কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩০
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
বিশাল গাড়িটা বস্তির গলিতে এসে থামতেই যেন আকাশ থেকে পড়ল একেকজন। কাজ-বাজ ফেলে হাঁ করে চেয়ে রইল তারা। অয়ন দরজা খুলে নামল। বস্তির এই জায়গা খুব স্যাঁতস্যাঁতে,নোংরা। এদিক-সেদিক ডাস্টবিনের ময়লা ছেটানো। ভনভন করে মাছি উড়ছে কোথাও। দুপুরের দিকে ঘন্টা খানেকের বৃষ্টি হয়েছিল, রাস্তা ভাঙা। একদম মাঝখানের ইট উঠে কূয়োর মতো ডেবে আছে। গাড়ি আর সামনে এগোনো যাবে না। অয়ন চারপাশ দেখল। সবে ১৬ নম্বর ঘরের সামনে এসছে। ২৭ তো তাহলে আরো ভেতরে। কিন্তু এমন প্যাঁচ,দুদিকে সমানতালে দুটো গলি ঢুকেছে। কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না ও। একবার আশপাশ ফিরতেই কিছু হতভম্ব হলো। সবাই কেমন অবাক হয়ে দেখছে! অয়নের কপালে ভাঁজ পড়ল। সানগ্লাসটা খুলে বোতামের হুকে রেখে ফের দেখল এদিক-সেদিক। পরপর হাত নাড়তেই দৌড়ে এক কিশোর এসে সামনে দাঁড়ায়। ও জিজ্ঞেস করে,
“ তুশিদের ঘর কোনটা বলতে পারবে?”
মাথা নাড়ল সে। হাতটা লম্বা করে বলল,
“ ওইদিক দিয়া সোজা যাইবেন।”
“ থ্যাংক ইউ।”
এবারেও মাথা ঝাঁকায় ছেলেটা। অয়ন দেরি করল না, হাঁটা ধরল দ্রুত। পেছন থেকে ভেসে আসা নারী কণ্ঠের কানাঘুষা ও তখনো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। কেউ একজন ফিসফিস করে বলছেন,
“ সবাই খালি তুশিগো ঘর খোঁজে ক্যা?”
“ কইতে তো পারি না। কিন্তু, কেডা এ বেডা?”
“ মনে হয় এইডাই তুশির স্বামী।”
অমনি অয়ন থমকে দাঁড়াল। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড! পরপরই হাঁটা ধরল ধীর পায়ে। কানের কাছে খুব করে বাজল, তুশির স্বামী!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুশিদের ঘর আরো ভেতরে। একদম শেষ মাথায় হয়ত। দুপাশে ছোটো ছোটো টিনের ঘর,মাঝে সরু রাস্তা। বৃষ্টি হচ্ছিল বলে ওপরে আবার চালের মতো বিশাল পলি টানিয়েছে। অয়ন যথেষ্ট লম্বা! হাঁটতে গিয়ে পানিতে ভেজা পলি মাথায় লাগছে তার। তারওপর আশপাশ এতো নোংরা,দূর্গন্ধ! রুমালে নাক চেপে ঝুঁকে ঝুঁকে কোনোরকমে এসে থামল জায়গায়। ততক্ষণে বস্তির প্রত্যেকটা ঘর থেকে একেকটা মাথা উঁকিঝুঁকি দিয়ে তাকে মেপে ফেলেছে। তিন্নির মা কাপড় কাচছিলেন। অয়নকে দেখে থামল হাতদুটো। ত্রস্ত গায়ের আঁচল টেনে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি । এমন ইন করা শার্ট-প্যান্ট পরব লোক আবার কে? কী একটা ভেবে দৌড়ে এলেন রমণী। অধৈর্য চিত্তে শুধালেন,
“ আপনে কি এন-জি-ও দিয়া আইছেন? আমগোরে কোনো ভাতা দেয়ার লইজ্ঞা?”
