কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৬
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
তুশি বালিশে নাক-মুখ গুঁজে উলটো হয়ে পড়েছিল৷ ইউশা রুমে এলো তখনই। আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ তুশি,কী হয়েছে?”
মেয়েটা সাড়া দিলো না। একটু ঝুঁকে মাথায় চাটি মারল ইউশা।
“ এই,এভাবে লটকে আছো কেন? মা,বড়ো মা কখন থেকে ডাকছে। খাবে না?”
তুশি দুঃখী দুঃখী গলায় জানাল,
“ আমার মন এই দুনিয়া থেকে উঠে গেছে, ইউশা। এখানে সাচ্চা পেয়ার আর সাচ্চা ইয়ারের কোনো দাম নেই। কী কম আছে আমার ভালোবাসায়,যে তোমার বিটকেল ভাই সব সময় এমন ভাব নিয়ে থাকে?”
ইউশার, সব কৌতূহল শেষ। বুঝে নিলো, তুশি যে কাজে হন্তদন্ত পায়ে ছুটেছিল তখন, তার কিচ্ছুটি হয়নি। নিশ্চয়ই কিছু বলতে পারেনি ভাইয়াকে। তুশি ফের বলল,
“ তোমার ভাই খুব খারাপ।
বিটকেল,
বেয়াক্কেল,
বদমহিষ। একটা আলুভাজা তোমার ভাই। সারাদিন কাপড়ের মতো চিপলেও মুখ দিয়ে এক ফোঁটা রস বের হয় না। কেন যে আমি ওই টাল্টু-বল্টু পুলিশটাকে ভালোবাসতে গেলাম? ওটাকে ভালোবাসার আগে আমার মনের মধ্যে আগুন লেগে পুড়ে গেল না কেন?
কেন,কেন কেন!”
ইউশা কপাল চাপড়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ হায় আল্লাহ! এই মেয়ের তো দুদিন প্রেমে পড়েই মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।”
তুশি মুখ তুলে চাইল। খুব সিরিয়াস হয়ে বলল,
“ দুদিন মানে? তোমার কি আমার প্রেমকে সন্দেহ হচ্ছে?”
“ না না,সন্দেহ কেন হবে? তোমার মুখেই তো লেখা আছে তুমি ভাইয়াকে কত ভালোবাসো!”
তুশি উঠে বসল। ঠোঁট উলটে বলল,
“ আমার সাথে চালাকি কোরো না,ইউশা। আমি কিন্তু এই মূহুর্তে পেছনে অদৃশ্য পেট্রোল নিয়ে ঘুরছি। ঐ বিটকেল আমাকে ভালোবাসতে রাজি নাহলে দেহ-মন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেবো। আর তুমি কী না মজা নিচ্ছ!”
ইউশা ঠোঁট চেপে হাসল। পাশে বসে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“ আরে বোকা মেয়ে, ভালোবাসলে একটু ধৈর্য রাখতে হয়। এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়লে হবে? আর ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসবে না কেন হু? আমার বোনটা কত মিষ্টি! এত মিষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার সাহস আছে কারো?”
তুশি ভরসা পেলো না! চিন্তিত মুখে বলল,
“ কী যে চলছে ওনার মনে!”
“ যা চলছে, চলছে। এখন চলো নাস্তা করবে। সবাই বসে আছে।”
ইউশা হাত ধরে টানল।
তুশি বলল,
“ আচ্ছা,তুমি না ক্লাসে যাবে? গেলে না যে!”
“ কী আর বলব বলো, ভার্সিটির ক্লাস এরকমই হয়। একটু আগে গ্রুপে ইনফো করে দিয়েছে,ক্লাস ক্যান্সেল। তবে ভালোই হয়েছে না হয়ে,বাড়িতে আজ প্রচুর কাজ বুঝলে! বিকেলে ফুপুরা আসছেন।”
“ ফুপু! তোমার ফুপু?”
“ আমার একার না,আমাদের।”
তুশি মাথা নাড়ল,
“ ও হ্যাঁ। আচ্ছা উনি কেমন? ওই ডাইনিটার মতো, নাকি তোমাদের মতো।”
ইউশা মিটিমিটি হাসল।
“ এলেই বুঝবে। এখন চলো তো… আমি তখন ঠিক করে নাস্তা করিনি। তোমার জন্যে বসেছিলাম। এসো।”
“ চলো চলো…”
অয়ন ডায়নিং রুমে হাজির হয়েছে মাত্র। চেয়ারের হাতলে সফেদ এপ্রোন ঝুলিয়ে রেখে খেতে বসল। এর মাঝেই এসে দাঁড়াল ওরা। ছেলেটার চোখ সোজাসুজি বর্তাল তুশির হাস্যোজ্জ্বল আদলে। দুচোখ মাখানো বিমোহ নিয়ে চমৎকার করে হাসল সে।
পাশের চেয়ার দেখিয়ে বলল,
“ তুশি,বোসো।”
ইউশার ঠোঁটের হাসি দপ করে নিভে গেল অমনি। ভেতরটা ক্ষয়ে গেল উঁচু পাহাড় ধ্বসে পড়ার শব্দে। চোখ জ্বলছে, যেন সবেগে আনতে চাইছে বড়ো কোনো সুনামি। কিন্তু ইউশা তো এখন কাঁদবে না। নিজের বদ্ধ ঘর ছাড়া, এই হাহাকারের সাক্ষি আর কাউকে হতে দেবে না সে। সাইফুল প্রফুল্ল স্বরে বললেন,
“ আরে,আমার দুই মা দেখছি। আয় আয় বাবার পাশে বোস।”
বলা মাত্রই তুরন্ত বেগে ছুটে গেল তুশি। বাবার পাশের ফাঁকা চেয়ারটায় বসল তাড়াহুড়ো করে। মাথা নাঁচিয়ে নাঁচিয়ে বলল,
“ আমি আগে বসেছি। এখন কী করবে ইউশা?”
