কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৭
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
“ কী ব্যাপার, রাতদুপুরে বানরের মতো লাফাচ্ছো কেন? হয়েছেটা কী?”
তুশির নাচানাচি,উল্লাস সব থেমে গেল অমনি। চকিতে ফিরে চাইল পেছনে। রেহনূমার হাতে জগ। নিচ থেকে পানি আনতে যাচ্ছেন। বিরক্তিতে চেহারা কুঁচকে বসেছে একচোট। তুশিকে এমন হাত পা ছুড়ে লাফাতে দেখে প্রথম দফায় ভড়কালেও, মাথা ঘামানোর ইচ্ছে হলো না আর। কেমন খমখম করে বললেন,
“ দেখি, সরে দাঁড়াও।”
বাধ্য মেয়ের মতো এক পাশে সরে এলো তুশি। রেহনূমা সিঁড়িতে কেবল পা রেখেছেন,আচমকা বলল সে,
“ আপনাকে দেখে আমার খুব অবাক লাগে জানেন!” ভদ্রমহিলা থামলেন। ঘুরে চেয়ে বললেন,
“ কেন? অবাক লাগার কী আছে?”
তুশি অদ্ভুত চোখে হাসল। খুব স্পষ্ট গলায় বলল,
“ আমি ভাবতাম গরিবদের বিবেক থাকে না। থাকে,কিন্তু কম। কারণ,ওরা অভাবের তোড়ে যা ইচ্ছে করে ফেলতে পারে। এই যে আমাকেই দেখুন না,আমিও কিন্তু এই চুরির পথে পেটের দ্বায়েই নেমেছিলাম। কিন্তু আমার ওসব ধারণা বদলে গেল আপনাদের বাড়ি এসে আপনাকে দেখার পর। বুঝলাম, আমি আসলে ভুল। গরিবরা তো মূর্খ! এক কলম পড়াশোনাও করেনি। তাই ভালোমন্দের জ্ঞান ওদের কম। কিন্তু আপনাদের কাছে সব আছে মান-সম্মান,টাকা,শিক্ষা অথচ বিবেক! সেটা এক আনাও নেই। আপনার মতো মহিলাদের কাছে নিজের সন্তান,নিজের রক্ত,নিজের আত্মীয়রাই সব কিছু। এখানে অন্যদের কোনো দামই নেই। সে যদি হয় আবার আমার মতো বস্তিতে বড়ো হওয়া মেয়ে। তাহলে তো সোনায় সোহাগা! অথচ আমাদের চোখে আপনাদের মতো গাড়ি চড়া মানুষকে কত সুখী মনে হতো এক সময়। কিন্তু যদি বিবেকই না থাকল,তার সুখ দিয়ে কী হবে? সেতো মানুষই নয় তাই না!”
রেহনূমা স্তব্ধ,বিস্মিত। হতবাক হয়ে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ কী বললে আমাকে তুমি?”
তুশির চাউনি নির্ভীক। কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ আমি কী বললাম? বলেছিলেন তো আপনি। যে কাজ আমি করিইনি,তার জন্যে আমাকে কত কি শোনালেন আজ। হ্যাঁ, এ বাড়িতে আসার পর থেকেই আমি আপনার কাছে পদে পদে খোটা শুনেছি,অপদস্ত হয়েছি। কিন্তু ওসব আমি কখনো গায়েই মাখিনি। লোকের গালমন্দ শোনার অভ্যেস ছিল আমার। অথচ আজ,আজ আপনি আমার বাবা-মা তুলে কথা বলেছেন। আমরা গরিব। আপনাদের মতো ধন-দৌলত নেই বলে বস্তিতে বড়ো হয়েছি। কিন্তু সেটাতো কারো দোষ হতে পারে না। আপনি আজ আমার জন্মপরিচয় নিয়েও কথা বলতে ছাড়েননি। অথচ ওই কাজ কে করল? আপনাদেরই বাড়ির আরেক মেয়ে। তখন আপনার কথার বুলি কোথায় হারিয়ে গেছিল বলুন তো! আজ যদি আমার জায়গায় ইউশা হতো,বা আমি আপনার নিজের মেয়ে হতাম,তখন পারতেন আমাকে এসব বিষ বিষ কথা শোনাতে?”
