কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৪ (২)

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৪ (২)
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

রাতের মধ্যভাগ শেষের পথে। অনেকক্ষণ যাবত শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলেন সাইফুল। ঘুম আসার নাম নেই আজ। ভ্রু দুটো কুঁচকে একদম কপাল বরাবর বসানো সাদা বাল্বটাকে দেখলেন তিনি। তারপর ক্লান্ত চোখে চাইলেন পাশে গুম মেরে বসে থাকা স্ত্রীর পানে। চ সূচক শব্দ করে বললেন,
“ লাইটটা এবার বন্ধ করো, রেহনূমা। আলোতে ঘুম হয় না আমার। ”
রেহনূমা চুপ করে বসে রইলেন। ভার মুখ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাইফুল।
“ হয়েছে কি তোমার? কটা বাজে,এখনো ঘুমোচ্ছো না কেন?”
ভদ্রমহিলা ছুড়ে ছুড়ে বললেন,
“ মন চাইছে না। তোমার ঘুম এসছে তুমি ঘুমাও।”
“ আমিও বা ঘুমোতে পারছি কই? মুখের সামনে একটা লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে, কড়া আলো একেবারে চোখে এসে লাগছে।

রেহনূমা দুম করে উঠে গিয়ে সুইচ টিপে দিলেন।
“ হয়েছে শান্তি? এবার নাক ডেকে ঘুমাও।”
সাইফুল প্রসন্ন চিত্তে মাথা নেড়ে ওপাশ ফিরে শুলেন। অমনি রেহনূমার মুখ অন্ধকারে ডুবল। ভেজা গলায় থমথম করে বললেন,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন তো ঘুম আসবেই। মনে কত আনন্দ আপনার! মেয়ে বাবা বাবা করে ডাকল সারাদিন। বুকে জড়িয়ে ধরল। সব জ্বালা তো আমার। আমি মা হয়ে একটু ছুঁতেও পারলাম না।”
সাইফুল হাসলেন। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে,উঠে বসলেন এবার। হাত দিয়ে জায়গা দেখিয়ে বললেন,
“ এসো এখানে।”
রেহনূমা গোমড়ামুখে এসে বসলেন পাশে। কিন্তু চেহারা ঘুরিয়ে রাখলেন অন্যদিক। ভদ্রলোক বললেন,
“ এতক্ষণ না ঘুমিয়ে বসে থাকার কারণ তবে এই?”
“ তো কী করব? শুনলে না মেয়ে কী বলল! আমি ওর মা নই। ও আমার মেয়ে নয়। আমার বানানো কেকটা পর্যন্ত কাটল না। আমার বুঝি কষ্ট হয় না!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রেহনূমার চোখ ছলছল করে উঠল। কণ্ঠ ভিজে প্রগাঢ়! সাইফুল ব্যতিব্যস্ত আওড়ালেন,
“ এই যে,একটা বাচ্চার মতো কাঁদছো রেহনূমা। আরে বাবা, মেয়েটা একটু রেগে আছে এখন। কিছুদিন সময় দাও ওকে,সব আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে।”
“ কিচ্ছু ঠিক হবে না। আমি এতদিনে ঢেড় বুঝেছি তুশি খুব ত্যারা। ও আমাকে পছন্দ করে না সাইফুল। এই অভিমান যদি ঘৃণায় বদলে যায়! ও যদি সার্থর মতো আমার সাথে আর কখনো কথা না বলে? আমি তখন কী করব সাইফুল? আমার তো ভাইজানের মতো সহ্য শক্তি নেই বলো। আমার তো বুক ফেটে যাবে।”
“ এরকম কিছু হবে না রেহনূমা। আমি বলছি তো,তুশি সব ভুলে যাবে। সার্থ একটু বেশিই স্ট্রিক্ট। তুশি তা নয়! ভাইজানের ব্যাপারটা মনে নেই? সারাদিন ওকে বকাঝকা করত,এক টেবিলে বসতেও চায়নি খেতে,তা সত্ত্বেও যখন উনি অসুস্থ হলেন মেয়েটা ভাঙা পা নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেই মেয়ে কি তার মায়ের সাথে রাগ ধরে রাখতে পারবে? এও সম্ভব!”
রেহনূমার সিক্ত নয়নে একটু খানি আশা এসে ভিড়ল।

“ সত্যি বলছো?”
“ সত্যি রে বাবা। তবে ভুল এখানে তোমারও আছে রেহনূমা, কেন শুধুশুধু আজেবাজে কথা বলতে মেয়েটাকে? বস্তিতে বড়ো হয়েছে বলেই তাকে কেন ছোটো করে দেখতে হবে?”
“ সেজন্যে না। আসলে, তুমি তো জানো সার্থ,অয়ন ওদের প্রতি আমি কত দূর্বল। ওদের সাথে কেউ খারাপ কিছু করলে আমি নিতে পারি না। তযখন জানতে পারলাম মাজহার লোকটার সাথে মিলে তুশি মিথ্যে মিথ্যে বউ সেজে বসেছে,তাও আবার টাকার লোভে! ওই মূহুর্তে সার্থর অপমানের কথা ভেবে আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। ইনিয়েবিনিয়ে রাগটা আমার বেরিয়ে আসতো। কতবার চেষ্টা করেছি,একটু নরম ভাবে কথা বলার, হতো না। মনে হতো মেয়েটা যোচ্চর,ঠক,আমাদের ছেলেকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছে। তখন রাগ হতো খুব!”