ওর ছেলেমানুষীতে হেসে উঠল সবাই। ইউশাও হাসল,তবে হিঁচড়ে আনা হাসি। বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। অয়ন ভাই তুশিকে নিজের কাছে বসাতে মরিয়া। কই,ওকে তো কখনো এভাবে ডেকে কাছে বসাল না।
ওহ,বসাবেই বা কেন? অয়ন ভাই তো তুশিকে ভালোবাসে। ওকে নয়! ইউশা নিজের ওপর হাসল। বিদ্রুপ করে ভাবল,
“ কেন যে এই নিষ্ঠুর সত্যিটা তুই ভুলে যাস মেয়ে! অয়ন তোর না,তোর হবেও না। এবার অন্তত একটু শক্ত কর নিজেকে। এখন থেকে যে প্রতি প্রহর এসব দেখেই তোকে বেঁচে থাকতে হবে। সেখানে এত তাড়াতাড়ি মরে গেলে চলে নাকি?”
মেয়েটা নিষ্প্রভ চিত্তে হাসনার পাশ বসল।
রেহনূমা, তনিমাকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বোঝালেন। তৎপর মাথা নেড়ে ফ্রুট কাস্টার্ডের বাটিটা তুশির পানে এগিয়ে দিলেন তিনি। হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
“ তুশি,খাও। তোমার জন্যে করেছি। পছন্দ না অনেক?”
তুশি ফল খুব ভালোবাসে। তারওপর এটা কী যে মজা। খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে বলল,
“ ওয়াও! এটা আবার বানিয়েছেন?”
তনিমা কপাল কুঁচকে বললেন,
“ ওমা,এখনো আপনি-আজ্ঞে করছো কেন? ইউশা আমাকে যেভাবে ডাকে,এখন থেকে সেভাবে ডাকবে,বুঝেছ?”
“ না, বুঝিনি। কারণ তুমিও তো ইউশাকে তুই করে বলো। কই,আমাকে তো বলছো না!”
তনিমা হেসে ফেললেন,
“ আচ্ছা বাবা, এখন থেকে তুই করেই বলব।”
আইরিন নাকমুখ কুঁচকে বিরক্ত শ্বাস ফেলল। এতদিন এ বাড়ি থেকে ওর যেতে ইচ্ছে করতো না। কতবার পাপা চাইলেন,স্কলারশীপ নিয়ে লণ্ডনে পাঠাতে। ও গেল না,স্রেফ ইয়াসিরের জন্যে। এই যে মাম্মাম ঘনঘন পাপার কাছে যায়,মাসের পর মাস থেকে আসে,আইরিনের কখনো যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। কারণ,সেই ইয়াসির। অথচ এখন মনে হচ্ছে এই বাড়ি থেকে ও পালাতে পারলে বাঁচে। তুশিকে নিয়ে সবার এসব ঢং আর আদিখ্যেতা যাস্ট নিতে পারছে না। খুব অনীহায় চামচের ডগায় খাবার নিয়ে মুখে তুলল মেয়েটা।
সাইফুল হাসনাকে বললেন,
“ এ কী খালা,আপনার প্লেট খালি কেন? ভাবি ওনাকে আর দুটো পরোটা দাও।”
“ ও আল্লাহ না না। আমি এত খাইতে পারি না বাবা। এডিই অনেক!”
তুশি বলল,
“ আরে দাদি খাও খাও। খেয়েদেয়ে মোটা হয়ে চেহারাটা আমার মত গুলুগুলু করো। তারপর তোমাকেও একটা সুন্দর ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবো। আর কতকাল একা একা থাকবে!”
টেবিলে হাসির রোল পড়ে গেল। আইরিনকে বাদ দিয়ে হুহা করে হেসে উঠল সকলে। ইউশাও আর মন খারাপ করে থাকতে পারল না। হাসনা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“ চুপ থাক ছেমরি। তুই নিজের বিয়া নিয়া ভাব। তর স্বামী যে নাস্তা করছে,না করেনাই হেডির খেয়াল নিছস?”