রেহনূমা চ্যাঁচিয়ে উঠলেন রুষ্টতায়,
“ অ্যাই মেয়ে, খুব বুলি ফুটছে দেখি! তখন থেকে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছো। আজকে নাহয় তুমি চুরি করোনি,কিন্তু তুমি যে চোর সেটা কি মিথ্যে? বলো,সাধু তুমি? হ্যাঁ মানলাম, আইরিন তোমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্যে ওমন একটা ভুল কাজ করেছে। তাতে কী হয়েছে শুনি? নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ? এখন সবাই মিলে তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে? কেন,কে তুমি হ্যাঁ? কী ভাবো নিজেকে!
আর তোমার সাহস তো কম নয়,আমার মেয়ের সাথে নিজের তুলনা করছো? আমার মেয়ে কত ভদ্র দেখেছ! আজ অবধি আমার চোখের দিক চেয়ে কথা পর্যন্ত বলেনি। সেখানে তুমি একটা তর্কবাজ,উগ্র। তোমার মতো মেয়ে আমি কখনো পেটে ধরতেই পারি না।”
তুশির মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। নিস্তব্ধ আওড়াল,
“ আপনি আবার আমার মাকে অপমান করছেন।”
“ হ্যাঁ করছি, কী করবে তুমি? কী করবে? সন্তান শুধু জন্ম দিলেই হয়না। শিক্ষা- দিক্ষারও প্রয়োজন আছে। মেয়ে জন্ম দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। পকেট কাটুক,চুরি করুক তাতে কী! ঘরে টাকা তো আসবে। বলি হারি বাবা মা এরা।”
তুশি প্রতিবাদ করে উঠল,
“ আপনি আমার বাবা মা নিয়ে আরেকটা কথাও বলবেন না। কতটুকু জানেন আপনি ওদের ব্যাপারে? কতটুকু চেনেন? ওরা আমাকে নামিয়েছে,না আমি নেমেছি সে…”
রেহনূমা কথা কেড়ে নিলেন,
“ সেসব আমার জানার কোনো দরকার নেই। নিজে সেধে কথা বাড়াতে এসেছ, তাই শুনছো। এইজন্যেই ছেলেমেয়েদের বুঝেশুনে চলতে হয়। নাহলে সন্তানের জন্যে কাদা গিয়ে সবার আগে বাবা-মায়ের গায়েই লাগে। আগে নিজে মানুষ হও। সভ্য হও৷ মেয়েদের জামা পরলেও ছেলে ছেলে হাবভাব তো এখনো যায়নি। শেখো এসব। তারপর অন্যকে বিবেক নিয়ে কথা শোনাতে আসবে। আমাদের বিবেক আছে বলেই,এখনো এ বাড়ি থাকছো,খাচ্ছো,ঘুরে বেড়াচ্ছ অবাধে। অন্য কেউ হলে তোমার মতো রাস্তার মেয়েকে ঘরের চৌকাঠ মাড়াতেও দিতো না। আর হ্যাঁ, খবরদার আর কখনো আমার মেয়ের সাথে নিজেকে তুলনা তো দূর,এসব মুখেও আনতে যেও না। যে যেটার যোগ্য নয়,তার সাথে সেটা বেমানান।”
তুশি স্তম্ভিতের ন্যায় সব কথা শুনল। রেহনূমা এক পা বাড়াতে নিলেই বলল,
“ আপনি আজ যে কথাগুলো বললেন,আমি এসব সারাজীবন মনে রাখব। এমন যেন নাহয়,যে কোনো একদিন এই রাস্তার মেয়েটার কাছে এসেই আপনাকে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে। মাথায় রাখবেন,সেদিন কিন্তু
আমি আপনাকে ক্ষমা করব না। কক্ষনো না।”
তারপর তরতরিয়ে নেমে গেল তুশি। সেদিক চেয়ে চিড়বিড় করে উঠলেন রেহনূমা,
“ অসভ্য, বেয়াদব মেয়ে একটা! ও আমাকে ক্ষমা করার কে?”