“ আর যখনই জানলে ওই যোচ্চর মেয়ে তোমার নিজের,তখনই সব রাগ শেষ হয়ে গেল? তখন থেকেই ভালোবাসতে শুরু করলে,এটা তুশির কাছে গড়মিল হবে না? ওতো ভাবতেই পারে,যে আমাকে বস্তির ভেবে দূরছাই করল,নিজের মেয়ে জানতেই বুকে টানতে চাইছে। তখন ওর রাগ হওয়া কি স্বাভাবিক নয়?”
শিশুর মতো ঘাড় নাড়লেন রেহণূমা। সাইফুল বললেন,
“ তাহলে? মেয়েটাতো নিজের জায়গায় ঠিক। আমি বা তুমি হলে নিশ্চয়ই আমরাও এমন করতাম।”
রমণীর কথা বেশ অবোধ শোনাল,
“ তবে এবার আমি কী করব?”
“ কী আবার করবে,মেয়ের মান ভাঙানোর চেষ্টা ছাড়া তো উপায় নেই। আমার রাগকে তো কখনো পাত্তা দিলে না,সব সময় ঝগড়া লাগলে আমাকেই এসে ক্ষমা চাইতে হতো। এখন নাও, মেয়ের রাগ সামলাও। ওর চোখে আজ তুমি যতটা খারাপ,চেষ্টা করো তার চেয়েও বেস্ট মা হয়ে ওঠার।
রেহণুমা ভারি দুশ্চিন্তায় পড়লেন। কী যে করবেন!
এর মাঝেই দরজায় টোকা পড়ল। ভেসে এলো চাপা নারী কণ্ঠ,

“ ও ছোটো,ঘুমিয়েছিস?”
ত্রস্ত চোখ মুছলেন রেহণুমা,
“ আপা! হ্যাঁ আপা আসছি।”
উনি নেমে যেতেই সাইফুল আরাম করে শুলেন। কাল সক্কাল সক্কাল অফিস যেতে হবে। ভাইজান এখনো ঠিক করে সুস্থ নন। বেড রেস্টের দু মাস এখনো শেষ হয়নি বলে চাপটা ঘাড়ে বেশ হালকা-পাতলা পড়েছে।
রেহনূমা দরজা খুলে হাসলেন।
“ আপা,ঘুমোওনি?”
“ না। আর আমি জানতাম তুইও ঘুমোসনি। এদিকে আয়।”
তারপর হাতটা ধরে সাথে নিয়ে চললেন তনিমা। রেহনূমা যেতে যেতে শুনলেন,ইউশার ঘর থেকে খুব জোরালো গানের শব্দ আসছে। অবাক হয়ে বললেন,

“ ওমা! এই রাত-বিরেতে মেয়েটা আবার সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়েছে কেন?”
“ আরেহ,আজ ওর জন্মদিন না? একটু তো আনন্দ করবে। তারওপর আবার দুবোন কত বছর পর এক হলো। তুই ওসব ছাড়। বোস এখানে।”
দু তলার ফাঁকা জায়গায় একটা টি কর্নার করা। ছোটো দুটো বেতের মোড়ার মাঝে আরেকটা গোল টেবিল পাতানো। তনিমা একটা টেনে বসতেই,আঁচল গুছিয়ে রেহণূমাও বসলেন। শুধালেন বড়ো কৌতূহলে,
“ কী হয়েছে, আপা?”
“ আপার কী হবে? হয়েছে তো আপনার। চোখে পানি কেন? এখনো শোক কাটেনি?”
ভদ্রমহিলা মাথা নোয়ালেন,

“ এমনিইইই!”
“ কাঁদছিস কেন বোকা? তুশির মন কত নরম জানিস না! মেয়েটা খুব ভালো। দেখবি দুটো দিন গেলে আপনা- আপনি বুকে এসে পড়বে।”
রেহনূমা ঘাড় নাড়লেন একটু করে। তনিমা হাসিহাসি মুখ করে বললেন,
“ আমি কী ভাবছি জানিস!
আমরা কেমন জা থেকে এখন বেয়ান হয়ে গেলাম। তোর মেয়ে এখন আমার ছেলের বউ। আবার আমার ছেলেটা তোর মেয়ে জামাই।”
রেহমুনা হাসলেন এতক্ষণে। প্রফুল্ল চিত্তে বললেন,
“ আরে তাই তো। এত কিছুর মাঝে কথাটা আমি ভুলেই গেছিলাম!”
তনিমা হাতটা ধরে বললেন,
“ আমি তোর ভাইজানকেও বলছিলাম। ভালোই হয়েছে, সেদিন কনে পাল্টে যাওয়ায়! এজন্যেই বলে আল্লাহ যা করেন,ভালোর জন্যেই করেন। ওইদিন ভুল করে ওদের বিয়ে নাহলে আজ আমরা তুশিকে পেতাম কোথায় বল তো!”