তুশি সচেতন চোখে জিভ কাটল। সত্যিই তো,বিটকেলটা সকালে খেয়েছে কিনা ওর তো জানাই হলো না।
ইউশা মাথা তুলে আড়চোখে অয়নকে দেখল একবার। মানুষটার সবথেকে অপছন্দের কথা।
অয়ন নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে। নরম ডিমের গায়ে চামচ নাড়ছে শুধু। ঝিম মেরে বসে থাকতে দেখে ইউশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঢেড় বুঝল,অয়ন ভাই খুব কষ্টে নিজেকে আটকে রেখেছেন।
তনিমা বললেন,
“ কে সার্থ? ও সকালে খেতে পারে না। ফ্রেশ হওয়ার অন্তত দু-এক ঘন্টা পরে খায়।”
“ এ দেহি আইশ্চর্য নিয়ম।”
তুশি বিড়বিড় করে বলল,
“ মানুষটাই আশ্চর্যের দাদি।”
পরপরই প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধা,
“ আইচ্ছা তুশি,তুই রাইতে কোনে ঘুমাইছিলি বু? আমারে কইয়া গেলি আইতাছি। আর আইলি না তো।”
তুশির উত্তর তৈরি। চটপট বলে দিলো,
“ ইউশার ঘরে ছিলাম দাদি। ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ তোমার সাথে শোবো।”
ইউশা মাথা নেড়ে ঠোঁট টিপে হাসল। মেজো ভাইয়ার জন্যে মেয়েটাকে যে আর কত কথা বানিয়ে বলতে হবে!
রেহনূমা রয়েসয়ে মুখ খুললেন,
“ বলছিলাম যে,এখন স্টোর রুমে না থাকলে হয় না? ও ঘরে তো খুব গরম! এসি-টেসি নেই। ইউশার ঘরে শিফট হলে হতো না!”
তুশি শক্ত কণ্ঠে বলল,
“ না।”
তনিমা বললেন,
“ কেন, কী হবে? তোরা দুবোন,সব সময় একসাথে থাকবি।”
“ আমি ইউশার ঘরে থাকব কী করে? ওই ঘরে থাকার যোগ্যতা আমার আছে নাকি!”
রেহনূমার মুখ কালো হয়ে গেল। মনে পড়ল সেদিনকার কথা। ইউশার ঘরে ঘুমিয়ে পড়ায়, এমনটাই তো শুনিয়েছিলেন তিনি। ভেজা গলায়
বললেন,
“ আমার ভুল হয়ে গেছে তুশি,। এবার অন্তত একটু…”
তুশি মাঝপথেই বলল,
“ আপনার ভুল হলে ঠিক আছে। ভালো কথা, মেনে নিলাম। কিন্তু আমি ইউশার ঘরে একেবারে থাকার জন্যে কখনোই যাবো না।
আমি ছোটো থেকে বস্তিতে মানুষ হলেও,আমার আত্মসম্মান আছে। এতদিন তো আপনাদের কারো মনে হলো না আমার ঘরে এসি নেই। আমার গরম লাগতে পারে,ওখানে থাকতে কষ্ট হতে পারে। আপনিই তো বলেছিলেন,আমি বস্তির মেয়ে আমার জন্যে স্টোর রুমই অনেক কিছু। তাহলে দয়া করে এখন আর এত ভালোবাসা দেখাতে আসবেন না। নিতে পারি না আমি।”
ইউশা বলল,
“ তুশি প্লিজ! মা তো বলছেন ভুল হয়েছে। আর এমন করো না। আমি অনুরোধ করছি,প্লিজ আমার ঘরে চলো।”
তুশি আপত্তি জানাল নরম স্বরে,
“ না ইউশা। এই প্রথম আমি তোমার কথা রাখতে পারব না। তবে এখন যেভাবে যাই,সেভাবেই যাব। কিন্তু সব সময় থাকতে বলো না আমাকে। আমি আমার ওই ছোট্ট ঘরেই ঠিক আছি।”
অয়নের ঠোঁটে ফিচেল হাসি ফুটল। ভীষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল সে। তুশি যখন বলল,আমার আত্মসম্মান আছে! এই কথাটা শুনতে এত ভালো লাগল কেন? অবশ্য লাগারই তো কথা..
পেডিট্রিশিয়ান সৈয়দ অয়ন আবসারের ভবিষ্যৎ স্ত্রী যে হবে,তার কথায় ঝাঁঝ না থাকলে চলে…
অয়ন যে ঘুরেফিরে কেমন করে তুশিকে দেখছে,লক্ষ্য করল ইউশা। গোঁ ধরা বেদনায় মেয়েটার বক্ষঃস্থল মুচড়ে উঠল ফের। মলিন মুখে ঢোক গিলে চুপ করে খাবার পুরলো মুখে ।
মেয়ের এই দৃঢ়তায় রেহণূমা আর বলার কিছু পেলেন না। অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে নিলেন শুধু। নেমে আসা থমথমে পরিবেশের ইতি টানা প্রয়োজন। সাইফুল গলা ঝেরে বললেন,
“ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। ও যখন থাকতে চাইছে না,থাকতে হবে না। মা,তোমার যেখানে ইচ্ছে তুমি সেখানে থাকবে। কেমন?”
