কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৩
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
ইউশার বক্ষপটে একটা হিংস্র ঘূর্নিঝড় কেমন শো শো করে ঘুরছে। যেন মরুর ধুলো আর বিস্তর ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছে সে। যেখানে শ্বাস নেয়া যায় না,শুধু চোখ ঝাপসা হয়। অথচ কার্নিশ ছোঁয়ার আগেই আগুন হয়ে পুড়িয়ে দেয় ভেতরটা।
বুকের ঠিক বাপাশে যেন এক টুকরো কাচ ছুড়ে সবটা চুরমার করে দিয়েছে অয়ন। ইটের দলা মেরে অনেক দিনের সাজানো আয়নাটা ভেঙে দিলে,যেমন ঝরঝর করে শব্দ হয়? শুধু ওই শব্দটুকু হলো না। তবে হৃদপিণ্ডের ছিড়েখুঁড়ে যাওয়াটা স্পষ্ট টের পেলো ইউশা। টের পেলো বুকের পাঁজরগুলো হাজার খণ্ডে ছড়িয়ে পড়ার আভাস,যা চাইলেও আর এক করা যাবে না। গলবিলে আটকে পড়া সুনামি ঠেসে ধরে অনুভূতিশূন্যের ন্যায় একইরকম অয়নের চেহারায় চেয়ে রইল মেয়েটা। এই মানুষটাকে ও নিজের পৃথিবী বানিয়েছিল। বানিয়েছিল নিজের ধ্যান-জ্ঞান সব কিছু। আর আজ সেই পৃথিবীটাই ধ্বসে পড়ল গায়ে?
ইউশার এই নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাশে মুখটা অয়ন দেখল না হয়ত। সদ্য প্রেমে পড়া যুবকের মস্তিষ্ক জুড়ে যেমন শুধুই রঙীন স্বপ্ন থাকে,অয়নের দুনিয়াও এখন হাজার রঙে রাঙানো। নিজেই বলল,
“ ইউ নো না ইউশা, এই বাড়িতে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস আর ভরসা করি একমাত্র তোকে। সেই ভরসার জায়গা থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে মিথ্যে বলতে পারলাম না। তুশি কিন্তু এসবের কিচ্ছু জানে না এখনো। তাই কথাটা যেন আমার আর তোর মাঝেই থাকে।”
এতগুলো কথা,এত এত শব্দ সব কেমন ইউশার কানের লতি ছুঁয়ে গেল। শুধু মস্তিষ্ক পড়ে রইল ওই এক লাইনে,
“ আমার আর তোর মাঝেই থাকে!”
ইউশার ভেতরের সত্তা হাসে। বিদ্রুপ করে বলে,
“ তোমার আর আমার মাঝে বলতে আর কী কিছু আছে, অয়ন ভাই? নেই তো! সব কেমন যত্ন করে গুড়িয়ে দিলে তুমি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইউশার কণ্ঠরোধ ছুটে আসতে চাওয়া স্যাঁতসেঁতে কান্নায়। অথচ শুকনো চোখজোড়া নিয়ে ও একইরকম চুপ করে রইল। মুখ খুলল প্রায় অনেকটা সময় পর। শুধু ঠোঁট নেড়ে বলল,
“ কিন্তু তুশি যে মেজো ভাইয়ার স্ত্রী!”
অয়ন কপাল গোছায়,
“ স্ত্রী! যে বিয়ে দুজনের কেউই মানে না,সেখানে আবার কীসের স্ত্রী?
বিয়েটা কি ওদের কারো ইচ্ছেতে হয়েছিল? আর তোর কী মনে হয়,জেনেশুনে ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে আমি এভাবে এগোবো? এতটা ব্রেইনলেস আমি? আমি অনেক আগে থেকে ভাইয়ার সাথে কথা বলে রেখেছি। পুরোপুরি শিয়র হয়ে নিয়েছি,এই সম্পর্ক নিয়ে ভাইয়া কী ভাবছে! ভাইয়া কী চায়! ভাইয়া নিজে আমাকে বলছে, ও তুশিকে পছন্দ করে না। হী ডাজেন্ট হ্যাভ এনি ফিলিংস ফর হার। আর খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দেবে এটাও বলেছে আমাকে। এরপরেই না আমি এগোলাম। একবার ডিভোর্সটা হোক, তুশিকে আমি আমার করবই।”
ইউশার বুকের হাড়গুলোও কেমন টনটন করে উঠল। খুব যন্ত্রণা,কিংবা ভীষণ ব্যথায় ঝলসে গেল অন্তঃপট। নিস্তব্ধের ন্যায় আওড়াল,
“ ওহ!”