রেহনূমার হাসিটা মুছে গেল হঠাৎ। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“ কিন্তু আপা, বিয়েটা কী আদৌ হয়েছিল?”
“ ওমা,এ আবার কেমন কথা। কেন হবে না?”
“ আপা, হাসনা খালার কথা শুনলে না তুমি? ওনার ছেলে বিদেশেই মারা গেছে। তাহলে তো তুশির বাবা-মায়ের নাম ভুল। ওনার বানানো। মানে এমন এমন নাম, যাদের পৃথিবীতে কোনো অস্তিত্বই নেই। আর কাবিনবামায় বাবা-মায়ের ভুল নাম দেয়া থাকলে বিয়ে কী করে হলো? তারওপর ছেলে মেয়ে দুটোর কেউই তো রাজি ছিল না। বিয়ে তো বৈধ হয়নি, আপা। এতদিন এসব নিয়ে ভাবিইনি। কিন্তু এখন…!
“ তাই তো, আমার যে এসব মাথাতেই আসেনি। তাহলে এখন উপায়?”
রেহণূমা সাগ্রহে শুধালেন,

“ ওদের আবার নতুন করে বিয়ে দিয়ে দিই?”
পরপরই শঙ্কিত হয়ে বললেন,
“ কিন্তু সার্থ,ও কি রাজি হবে? তুশিকে তো ও পছন্দই করে না।”
তনিমা ভাবুক হয়ে বললেন,
“ মহাচিন্তায় ফেলে দিলি দেখছি। কী করব এখন? তুই একবার আলোচনা করে দেখবি?”
রেহণূমা মাথা পিছিয়ে দুহাত নেড়ে বললেন,
“ না না,বাবা। যা রাগ তোমার ছেলের! বিয়ে-টিয়ে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ইংরেজিতে কতগুলো কথা শুনিয়ে দেবে। আমি পারব না!”
তনিমা শ্বাস ফেললেন,

“ আচ্ছা,তাহলে আমিই বলব। সকাল হোক! তবে মনে হচ্ছে না এবার আর আপত্তি করবে। এখন তুশির তো পরিচয় পাল্টেছে। এইবার সার্থ এক পায়ে রাজি হবে, দেখিস!”
“ তাই যেন হয়,আপা। তাই যেন হয়!”

অন্ধকার রাতের বুক ফুড়ে ভোরের ঠান্ডা আভা সদর্পে ছুটে আসছে। পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখোরিত বাতায়ন। একটু একটু করে দুলতে থাকা দোলনায় এখনো ঠায় বসে আছে তুশি। মেয়েটার চেহারায় ক্লান্তি। পায়ের পাতা থেকে পিঠের হাড়টাও বিবশ ভঙ্গিতে মিশে আছে যেন। অথচ দুচোখ ছাপানো বিমোহ নিয়ে নিষ্পলক এক পুরুষ পানে চেয়ে রইল সে। কোলের ওপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে ইয়াসির। বড়ো গভীর ঘুম! আর সেই ঘুমন্ত মুখখানা দেখে নিজের ইহকাল ক্ষণিকের জন্য ভুলে বসল তুশি। ভুলল নিদ্রা,সামান্য একটু নড়চড় শরীরের। পাছে, ইয়াসিরের ঘুম ভেঙে যায়! নিরন্তর তার ট্রিম করা গোছানো চুলে হাত বোলাল সে। তুশির হৃদয়পটে একটা দুধ-সাদা সফেদ স্রোত কলকল করে বইছে। যার গতিবেগ আকাশের বুক হতে খসে পড়া তারার চেয়েও শতগুণ বেশি। বা-পাশের ঢিপঢিপ শব্দটাও ততোধিক ভারি। তুশি মন ভরে ইয়াসির কে দেখল আজ। একটু সময়ের জন্যেও চোখ সরাতে হয়নি। ইয়াসিরের তীক্ষ্ণ চাউনি থেকে লুকোতে হয়নি নিজেকে। পেলব আঙুল চালিয়ে মানুষটার শক্ত চিবুক ছুঁলো,ছুঁলো খোঁচা খোঁচা দাড়িভরতি গালজোড়া।