তুশি মৃদূ হেসে বাবার পানে তাকায়। জন্ম থেকে শূন্যের মতো বড়ো হওয়া ও যে জীবনের এই মোড়ে এসে এত ভালোবাসা পাবে,আদৌ ভাবেইনি কখনো। আচ্ছা,এর পেছনে কি বিটকেলটার হাত নেই? আছে তো। মানুষটা জীবনে আসতেই,তুশির সব কেমন চুটকিতে বদলে গেছে। ও বদলেছে,ওর পরিচয় বদলেছে। বিরাট এক শূন্যতা থেকে পূর্ণ হয়েছে চোখের নিমিষে। মরণ অবধি তুশির আর চাওয়ার কিছু নেই। এখন শুধু অনুভূতির সবটুকু দিয়ে ও ইয়াসিরকে চায়। শুধু ইয়াসিরকে….ব্যস!
তনিমা মাথায় হাত রেখে বললেন,
“ আচ্ছা তুশি,বলতো দুপুরে কী খাবি? তোর যা পছন্দ, আজ আমি তাই রান্না করব।”
আইরিন বিড়বিড় করে বলল,
“ ও গড,আমি রুম থেকে সাথে করে তুলো কেন আনিনি!”
অয়ন বলল,
“ বাহ মামুনি,শুধু তুশি? আমি আর ইউশা কিছু পাব না?”
তুশি স্ফূর্ত গলায় বলল,
“ পাবেন না কেন? আমরা সবাই মিলেমিশে খাব। আমার যা,তাতো আপনাদের দুজনেরও। ”
অয়ন একপেশে হাসল। মাথা নামিয়ে ভাবল,
“ আমরা না তুশি। কথাটা হবে,আমি আর তুমি। আমাদের দুজনের মাঝে আর কিচ্ছু আসবে না, কোনোদিন না।”
সাইফুল বললেন,
“ তাহলে তো বাজার করতে হবে ভাবি। বাজার আছে? না লোক পাঠাব?”
“ আগে তো শুনি তোমার মেয়ে কী খাবে!”
তুশি মাথা নেড়ে নেড়ে বলল,
“ লাউ দিয়ে ডাল, চিংড়ি ভুনা,আর ইলিশ মাছ খাব।”
“ ব্যস?”
“ হ্যাঁ।”
তনিমা জায়ের পানে চাইলেন। রেহনূমার ঠোঁটে রাজ্যজয়ী হাসি।
সাইফুল ব্যতিব্যস্ত আওড়ালেন,
“ আমি এক্ষুনি লোক পাঠাচ্ছি মাছ আনতে। একেবারে বাজারের টাটকা ইলিশটা আমার ঘরেই যেন আসে।”
হাসনা বানু সব চুপ করে দেখছিলেন। তুশির প্রতি সবার এত আদর আহ্লাদে বুক জুড়িয়ে গেছে তার। আহা,মেয়েটা এত বছর পর নিজের লোকদের ফিরে পেলো, এখন খুব সুখে থাকুক ও। এছাড়া ওনার আর কী চাই?
আচমকা কলিংবেল বাজল। ইয়াসির আর মিন্তু ছাড়া বাড়ির বাইরে কেউ ছিল না। ওদেরও এখন ফেরার কথা নয়। তাও দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজা খুলল আসমা। সাথে সাথে একটি নারীকণ্ঠ চ্যাঁচিয়ে উঠল আনন্দে,
“ মায়ায়ায়ায়ায়া…”
আসমা আঁতকে ওঠে। এক লাফে ছিটকে আসে পেছনে। চোখ বড়ো করে বলল,
“ ও মাগো… আমনে ক্যাডা?”
নারীটি চোখের কালো চশমা খুললেন। কপাল কুঁচকে দেখলেন আসমাকে।
“ হু আর ইউ? তুমি কে?”
আসমা কিছু বলার আগেই,খাবার ফেলে ছুটে গেল আইরিন। দুহাতে জাপটে ধরে ডাকল,
“ মাম্মাম..”
বাকিদের চোখেমুখে বিস্ময়। তুশি কৌতূহলে ইউশার দিকে চাইল। সে ফিসফিস করে বলল,
“ ফুপি!”
এইবার ঠোঁট ফাঁকা করে ফিরে চাইল মেয়েটা। বিহ্বল চোখে পা থেকে মাথা অবধি দেখল ওনার। কাঁধ সমান চুল, কপালের কাছে আবার ব্যাঙ্গস কাট করা। পরনে হাঁটু সমান ঢিলেঢালা ফতুয়া,নিচেও জিন্সের ঢিলেঢালা প্যান্ট। জর্জেটের স্কার্ফ ঝুলসে গলায়। ঘাড়ে রাখা ছোট্ট ব্যাগটা চকচক করছে খুব। ভীষণ ফরসা গায়ের রং। তুশি বোকা বোকা চোখের পাতা ঝাপটাল টুপটাপ করে। এরকম হিপহপ ফুপি তো ও বাপের জন্মে দেখেনি। রোকসানা মেয়ের মাথায় চুমু খেলেন। আদরে গদগদ হয়ে বললেন,
“ আওঅঅ মাই বেবিই…কেমন আছো তুমি?”
“ ভালো আছি মাম্মাম। পাপা কোথায়?”
