কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৮
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
একটা খরখরে কণ্ঠের রুঢ় ডাকে তুশির ভেতরে দুম করে শব্দ হলো কিছুর। ভয়ডরে চোখের পাতায় ঝড় নামিয়ে ঢোক গিলল মেয়েটা। অয়ন পিছু ফিরে চাইল এবার। বারান্দায় দাঁড়ানো ইয়াসিরকে এতক্ষণে দেখেছে সে। কিন্তু চেহারার সাবলীলতা এক ফোঁটা কমেনি। কারো বিয়ে করা বউকে যে সে ফুল দিচ্ছিল, সেসব নিয়ে একটুও বিব্রতকর ছাপ বসেনি মুখে। উলটে হেসে হাত নাড়ল অয়ন। স্ফূর্ত স্বরে বলল,
“ গুড মর্নিং ভাইয়া।”
ইয়াসিরের তপ্ত চোখে পরিবর্তন এলো না। উত্তরও দিলো না কোনো। সোজাসাপ্টা নির্দেশ করল তুশিকেই,
“ ভেতরে এসো।”
তারপর ঢুকে গেল ঘরে। অয়ন ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ এই ভাইয়ার আবার কী হলো?”
তুশির কণ্ঠে ভয়,
“ সার মনে হয় রেগে গেলেন।”
হতভম্ব চোখে ফিরল অয়ন।
“ ষাঁড়? তুমি ভাইয়াকে ষাঁড় ডাকো?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুশি ওই ষাড়,আর এই সারের পার্থক্য ধরতে পারল না। মাথা নাড়ল ছোট করে। অয়ন চোখ কপালে তুলে বলল,
“ এরপরও সুস্থ আছো কী করে? ভাইয়ার তো এতদিনে তোমাকে গুলি করে মেরে দেয়ার কথা।”
তুশি ছটফট করে বলল,
“ আমি যাই। উনি ডেকেছেন, বেশি দেরি করলে সত্যি সত্যিই গুলি করে দেবে।”
অয়ন কিছু বলতেই যাচ্ছিল,পূর্বেই বিক্ষিপ্ত পায়ে ছুটল মেয়েটা। গতির তোড়ে ফুলটাকেও ফেলে গেল ফের। অয়নের সব স্ফূর্তি মুছে গেল বোধ হয়। ভাইয়ার এখনই ডাকতে হলো? চোখ সরিয়ে আনতেই খেয়াল পড়ল পায়ের দিকে। ওর দেয়া হলদে সতেজ ফুলটা এখন নেতিয়ে পড়ে আছে মাটিতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ তুই হাতেই জায়গা পেলি না? তাহলে আমি মনে পাব কীভাবে?”
ইয়াসির হনহনে পায়ে নিচে নেমে এসেছে। শরবতের মতো ঠান্ডা হওয়া কফির মগটা সেন্টার টেবিল দুম করে রাখল। এর মাঝেই বাইরে থেকে হন্তদন্ত গতিতে দৌড়ে এসে হাজির হলো তুশি। ততক্ষণে বাড়ির অর্ধেক মানুষ সজাগ হয়েছে। রেহনূমা,তনিমা খাবার সাজাচ্ছিলেন টেবিলে।
ইয়াসিরের আওয়াজে কাজ ফেলে ঘুরে তাকালেন তারা। সে মেঘমন্দ্র গম্ভীর স্বরে বলল ,
“ কার অনুমতি নিয়ে বাইরে গেছিলে?”
তুশি ঘাবড়ে শেষ। কথা বলতে গিয়ে তুতলে উঠল। “ আমি মানে,আমি তো..”
রেহূনূমা নির্বিকার। তুশি গোল্লায় গেলেও তার কিচ্ছু না। কিন্তু তনিমা এগিয়ে এলেন জলদি। বললেন,
“ আমি ওকে যেতে বলেছি।”
ইয়াসির অবাক হলো,
“ তুমি,কেন?”
“ কেন মানে? মেয়েটা সারাদিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকে। একটু বাইরের আলো বাতাসও তো দরকার আছে নাকি। স্কুলে ভর্তি করালি,ক্লাস করতে যায় না। সামান্য বাগানে গেলে কী হয়? সব সময় এরকম চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে থাকলে তো,মাথা খারাপ হয়ে যাবে।”
ইয়াসির শক্ত কণ্ঠে বলল,
“ এই চোরের মাথা এমনিতেই খারাপ। নতুন করে খারাপ হওয়ার কিছু নেই। বাইরে যেতে যে বলেছ,যদি পালিয়ে যেত!”