অয়ন দুহাত মেলে আড়মোড়া ভাঙল। বলল,
“ যাক গে, ক্লান্ত লাগছে। ঘুমোবো। তুশি ঘুমিয়েছে?”
ইউশা কিছু বলল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। উত্তরের অপেক্ষাতেও রইল না অয়ন। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মাথায় হাত রেখে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো।
কণ্ঠ চেপে বলল,
“ মনে করে দিস কিন্তু!”
যন্ত্রের ন্যায় এক পাশে ঘাড় নাড়ল ইউশা। শিষ বাজাতে বাজাতে স্ফূর্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল অয়ন। মূর্তির ন্যায় সেই প্রস্থান চেয়ে চেয়ে দেখল সে। তারপর আস্তেধীরে ঘরের পথ ধরল। কিন্তু, পা চলছে না তো! মেঝেতে এমন আটকে আসছে কেন? ইউশা এক পা হাঁটে,ফের দাঁড়িয়ে যায়। ঠোঁট হাঁ করে বড়সড় শ্বাস টানে। আবার এগোয় একটু। এক ধাপ এক ধাপ করে একেকটা সিঁড়ি দিয়ে কোনোমতে উঠল মেয়েটা। অতটুকু পথেই কত সময় পেরোলো কে জানে! পিপড়ের চেয়েও ধীরুজ পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকল তারপর। বাইরের বৃষ্টিটা এখন নেই। খোলা জানলা হতে ফুরফুর করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। নিষ্প্রভ চোখদুটো ঘুরিয়ে ইউশা সারাঘর দেখল। তুশি নেই! চুপচাপ দরজার ছিটকিনি তুলে দিলো ইউশা। একে একে সব জানলা বন্ধ করে, ফুলগুলো হাত থেকে নামিয়ে রাখল টেবিলে। পাশে রাখা সাউন্ডসিস্টেমে ফুল ভলিউমে গান বাজাল । টকটকে গোলাপের গায়ে হাত বোলাতে গিয়ে ধারালো কাঁটায় খোঁচা লাগল হঠাৎ । চিকণ একটু রক্ত উঁকি দিলো আঙুলের ডগায়। অথচ ওই রক্ত দেখে বাঁকা হাসল ইউশা। ওর বুকের ভেতর যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে,যেভাবে কেটেকুটে দুভাগ হয়েছে মনটা,তার কাছে এটুকু আর এমনকি! মেয়েটা বড়ো যত্ন নিয়ে গোলাপের গা ছুঁয়ে দেয়। কানে বাজে অয়নের কথা,
“ একবার ওদের ডিভোর্স হোক,আমি তুশিকে আমার করবই।”
সহসা চোখ খিচে নিলো মেয়েটা। হাঁসফাঁস করে দুকান চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠল,
“ শুনব না আমি,আমি শুনতে চাই না। শুনতে চাই না আমি….”
ইউশা চিৎকার করে। ফাঁকা ঘরে সেই চিৎকার মিশে যায় নিশ্চুপ হাওয়ার সাথে। পরপরই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। দুহাত দিয়ে এক ধাক্কায় টেবিলের সমস্ত কিছু ফেলে দিলো ফ্লোরে। বই-খাতা,ফুল সব এলোপাথাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। পরপর গা থেকে টান মেরে শাড়ি খুলে ফেলল ইউশা। এক ঘষায় লেপ্টে দিলো লিপস্টিক। চোখ ডলে ডলে কাজল মুছে সারামুখে ঘষল। হাতের চুড়ি গুলো পাগলের মতো খুলে খুলে ছুড়ে মারল দিক-বিদিক। তারপর পা ভেঙে ধপ করে বসে পড়ল নিচে। দুহাতে মুখ চেপে ধরে বুকফাটা কান্নায় মেতে উঠল । সেই কান্না ঝড়ের বেগে উছলে আসা ঢেউয়ের মতো। অয়ন ভাই ওকে ভালোবাসে না। অয়ন ভাইয়ের মনের কোথাও ও নেই? তাহলে ওর এত ভালোবাসা,এই অপেক্ষা, এই টান সব মিথ্যে? সব এক তরফা ছিল?