বলতে না বলতেই পেছনে একজন সুপুরুষ ঢুকলেন। সাথে দুহাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে ড্রাইভার। ইশারা মেনে সেগুলো আসমার হাতে তুলে দিলেন তিনি।
এতক্ষণে সবাই ধাতস্থ হয়েছে। কাঁধে আঁচল তুলেই রেহণুমা,তনিমা এগিয়ে গেলেন। হেসে
সালাম দিলেন নাসির উদ্দীন।
“ আসসালামু আলাইকুম ভাবি। ভালো আছেন আপনারা?”
“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। জি,আপনি ভালো আছেন? শরীর ভালো আছে এখন?”
“ জি জি।”
সাইফুল,অয়ন উঠে এলো ত্রস্ত। সবাই মিলে একচোট কোলাকুলি সারল।
তনিমা হেসে বললেন,
“ রোকসানা,কেমন আছো?”
ভদ্রমহিলা নাক সিটকে বললেন,
“ ভাবি,ডোন্ট কল মি রোকসানা প্লিজ। এটা শুনতেই ব্যাকডেটেড লাগে। আমার লুকের সাথে নামটা যায় বলো? কল মি সানা,অনলি সানা।”
তনিমা, রেহনূমার মুখ দেখলেন। বললেন,
“ আচ্ছা আচ্ছা,এসো ভেতরে এসো।”
দুজন ভেতরে এলেন। সাদর আপ্যায়নে বসলেন সোফায়। রোকসানা শুধালেন,
“ আম্মু, বড়ো ভাইজান সবাই কোথায়?”
রেহনূমা বললেন,
“ ঘরেই আছে। যা তো আসমা,ডেকে নিয়ে আয়।”
মেয়েটা জোরালো পায়ে ছুটল। রোকসানা অয়নকে বললেন,
“ কেমন আছো, বেটা? ফুপিকে তো ভুলেই গেছ। মনে করেও একটা কল দাও না কখনো। সব কিছু ভালো চলছে তো? আর সার্থ,সে কোথায়?”
অয়ন এক আঙুলে কপাল চুলকে বলল,
“ কোনটার উত্তর আগে দেবো ফুপি? যদি বলতে!”
তনিমা বললেন,
“ সার্থ থানায় গিয়েছে। আটটা নাগাদ চলে আসবে। আসলে তোমাদের তো বিকেলে আসার কথা। তাই..”
রোকসানা কথা টেনে নিলেন,
“ তাই সকালে এসে বুঝি তোমাদের খুন অসুবিধায় ফেলে দিলাম?”
রেহনূমা বললেন,
“ এমা না না,আপা তা বলেনি। আসলে…”
“ আসলে নকলে ছাড়ো তো।
তারপর আইরিনের দিক ফিরে বললেন,
“ আচ্ছা মাই বেবি,তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন? ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করো না? তোমার মামিরা বুঝি ঠিক করে তোমার টেইক কেয়ার করেনি?”
ইউশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল,
“ এই শুরু!”
তুশি অবোধের মতো সব চেয়ে চেয়ে দেখছে। ইউশার কথা শুনেও কিছু বুঝল না। ও শুধু ভাবছে,এই মহিলা এত ঢং করে কথা বলছে কেন? বিদেশীরা বাংলা বললে যেমন দাঁত ভেঙে ফেলে,এরকম করছে। কেন? এ তো দেশেই জন্মেছে। তাহলে এর সমস্যাটা কোথায়?
এদিকে মায়ের প্রশ্নে আমতাআমতা করে হাসল আইরিন। কদিন ধরে ওর মনের যা অবস্থা,গলা দিয়ে খাবার নামছে এই ঢেড়।
রেহনূমা-তনিমা হতাশ চোখে ফের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
অয়নের এসব ভালো লাগছে না। ফুপিকে তো চেনে। ব্যস্ত গলায় বলল,
“ ফুপি, তাহলে তোমরা থাকো। আমাকে এখন বের হতে হবে। অলরেডি আম গেটিং লেইট।”
“ যা,এইত এলাম। এর মধ্যে চলে যাবে? ফুপিকে দেখেই কাজ বেড়ে গেল বুঝি।”
“ আমার সেমিনার আছে ফুপি, এখন আসি। রাতে দেখা হবে।”
ছেলেটা গেল না,এক প্রকার পালাল যেন। রোকসানা এদিক-ওদিক দেখলেন,
“ আচ্ছা ইউশা…”
তক্ষুনি চোখ পড়ল মেয়েটাতে। গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে সে। ফুপি তাকাতেই যার রেশ আরেকটু বাড়ল। রোকসানা হেসে এক হাত বাড়ালেন
“ কী ব্যাপার, তুমি ওখানে কেন? এদিকে এসো।”
ইউশা টেনেটুনে হেসে এগিয়ে এলো। তার গতিতে এক রাশ জড়োতা। হাত তুলে সালাম দিল দুজনকে। রোকসানা উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। কতগুলো প্যাকেট দেখালেন নেড়েচেড়ে। বললেন,
“ এর মধ্যে অনেক দামি দামি বিউটি প্রোডাক্টস আছে। এই যে তোমার গালে এত পিম্পল না! সব একদম ভ্যানিশ হয়ে যাবে।”
ইউশা ক্লান্ত শ্বাস ফেলল। রাত জাগলেই ওর ব্রণ হয়। আবার সেরেও যায় নিজে থেকে। কিন্তু ফুপির চিন্তার শেষ হয় না! মেয়েটা হাসল তাও।
“ থ্যাংক ইউ ফুপি।”
তুশির মতিভ্রম এখনো কাটেনি।