অয়ন ভড়কে গেল একটু৷ পরমূহুর্তে ভ্রু কুঁচকানোর মতো বিরক্তি মিলল মুখটায়। ভদ্রমহিলার হাসিহাসি চেহারায় চেয়ে বলল,
“ নো।” তিন্নির মা ঘাবড়ে গেলেন। নো বলেছে? মনে হয় অনেক শিক্ষিত! চট করে সরে এলেন পেছনে। চোখ ছোটো করে আপাদমস্তক মাপলেন ওর।
“ তাইলে আপনে ক্যাডা?”
অয়ন চুপ। তার চোখ ২৭ নং ঘরের দিকে। দরজায় মরিচা পড়া লোহার তালা ঝুলছে। বাড়িতে কেউ নেই নাকি! ওর চাউনি দেখেই তিন্নির মা ধরে ফেললেন ব্যাপারটা। আগ বাড়িয়ে শুধালেন,
“ আপনে কি হাসনা চাচির কাছে আইছেন?”
অয়ন নাম জানে না। তবে আন্দাজ করল,তুশির দাদির কথাই হবে। মাথা নাড়তেই উনি বললেন,
“ হে তো বাইত্তে নাই। কামে গেছে।”
“ কখন ফিরবে?”
“ সন্দ্যা হইলেই তো আইসা পড়ে। আইজ অহনও ক্যান আইতাছে না বুঝলাম না। আপনে বসেন,আমি আপনারে একটা চেয়ার দিতাছি।”
তিন্নির মা ঘরে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এলেন। অয়নের মেজাজের দফারফা অবস্থা তখন। ভেবেছিল এসেই নিয়ে যাবে,সময় লাগবে না। কিন্তু…
ও হাত উলটে ঘড়ি দেখল এক পল। সাতটা পার হয়েছে প্রায়। ইউশার কেক কাটা বাকি। মেয়েটা নিশ্চয়ই ওর অপেক্ষায় বসে থাকবে! ওর খুব ভক্ত যে। কতক্ষণ লাগবে তুশির দাদির ফিরতে? তিন্নির মা বললেন,
“ আরে বসেন। চাচি আহোনের টাইম হইছে তো।”
অনীচ্ছায় বসল অয়ন। ছটফটে চিত্তে হাত ঘড়িতে নজর ফেলল তাও।
তিন্নির মা এই পুরো সময়টায় ওকে খুঁটেখুঁটে দেখলেন। ছেলেটা সুন্দর, গা থেকে কড়া আতরের ঘ্রাণ আসছে। পোশাক কী পরিপাটি! কী পরিষ্কার! দেখেই মনে হচ্ছে অনেক বড়োলোক। ভদ্রমহিলা উশখুশ করে বললেন,
“ চা খাইবেন?”
“ জি না।”
“ আপনে চাচির কী হন?”
“ কেউ না।”
“ তয় খোঁজেন ক্যা?”
“ দরকার আছে। আপনাকে বলতে চাচ্ছি না।”
স্পষ্ট উত্তরে ভদ্রমহিলার কথা বন্ধ হয়ে গেল। মিনসে গলায় বললেন,
“ আমি তো এমনেই জিগাইছি। আইচ্ছা আপনে বসেন তাইলে।”
ওর পালটা উত্তর এলো না। তিন্নির মা মোড়াতে মোড়াতে কাজে ফিরে গেলেন। বিরক্তি গলে বসে রইল অয়ন। অতীষ্ঠ চোখে তুশিদের ঘরের দরজায় দেখল বারবার। টিনের পুরোনো একটা দরজা। এক ধাক্কায় বোধ হয় খুলে আনা যাবে। ভেতরে অত বড়োও নয় নিশ্চয়ই। ইস,এরকম জায়গায় মেয়েটা থাকতো কী করে? একেই বুঝি বলে,গোবরের পদ্মফুল! অত সুন্দর,সুশ্রী মেয়েটাকে তো এখানে মানায় না। ওকে মানায় শুধু অয়নদের বাড়িতে,অয়নের রাজ্যে।