এক অবাধ্য,অশান্ত ইচ্ছে হৃদয়ে উঁকি দিলো হঠাৎ। মন চাইল, ইয়াসিরের ঠিক কপালে এক গভীর চুমু বসাতে! এই ইচ্ছে প্রেমিকার অস্থির মনের,নাকি স্ত্রী হিসেবে অধিকারের তুশি জানে না। শুধু জানে কিছু ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিতে হয়। মেয়েটা আস্তেধীরে ঠোঁট নামিয়ে আনল। ওষ্ঠপুটের নরম ত্বক যখনই ছুঁইছুঁই হবে,তক্ষুনি নড়ে উঠল ইয়াসির। সহসা বিদ্যুৎ বেগে সরে এলো তুশি। ইয়াসির বালিশ ভেবে দুহাতে আরেকটু আকড়ে ধরল ওর লতানো কোমর। মসৃণ পেটে মুখ গুজে দিতেই তুশির বিশীর্ণ শরীর স্তম্ভ বনে গেল। মূর্তি বনে দোলনার কাঠে লেগে গেল মেয়েটা। ধাতব হাতলগুলোতে শব্দ হলো জোরে। ইয়াসিরের ঘুম ভেঙে গেল তাতে। কুঁচকানো ভ্রুয়ের নিচে নিভু চোখ মেলে চাইল সে। তুশি ঢোক গিলল অমনি। মুখটা ছোট হয়ে গেল। মানুষটার গায়ে রাখা হাতজোড়া সরাল ঝট করে। ইয়াসির হতবুদ্ধি চোখে একপল আশেপাশে দেখল। মাথার ওপর খোলা আকাশ দেখে সেই রেশ বাড়ল আরো। যখনই চোখ দুটো পৌঁছাল তুশির শুষ্ক মুখে,চমকে গেল ছেলেটা। দু সেকেন্ড প্রকট নেত্রে চেয়ে থেকে, তড়াক করে উঠে বসল ইয়াসির। ছিটকে সরল কয়েক হাত দুরুত্বে। চেহারায় স্পষ্ট অস্বস্তি। পরপর চ সূচক শব্দ করে কপালে আঙুল ঘষল ইয়াসির। তুশি মিনমিন করে আগ বাড়িয়ে বলল,

“ রাতে মানে… হয়েছে কী…আপনি আসলে..”
পুরো কথা শুনল না সে। ঝট করে দাঁড়িয়ে,
ছুড়ে দিয়ে গেল,
“ সরি!”
তারপর তরবড় করে ছাদ থেকে নেমে গেল নিচে। তুশি সুস্থির বনে চেয়ে রইল সেদিকে। পরপরই চিবুক নামিয়ে মিটিমিটি হাসল। লাজুক লাজুক হাবভাব করে বলল,
“ আপনি সরি!
আর আমি আই লাভ ইউ।”

ইউশা একটা চেয়ার টেনে খাবার টেবিলে বসল। কাঁধের ব্যাগটা রাখল তার পাশের কেদারায়। ভাঙা গলা তুলে ডাকল,
“ মা, এক কাপ চা দেবে?”
রান্নাঘর থেকে মাথা নামিয়ে তাকালেন তনিমা। বললেন,
“ ইউশা চা চাইলি? তোর গলার একি অবস্থা! এত ভাঙল কী করে? সারারাত এসি ছেড়ে ঘুমিয়েছিস?”
শুকনো হাসল মেয়েটা,
“ হ্যাঁ মানে ওই আরকি। মা ওঠেনি এখনো?”
“ না। ঘুমাক একটু। আমি চা দিচ্ছি দাঁড়া।” ইউশা ঘাড় নাড়ল। চুপ করে চেয়ে রইল, খালি প্লেটের দিকে। কাল সারারাত ও কেঁদেছে। গলা ফাটিয়ে আর্তচিৎকার করেছে। সেজন্যে গলায় ব্যথা করছে খুব। ঢোক গিললেও যেন টান পড়ছে নালীতে। কিছু সময় পর স্কুলের জন্যে তৈরি হয়ে নেমে এলো মিন্তু। চুপচাপ, গুরুতর মুখে বসল ইউশার থেকে কয়েক হাত দূরে।
থমথমে কণ্ঠে বলল,

“ বড়ো মা,খাবার দাও।”
ইউশা শান্ত চোখ তুলে এক পল ভাইকে দেখল। মিন্তু এমনিতে চটপটে। আজ হলো কী? জিজ্ঞেস করল,
“ কী হয়েছে তোর?”
দুপাশে মাথা নাড়ল ছেলেটা। বোঝাল,কিছু না। ইউশা বলল,
“ উহু, কিছু তো একটা ঘটিয়েছিস। তুইত এমন চুপ থাকার ছেলে না। আবার ক্লাস টেইস্টে ফেইল করেছিস, তাই না!”
মিন্তু রেগে রেগে বলল,
“ তুই আমার সাথে কথা বলবি না। তুইও ভালো না,তোর সাথে মিশে তুশিপুও ভালো না হয়ে যাচ্ছে।”
“ কী করলাম?”
“ তোরা যে কাল এক ঘরে ঘুমোলি,গান বাজিয়ে নাচানাচি করলি,আমি যে এত দরজা ধাক্কিয়ে ডাকলাম, খুললি না কেন? আমি তোদের দুবোনের একমাত্র ভাই। কিন্তু তোরা আমাকে ছাড়া রুম পার্টি করতে পারলি? ছি!”
ইউশার কথা বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ে রইল অসহায় চোখে। ও কাল
গান ছেড়ে নাচছিল? রুম পার্টি করছিল? তার ভাবনার মাঝেই ওপরের কোনো এক ঘর হতে পুরুষালি স্বর ছুটে এলো নিচে,