একটা বাংলা ছবিতে রিনা খানের ঠিক এইভাবে চুল কাটা ছিল। আয়হায়,এখন ডাইনিটার মা যদি ওরকম হয়? পরপর মাথা নাড়ল দুপাশে। জিভ কেটে ভাবল,
“ না তুশি না, উনি না তোর ফুপি হন? রেসপেট কর।”
গতকালকের পর থেকেই এক প্রকার ঘরে খিল দিয়ে বসেছিলেন শওকত। একটাবারের জন্যেও নিচে আসেননি। কিন্তু বোন আসার খবরে আর বসে থাকতে পারলেন না। নেমে এলেন দ্রুত। জয়নবকেও ধরে ধরে নিয়ে এল আসমা। বসার ঘর আরেকটু সরব হলো সাথে। রোকসানা এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে ছিলেন। দু ভাইয়ের আদরের ছোটো বোন! এখনো ওই আদর-আহ্লাদ কমেনি। ছুটে গিয়ে ভাই,মাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। নাসীর উদ্দিন শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। তনিমা-রেহণুমা গেলেন রান্নাঘরে। অতিথি এসেছে,নাস্তা-শরবতের ব্যবস্থা করতে হবে তো!
বসার ঘরে একটা বিস্তর গল্প জমে উঠল তারপর । মেয়েকে পেয়ে যেন আটখানা হয়ে পড়েছেন জয়নব। তারওপর সবার জন্যে জিনিসপত্র এনেছেন ওনারা। প্রত্যেকের মুখ হাসিতে চকচক করলেও,আইরিনের গোমড়ামুখের বিন্দুমাত্র বদল হলো না। মাম্মাম তো এবার ওকে সাথে নিয়ে যাবে। আবার কবে এ বাড়ি ফিরবে কে জানে! অতদিনে তুশি যদি ইয়াসিরকে কব্জা করে ফেলে?
ততক্ষণে বাহারি নাস্তা নিয়ে গৃহীনিরা হাজির হয়ে গেলেন।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে নাসীর উদ্দিনের নজর পড়ল খাবার টেবিলের ওদিকটায়। বৃদ্ধা এক নারীর পাশে একটি ফুলের মতো মেয়ে কেমন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
ভদ্রলোক কপাল কুঁচকে বললেন,
“ এই বুঝি তুশি? আপনাদের মেয়ে, সাইফুল ভাই?”
জয়নব অবাক হয়ে বললেন,
“ ওর কথা তোমরা কী করে জানলে?”
“ আইরিন জানিয়েছিল, মা। তোমরা তো আর নিজে থেকে আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি।”
শওকত বললেন,
“ আমরা জানাতাম। চাইছিলাম একবারে দেশে এলে সামনাসামনি কথাবার্তা বলব।”
“ থাক ভাইজান,আমি সব বুঝি।”
ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। রোকসানা ডাকলেন,
“ তুমি ওদিকে দাঁড়িয়ে কেন? এসো।”
কিন্তু তুশি নড়ল না। হাসনা কনুই দিয়ে গুঁতো দিলেন। কণ্ঠ চেপে বললেন,
“ কী রে,যাস না ক্যা? যা।”
“ উম, আমার লজ্জা লাগছে।”
হাসনা মৃদু রেগে বললেন,
“ ঢংগের কতা কয়। হারাডা জনম,ব্যাডা মাইনষের পাছা হাতাইয়া পকেট মারলি। অহন একটা মহিলার সামনে শরম লাগে তর?”
তুশি চ সূচক শব্দ করল। হাসনা ধাক্কা মারলেন,
“ যা।”
তনিমাও ডাকলেন তখনই,
“ কী রে,আয়।”
তুশি মোড়াতে মোড়াতে এসে দাঁড়াল। এক পল চেয়েই মেয়েটার থেকে মাথা নুইয়ে নিলেন শওকত। ঢোক গিলে মন দিলেন চায়ের কাপে। এই মেয়েটাকে দেখলে তার কষ্ট হয়! অপরাধবোধটা তরতর করে বাড়ে। চোখে চোখ মেলাতে পারেন না। সাথে ভয় হয় খুব! তুশিটা তাকে বাবার মতোই ভালোবাসে। কিন্তু যেদিন ও সব সত্যি জেনে যাবে,তখন তো আর এই ভালোবাসা থাকবে না। সার্থর মতো মেয়েটাও ঘৃণা করবে ওনাকে।
রোকসানা সূক্ষ্ণ চোখে তুশির পা-মাথা মাপলেন। বললেন,
“ যাক, ছোটো ভাইজানের দুটো মেয়েই ভাবির মতো গায়ের রং পায়নি। একদম আমাদের মতো হয়েছে।”
নাসীর উদ্দিন বিরক্তি গিলে মাথা নাড়লেন দুপাশে। স্ত্রীর এসব ত্যারা ব্যাকা কথা তার একদম পছন্দ না।
এদিকে রেহনূমা চুপ রইলেও, আস্তে করে চ সূচক শব্দ করল ইউশা। ফুপির এমনিতে সব ভালো। কিন্তু মা,আর বড়ো মায়ের পেছনে কেমন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। ওর
মা শ্যামলা নয়,আবার খুব আহামরি ফরসাও না! কিন্তু ফুপি প্রত্যেকবার কিছু না কিছু শোনাবেই।
কথাটায় কেউ কোনো রা করল না। সবাই চুপ! এর মাঝেই তুশি ফট করে বলে ফেলল,
“ ইস,আপনার মেয়েটাও যদি আমাদের মতো হতো!”