ছেলেটা মাথা নুইয়ে হাসল। চট করে পকেট থেকে ফোন বের করে আনল হঠাৎ। গ্যালারিতে ঢুকতেই প্রথম ছবিটা বেরিয়ে এলো তুশির। সেদিন ইউশা ছিল না বলে ওর কাছে অংক বুঝতে এসেছিল সে৷ কফি বানানোর ছুঁতোয় খুব সন্তর্পণে ছবিটা তুলেছিল অয়ন। এক হাত গালে রেখে,আরেক হাত দিয়ে তুশি খাতায় লিখছে। কত মনোযোগ! বেনুনির ফাঁক গলে ছোটো ছোটো চুলের কপালে লেপটে থাকা, অয়ন মন দিয়ে দেখল। ঠিক সেই সময় ছবির ওপরে স্ক্রিনে কারো কল ভেসে ওঠে। মেদুর মুখটা থেকে এতক্ষণে চোখ ফেরাল অয়ন। ইউশার কল! ধরল না সে। হয়ত কেক কাটবে বলে বাড়ি ডাকছে সবাই। কিন্তু অয়ন যে এখন তুশির দাদিকে সাথে না নিয়ে কিছুতেই ফিরবে না। তুশিকে ও কথা দিয়েছে। একটু হলেও ওর ওই আস্থায় ভরসা করেছে মেয়েটা। ওই ভরসা অয়ন ভাঙবে না। দাদিকে দেখলে তুশি খুশি হবে। হাসবে আলোর মতো। ঐ হাসি বিফলে যেতে দেবে না অয়ন। ও আবার হাতঘড়ি দেখল। কী আশ্চর্য, আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে হাসনার কোনো খবর নেই। আদৌ আসবে নাকি! ওদিকে ফোন ফের ভাইব্রেট হচ্ছে। তিতিবিরক্ত চিত্তে কানে গুঁজল অয়ন। অমনি ইউশা ছটফট করে বলল,
“ অয়ন ভাই তুমি কোথায়?”
“ কেন?”
“মেজো ভাইয়া বাড়ি এসেছেন।”
“ তো?”
“ সাথে মনে হয় তুশির দাদি আছে।”
চমকে গেল অয়ন,
“ কীহ!”
“ হ্যাঁ, তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো!”
অয়ন বিস্ময় থেকে ধাতস্থ হতে পারল না।
“ আসছি” বলে লাইন কাটল কোনোমতে।
এক আমূল দ্বিধায় বিভ্রান্ত সে। ভাইয়া নিজেই তুশির দাদিকে বাড়িতে নিয়ে গেছে? অথচ ওই না নিয়ম জারি করেছিল দেখা করতে না দেয়ার! আজব তো,কী চাচ্ছেটা কী ভাইয়া!
ইউশা কথা শেষ করেই দৌড়ে নিচে নামল। বসার ঘরে তখন ওর বন্ধুরাও এসেছে। তনিমা সবাইকে নাস্তা বেড়ে দিচ্ছেন। ইউশা আলগোছে এক কোণে এসে দাঁড়াল। তার পরনে এখনো শাড়ি। অয়নের সাথে কিছু ছবি তুলবে,তারপর খুলবে এসব। তুশিকে তনিমা তৈরি হতে পাঠিয়েছেন। মেয়েটার আজ জন্মদিন,এমন বাসি মুখে ঘুরবে নাকি! জয়নবও হাজির হয়েছেন মাত্রই। ওকে দেখেই বললেন,
“ কী গো সুন্দরী রমনী! আজ হঠাৎ
শাড়ি পরলে যে?”
ইউশার মুখটা হাসিহাসি। বারবার উদগ্রীব চোখে তুশির ঘরের দিকে দেখছিল। এখনো আসছে না কেন? ইউশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইয়াসিরকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেছে। বাইকের পেছনে এক জরাজীর্ণ বৃদ্ধা নারী ছিলেন। ইউশা নিশ্চিত, ওটা তুশির দাদিই হবে। এই ক মাসে মেয়েটা দাদির এত বর্ণনা দিয়েছে,ওর মুখস্থ এখন। ইস! তুশি যখন দেখবে, ওর প্রাণপ্রিয় বিটকেলই ওর দাদিকে নিয়ে এসেছে,খুশিতে অজ্ঞান হয়ে যাবে না?