ও যে অয়ন ভাইয়ের প্রেমে তিলে তিলে মরছিল,সেসব ভুল?
অয়ন ভাই কোনোদিন ওকে ওই চোখে দেখেননি! ইউশা কাঁদতে কাঁদতে কাত হয়ে ওখানেই শুয়ে পড়ল। শক্ত মেঝে থাপড়ে থাপড়ে কাঁদল,চ্যাঁচাল,গোঙাল আহাজারি করল। এপাশ ওপাশ করে ছটফট করল একটা জবাই করা পশুর মতো। তার ভাঙা সুরের কান্নায় ঘরবাড়ির প্রাচীরও যেন চুপসে বসেছে এক চোট।
কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ আমার ভালোবাসা এত সহজে তুমি মিথ্যে করে দিলে অয়ন ভাই? একটা মেয়ে দিনের পর দিন পাগলের মতো ছুটেছে তোমার পেছনে। তুমি হাসলে সে হেসেছে, তোমার একটু মন খারাপে যার খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়েছে,তোমাকে দেখার জন্য চাতকের মতো রাত জেগে যে বসে থেকেছে, সেই মেয়েটার ভালোবাসা তোমার একটুও চোখে পড়ল না? তুমি আমাকে ভালোবাসো না অয়ন ভাই! আমি কীভাবে বাঁচব এখন? কী নিয়ে বাঁচব ? আমি তো কোনোদিন কোনো ছেলের দিকে তাকাইনি। তুমি ছাড়া কারো কথা ভাবিনি। তাহলে তুমি কী করে পারলে আমাকে রেখে তুশিকে ভালোবাসতে?”
এ অবধি এসে হঠাৎ থেমে গেল ইউশা। সচেতন চোখে ভাবল,
“ কিন্তু তুশি যে তোমায় ভালোবাসে না অয়ন ভাই। ও তো মেজো ভাইয়াকে ভালোবাসে। আমার জানাতে হবে তোমাকে, জানাতে হবে।”
মেয়েটা ধড়ফড় করে উঠল। এক ছুটে দোর অবধি এসে ছিটকিনি টানতে গিয়েও থমকাল ফের।
“ না না,আমি এ কথা কী করে বলব? তুশি অন্য কাউকে ভালোবাসে জানলে অয়ন ভাই যে কষ্ট পাবে! অয়ন ভাই হাসছিল, সুখ ছিল ওনার হাসিতে, ওই হাসি তো মুছে যাবে তাহলে। আমি বলব না,আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। কিচ্ছু বলব না আমি।”
পরপরই গলা ভেঙে ডুকরে কেঁদে উঠল ইউশা,
“ কিন্তু আমি,আমার কী হবে? আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব? এতদিন তো তোমাকে ঘিরে বাঁচতাম,তোমাকে ভেবে বাচতাম,এখন যে ওই অধিকারটাও আমার রইল না অয়ন ভাই। এত নিষ্ঠুর হতে পারলে তুমি!”