রাত প্রায় অনেক! যে যার ঘরে থাকায় লিভিংরুম ফাঁকা। স্টোর রুমে যেতে বসার ঘর ফেলে আসতে হয়। পাংশুটে মুখে হাঁটতে হাঁটতে শুকনো ঢোক গিলল তুশি৷ কেন যেন বুক তোলপাড় করে কান্না পাচ্ছে হঠাৎ। আজ কি তুশি একটু বেশিই নরম হয়ে এসছে? নাহলে ন্যাকা মেয়েদের মতো বারবার এমন চোখ ভরে আসছে কেন? কেন পৃথিবীর এই হাজার কোটি মানুষের মাঝে বড্ড তুচ্ছ লাগছে নিজেকে৷ তুশির ভেতরটা হুহু করছে মায়ের জন্যে। আজ মা বেঁচে থাকলে ওকে নিশ্চয়ই চোর হতে দিতেন না। আর পাঁচটা নারীর মতো বুকে আগলে মানুষ করতেন। কেন যে তুশি চোর হতে গেল! দাদির কথা মতো লোকের বাড়িতে কাজ করলেও বাবা-মা নিয়ে কেউ এতটা অপমান করতো না বোধ হয়!
তুশির বেখেয়ালে কদম ফেলার মাঝেই, আচমকা ধাক্কা লাগল আইরিনের সাথে। আপেল খেতে খেতে যাচ্ছিল সে। ভাবনায় মগ্ন মেয়েটা চমকে ওঠে। প্রকট চোখে ফিরে চায়। আইরিনকে দেখেই কপাল কুঁচকে বসে পরপর। তুশি ভেবেছিল এড়িয়ে যাবে। নীরস চিত্তে যেতে নিলো, তক্ষুনি ভেংচি কাটল আইরিন। কাঁধ থেকে চুলের ঝাপটা এমন ভাবে সরাল, সোজা এসে চোখে লাগল তুশির। অমনি দাঁত কপাটি পিষে ধরল মেয়েটা। মেজাজ এমনিই চটে আছে। আরো বিগড়াল এবার। আইরিন পাশ কাটাতে গেলেই,তুরন্ত খপ করে ওর হাতটা চেপে ধরল তুশি। সে মেয়ে হতবুদ্ধি হয়। তেতে ওঠে পরপর,
“ কোন সাহসে আমার হাত ধরেছে তুমি?”
“ ভেংচি কেটেছ কেন?”
“ আমার ইচ্ছে হয়েছে কেটেছি,ব্যস।”
“ আমারও ইচ্ছে হয়েছে, ধরেছি ব্যস।”
আইরিনের হাত তুলতুলে। তুশি ইচ্ছে করে কব্জিতে আঙুল দাবিয়ে দিলো। ব্যথায় মুচড়ে উঠল মেয়েটা,
“ আ লাগছে।”
“ কেন? এখন লাগছে কেন? আমার পেছনে লাগার সময় এসব মনে ছিল না?”
“ তুমি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছো তুশি। ভাইয়া কী একটু তোমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে, সেজন্যে এখন হাওয়ায় উড়ছো তাই না?”
“ উড়ছিই তো। এই যে দেখো, আমার পিঠে কত সুন্দর দুটো ডানা। দেখতে পাচ্ছো না? পাবে কী করে,মনের মাঝে শয়তানি থাকলে এমন ভালো জিনিসস দেখতে পাওয়া যায় না।”
“ হাত ছাড়ো আমার। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”
তুশি নিরুৎসাহিত বলল,
“ হোক খারাপ। আমিও খারাপ,তুমিও খারাপ। আরেকটু খারাপ হলে দোষ কী?”