রেহনূমা কপাল কুঁচকে বললেন,
“ কী রে, তোর দিদুন কি বলেছে শুনিসনি?”
নড়ে উঠল ও,
“ হু? হ্যাঁ শুনেছি তো। এমনি পরেছি দিদুন, হঠাৎ ইচ্ছে হলো আরকি। কেন, ভালো লাগছে না?”
“ ভালো লাগছে না আবার? একেবারে আসমানের পরির মতো লাগছে?”
লজ্জা পেয়ে হাসল ইউশা। তুশি সেজেগুজে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই। খোলা চুল,পরনে সমুদ্রের মতো নীল রঙের ভারি কাজের আনারকলি। ঠোঁটে লিপস্টিক। এইসব কিছুই ইউশার দেয়া।
রেহনূমা মেয়ের চিবুক ছুঁয়ে বললেন,
“ আমার মেয়েতো পরিই আম্মা। মাশআল্লাহ, কারো নজর না লাগুক। মনে হচ্ছে শাড়িটা তোর জন্যেই কেনা।”
ইউশা মিনমিন করে বলল,
“ না বলে আলমারিতে হাত দিয়েছি,রাগ করোনি?”
রেহনূমা হাসলেন,
“ শোনো মেয়ের কথা! রাগ করব কেন? মায়ের যা আছে সব তো তোরই। মাঝেমধ্যে শাড়ি পরিস তো মা। একেবারে পরি,মাশ আল্লাহ মাশ আল্লাহ!”
মেয়ের মাথা নুইয়ে এনে কপালে চুমু খেলেন রমণী। পাশ থেকে
মিন্তু ফোড়ন কেটে বলল,
“ ইস,
পরি না পেত্নী”
যার হবে পত্নী,
ঘাড় দেবে মটকে,
বেচারা চলে যাবে
পরপারে লটকে।”
চোখ পাঁকিয়ে চাইল ইউশা,
“ তবে রে..
তেড়ে যেতে নিলেই মিন্তু চট করে মায়ের পিছনে লুকাল। রেহনূমা গম্ভীর গলায় বললেন,
“ উহহু, আজকের দিনে কোনো ঝগড়া না। মিন্তু, যাও ওখানে গিয়ে বোসো। বড়ো মা খেতে দেবে, যাও।”
মিন্তু তাও জিভ বার করে ভেঙাল। ইউশা কটমটিয়ে বলল,
“ পাই তোকে দাঁড়া।”
ও গায়েই নিলো না। হেলেদুলে গিয়ে সোফায় বসে বলল,
“ বড়ো মা, আমাকে শুধু স্মুদি দাও। আমার গরম লাগছে।”
“ দিচ্ছি বাবা,বোস দু মিনিট।”
এতক্ষণ এইসবটা খুব মন দিয়ে দেখছিল তুশি। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাথা নুইয়ে। আক্ষেপের টানাপোড়েনে চৌচির তার বুক। ওরও যদি এমন একটা পরিবার থাকতো! এমন ভাই,এমন বোন! রেহনূমা ইউশাকে বললেন,
“ পায়েস খেয়েছিলি?”
“ না।”
“ সারাদিন ছোটাছুটি করলে কীভাবে খাবি? দাঁড়া, আমি নিয়ে আসছি।”
“ মিষ্টি ভালো লাগে না আম্মু। খাব না।”
রেহনূমা মন খারাপ করলেন,
“ কত যত্ন করে বানালাম,খাবি না?”
ইউশা পরাস্ত কণ্ঠে বলল,
“ আচ্ছা যাও,নিয়ে এসো।”
ভদ্রমহিলা হাসলেন। রান্নাঘরের পথ ধরলেন তড়িঘড়ি করে। ওপর থেকে সফেদ পাঞ্জাবি পরে নেমে এলেন শওকত। হাতাটা গোটাতে গোটাতে বললেন,
“ সাইফুল কোথায়? এখনো আসেনি? আমার আগেই না তৈরি হতে গেল!”