ইউশা ফের টেবিলের কাছে ছুটে এলো। কেমন উন্মাদের মতো এ ড্রয়ার- ও ড্রয়ার হাতাল। সব এলোমেলো করল,ড্রয়ারে যত কাগজপত্র ছিল ছুড়ে ছুড়ে ফেলল বাইরে। কিন্তু যেটা খুঁজছে নেই। অধৈর্য চিত্তে মেঝেতে বসে টেবিলের নিচের ড্রয়ার খুলল তারপর। জোরালো বেগে হুক ধরে টানতেই ঝুপ করে একটা ডায়েরি কোলের ওপর পড়ল। ইউশার হাত থামে। মলিন হেসে ধরে ডায়েরিটা। উঠে বসে বিছানায়।
প্রথম পৃষ্ঠা ওল্টাতেই সারা পাতা ভরতি অয়নের নাম! পরেরটাতে অয়নের স্কেচ। এক হাতে ইউনিফর্ম,গলায় স্থেটোস্কোপ ঝোলানো কোমর অবধি আঁকা একটা পুরুষালি স্বাস্থ্যবাণ শরীর। যার চারপাশটা জুড়ে শুধু লিপস্টিক পরা ঠোঁটের ছাপ৷ ডায়েরিটা বুক চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল ইউশা। নদীর মতো উথাল-পাতাল চোখের পানিতে গাল-গলা ছাপিয়ে বুক ভিজে গেল তার। সতেজ দেহ নিশানা করে ছুড়ে দেয়া তির বুকে এসে বিধলে, নিস্তেজ হয়ে মানুষ যেমন পেছনে হেলে যায়? অমন নিথরের মতো শরীরের ভার ছেড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ইউশা। বিড়বিড় করল বোজা গলায়,
“ আমি এখন কী করব অয়ন ভাই? তুমি আমার না,আমি তোমার কেউ না,এসব জেনেও কী করে থাকব আমি! কীভাবে প্রতিটা দিন তোমাকে চোখের সামনে দেখব! তোমার মন অন্যতে,এসব জেনে-বুঝেও কী করে সহ্য করব সেটা? কেন তুশিকে ভালোবাসলে অয়ন ভাই! এবার যে তুমিও কষ্ট পাবে। ঠিক আমার মতো কষ্ট। যখন জানবে,তুশি তোমাকে ভালোবাসে না,ঠিক এইভাবে ছটফট করবে তুমি। ভালোবাসার মানুষ ভালো না বাসলে যে খুব যন্ত্রণা হয় অয়ন ভাই। ওই যন্ত্রণা মরে যাওয়ার চেয়েও ভয়ানক। কেন ওকে ভালোবাসতে গেলে অয়ন ভাই! কেন কেন কেন!”
ইউশার আহাজারি রুমের ইট-কাঠ-আসবাবগুলো চুপ করে শুনছে। জানলার গ্রিলের ফাক গলে তেড়ে আসা জ্যোৎস্নাও মুখ তুলেছে হাহাকারে। অবহেলায় নিরন্তর বাজতে থাকা সাউন্ডসিস্টেমটাও এসব বুঝে ফেলল বোধ হয়। তার ভেতর থেকে করুণ এক সুর এসে ঠিকড়ে পড়ল ঘরময়,মিহি স্বরে গাইল,
❝ কেন রোদের মতো হাসলে না,
আমায় ভালোবাসলে না,
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না!
এই মন কেমনের জন্মদিন,
চুপ করে থাকা কঠিন,
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন…❞
তুশি পা টিপে টিপে সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে থেমেছে। চারপাশে ভূতুড়ে অন্ধকারের মাঝে ছাদের একদিকে একটা ছোট্টো বাল্ব জ্বলছে। ও দরজা দিয়ে মুখ নামিয়ে উঁকিঝুঁকি মারল। চোখ পড়ল একটু কোণের দিকে। ধোঁয়া,আর সিগারেটের তামাটে গন্ধে বুঝে নিলো ইয়াসির নিশ্চয়ই ওখানে। অমনি তুশি নাক কুঁচকায়। বিটকেলটা এত সিগারেট টানে কেন! কদিন আগেও দেখেছিল,আজকেও। পাক্কা বিড়িখোর একটা!