“ মামুনি,আমার চা!”
ইউশা ছলকে উঠল। কাঁটা ফোটার মতো অহেতুক কাঁপল তার সমস্ত শরীর। কিন্তু,এই কাঁপুনি তো অনুভূতির নয়! একতরফা প্রেমের তরে সবকিছু হারিয়ে ফেলার বিষণ্ণতা এ! সতেজ ফুলের নেতিয়ে মুষড়ে যাওয়ার মতো শরীর ভেঙে এলো ইউশার। মাথা নোয়ানোর মাঝেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন তনিমা। এক হাতের পরোটা, ডিম পোচের প্লেটটা রাখলেন মিন্তুর সামনে। আরেক কাপ চা ইউশার সামনে রেখে বড়ো ব্যস্ত গলায় বললেন,
“ অয়নকে একটু চা টা দিয়ে আয় না, মা।”
কেমন করে আঁতকে উঠল মেয়েটা,
“ আমি? আমি কেন বড়ো মা,তুমি যাও না।”

“ রান্নাঘরে অনেক কাজ! চুলায় আলু ভাজি বসিয়েছি। আসমা তো কাপড় ধুতে ঢুকেছে। একটু পরই সবাই খেতে নামবে। ছেলেটা সেই কখন চা চেয়েছে আমি ভুলেই গেছিলাম। তাড়াতাড়ি দিয়ে আয়, যা।”
ইউশার ভেতর আপত্তি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব মুখ জুড়ে। তনিমা কপাল কুঁচকে বললেন,
“ কী হয়েছে তোর! আগে তো বলার আগেই অয়নের কাজে দৌড়ে দৌড়ে যেতিস। কিছু বলেছে ও? বকাঝকা করেছে নাকি!”
মিন্তু টেনে টেনে বলল,
“ অলস অলস। রান্নাঘর থেকে ঝাড়ুটা এনে পিঠে দুটো বাড়ি দাও,দেখবে ছুট্টে যাবে।”
কথার পিঠে ইউশা আজ চোখ পাকাল না। ধমকালও না একটুখানি। ঠোঁট টিপে চুপ করে রইল। ভেতরে সে ক্লান্ত খুব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল তারপর । কাপ হাতে তুলে বলল,
“ নিয়ে যাচ্ছি।”
মেয়েটার যাওয়ার পথে হাঁ করে চেয়ে রইল মিন্তু। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ কী ব্যাপার, বড়ো মা ও আজ আমাকে ধমকাল না যে! একটু তো তেড়েও এলো না।”
তনিমারও একই প্রশ্ন। রোজ তো এ দুটোর খুনশুঁটিতে বাড়ি মাথায় ওঠে। বিভ্রান্ত চিত্তে বললেন,
“ কিছুই বুঝতে পারছি না।”

অয়নের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল ইউশা। বড়ো করে শ্বাস টেনে নিঃশব্দে ঢুকল ভেতরে। অয়ন তখন বারান্দায়। ঝুলন্ত হেভি ব্যাগটায় একের পর এক ঘুষি মারছে। পরনের স্যান্ডো গেঞ্জি ঘামে ভিজে লেপ্টে গেছে পিঠে। উন্মুক্ত ফরসা-ফোলা বাহু জোড়া। কোমরের কালো ট্রাউজার নিচের দিকে নেমে এসেছে কিছুটা। অথচ এই চোখ ধাধানো, আকর্ষণীয় সুতনু পুরুষ পানে ইউশা বেশিক্ষণ চাইল না । চট করে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ডাকল হাস্যহীন,
“ অয়ন ভাই,তোমার চা।” থামল অয়ন। থামল তার হুক প্র‍্যাকটিসিং। ঘাড়ে তোয়ালে ঝুলিয়ে ঘরের ভেতরে এলো। গলার ঘাম মুছতে বলল,
“ যাক, অবশেষে চা পেলাম তবে। আমি তো ভাবলাম আজ আসবে না। মামুনি এত ভুলোমনা হচ্ছে দিনদিন।”
ইউশা কথা বাড়াল না। চুপ করে শুনে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল টেবিলে। ফিরতে পা বাড়াতেই অয়ন বলল,