“ ওমা, পালাবে কেন?”
“ কেন পালাবে না? একে আমি এক ফোটাও বিশ্বাস করি না।”
শেষ টুকু তুশির দিকে চেয়ে কেমন খটমট করে বলল ইয়াসির। বেচারি মেয়েটা ঠোঁট উলটে ফেলল অমনি। অথচ তনিমা মিটিমিটি হেসে বললেন,
“ কিন্তু আমার তো মনে হয় তুই-ই ওকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করিস।”
চোখ ছোটো করে চাইল ইয়াসির।
“ মানে!”
তনিমা বললেন,
“ মানেটা আমাদের থেকে তুই ভালো জানিস। সারাটাদিন মেয়েটাকে চোর চোর বললেও ঠিকই তো যখন ওর ওপর চুরির আরোপ পড়ল,তখন সবার সাথে কেমন হম্বিতম্বি করলি! বিশ্বাস না থাকলে এটা হয়?”
ইয়াসিরের কণ্ঠ একরোখা,
“ সেটা আলাদা ব্যাপার ছিল।”
“ এটাও আলাদা ব্যাপার। একটু বাগানে যাওয়া নিয়ে এত রাগের কী আছে?
আর ও যদি পালাতোই, তাহলে এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছে কী করে শুনি?”
তুশির চোখদুটো বিশ্রামহীন ঘুরছিল। মা-ছেলের বাগবিতণ্ডায় কলের পুতুল সে। হতবাক চোখে একবার ইয়াসিরকে দেখছে,পরেরবার তনিমাকে। ইয়াসির আশ্চর্য চোখে বলল,
“ আজব তো,তুমি ওর হয়ে এভাবে ঝগড়া করছো কেন?”
তনিমা নিজেকে দমালেন। চোখমুখ ঠিক করে বললেন,
“ তাহলে ওকে কিছু বলবি না। খবরদার কিন্তু…”
তুশি এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেলো। মিনসে মুখে বলল,
“ আপনি না চাইলে আমি আর যাব না।”
চট করে তাকাল ইয়াসির। ভ্রু বেঁকে চলে এলো গুছিয়ে,
“ আমি না চাইলে মানে!”
তনিমা গদগদ হয়ে বললেন,
“ কত লক্ষ্মী মেয়ে! কী সুন্দর স্বামীর সব কথা শোনে। আহা, কত ভালো বউ!”
ইয়াসির নির্বোধ বনে বলল,
“ স্বামী, বউ,এখানে এসব কথা আসছে কেন?”
“ আমি আনছি তাই।”
ও বিরক্ত হয়ে বলল,
“ মা তোমার মাথা ঠিক নেই। যাও, যেটা করছিলে তাই করো।”
“ তা করছি। কিন্তু ওকে ধমকাবি না বলে দিলাম।”
তনিমা গেলেন। আজ যেন তুশির ওপর তার দরদ কয়েক পারদ বেশিই দেখা গেল। ইয়াসির বুঝল না,এই আচমকা মায়ের রূপ বদলের কারণ কী?
তুশি হাতের আঙুল কচলাচ্ছে। চোরা চোখের নজর ইয়াসিরের শক্ত চিবুক পানে। ইয়াসির তাকাতেই মাথা নামিয়ে নিলো। কানে এলো রুক্ষ ভাষার শব্দ,
“ মা যেতে বলেছে শুনে কিছু বললাম না। তবে এভাবে যখন-তখন বাইরে বের হবে না। আর তোমার পড়া নেই? সকালে উঠে পড়তে বসতে পারো না? নাকি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে পড়ার ইচ্ছে গায়েব হয়ে গেল!”
ইয়াসির বকছিল। সেই বকাঝকায় একটুও মিষ্টতা নেই। অথচ এক বার তাকিয়েই মনের খেই হারিয়ে ফেলল তুশি। ফের এক চোট মন্ত্রমুগ্ধতায় ভরে এলো অন্তঃপুর। চোখ জোড়া থেমে গেল, ঝলকে যাওয়া দৃষ্টিতে এক ধ্যানে চেয়ে রইল মেয়েটা। ওর কানে ইয়াসিরের কোনো কথা যাচ্ছে না। পৃথিবীর সব যেন তুচ্ছ। ইয়াসিরের চোখের ভাঁজ, প্রতিটি শব্দ সব যেন কবিতার স্বচ্ছ কোনো নীড়। যার মোহে তুশির অন্তঃপটে কোথাও একটা গুনগুন করে বাজছে,
“ সে আমার সাথে চলে, কখনো কথা বলে,কখনো অনুভবে মিশে আছে মনে হয়।
হুউউউ… ভাবে মন আবোল-তাবোল,
লাগেরে পাগল পাগল,
কবে যে করবো আমি ভালোবেসে তাকে জয়!