ও আরো ইচ্ছে করে বাধন শক্ত করল। ব্যথায় চোখমুখ খিচে নিলো আইরিন৷ পরপরই কটমটিয়ে বলল,
“ তোমাকে আমি…”
মেয়েটা অন্য হাত তুলল সপাটে এক চড় মারবে বলে,চট করে ধরে রাখা হাতটা পিঠের সাথে মুচড়ে ধরল তুশি।
“ এই ভুল করতে যেও না ডাইনি। কসম আল্লাহর, একেবারে হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেবো।”
আইরিন আর্তনাদ করে উঠল,
“ আয়ায়ায়া লাগছে আমার৷ ছাড়ো!”
“ কী ভেবেছিলে? তুশি দূর্বল,মিনমিন করছে মানে গায়ে জোর নেই? এই হাত দিয়ে ছোটোবেলায় ইট ভেঙেছি,পুকুর সাঁতরে মাছ ধরেছি। লোকের গাছে ঢিল মেরে ফল পেরেছি। আর তুমি এসেছ, তোমার এই নেলপলিশ পরা হাত দিয়ে আমাকে মারতে? ভেবেছিলাম বয়সে বড়ো দেখে সম্মান দেব। কিন্তু না,তুমি শালী সম্মানের যোগ্য নও।”
” তুমি আমাকে গালি দিলে?”
” দিলাম। বস্তিতে বড়ো হয়েছি তো, এর চেয়েও সুন্দর গালি জানি। ভদ্রতার দাম যখন দিচ্ছো না,শোনাব সেসব?”
রেহনূমা তক্ষুনি হাজির হলেন সেখানে। বসার ঘরের এই দৃশ্যে রমনীর মাথা চক্কর দিলো। চ্যাঁচিয়ে উঠলেন হতভম্বতায়,
“ এ কী,এসব কী হচ্ছে? এই মেয়ে ছাড়ো ওকে ছাড়ো।”
তুশি এক কথায় ছেড়ে দিলো। খাাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া মুক্ত পাখির মতো ছটফট করে সরে এলো আইরিন। টলমলে চোখে বলল,
“ মামি,আমার হাতটা বোধ হয় ভেঙেই গেল।”
রেহণুমা ছুটে এলেন। আইরিনকে আগলে ধমকে বললেন তুশিকে,
“ তুমি তো আসলেই একটা চূড়ান্ত অসভ্য মেয়ে। এভাবে কেউ মানুষের হাত মুচড়ে ধরে? আপা আপা,দেখে যাও ডাকাত মেয়েটা কী করেছে দেখে যাও।”
তনিমার সাড়াশব্দ এলো না। তুশি বলল,
“ মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। আমি গিয়ে ডেকে আনব?”
“ ফাজলামো করছো? খুব সাহস বেড়েছে দেখছি। সার্থকে বলছি দাঁড়াও।”
তুশি হাসল। ভয়ই পেলো না আজ। উলটে বুক চিতিয়ে বলল,
“ বলে দিন। বললে কী হবে? নালিশ করে বালিশ তো আর পাবেন না। কারণ,উনি আমার হয়েই কথা বলবেন আমি জানি।”
তারপর আইরিনের পানে ক্ষিপ্ত চোখে চাইল সে। মেয়েটা এখনো ফোঁপাচ্ছে। কব্জি ডলছে সমানে। তুশি আঙুল তুলে বলল,
“ আমার পেছনে লাগতে এলে এমনই হবে। আপনাদের আদরের ভাগ্নিকে বলবেন, এরপর থেকে যেন আমার সাথে বুঝেশুনে কথা বলে।”
রেহণূমা তাজ্জব চোখে বললেন,
“ কেন? তোমার সাথে বুঝেশুনে কথা বলতে হবে কেন? কোন হরিদাস পাল হে তুমি?”