“ কোথায় যাচ্ছিস?”
“ ক্লাস আছে।”
“ মাত্র নটা বাজে। ক্লাস তো এগারটায়।”
“ কিছু কি বলবে?”
অয়ন আশ্চর্য হলো। ইউশার জবাব রোবটের মতো। মেয়েটাতো এভাবে কথা বলে না। মোলায়েম কণ্ঠে শুধাল,
“ কী হয়েছে তোর?”
“ কিছু না। যাই।”
ইউশা এক পা বাড়াল,অমনি
হাতের কব্জি টেনে ধরল অয়ন। মেয়েটার বুক খণ্ড হলো। ভেঙে এলো শরীরটা। ক্লেশে চৌচির হয়ে ভাবল,
“ আমাকে ছুঁয়ো না অয়ন ভাই। যেটুকু বেঁচে আছি সেটুকুও মেরো না আমায়।”
“ ইউশা,তাকা এদিকে। কী হলো? তাকাতে বলছি তো।”
পুরু কণ্ঠে বাধ্য হয়ে পিছু ঘুরল মেয়েটা। চেহারার ঘোর আমাবস্যা দেখে অয়ন ভ্রু গোছাল। গুরুতর ভঙ্গিতে গাল ছুঁতে হাত বাড়ানো মাত্রই,চট করে সরে গেল ইউশা। একটু থমকাল অয়ন। পৃথিবীর সব নম্রতা কণ্ঠে ঢেলে বলল,
“ তোর কি মন খারাপ,ইউশা? কিছু হয়েছে? চোখমুখ এত ফোলা কেন,শরীর খারাপ?”
ইউশা অবিলম্বে বলল,

“ না। কদিন পরে পরীক্ষা,তাই একটু চিন্তা হচ্ছে।”
এই এক কথায় মেনে নিলো অয়ন। ধরে রাখা হাত ছাড়ল সহসা।
“ এতে চিন্তার কী আছে? পরীক্ষা আগে কখনো দিসনি? গাধা!”
ইউশার সুপ্ত বিষণ্ণতা মন ছাপিয়ে ভেসে উঠল মুখে। বিমর্ষের ন্যায় চেয়ে থেকে ভাবল,
“ অয়ন ভাই মন খারাপ বুঝল,কিন্তু ওকে বুঝল না? অবশ্য যার মনেই ও নেই,সে ওর মন বুঝবে কীভাবে!”
অয়ন চায়ে চুমুক দেয়। ইউশা চেয়ে রয় তখনো। বুকের ভেতরটাসহ তুফানে হুহু করে ওঠে। এই মানুষটা ওর নয়। যাকে ও বয়ঃসন্ধিতে ভেবেছে,

কিশোরীতে চেয়েছে,তরুণী বয়সে ভালোবেসেছে সেই অয়ন ওকে নিয়ে এক দণ্ড, এক ফোঁটাও কখনো ভাবেনি। এই হাহাকার,এই ব্যর্থতা ইউশা কী দিয়ে মেটাবে? এত শোক,এত যন্ত্রণা লুকোনোর প্রয়াসে কে সান্ত্বনা দেবে ওকে? এমন গভীর ক্ষত ও যে কাউকে দেখাতেও পারবে না। সারাজীবন এই না পাওয়ার কষ্ট নিজের ভেতর দাফন করে ভালো থাকবে ইউশা? কী আশ্চর্য ভাবে স্বীয় বুকের ভেতর ইউশা আস্ত একটা কবর খুড়ে ফেলল। যে কবরের লাশটা স্বয়ং ও-ই। ও মরল,ওর ভালোবাসা মরল,মরল ওর সব অনুভূতি আর স্বপ্নরা। অথচ কেউ জানলো না,বুঝলো না,দেখল না। আচ্ছা, একা একা বুকের মাঝে কষ্ট চেপে রাখার মতো দূর্ভোগ কী আর অন্য কিছুতে হয়?
অয়ন তাকাল তখনই। ইউশা আকুল হয়ে চেয়ে। ও ভ্রু নাঁচায়,

“ কী দেখছিস?”
ইউশার চোখ সরল না। মুখের চামড়াও নড়ল না। মূর্তির মতো শুধাল,
“ একটা কথা বলব অয়ন ভাই?”
অয়নের কণ্ঠে কৌতুক,
“ না করলে বলবি না?”
ইউশা এই দুষ্টুমিতে সঙ্গ দিতে পারল না। বুকের টালমাটাল ঘূর্ণি ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো,
“ কখনো যদি জানতে পারো,তুশি অন্য কাউকে ভালোবাসে কী করবে তুমি?”
বিস্ফোরিত চোখে চাইল অয়ন। মাথার ওপর মিসাইল পড়েছে যেন। ইউশা জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ না আসলে, এমন হবে বলছি না। যদি এরকম কখনো হয় আরকি। মানে ধরো হলো,কী করবে তাহলে?”
“ জ্বালিয়ে দেবো।”
স্পষ্ট, শান্ত জবাবে আঁতকে উঠল মেয়েটা। ভড়কে বলল,

“ তুশিকে?”
হেসে ফেলল অয়ন,
“ তুশিকে কেন জ্বালাব? ও যাকে ভালোবাসবে তাকে।”
ইউশা হতবাক হয়ে বলল,
“ কী বলছো তুমি!”
অয়ন কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ অফকোর্স আই’ল ডু ইট। ভালোবাসায় সব সময় ত্যাগ করতে নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছিনিয়ে নিতে জানতে হয়৷ ভালোবাসা একটা যুদ্ধ ইউশা। এই যুদ্ধে কোনো ভুল নেই,অন্যায় নেই। যে তোর মানসিক শান্তির কারণ,সেই শান্তি কেড়ে নিতে যত প্রতিপক্ষই আসুক না কেন লড়াই করতে হবে। ভালোবাসা মানে শক্তি,অধিকার, আত্মবিশ্বাস। তাই যাকে ভালোবাসব তাকে নিজের পাশে রাখার জন্যে পৃথিবীর সাথেও যুদ্ধ করতে হলে,করব না? ডোন্ট ইউ নো, এভ্রিথিং ইজ ফেয়্যার ইন লাভ?”