সে যেন আমায় ডাকে,
দেখি না কোথাও তাকে,
ভালোবাসায় জড়িয়ে সে আমায় ধরেছে।
প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।”
ইয়াসির হঠাৎ তাকাল। তুশির হাঁ করে থাকা দেখে ভাঁজ বসল কপালে। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নিজেও। সেই চাউনিতে তুশি থতমত খায়। এলোমেলো এই চিত্ত হতে বাঁচার ছুঁতোয় পাশ কাটাতে নেয় ত্রস্ত বেগে। তুরন্ত হাতটা টেনে ধরল ইয়াসির। তুশি থমকে দাঁড়াল, স্তব্ধ হলো। বিস্ময়াহতের ন্যায় হাতের পানে চাইল ফিরে। অমনি কব্জি ধরে এক টান মারল ইয়াসির। তিরের গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো এক ঝটকায় ওর শক্ত বুকে এসে পড়ল তুশি। খোলা চুলের একাংশ এসে হামলা ছুড়ল কপালে। বড়ো যত্নে,নিঁখুত মনোযোগে সেই চুল সরিয়ে কানে গুঁজে দিলো ইয়াসির। নিঃশ্বাসের এই অন্তরঙ্গতায় তুশির প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রথম ইয়াসিরের এতটা সান্নিধ্য,এতটা কাছাকাছি আসায় বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দটা যে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ইয়াসিরের নিটোল ঠোঁটের নিশানা তুশির মসৃণ কপাল। যেন এক গভীর ছোঁয়ার অপেক্ষায় ওরা। অনুভূতির গাঢ় এক স্পন্দনে মেয়েটার পায়ের পাতা শিরশির করে উঠল। তপ্ত অধরের স্পর্শ পাওয়ার আকাঙ্খায় ঢোক গিলে চোখ খিচে বুজে নেয় সে। কেউ ধমকে ওঠে তক্ষুনি,
“ অ্যাই চোর, কথা কানে যাচ্ছে?”
তুশির বুক ছ্যাৎ করে উঠল। চোখ মেলল ধড়ফড়িয়ে। তড়াক চাউনিজোড়া অমনি বিধ্বস্ত হলো। সে কোথায়,আর ইয়াসির কোথায়? কীসের সেই কাছাকাছি! বিটকেলটা তো ওর থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। তাহলে এসব কল্পনা? তুশি লজ্জায় মাটিতে মিশে গেল। যে মানুষটা ওর দিকে ভালো করে তাকায়ও না,ও কিনা তাকে নিয়ে চুমুচামাটি অবধি ভেবে ফেলেছে? কুণ্ঠার তোড়ে মেয়েটা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। পালানোর অজুহাতে ঝড়ের বেগে ছুট লাগাল অমনি। এই হঠাৎ হঠাৎ কাণ্ডে আরেক দফা তব্দা খেল ইয়াসির। দাপুটে ভ্রুজোড়ায় খেলে গেল বোকা বোকা চিহ্ন। বড়ো তাজ্জব হয়ে ভাবল,
“ এই মেয়ে আজকাল এমন করছে কেন?”
ইউশা ছাদে উঠেছিল গাছে পানি দিতে। এটা তার দৈনিক রুটিন। হঠাৎ কার্নিশ ছাপিয়ে নিচের বাগানে চোখ পড়তেই দেখল অয়ন পড়ছে। অমনি সব ফেলে এক ছুটে নেমে এলো মেয়েটা। উড়ন্ত পাখির মতো ডানা মেলে দৌড়ে এসে থামল ওর পাশে।
হাঁপ তুলে ডাকল,
“ অয়ন ভাই!”
বইয়ে মগ্ন অয়ন চোখ তুলে চাইল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ তুই,এত সকালে? কী ব্যাপার? “
“ তোমাকে দেখে এলাম।”
“ আমাকে!”
ইউশা বোকা বোকা হাসল,
“ না মানে,ভাবলাম তুমি একা আছো। বসে বসে কী করবে!”