তুরন্ত, চটক কাটার ন্যায় ঘুরে চাইল সকলে। হতভম্ব চোখে মুখ তুলল আইরিন। এই হাড়েবজ্জাত মেয়ে আবার ওকে নিয়ে কী বলবে এখন?
রোকসানা বুঝতে না পেরে বললেন,
“ মানে!”
তুশি নাকমুখ গুটিয়ে বলল,
“ মানে আবার কী? এই তো দেখুন না, ওর নাকটা কী বোচা! মনে হচ্ছে কেউ দুটো বাঁশের মাঝে রেখে চাপ দিয়ে ভোতা করে দিয়েছে। আর ঠোঁট? এত্তখানি চ্যাপ্টা..
বস্তিতে আমি কাউকে ঘুষি দিলে,তার ঠোঁটের অবস্থা ফুলে এমন ঢোল হয়ে যেত। আর সাইজের কথা কী বলব? আমি খাটো,এ আমার চেয়েও খাটো।”
তারপর তুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেন কত দুঃখ পাচ্ছে। বলল,
“ শুধু গায়ের রং ক্যাটক্যাটে সাদা হলেই কী আর চলে? যদি বাকিসব ভালো না হয়!”
হাসনার জিভ এক হাত বেরিয়ে এলো। এই মেয়ে আর শুধরালো না!
রোকসানা তাজ্জব,স্তম্ভিত। নিউড লিপস্টিক পরা ঠোঁট জোড়া দুইপ্রান্তে গিয়ে বসল তার। বাকিরাও গোল গোল চোখে চেয়ে। হতবুদ্ধি বনে নিজের চেহারা ছুঁলো আইরিন! ওর নাক-ঠোঁট সত্যিই অমন দেখতে?
রেহণুমা ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিস্ময়াভিভূত বনে গেলেন মেয়ের কথা শুনে। তার তুশি,তার হয়ে লড়ল? তাকে ছোটো করার বিরুদ্ধে আকারে-ইঙ্গিতে প্রতিবাদ জানাল? এসব কি সত্যি?
ভদ্রমহিলা হতবাক নয়নে স্বামীর পানে চাইলেন। দুই ঠোঁট টেনে তৃপ্তির হাসি হাসলেন সাইফুল। চোখের পাতা ফেলে বোঝালেন,
“ আমাদের মেয়ে!”
নাসীর গলা খাকারি দিলেন। প্রসঙ্গ কাটাতে বললেন,
“ আচ্ছা, তোমার সাথেই তো সার্থর বিয়ে হয়েছে তাই না!
তুশির সব চেয়ে প্রিয় প্রশ্ন এটা। সবেগে মাথা নাড়তে যাবে,রোকসানা পথিমধ্যে টেনে টেনে বললেন,
“ ওটা তো এক প্রকার লোক ঠকানো বিয়ে। তুমি আগে চুরি করতে না? কী কপাল তোমার! সারাজীবন চুরি-টুরি করে শেষে আমাদের বাড়ির মেয়ে হয়ে গেলে। ভাইজান,তুমি তো আমাকে এসব নিয়ে কিছু বললেই না। আইরিনই সব ফোন করে জানিয়েছে। আচ্ছা ছোটো ভাইজান,তোমরা সব রকম প্রমাণ টোমান নিয়েছ তো? মানে শিয়র তো ও তোমাদেরই মেয়ে? এসব আবার ওই ভদ্রমহিলার কোনো বানানো গল্প-টল্প নয় তো?”
হাসনার মুখখানা সংকীর্ণ হলো।
তুশি মেজাজ ভারি চটে গেল এবার। এই মহিলা তো ডাইনি আইরিনেরও এক কাঠি ওপরে। তেড়েমেরে উত্তর দিতে গেলে,সামনে থেকে ইউশা মাথা নেড়ে না করল। অনুনয়ে বোঝাল,
মেহমান মানুষ অশান্তি করার দরকার নেই।
সাইফুল বললেন,
“ কী আর প্রমাণ নেব? উনি কি নিজে যেচে এসব বলেছেন? সার্থ প্রেসার দিতেই না স্বীকার করা। আর সব থেকে বড়ো কথা, উনি যে ওই হাসপাতালের আয়া ছিলেন,সেটাতো আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে।
তাই এই ব্যাপারটা নিয়ে অন্তত মিথ্যে বলার কোনো জায়গা নেই।”
“ না থাকলেই ভালো। তোমাদের ব্যাপার, তোমরাই বোঝো। আমার তো বড়ো ভাবির জন্যে খারাপ লাগছে। ছেলে এত বড়ো পুলিশ অফিসার,ভাইজান এত বড়ো আর্মি অফিসার ছিলেন অথচ ছেলের বউ হবে একেবারে ইল্যিরেট একটা মেয়ে। হোক সে আমাদের বংশের। কিন্তু ওই যে বস্তিতে চুরি-টুরি করে বেড়াল এতদিন,এই ট্যাগ কি আর সহজে মোছা যাবে?