ওপাশ থেকে উত্তর আসার সুযোগ পেলো না, তক্ষুনি চৌকাঠে পা রাখল ইয়াসির।
তার ভারি কণ্ঠের ‘আসুন’ শব্দটায় এক যোগে ফিরে চাইল সকলে। তাকাল তুশিও। বলিষ্ঠ দেহ পার করে ওর নজর সোজা গিয়ে পড়ল পেছনের প্রৌঢ়ায়। খুব আস্তে, ভয়ার্ত -বিভ্রান্ত পা জোড়া নিয়ে আসছেন তিনি। সাথে হাঁ করে দেখছেন পুরো ঘর। তুশি হোচট খায় বিস্ময়ে। বুকের ভেতরটা সহ ধ্বক করে কাঁপে। চিৎকার ছোড়ে পরপর,
“ দাদিইইইইই…”
কিছু চমকালেন হাসনা। ভালো করে দেখতেও পারলেন না, তিরের বেগে এসেই বুকের ওপর হামলে পড়ল মেয়েটা।
রুগ্ন নারী ওই ভার নেয়ার সাধ্যে নেই। হেলে পড়ে যেতে নিলে, চট করে হাতটা ধরে ফেলল ইয়াসির। শক্ত খুঁটির আশ্রয়ে হাসনা ধাতস্থ হলেন। হেসে আগলে ধরলেন নাতনিকে। তুশির কিছু দেখার সময় নেই। দাদিকে দুহাতে সাপের মত প্যাঁচিয়ে ধরেছে সে। জীবনে চোখ ফেটে যাকে প্রথম দেখা, যে ওকে বাবা-মায়ের মতো বুক দিয়ে আগলেছে, সেই মানুষটার সাথে আজ তিন মাসের দুরুত্ব। তুশি মন ভরে দাদির গায়ের গন্ধ নিলো। পুরোটা সময় ওর পিঠে হাত বোলালেন হাসনা। মেয়েটা সরে এসে ভেজা স্বরে বলল,
“ দাদি,কেমন আছ তুমি? অল গুড তো?”
হাসনার চোখে জল। হাসলেন তবুও। কতদিন মেয়েটার এমন ছোড়া ছোড়া ইংরেজি তিনি শোনেননি। মাথা নেড়ে বোঝালেন,ভালো আছি। পরপরই নজর পড়ল তুশির বেশভূষার দিকে। সেই কোকড়া, আলুথালু চুলগুলো এখন তিরের মতো সোজা। পরনে আনারকলি,ঠোঁটে লিপস্টিক। ওরনাও পরেছে। বৃদ্ধা
অবাক হয়ে বললেন,
“ বু, তোর চেহারা কত বদলাই গেছে। বু তুই জামা পিনছস? আমার বুরে কত সুন্দার লাগে আল্লাহ। এককেরে চান্দের মতোন লাগে!’’
তুশির শুকনো চোখে আকুলতা। সেই সাথে আনন্দ। হাসনা একটু কণ্ঠ চেপে বললেন,
“ এইডা তোর শউর বাড়ি বু?”
অমনি শোনা গেল ইয়াসিরের পুরু স্বর,
“ এটা ওর শ্বশুর বাড়ি নয়। ও শুধু এখানে ছিল। এবার আপনি এসেছেন, যাওয়ার সময় সাথে নিয়ে যাবেন।”
বাতাসের ঝটকায় জ্বলন্ত মোমের যেমন দম ফুরিয়ে যায়? ঠোঁটের হাসিটা ঠিক সেইভাবে মুছে গেল তুশির। নিয়ে যাবেন মানে! বিটকেলটা কি ওকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে? তবে কি ওইসময় মুক্তি বলতে সত্যিই উনি এসব বুঝিয়েছিলেন?