অয়ন চোখের ইশারায় পাশের চেয়ার দেখাল,
“ বোস।”
বসল মেয়েটা। তার শরীরের কোথাও এক প্রস্থ জড়োতা। গাল জোড়ায় লজ্জা কয়েক শতক। দৃষ্টির কোণে নরম আহ্লাদ মেখে অয়নকে দেখল কয়েক বার৷ এই একটা মানুষ যার কারণে পুরো বিশ্বকে ইউশা ওলটপালট করে দিতে পারে। যার চোখে লুকোনো তার বিশ্বাস,তার ভালোবাসা, তার ভবিষ্যতের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া। অয়ন প্রশ্ন ছুড়ল তখনই,
“ তোর ফিউচার নিয়ে কী প্ল্যান? বড়ো হয়ে কী হবি?”
ইউশা বিরক্ত হলো। চ সূচক শব্দ করে ভাবল,
“ এসব কী প্রশ্ন? কোথায় জিজ্ঞেস করবে তোর কেমন ছেলে পছন্দ! আর ও ইনিয়েবিনিয়ে বলবে আপনার মতো। তা না,ধ্যাত!”
কণ্ঠে অসন্তোষ নিয়ে বলল,
“ জানি না। কিছু একটা হতে পারলেই হবে।”
অয়ন হতাশ চোখে চাইল।
“ তোর লজ্জা করবে না ইউশা,আমি আর ভাইয়া এত ভালো রেজাল্ট করলাম। আর তুই যদি…”
ইউশা পুরোটা শুনল না। ব্যগ্র চিত্তে প্রশ্ন করল মাঝপথে,
“তোমার সব বন্ধুদের কি বিয়ে হয়ে গেছে অয়ন ভাই?”
অয়ন তব্দা খেয়ে বলল,
“ আমি তোকে কী বললাম,আর তুই কী বলছিস?”
ইউশা অপ্রস্তুত হাসল।
“ না আসলে আমি ভাবছিলাম যে, তুমি কবে বিয়ে করবে?”
“ আমার বিয়ে দিয়ে তোর কী কাজ?”
ও মনে মনে বলল,
“ আমারই তো সব কাজ। তুমি বিয়ে না করলে আমি কীভাবে বউ সাজব?”
ফের শুধাল,
“ আচ্ছা অয়ন ভাই,তোমার কাউকে ভালো লাগে না?”
একেকটা প্রশ্নে বিস্ময়ের তোড়ে হোচট খাচ্ছে অয়ন। ইউশার মুখে এমন কথাবার্তা ও এর আগে শোনেনি। বইটা বন্ধ করে পুরোপুরি ঘুরে বসল এবার। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“ তোর হয়েছেটা কী,ইউশা? তুই কি কারো সাথে প্রেম করছিস?”
মেয়েটার সব উত্তেজনা ফুস করে উড়ে গেল অমনি। ও এতক্ষণ কী বলছিল, অয়ন ভাই কী বুঝলেন! সে কড়া কণ্ঠে বলল,
“ ইউশা, এটা কিন্তু প্রেমের বয়স নয়। এগুলোর জন্য সামনে অনেক সময় আছে। এখন পড়াশোনার সময়,পড়াশোনা কর।”
ইউশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ প্রেমে পড়লে বুঝি পড়াশোনা হয় না?”
অয়নের কণ্ঠে সতর্কতা,
“ এর মানে আমি ঠিক ধরেছি,তাই তো? চাচ্চু জানে এসব?”
ইউশার চোখ বেরিয়ে আসার পথে। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ এ বাবা না না। আমি আবার কার সাথে প্রেম করব? আমি তো ভালো মেয়ে।”
অয়নের কণ্ঠ সন্দেহী,
“ কতভাগ সত্যি?”
সবেগে মাথা ঝাঁকায় সে,
“ একশ ঊনিশ ভাগ।”
“ আর বাকি এক ভাগ?”
ইউশা বিড়বিড় করল
“ ওটাতো তোমার কাছে।”
ওকে চুপ দেখে প্রসঙ্গ আর ঘাটাল না অয়ন। একটু পরই আবার কথা বলল ইউশা,
“ আচ্ছা, সব সময় পড়তে তোমার বিরক্ত লাগে না অয়ন ভাই?”
“ না।”
“ তাহলে এমন একা একা চুপচাপ থাকো যে এতেও বিরক্ত লাগে না?”