তুশি মাথাটা ঝুঁকিয়ে আনল অমনি। চুল ব্যাকব্রাশ করে বলল,
“ আমি আমার স্বামীর বিয়ে করা বউ। মিসেস ইয়াসির আবরার সার্থ। আমার স্বামী যদি শোনে না, আপনারা আবার আমার সাথে এরকম করছেন, একেবারে কোমরে দড়ি পরিয়ে থানায় নিয়ে যাবে। আসলে আমাকে অনেক ভালোবাসে তো , তাই কেউ কিছু বললে সহ্য করতে পারে না। সেজন্যে সাবধান, মাইন্ড ইওর ওন বিজিনেস।”
তারপর এপাশ ফিরে বেনুনিটা সামনে থেকে পিঠের ওপর ছুড়ে মারল তুশি। ভেংচি কেটে খুব দাপট নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
আইরিন, রেহনূমার সব কথা শেষ। দুজনেই নির্বাক বনে মেয়েটাকে দেখে গেল শুধু।
সকালের আলোটা সবে সবে হাত-পা মেলে চেয়েছে। ঘড়িতে সময়ের ঠিক নেই। তুশির ঘুম ভাঙল তখনই। হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে নামল। একেবারে চোখমুখ ধুয়ে যখন বসার ঘরে এলো,সবকিছু নিশ্চুপ তখনো। এমা,কেউ ওঠেনি? দেওয়ালে ঝোলানো বিশালাকার ঘড়িটায় চাইল ও।
মাত্র ছয়টা বাজে? হায় হায়! জীবনে প্রথম এত ভোরে উঠল সে। তুশির ফুরফুরে মেজাজ মূহুর্তেই কেমন হাওয়া ছেড়ে দিলো। কেউ ওঠেনি,ও একা একা কী করবে এখন?
টিভি দেখবে? কিন্তু এই রিমোর্টের ও কিচ্ছু বোঝে না। বাইরে যাওয়ারও উপায় নেই। দরজাটা সারাক্ষণ লক করা থাকে। তক্ষুনি সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলো তুশি।
নামছেন তনিমা। ওকে দেখেই অবাক হয়ে বললেন,
“ ওমা তুশি! এত সকাল সকাল যে,কী ব্যাপার?”
“ ইয়ে, ঘুম ভেঙে গেল।”
“ গরমে বোধ হয়,তাই না? কতবার যে মনে করলাম সার্থকে একটা ফ্যানের কথা বলব! আচ্ছা নিচে নামুক আজ,বলবই।”
তুশি মাথা নাড়ল। তনিমা বললেন,
“ চা খাবে?”
“ না না।”
“ একা একা কী করবে তাহলে? ইউশাও তো ওঠেনি। যাও তবে,বাগান থেকে হেঁটে এসো। ভালো লাগবে!”
তুশির কণ্ঠে অবিশ্বাস আর আনন্দ একসাথে শোনাল,
“ বাগানে? যাব,সত্যি!”
“ হ্যাঁ যাও। কিন্তু ভুলেও পালাতে যেও না আবার।”
তুশি উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
“ এ বাবা না না। ওনাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব?”
তনিমা দুই ভ্রু উঁচাতেই,থতমত খেয়ে বলল,
“ না মানে বলতে চাচ্ছিলাম এখান থেকে আমি কোথায় যাব?”