তনিমা এগিয়ে এলেন তখনই। হেসে বললেন,
“ আসসালামু আলাইকুম। আপনিই তাহলে তুশির দাদি? কত শুনেছি আপনার কথা! ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে আসুন!”
হাসনা বেশ চমকালেন,এত অমায়িক ব্যবহার দেখে! তনিমা বসতে বললেন কয়েকবার। কিন্তু অত চকচকে সোফাটায় এই ময়লা কাপড়ে বসার সাহস হলো না প্রৌঢ়ার। বিভ্রান্ত নজরে নাতির দিকে চাইলেন তিনি। তুশি বলল,
“ বসো দাদি, কোনো সমস্যা নেই। তুশি হিয়ার নো ফায়ার।”
ইউশা হেসে ফেলল। হাসল বাকিরাও। ইয়াসির ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে টি-টেবিলের কাছে এলো। নিজেই জগ তুলে পানি ঢালল গ্লাসে। তুশির ব্যাকুল চোখ বারবার তার পানে ঘুরছে। প্রহেলিকার তাণ্ডবে ভীষণ ফাঁকা লাগছে মাথাটা। ইয়াসির সত্যিই ওকে দাদির সাথে পাঠিয়ে দেবে না তো? তবে কি একটু আগে ভেবে রাখা তুশির ওসব ভাবনা অবান্তর ছিল? কেকটা কেবল শুধুই দায়িত্ব বোধ! এতদিনে কি মানুষটার ওকে একটুও মনে ধরেনি? সবাই যে সারাক্ষণ বলে বেড়ায়,তুশি দেখতে সুন্দর! এই সৌন্দর্য তবে ইয়াসিরকে এক ফোঁটাও কাবু করতে পারল না?
হাসনা হাতটা টানলেন তখনই,
“ বু,আমার পাশে ব।”
বুকের উত্তালতা চাপা দিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বসল মেয়েটা। ইউশা ভ্রু নাঁচিয়ে বলল, “ কী তুশি, খুব দাদি দাদি করছিলে এবার খুশি তো?”
তুশির ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলছে। উজ্জ্বল মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই,ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে দুঃসহ কোনো বেদনায়। হাসনা শুধালেন,
“ উনি কেডা?”
জবাবটা ইউশাই দিলো। একেবারে পেছন থেকে দুহাতে তুশির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“ আমি তুশির বোন।”
হাসনার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দপ করে নিভে গেল অমনি। ঢোক গিলে একপল ইউশাকে দেখে,তুশির পানে চাইলেন। মুখের দশা লোকাতে কেমন করে হাসলেন তাও। প্রসঙ্গ কাটাতে আঁচলের তলা থেকে বের করলেন স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ারের ছোট্ট বাটিটা। কণ্ঠে প্রফুল্ল হওয়ার চেষ্টা,
“ বু, তর লইগা আমি সেমাই আনছি। খাবি না?”
“ খাব দাদি।”
হাসনা সানন্দে বাটির ঢাকনা খুললেন। তক্ষুনি ওপাশের রান্নাঘর থেকে পায়েস হাতে বেরিয়ে এলেন রেহণুমা। তুশির মাথা ছাপিয়ে হাসনার চোখ ঠিক সেইখানেই পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মুখের রং বদলে গেল তার। দৃষ্টি থমকাল,আঁতকে উঠল অন্তঃপট। কোত্থেকে আছড়ে পড়া বাজে যেন চৌচির হলো মাথাটা।
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৯
বৃদ্ধার শীর্ণ হাত কাঁপে। দুম করে সেমাইয়ের বাটি খসে পড়ে মাটিতে। স্টিলের ঝনঝন শব্দে সবার মনোযোগ ঘুরে এলো হেথায়। তুশি ভ্রু গোছাল। হতবুদ্ধি বনে মেঝেতে পড়ে যাওয়া বাটিটাকে দেখল এক পল। জিভ নেড়ে কিছু বলতেও পারল না,আচমকা জ্ঞান হারিয়ে গায়ের ওপর ঢলে পড়লেন হাসনা।