“ আমি চুপচাপ থাকি তো কী? কথা বলার জন্যে তুই আছিস না? ব্যালেন্স তো হচ্ছে।”
ইউশা কী বুঝে নিলো কে জানে! নিজের মতো হিসেব সাজিয়ে বুকের ভেতরটায় আলোড়ন তুলে ফেলল। ঘাড় নেড়ে ভাবল,
“ তাই তো, দুজনেই কথা বললে শুনবে কে!”
অয়ন নিজেই বলল,
“ তাছাড়া মানুষের সাথে বেশি কথা ঝামেলা। কথা বাড়াতে গেলেও ঝামেলা। আসলে মানুষ মানেই আস্ত এক ঝামেলা।”
“ আমিও কী ঝামেলা?”
অয়ন ভ্রু বাঁকাল।
“ তা কখন বললাম?”
ইউশার কণ্ঠ নেমে এলো। চঞ্চল চিত্তে ভাটা পড়ল খানিক। সাগ্রহে শুধাল,
“ তোমার কাছে আমি কেমন অয়ন ভাই?”
অয়ন হাসে। জবাব দেয় বিলম্বহীন,
“ কেমন? তুই যেমন, তেমন অমন।”
ইউশার আশায় জল পড়ল। মুখ ভার করে বলল,
“ এটা একটা উত্তর হলো।”
“ তোর পরীক্ষা কবে?”
ও ফের বিরক্ত হয়,
“ আবার পড়াশোনা! এসব ছাড়া কোনো কথা জানে না নাকি! তুমি তো পড়ছো,আমি না পড়লে কিচ্ছু হবে না।”
মুখে জানাল,
“ দু মাস পর।”
অয়নের কথায় বিজ্ঞভাব। বলল,
“ কোনো চ্যাপ্টার নিয়ে সমস্যা হলে আমাকে জানাবি। এক একা গুম মেরে বসে থাকবি না। আমি সব সময় তোর সাথে আছি।”
তারপর মেয়েটার মাথায় হাত রেখে এক টুকরো আলোর মতো হাসল অয়ন। ভোরের মনোহর সৌন্দর্যে সেই হাসি আরো একবার ইউশার প্রাণ কেড়ে নেয়। পরপরই বক্ষভাগের অতলটা ঝুপ করে তলিয়া যায় বিষাদে। অয়ন ভাই কী চায়,কী না চায় ও জানে না। ভালোবাসলে এমন দূরে থাকে কেন? বা ভালো না বাসলে সরাসরি বলে না কেন? কেন এই ধরার মাঝেও আকাশ সমান অধরা ভাব? সৌজন্যতায় ইউশা হাসল, তবে টেনেটুনে। বিমর্ষ চেয়ে ভাবল,
“ এই থাকাকে থাকা বলে না, অয়ন ভাই। থাকলে এমন ভাবে থাকো যেভাবে মানুষের শরীরে প্রাণ মিশে থাকে। যাকে মৃত্যু ছাড়া কক্ষনো আলাদা করা যাবে না।”
বিকেলের পরপরই থানা থেকে ইয়াসিরের কাছে জরুরি ফোন এসেছে। সেন্ট্রাল জেল থেকে পালিয়েছে রুহান। খবরটা শুনেই খুব তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ছাড়ল সে। এখন রাতের প্রায় মধ্যভাগ ,ফেরার নাম নেই অথচ। ঘড়িতে টিকটিক করছে বারোটার কাাঁটা। বাড়িতে শুধু বলেছিল, ফিরতে দেরি হতে পারে। এমনটা অবশ্য ওর আগেও হয়েছে। রাত করে ফেরা তনিমার কাছে নতুন ঘটনা নয়। তাই ব্যাপারটা নিয়ে আলাদা করে কেউ ভাবল না। খেয়েদেয়ে যে যার মতো ঘরে চলে গেল। শুধু একইরকম বসে রইলেন তনিমা। সাথে আরো একটা মানুষ, আরো দুটো চোখ!
যারা একটু পর পর আকুল হয়ে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। দেখছে, ইয়াসির এলো কি না। তনিমা ঘুমে ঢুলছেন। তুশি খেয়াল পড়তেই তড়িঘড়ি করে এসে দাঁড়াল সেখানে। পায়ের শব্দ পেয়ে তড়িৎ চোখ মেললেন রমণী। ভেবছিলেন,ইয়াসির। তুশিকে দেখেই সেই সজাগ দৃষ্টি নিভল। বললেন,
“ ওহ,তুমি! ঘুমোওনি এখনো?”