ভদ্রমহিলা ঠোঁট চেপে হাসলেন৷ আঁচল থেকে চাবির গোছাটা খুলে দিয়ে বললেন,
“ এটা দিয়ে খুলবে। যাও।”
তুশি ভদ্রের ন্যায় চাবি হাতে নিলো । এপাশ ফিরেই চোখ খিচে জিভ কাটল আস্তে। মুখ ফস্কে কী একটা কথা বেরিয়ে গেল,ইস! ভাগ্যিস উনি কিছু বোঝেননি।
বাগান লনের ডান দিকে। তুশি আজ প্রথম এলো এখানে। এবং সেই সাথে আবিষ্কার করে ফেলল, এই জায়গা ওর স্বপ্নে দেখা পুরির মতো সুন্দর। চারপাশের সব রং, সব সৌন্দর্য যেন হুড়মুড় করে দৃষ্টিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পায়ের নিচের নরম মাটি ঠিক এক টুকরো মেঘ। কত রঙের ফুল! হাওয়ার তালে পাপড়িগুলো দুলছে ওদের। তুশির টুকটুকে ঠোঁট জোড়া আপনাআপনি দুপাশে সরে গেল। বাগান তো নয়, যেন শান্তিনীড়। ইস,বিটকেলটা ওই স্টোর রুমে না দিয়ে ওকে এখানে শুতে দিলেও পারতো! রোজ এক দফা রোদ আর বৃষ্টির সাথে সময় গুণতো তুশি। ফুলের সাথে হাসতো,বাতাসের মোহে উড়তো। ধ্যাত! তুশির হঠাৎ চোখ পড়ল অদূরে। কাঠের দোলনা দেখেই এক ছুটে চলে গেল সেখানে। স্ফূর্ত চিত্তে বসল তারপর। এক পায়ে ভর দিয়ে ধাক্কা দিতেই,দোলনা দুলে ওঠে। তার শীর্ণ শরীর সহ বাতাসে উড়ে বেড়ায়। তুশি আনন্দে খলবলিয়ে উঠল। খিলখিলে এক হাসি কণ্ঠ ফুড়ে ছিটকে এসে লুটিয়ে পড়ল বাতাসে। ইয়াসিরের আজ থানায় যাওয়ার তাড়া নেই। তাও স্বভাবসুলভ নিয়মমাফিক সকাল সকালই উঠল সে। তনিমা এর মাঝে কফি দিয়ে গেলেন। ধোঁয়ায় ভরতি মগ নিয়ে বারান্দার থাই গ্লাস সরিয়ে মাত্রই এসে দাঁড়িয়েছে সে। কোত্থেকে ভেসে আসা হাসির ঝংকার শুনে,মগে চুমুক দিতে গিয়েও থামল ইয়াসির। ঘাড় ফিরিয়ে চাইল ভালো করে। দোলনায় দুলতে থাকা হলুদ জামা পরা মেয়েটা ওর চেনা। তুশি!
ইয়াসিরের কপাল বেঁকে গেল অমনি। বিড়বিড় করে বলল,
“ এই চোর বাইরে গেল কী করে?”
তুশি যখন ভুবন ভুলে দুলছিল, আচমকা দুটো হাত এসে কাঠটা ঠেলে দিলো একটু। দোলনার শিকল গায়ের জোর দেখাতেই,হকচকিয়ে ফিরল তুশি। সহসা চমৎকার করে হাসল অয়ন,
“ গুড মর্নিং!”
অমনি এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। অয়ন ভ্রু উঁচাল,
“ ভয় পেয়েছ?”
“ আপনি, মানে এখানে এত সকালে?”
তুশির মনে ভয়। দাদি বলেছে খুব সকাল আর সন্ধ্যায় জিন মানুষের লেবাস ধরে ঘোরাঘুরি করে। কোনোভাবে এটাও জিন না তো!
অয়নের কণ্ঠ স্বাভাবিক। বলল,
“ বাগানে আমি রোজ সকালেই আসি। আজকেও ওখানে বসে পড়ছিলাম। তোমাকে দেখেই উঠে আসা।”
হাত দিয়ে অদূরের চেয়ার-টেবিল দেখাল সে। তারওপর দুটো মোটা মোটা বই দেখে চোখ কপালে তুলল তুশি৷ বাবাহ, এরা সারাদিন পড়ে! নিশ্চিন্ত মেয়েটা মাথা নাড়ল এবার। হাসল এতক্ষণে। বলল,
“ ওহ, তাহলে চিন্তা নেই।”
“ কীসের চিন্তা?”
