমি জানতাম তুশি,তুমি আমার কথা ফেলবে না আমি জানতাম।”
তুশি সেসব শুনল কি না কে জানে! তার মূঢের ন্যায় নয়নতারা ইয়াসিরের প্রস্থানপথে আটকে। বুট পরা ওই প্রতিটি কদমের সাথে বুকের গতি কেমন করে বেড়ে এলো হঠাৎ। তুশি টের পেলো হৃদয়ের এই তাল হারানো। ধুকপুক,ধুকপুক করে তাদের নেচে ওঠার শব্দে খোয়ানো বহুদূর। হ্যাঁ কাঁপছে,আজ বুক কাঁপছে তুশির। সেই সাথে বেহালার এক সুর এসে কানের কাছে বলছে,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৪
“ বাতাসে গুনগুন,
এসেছে ফাগুন,
বোঝেনি তোমার শুধু ছোঁয়ায় এত যে আগুন!”