তুশির সাহস শুধু বাড়ছে। আরেকদফা পা চেপে চেপে ইয়াসিরের পেছনে এসে দাঁড়াল। সচেতন দুরুত্বে! পিলার ধরে গলা নামিয়ে দেখল, দোলনায় বসে আছে মানুষটা। কাঠ আর লোহার তৈরি পুরোনো একটি দোলনা। আঙুলের ভাঁজে জ্বলজ্বল করছে আধপোড়া সিগারেট। একটু আগে বিরক্ত হওয়া মেয়েটা এবার মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। ইয়াসির যতবার সিগারেটে টান বসিয়ে ফুরফুরে ধোঁয়া ছাড়ল, ততবার নিবিষ্টতায় খেই হারাল তুশি। এক অদ্ভুত উচাটনে আবিষ্কার করে ফেলল,
“ পুরুষ মানুষকে সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় দেখতে লাগে সিগারেট খাওয়ার সময়।”
ইয়াসির হঠাৎ নড়ল। লোহার দোলনার শিকলে ঝনঝন শব্দ হতেই ঘাবড়ে গেল তুশি। ভাবল,উঠে আসবে। তারপর ওকে দেখে নিলেই তো সর্বনাশ। চুপিচুপি ছুটতে নিলো ফিরতে, অমনি রুক্ষ স্বরে ডাকল সে,
“ অ্যাই চোর।”
মেয়েটার পা থমকে গেল অমনি। চোখদুটো বেরিয়ে এলো বাইরে। কী আশ্চর্য, দেখে ফেলল? তুশি চুপসানো মুখে পিছু ফিরে চাইল। ভ্রু কুঁচকে বসল সহসা। ইয়াসির এখনো ওদিক ফিরেই বসে আছে। এদিকে তাকায়নি তো। তাহলে ওকে দেখল কী করে?তার ভাবনার মাঝেই ফের আদেশ ছুড়ল সে,
“ এদিকে এসো।”
তুশির এবার ভয় লাগছে। এদিকে এসো মানে কী? ধাক্কা দিয়ে আবার নিচে ফেলবে নাকি! নিশ্চয়ই ভাবছে পরিচয় পেয়ে তুশি ওর খাবারে ভাগ বসাবে। হু এত সোজা? ফেলতে এলে ভালোবাসা ভুলে তুশি এমন জায়গায় মারবে, জীবনে কাউকে দেখাতেও পারবে না। মেয়েটা তাও ভদ্রের ন্যায় পাশে এসে দাঁড়াল। এইবার চোখ তুলে চাইল ইয়াসির। লাল দুটো মণি দেখে তুশির মারপিটের সব ইচ্ছে হাওয়া ছেড়ে দেয়। নেতিয়ে আসে মুখশ্রী। আগ বাড়িয়ে হড়বড় করে ওঠে,
“ আমি আপনার পিছু নিয়ে আসিনি। বিশ্বাস করুন। আমি তো এমনিই এসে…
কথা কেড়ে নিলো ইয়াসির। বলল মাঝপথে,
“ বোসো।”
তুশির চোখ শৃঙ্গে। আটকে পড়ল কথার বাণ। বসবে,তাও ওনার পাশে,ঠিক শুনেছে ও?
“ কী হলো? বোসো।”
ধমকের জোরে ধপ করে বসে পড়ল তুশি। খুব জোরে নড়ে উঠল দোলনাটা। কিন্তু ইয়াসিরের শক্ত শরীর বিন্দুমাত্র টলল না। আর কোনো কথাও বলল না সে৷ নিশ্চুপ বাতায়ন গায়ে মেখে সিগারেটে ঠোঁট পুড়ল শুধু। পুরোটা শেষ করে বাকিটুকু ছুড়ে ফেলল নিচে। অদূরের হবে কোথাও একটা! তুশি খুঁজতে যায়নি। ওর সেই মন থাকলে তো! দুচোখ ছাপানো অলীক মুগ্ধতা নিয়ে ইয়াসিরকেই দেখছিল সে। বিস্তৃত ঐ আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছে আজ। পাশে অসংখ্য টিমটিমে তারা। এর মাঝে এই নির্জন ছাদের কিনারায় ও আর ওর বিটকেল! যাকে তুশি ভালোবাসে। হৃদয় থেকে নিংড়ে দেয়া সব অনুভূতি এক করে ভালোবাসে। বড়ো দোলনার দুই প্রান্তে বসে দুজন। তুশি দৃষ্টি নামিয়ে একবার মাঝে রাখা ইয়াসিরের হাতটাকে দেখল। খুব লোভ হলো ধরতে। কোলের ওপর থেকে নিজের হাতটা তুলে পাশে রাখল সেও। পিলপিল করে আঙুলগুলো বাড়াল একটু। আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল ইয়াসির। তুশি ঝট করে হাত গুটিয়ে সোজা হয়ে বসল। ইয়াসির আবার চোখ সরিয়ে নেয়। তাকায় উজ্জ্বল আকাশ পথে। আবার ওর দিকে চেয়ে থাকে তুশি। হঠাৎই মুখ খুলল ইয়াসির,
“ আমাকে এভাবে দেখার কিছু নেই।”
তুশি নড়েচড়ে উঠল। মাথা চুলকাল ঠোঁট উলটে। লজ্জা পেয়েছে! বিটকেলটার জিভে একটু লাগামও নেই! মুখের ওপর কেউ এভাবে বলে দেয়? দেখবে,একশ একবার দেখবে। কী করবি রে তুই বিটকেল? তুশি তার স্বামীকে দেখবে,তাতে তোর কী?