“ কিছু না, এমনি।”
তুশি বোকা বোকা হাসছে। কথা এড়াতে বলল,
“ আপনাদের গাছে অনেক ফুল। কত সুন্দর সুন্দর গোলাপ! আমার অনেক ভালো লেগেছে জায়গাটা। আমাকে যদি প্রতিদিন আসতে দিতো।
“ তুমি আসতে চাও?”
তুশি ঘাড় নাড়ল সজোরে৷
“ বেশ,আমি ব্যবস্থা করে দেবো। তবে উল্টোপাল্টা কিছু করা যাবে না।”
“ না না একদম না। আমি ভালো হয়ে যাচ্ছি।”
অয়ন চুপ করে গেল। সময় নিয়ে কাটিয়ে তুলল ইতস্তভাব। আস্তেধীরে বলল,
“ তুশি, আসলে কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। কালকের জন্যে আম এক্সট্রিমলি সরি! তখন খুব জরুরি কাজ থাকায় বেরিয়ে যেতে হয়েছিল৷ ফিরলামও রাত করে। তাই তোমার সাথে দেখা হয়নি৷ প্লিজ,কালকের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু মনে করো না,প্লিজ!”
এত অনুনয়ের পিঠে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ল তুশি।
“ আরে ধুর! ওসব আমি কখন ভুলে গেছি। আপনি, ইউশা সবাই এবার একটু রিলিস হন তো!”
“ রিলিস? ওহ,রিল্যাক্স?”
তুশি ঠোঁট টিপে মাথা চুলকাল৷ ইংরেজি বলতে চায় না, তাও বেরিয়ে যায় জিভ ফসকে। আবার ভুল! আবার বেইজ্জতি!”
ওর মুখের অবস্থা দেখে মাথা নুইয়ে হাসল অয়ন। তারপর হলুদ ফুলে ভরতি গাছের দিকে এগিয়ে গেল কয়েক পা। একটা রঙীন,স্নিগ্ধ ফুল ছিঁড়ে এনে বাড়িয়ে দিলো সামনে। বলল,
“ আ বিউটিফুল ফ্লাওয়ার্স,ফর এনাদার বিউটিফুল লেডি।”
তুশি চোখের পাতা টুপটুপ করে ফেলল। অবোধ স্বরে শুধাল,
“ আমার জন্যে?”
অয়ন মাথা নাড়ে। তাড়া দেয়,
“ ধরো।”
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৬
তুশি দোনামনা করে হাতটা বাড়াল। ফুল ধরতে ধরতেই আচমকা চোখ পড়ল দোতলায়। ইয়াসির শক্ত পিলারের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ততক্ষণে গরম কফি শরবত হয়ে গেছে। তাতে কী! খুব তাজ্জব চোখজোড়া তার এখানেই আটকে। ফুল দেয়া-নেয়ার এই দৃশ্যটা যে অনাকাঙ্ক্ষিত, ইয়াসিরের তাকানোতেই স্পষ্ট তা। কিন্তু অজান্তেই কেমন ঘাবড়ে গেল তুশি। দক্ষ শিকারির ওই দৃষ্টির তোড়ে হাত খসে ফুলটা পড়ে গেল নিচে। অয়ন শ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়ল৷ ফুলটা ঝুঁকে তুলে দিলো ফের। এগিয়ে দেয়ার পরেও তুশি ধরছিল না। কচলাতে থাকা হাতটা টান মেরে ধরে মুঠোয় ফুল গুঁজে দেয় অয়ন। কেমন করে বলে,
“ কিছু জিনিস আকড়ে ধরতে শেখো, তুশি।”
ইয়াসির সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার উন্মুখ গ্রিল চেপে ধরল তালুতে৷ খ্যাক করে ডাকল,
“ অ্যাই চোর অ্যাই!”