“ আপনি ঘুমাবেন না?”
“ না, সার্থ আসুক। নাহলে আবার না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে।”
তুশি মাথা চুলকাল। যেন কথা সাজানোর প্রস্তুতি। তনিমা নিজেই বললেন,
“ কিছু বলবে?”
“ হু? না মানে আমি যদি থাকি? আমি ওনাকে ভাত বেড়ে দেবো।”
“ তুমি পারবে?”
তুশি প্রফুল্ল স্বরে জানাল,
“ হ্যাঁ। রান্না ছাড়া আমি সব পারি।”
ভদ্রমহিলা হাসলেন। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও,মাথা নাড়লেন তাও। এই সুযোগে ছেলেমেয়ে দুটো যদি একটু কাছাকাছি আসে!
“ আচ্ছা। যাচ্ছি তাহলে।”
ঠোঁটে হাসি পিষে উঠে গেলেন তিনি। তুরন্ত তার জায়গায় তুশি পা তুলে আসন করে বসল। ওর ঠিক সামনেই কিছুটা দূরে একটা বিশালাকার শোকেজ রাখা আছে। কাচের মধ্য দিয়ে নিজেকে আবছা রূপে দেখতে পাচ্ছে তুশি। এই যে ও ইয়াসিরের অপেক্ষায় বসে আছে এমন, চেহারায় বউ বউ ভাব এসেছে না? না না, বউরা তো ঘোমটা দেয়। সাথে সাথে গায়ের ওড়নাটা চটপট মাথায় তুলে ঘোমটা পরল তুশি। লাজুক হেসে বিড়বিড় করল,
“ আপনি এসেছেন? আপনার জন্যেই বসেছিলাম।”
পরপরই ঘাড় ঝাঁকাল।
“ না না এভাবে বললে ম্যাড়মেড়ে লাগবে। ইউনিক কিছু বলতে হবে ওকে।”
ফের কথা সাজাল,
“ বিটকেল আপনি… না না কীসের বিটকেল? এটা বললে ব্যাটা ওর গলা টিপে দেবে।”
তুশি হাল ছেড়ে দেয়,
নাহ, এসব মেয়েলিপনা তুশির দ্বারা হবে না। প্রেমে পড়ে ও বলদ হয়ে যাচ্ছে৷
মেয়েটার আনচান করার মাঝেই দরজায় লক ঘোরানোর শব্দ হলো। অমনি তটস্থ চিত্তে উঠে দাঁড়াল তুশি৷ মনের মাঝে দুরুদুরু ভয়,সাথে একটু-আধটু লজ্জা তখন। সকালের ওই কল্পনা আর ওই কাণ্ডের পর তুশি আর ইয়াসিরের সামনে আসেনি। কিন্তু এখন বসে আছে ওর জন্যে। সব মিলিয়ে বিটকেলটা না ধমকালেই হয়। তুশি একবার ঘরের দিকে ছুটতে নিয়েও আবার গাট হয়ে দাঁড়াল। কী করবে না করবে কেমন হযবরল অবস্থা। ইয়াসির ঢুকল এর মাঝেই। দরজা লাগিয়ে ফিরতেই ডিমবাতির আলোতে ওকে দেখে আঁতকে উঠল তুশি। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। ছুলে গেছে কপালের পাশটাও। বাম হাতের কব্জিতে রুমাল প্যাঁচানো। অথচ সাদা কাপড়টা রক্তে ভিজে দিব্যি লাল হয়ে বসেছে। তুশির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ইয়াসির ওকে দেখেছে। কিন্তু খুব আরামসে এডিয়ে গেল তাও। চুপচাপ পাশ কাটাতে নিলেই, হতবাক তুশির হুশ ফিরল এতক্ষণে। আর্তনাদ করে বলল,
“ এ কী, আপনা…”
তুরন্ত পিছু ফিরে নিজের ঠোঁটে আঙুল চাপল ইয়াসির।
“ শশশস।”
তুশি মিইয়ে যায়। ইয়াসির সতর্ক চোখে ওপরের ঘরটা দেখল একবার। জিজ্ঞেস করল ধীরে,
“ মা কোথায়?”