অয়নের কথা বলার ভঙ্গিমা সাবলীল। যেন এটাই ঠিক,এটাই উচিত। অথচ ইউশা স্তব্ধের মতো শুনে গেল। এ কোন অয়ন ভাই! পড়াকু,শান্ত,মেধাবী,হাসিখুশি অয়ন ভাইয়ের মুখে ছিনিয়ে নেয়ার কথা! ভালোবাসা নিয়ে যুদ্ধের কথা! অয়ন ওর হাঁ হওয়া দেখে হেসে উঠল জোরে। স্বশব্দ ওই হাসি হাওয়ায় ভেসে বেড়াল। দু আঙুল দিয়ে কপালে টোকা মেরে বলল,
“ বোকা,মজা করেছি।”
কিন্তু ইউশার এটা মজা মনে হলো না। তখনো ওই এক লাইনে পড়ে রইল সে। ভালোবাসা যুদ্ধের মতো? ভালোবাসলে পৃথিবীর সাথেও যুদ্ধ করতে হবে? মনে মনে বলল,
“ ভালোবাসা যুদ্ধ হলে আমি সেই সবার সাথে তোমার জন্য যুদ্ধ করতে পারব অয়ন ভাই,যারা তোমাকে চায়। কিন্তু যাকে তুমি চাইছো,তার সাথে যুদ্ধ করব? এতটা মনের জোর তো আমার নেই!”

দুহাতে ওড়নার দুই প্রান্ত উড়িয়ে উড়িয়ে চপল পায়ে ঘরে ঢুকল তুশি। ছুটতে থাকা সহস্র প্রজাপতি তার অন্তরে। বুকে উচ্ছ্বাস,মুখে হাসি। তবে স্ফূর্ত পা জোড়া থমকাল ভেতরে ইউশাকে দেখে। তুশি থামে,চোখ ঝাপটে বলে,
“ আরে,তুমি!”
ইউশা গলার খাঁজে চিবুক মিলিয়ে বিছানায় বসেছিল। উঠে এলো এবার। হাতের ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ নাও।”
ফুলের পানে এক পল চাইল তুশি। চোখে প্রশ্ন। ও বলল,
“ অয়ন ভাই কাল দিয়েছিলেন,তোমার জন্মদিনের উপহার। রাতে তো তুমি আর আমার ঘরে এলে না, তাই সকাল হতে হতে নেতিয়ে গেছে।”
বলতে বলতে ছোট্ট একটু ঢোক গিলল ইউশা। মলিন মুখখানা টেনেটুনে উজ্জ্বল রাখল খুব!
তুশি খুশি হয়ে বলল,

“ ও তাই! কিন্তু আমি এখন ফুল দিয়ে কী করব? এগুলো বরং তুমি রেখে দাও।”
“ আমি কেন রাখব?”
“ তবে? তুমিই তো রাখবে। অয়ন ভাইও তোমার,তার দেয়া ফুলও তোমার।”
ইউশা কাষ্ঠ হাসল। ছিড়েখুঁড়ে আসা বেদনার সাথে সুর মিলিয়ে ভাবল,
“ অয়ন ভাই আর আমার নেই তুশি। নিজের সাথে সাথে আমার এতদিনের জমানো ভালোবাসাও উনি কেড়ে নিয়ে গেলেন। আমার ভেঙেচুরে যাওয়া মনটাই কেবল আমার রইল আজ।”
তুশি হঠাৎ ভ্রু গোছাল। সতর্ক কণ্ঠে বলল,
“ এই, এই, তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন? চোখমুখ এত ফুলল কী করে?”
ইউশা গালে,মুখে হাত দিলো।

“ কই?
আসলে রাতে ঘুম বেশি হয়েছে তাই বোধ হয়?”
তুশি তাও চেয়ে রইল। চোখ সরু করে,সন্দেহী নজরে। ইউশা প্রসঙ্গ কাটাতে বলল,
“ আচ্ছা ওসব ছাড়ো। তুমি এমন নেচে নেচে ঘরে এলে যে। এত খুশি কেন আজ? মুখটা তো কেমন গ্লো করছে? ব্যাপার কী হুঁ?”
ও ভ্রু নাঁচায়। স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠ। তুশি এবার নিশ্চিন্ত হয়ে হাসল। পরপর দুহাত মেলে এক পাক চক্কর কেটে বলল ,
“ আজ আমি খুব খুশি,ইউশা। জীবনের সবচেয়ে বেশি খুশি! জানো, এই অবধি এটা আমার সবথেকে সুন্দর জন্মদিন।”
ইউশা বিড়বিড় করে বলল,
“ আর এটা আমার জীবনের সবথেকে অভিশপ্ত জন্মদিন!”
কিন্তু তুশির হাস্যোজ্জ্বল,প্রানবন্ত মুখখানা মেয়েটা মন দিয়ে দেখল। মুচকি হেসে ভাবল,
“ তাও ভালো,তুমি অন্তত আনন্দে আছো তুশি। এতদিন তো সবার ভালোবাসা, সবার আদর থেকে বঞ্চিত ছিলে। এবার সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সব ঢেলে দিক। আমার ভাগের যত সুখ, যত প্রাপ্তি সেই সবটা তোমার হোক । তুমি খুব ভালো থাকো তুশি। খুব খুব ভালো থাকো তুমি!”
তুশি উড়ে উড়ে থামল। ফিসফিস করে বলল,