অথচ কেমন মিনমিন করে শুধাল,
“ আপনি কি সব সময় সিগারেট খান?”
“ না।”
“ এই যে খেলেন!”
ইয়াসিরের ভণিতাহীন স্বীকারোক্তি,
“ মন খারাপ হলে খাই।”
তুশি বিস্মিত হয়ে বলল,
“ আপনার মন খারাপও হয়?”
সরু চোখে ফিরল ইয়াসির,
“ আমাকে তোমার পাথর মনে হয়?”
তুশি দুপাশে মাথা নাড়ল। পরপরই ওপর নিচে নেড়ে বোঝাল- হ্যাঁ। হেসে ফেলল ইয়াসির। সেই হাসি উড়ে আসা শীতল বাতাসের মতো ফুরফুর করে হৃদয়ে ঢুকে গেল তুশির। রামগরুরের ছানাটা হাসতেও পারে নাকি! অথচ চট করে হাসি মুছে গেল আবার। সুতনু মুখটা ঢেকে এলো অন্ধকারে, যতটা অন্ধকার এই মুহূর্তে রাতের বুকেও নেই। কেমন করে ডাকল,
“ তুশি!”
বুকের খুপড়িতে ঢুকে যাওয়া ছুড়ির প্রহারের মতো ডাক! তুশির জবাব এলো জড়িয়ে,
“ জি…”
“ ছোটো মায়ের ওপর তোমার অনেক রাগ?”
এই সময় এই প্রশ্ন তুশি আশা করেনি। মাথা নুইয়ে নিলো গলায়। ইয়াসির বলল,
“ ছোটো মা এমন নন! উনি খুব নরম মনের মানুষ। এত অভিমান রেখো না।”
“ দাদির কাছে শুনেছি,অস্ত্রের ঘায়ের থেকেও মানুষের কথার ঘা অনেক ভয়ানক হয়। উনি আমাকে যা ইচ্ছে বলতেন,আমার গায়ে লাগেনি। কিন্তু যেদিন আমার জন্ম তুলে কথা বলা শুরু করলেন আমি সেদিন থেকেই ওনাকে আর সহ্য করতে পারি না।”
“এভাবে বলতে নেই। উনি তোমার মা! মায়ের ওপর রাগ করা ঠিক নয়।”
তুশি জিভে ঠোঁট ভেজাল। বড্ড সাহস নিয়ে বলল,
“ তাহলে আপনিও যে বাবার ওপর রাগ করে আছেন,তার বেলা?”
মুহূর্তেই ইয়াসির থম ধরে গেল। শক্ত গলায় বলল,
“ আমার আর তোমার ব্যাপার এক নয়।”
“ আলাদাও তো নয়।”
ইয়াসিরের মুখভঙ্গি আরো বেশি বদলাল। বদলাল নরম চোখজোড়াও। স্বভাবসুলভ কঠোর স্বরে বলল,
“ আলাদা,পুরোপুরি আলাদা। আমার বাবার সাথে কাউকে তুলনা করবে না তুশি। খবরদার না!”
তুশি মিইয়ে এলো। ভুল কিছু বলে ফেলল বুঝি? বাবার প্রসঙ্গ এলেই মানুষটা কেমন যেন করে। কী যে লুকিয়ে আছে এর পেছনে!
ইয়াসির ডাকল তক্ষুনি,
“ তুশি!”
ও জবাব দিলো সাথে সাথে,
“ জি?”
উদাস স্বরে প্রশ্ন করল ইয়াসির,
“ তোমার জানতে ইচ্ছে হয় না,তোমার এই হারিয়ে যাওয়ার কারণ? বা কেন তোমাকে চুরি করা হয়েছিল?”
তুশি সজোরে মাথা নাড়ল,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩২
“ করে।”
ইয়াসিরের শুষ্ক কণ্ঠ গাঢ় হলো। ভরাট-জমাট স্বর কেমন হাঁসফাঁস করে বলল,
“ আমার বাবার জন্যে!”
চমকে উঠল তুশি। হতবাক আওড়াল,
“ উনি চুরি করিয়েছিলেন?”