“ ঘু ঘুমোচ্ছেন।”
ইয়াসির স্বস্তি পেলো। ঠোঁট কামডে,
মাথা নেড়ে রওনা করল আবার। তুশি স্তম্ভিতের ন্যায় কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। মাথায় তার শত শত প্রশ্ন, ইয়াসির কি এক্সিডেন্ট করেছে? নাকি কেউ আবার…”
ইয়াসির ঘরে এসে আলো জ্বালাল। সোজা আয়নার সামনে গিয়ে ইউনিফর্ম বুক থেকে সরাল একটু। এখানেও ছিলে গেছে। হুট করে সামনে একটা রিকশা এসে পড়ায় বাইকের টাল সামলাতে পারেনি। ভাগ্যিস মা জেগে নেই। নাহলে চিন্তায় পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতেন। ইয়াসির ফার্স্ট-এইডের বাক্স বের করল। স্যাভলনে মাখা তুলো নিয়ে বুকের ক্ষততে চেপে চেপে লাগাল তারপর। ইউনিফর্মটা আরেকটু কাঁধ থেকে নামাল নিচে। পিঠের কোথাও খুব জ্বলছে। কিন্তু ওই কাটা অংশে হাত যাচ্ছে না। বোতাম খুলতে নিলো, আচমকা একটা নরম হাত এসে লাগল পিঠে। ভেজা তুলোটা আঙুল থেকে টানতেই,চমকে পিছু ফিরল ইয়াসির। তুশিকে দেখেই এক ঝটকায় সরে গেল দূরে।
“ তুমি,আবার এসেছ?”
“ আমাকে দিন,আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
ইয়াসির ইউনিফর্মের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
“ আমি বলেছি তোমাকে ? যাও, যাও চুপচাপ।”
তুশির মেজাজ চটে গেল। উড়ে পালাল সব ভয়। রোবটের ন্যায় বলল,
“ যাব না।”
ইয়াসির হতচকিত,
“ কী?”
“ যতক্ষণ না ওষুধ লাগাতে দেবেন আমি কোত্থাও যাব না।”
ইয়াসিরের চিকণ চোখ প্রকট হলো। সেই দৃষ্টিতে হতবুদ্ধি ছাপ। সকালেই ওর ভয়ে নেতিয়ে থাকা তুশির সাথে, এই মেয়ের বড্ড অমিল। কণ্ঠ গম্ভীর করে বলল,
“ মাথার তার ঠিক আছে?”
তুশির জবাব এলো সাথে সাথে,
“ না। সব ছিড়ে ভর্তা হয়ে গেছে। খাবেন আপনি?”
আরেক চোট ভ্যাবাচ্যাকায় বাকরুদ্ধ ছেলেটা। তুশি কখনো এভাবে কথা বলেনি। মেয়েটা শক্ত মুখে বলল,
“ আমাকে ওষুধ লাগাতে দিন। চুপচাপ চলে যাব।”
ইয়াসির রেগেমেগে কিছু বলতে যাবে, কথা কেড়ে নিলো সে,
“ আমি জানি আপনি কী বলবেন। স্ত্রী হতে এসেছ? না, আসিনি। ওইদিন আমার কপাল কেটে যাওয়ায় আপনি আমাকে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিলেন না? সেটা শোধ করতে এসেছি। তুশি কারো ঋণ রাখে না।”
ইয়াসির তপ্ত কণ্ঠে বলল,
“ তোমার বাজে কথা শোনার সময় আমার নেই। যেতে বলেছি, চুপচাপ বের হও। আউট!”
কর্কশ ওই চিৎকারে বুকের গতি লাফিয়ে উঠল তুশির। কিন্তু হার তো মানা যাবে না। বুকে সাহস এনে বলল,
“ ঠিক আছে, দেবেন না তো? আমি তাহলে আপনার মাকে ডেকে আনি।”
ইয়াসির বিহ্বল হয়ে বলল,
“ মানে! তুমি কি আমাকে ব্লাকমেইল করছো?”
তুশির কণ্ঠে সরল জেদ,
“ ওসব মিল-অমিল জানি না। আমি ওষুধ লাগাব, ব্যস। হয় লাগাতে দিন। নাহলে যাচ্ছি!”