“ ইউশা জানো, কাল রাতে আমি ছাদে গিয়েছিলাম।”
“ সে কী, অত রাতে? একা?”
তুশি মিটিমিটি হাসল,
“ উহু।”
“ তবে?”
হাসিটা বাড়ল ওর৷ ইউশা সচেতন কণ্ঠে বলল,
“ প্লিজ, এখন বোলো না যে মেজো ভাইয়াও তোমার সাথে ছিল।”
তুশি ফিক করে হেসে ফেলতেই চোখ কপালে উঠল তার। আশ্চর্য হয়ে ভাবল,
“ সত্যিই ভাইয়া কাল তোমার সাথে ছাদে ছিল? মাই গুডনেস,এটা কী করে সম্ভব?”
তুশির ফরসা মুখ লাল হলো। মসৃণ গাল ফেঁপে উঠল লাজে। ওড়নার সুতো আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল,
“ আমরা সারারাত ছাদে ছিলাম!”
ইউশা হাঁ করে বলল,

“ কীহ!”
তুশি মাথা নাড়ে অল্প করে। লাজুক চাউনি হাতের ওপর। পরপরই সাগ্রহে শুধায়,
“ আচ্ছা ইউশা,কেউ যদি এমন কিছু তোমাকে বলে যা সে কখনো কাউকে কোনোদিন বলতে পারেনি,তাহলে তার কাছে তুমি কী?”
“ কী আবার,হয়ত খুব ভরসার আর বিশ্বস্ত মানুষ।”
তুশির কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ আর ভালোবাসা? ভালোবাসার না?”
ইউশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসল। কানে বাজল অয়নের কথাটা,
“ আমি তোকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি,ভরসা করি ইউশা।”
অথচ ভালো? ভালো তো বাসি না।
মেয়েটা জবাব দিলো উদাস গলায়,

“ জীবন আসলে খুব বিচিত্র রূপকথার মতো তুশি। এখানে অনেকেই তোমাকে বিশ্বাস করবে ভরসা করবে,কিন্তু ভালোবাসবে না। আবার অনেকে কিছুই করবে না। না ভরসা,না বিশ্বাস,কিন্তু ভালোবাসবে। পাগলের মতো ডেস্পারেটলি ভালোবাসবে।”
তুশি ঠোঁট উলটে বলল,
“ অনেক কঠিন কথা! মাথার ওপর দিয়ে গেল।”
মৃদূ হাসল ইউশা।
“ ছাড়ো। কিন্তু তুমি এসব কেন জিজ্ঞেস করছো? ভাইয়া কি তোমায় এমন কিছু বলেছে?”
“ হুউ। জানো, কাল উনি একদম অন্যরকম ছিলেন। পুরোপুরি আলাদা একটা মানুষ। গলার স্বর একেবারে জনসন ক্রিমের মতো নরম!
কত কথা বললেন আমার সাথে। আমার নাম ধরে ধরে ডাকলেন। আর তার… “
“ তারপর?”
লজ্জায় ওটুকু তুশি মুখে আনতে পারল না। ইউশা বুঝল কী না কে জানে। তবে
উচ্ছ্বল কণ্ঠে বলল,

“ মনে হচ্ছে ভাইয়া তোমার ওপর ফল করছে তুশি”
“ কিন্তু ফল তো খেয়ে ফেলতে হয়।”
ইউশা কপাল চাপড়ে বলল,
“ উফ রে, আমি বোঝাতে চেয়েছি ভাইয়া মনে হয় তোমার ওপর দূর্বল হচ্ছে। তুমি কি তোমার মনের কথা বলেছ?”
তুশি মাথা নেড়ে বলল,
“ উহু। বলে দেব?”
“ হ্যাঁ, বলে দিও।”
“ এক্ষুনি যাচ্ছি।”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৪

কিছু না শুনেই ছুটে বেরিয়ে গেল তুশি। ঐ গতিবেগে রাশ টানার উপায় নেই। ব্যাপারটায় ইউশা বোকা বনে যায়। মাথায় হাত দিয়ে বলে,
“ এমা, এ মেয়ে তো চলে গেল। কিন্তু আমি তো এক্ষুনি বলতে বলিনি। হায় আল্লাহ, এবার কী হবে?”

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৫