ভাইজানকে কতবার করে বলেছিলাম,আমার আইরিনের সাথে সার্থকে ভাবতে। শুনলোই না। এখন বুঝুক,যা বোঝার।”
এতক্ষণ দুঃখে চুপসে থাকা আইরিন মুখ তুলল অমনি। অবিশ্বাস আর বিমূর্ততায় চোখজোড়া ঝলকে উঠল তার। মাম্মাম ওর আর ইয়াসিরের বিয়ের ব্যাপারে আগে থেকেই ভেবেছেন? এটা তো ও জানতোই না। ও আরো মাম্মামের ভয়ে এতদিন কোনো বাড়াবাড়ি করেনি। জানলে তো ব্যাপারটা আরো সহজ হয়ে যেত।
তনিমা স্বামীর দিকে তাকালেন। দুজনের মুখেই অস্বস্তির চিহ্ন। রেহনূমা,সাইফুলের চেহারা ছোটো হয়ে বসেছে। মেয়ে নিয়ে এ ধরণের কথাবার্তা শোনা যায়? জয়নব বললেন,
“ আহা,এসব এখন থাক না ।”
নাসীরও বললেন,
“ সেই,থাক। বললেই তো আর সব ঠিক হবে না।”
শওকত জবাব দিলেন এতক্ষণে,
“ তুশিকে নিয়ে আমাদের কারো কোনো সমস্যা নেই। আমারো না,তোর ভাবিরও না। একটা দূর্ঘটনায় ও আলাদা হয়ে গেছিল,তাই ওকে এভাবে বড়ো হতে হয়েছে। ছোটো থেকে আমাদের সাথে থাকলে,ও বাকি সবার মতোই হতো। তুই আমাদের জন্যে অহেতুক চিন্তা না করে, বরং শুকরিয়া কর যে ওকে আমরা এত বছর পরে আবার ফিরে পেলাম। ও ইল্যিটারেট হলেও,ওর মতো বড়ো মন সবার হয় না। পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা দিয়ে কী হবে? মনের দিক থেকে মানুষটাই যদি ঠিক না হয়! আজ হয়ত সার্থ আর ওর মাঝে কিছু ঝামেলা আছে,কিন্তু আমরা সবাই জানি তুশি ওর গুণ দিয়ে ঠিক সব জয় করে নেবে। কী রে সাইফুল,তাইত!”
ভদ্রলোকের ঠোঁটে হাসি ফুটল। ঝকঝকে নয়নে স্ত্রীকে দেখলেন একবার।
ভাইয়ের কথায় দুজনেরই ভেতর জুড়িয়ে গিয়েছে। জবাবে ঝটপট মাথা নাড়লেন তিনি।
তনিমা হেসে বললেন,
“ একদমই তাই। তুশি খুব ভালো মেয়ে। আমার ছেলের জন্যে আমি যেরকম বউমা চেয়েছি,ও ঠিক তেমন।”
বলতে বলতে মেয়েটার মাথায় হাত বোলালেন তিনি। তুশির আর উত্তর দিতে হলো না। চাচা-চাচির কথাতেই তার হৃদয় ভরে গেল। স্বচ্ছ চোখ ভিজল ভীষণ ভালো লাগার জোরে। ও জানে,তনিমার কথা সত্যি নয়। ওর মতো বেগুন,ওর মতো মূর্খ,ডানপিটে বউমা কেউ কখনো চাইতেই পারে না। কিন্তু তাও তো ওর হয়ে দুজন লড়েছে। কারো কাছে ছোটো হতে দেয়নি। এর বেশি একটা মেয়ের তার পরিবার থেকে চাওয়ার আর কী থাকতে পারে?
সবার এত মিল! একেকজনের ঠোঁট ভরা হাসি! অথচ রোকসানার গা জ্বলে গেল।
কপাল কুঁচকে কোনোমতে চায়ের কাপে ঠোঁট রাখলেন তিনি। নাসির উদ্দীন কানের পাশে কণ্ঠ চেপে বললেন,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৫
“ কী দরকার ছিল তোমার এসব বলার? এখন দিলো তো মুখের ওপর অপমানটা করে? এতকাল অ্যাবরোডে থেকেও কখন কী বলতে হয় কিচ্ছু শিখলে না।”
স্বামীর কথা যেন রাগের আগুনে এক টুকরো ঘি। দাঁতমুখ খিচে রোকসানা চুপ করে রইলেন। মাথায় ঘুরছে,
বড়ো ভাবি,এমন মেয়েই ছেলের জন্যে চেয়েছি বলতে কী বুঝালেন?
তার মেয়ে তবে ফ্যালনা?