ও যেতে নিলেই,তাড়াহুড়ো করে হাতটা টেনে ধরল ইয়াসির । অমনি এক ঝটকা বাতাসে বক্ষকোষগুলোও দুলে উঠল তুশির। মনে পড়ল সেই সকালের কথা। ইয়াসিরের ওই হাত টেনে বুকের ওপর ফেলে দেয়ার দৃশ্য।
কিন্তু হায়! ওসব কী আর হয়? তুশি মুখ ফিরিয়ে চাইতেই হাতটা আবার ছেড়ে দিলো ইয়াসির। গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“ ঠিক আছে,আমি রাজি।”
তুশির চেহারায় চাঁদ উঠেছে। চোখের কোণে ঠিকড়ে আসা জ্যোৎস্না। দুরন্ত পায়ে বিছানায় গিয়ে বসল। পাশের জায়গাটায় হাত রেখে দুটো বাড়ি দিয়ে বোঝাল,
“ বসুন।”
ইয়াসিরের চেহারায় বিরক্তি। অনীহা ততোধিক বেশি। শুধু মাত্র মাকে জানাবে না বলে,অনীচ্ছা গিলে এসে বসল পাশে৷ তুশির আনন্দ কে দেখে! সাথা সাথে ঘুরে বসল ওর দিক। ফার্স্ট এইডের কী কী করতে হয় সেদিন ইয়াসিরের থেকে দেখেছিল সব। আজ আর বিশেষ অসুবিধে হলো না। তুলো নিয়ে আরেকটু এগোলো ওর দিকে। নিশ্বাসের ছুঁইছুঁই হওয়া আর ইঞ্চিখানিক বাকি। ইয়াসির সরতে গেলে ইউনিফর্মের কলারটা খপ করে টেনে ধরল তুশি। জড়বুদ্ধি ছেলেটা চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ কী হচ্ছে এসব?”
তুশির কণ্ঠ নির্ভীক,
“ রোগীদের বেশি কথা বলতে হয় না। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।”
ইয়াসির স্তম্ভিত,বিস্মিত৷ বিমুঢ চাউনি শৃঙ্গে প্রায়। তুশি নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে চাইলেও,স্বাভাবিক ও নেই। মেয়েটার বুক কাঁপছে। কাঁপছে হাতের আঙুল। এক চোট উথাল-পাতাল অনুভূতিতে মরে যাচ্ছে ভেতরটা। ইয়াসিরের তাজ্জব চোখের চাউনি আস্তেধীরে মুছে গেল। শান্ত হলো চেহারা। চুপ করে সামনের মেয়েটার পানে চেয়ে রইল সে। ভীষণ ঠান্ডা, খারা দুটো চোখ। ভাষা নেই,বা পড়ার মতো বোধ নেই তুশির! কোনোওরকম হাতটা বাড়িয়ে ঠোঁটের কোণে তুলোটা ছোঁয়াল সে।
জায়গাটা জ্বলল বোধ হয়। ইয়াসির সসস বলে শব্দ করল একটু। তুশি উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
“ লাগল?”
ভ্রু গুটিয়ে দুপাশে মাথা নাড়ল ইয়াসির। তুশি তাও ফুঁ দিলো। ঝটকার মতো উড়ে আসা শীতল ওই স্বল্প হাওয়ায় চোখ বুজে মুখ ঘুরিয়ে নিলো ইয়াসির৷ তুশি ভেতরের উন্মাদনা চাপা দিতে চাইছে। চেষ্টার সবটুকুনি খাটাচ্ছে নিজেকে সংযত রাখার আশায়। ঠোঁট থেকে তার হাতটা এরপর নেমে এলো বুকে। বোতাম খুলে ঠিক বা পাশের জায়গায় থেকে ইউনিফর্মটা সরাল। বেরিয়ে এলো লোম হীন ফর্সা -নগ্ন বুক। ঢোক গিলল তুশি। তুলো ছুইয়ে,মাথা নামিয়ে ফু দিলো একইরকম। ইয়াসির আরো শক্ত হয়ে গেল । হাত মুঠো করে চেয়ে রইল আরেকদিক । তার শরীরের একাংশ ভরে গেল তুশির যত্নের ছোঁয়ায়। তারপর রক্তে ভেজা রুমালটা খুলল সে। ঝর্ণার মতো একটা লাল রেখা ক্ষত বেয়ে নামল অমনি। সঙ্গে সঙ্গে সেখানটায় নিজের ওরনা চেপে ধরল তুশি।
ইয়াসির বলল,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৭
“ হচ্ছেটা কী? ওড়নায় লাগছে তো।”
তুশি নিরুদ্বেগ,
“ লাগুক না।”
“ রক্ত কেউ ইচ্ছে করে কাপড়ে লাগায়?”
তুশি মুখ তুলে চাইল। নিভু কণ্ঠে বলল,
“ কী হবে? আপনারই তো রক্ত।”