কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৭
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
টেলিভিশনে ইয়াসিরের একটা ফুটেজ দেখাচ্ছে। গণ মাধ্যমে তার দেয়া ইন্টারভিউ। সম্প্রতি আরেকটা নতুন কেস নিয়ে সরব থানা। পরকীয়ার জের ধরে নিজের স্ত্রীকে গলা কে-টে হ-ত্যা করে পালিয়েছেন এক লোক। তদন্তের দ্বায়িত্ব পড়েছে ইয়াসিরের কাঁধে। সংখ্যাতীত মাইকের সামনে সে জানাচ্ছিল কী থেকে কী হয়েছে! খবরটা আজ সারাদিনই এ চ্যানেল-ও চ্যানেলে ঘুরছে। সৈয়দ পরিবারের কাছে এসব অবশ্য ডালভাতের মতো। তবে চলমান ওই চিত্রের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইল তুশি।
হঠাৎই খুব মন খারাপ হলো। এই মানুষটা যে কবে ওর হবে! কবে একটু তৃষ্ণা মিটিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে। কবে ইয়াসিরের এই শক্তপোক্ত গড়ন স্পর্শ করে চোখে চোখ রাখবে তুশি?
ও যে ভয়ডরে সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতেই পারে না। তুশির মন আজ সারাদিনই এ নিয়ে বিক্ষিপ্ত ছিল। বাড়িতে এত রান্নাবান্না,এত আয়োজন,রোকসানা আসায় দিদুন- বাবাদের উৎসবে সে চাইলেও মন দিতে পারছে না। বসার ঘরে তখন গল্প-গুজব হচ্ছিল। রোকসানা আসাতে আজ আর কেউ কাজবাজে যাননি । তুশি আলগোছে সেখান থেকে উঠে গেল। আপাতত এই দুনিয়া ওর কাছে বিস্বাদ,তিক্ত। এসব আড্ডা-গল্পে থাকার কিছু নেই!
ইয়াসির বাড়ি ফিরল রাত নয়টার পরে। বিশাল সোফাসেট জুড়ে তখন সকলেই ছিলেন। এক দফা চায়ের আসর শেষ হয়েছে সবে। ইয়াসির তখনই এলো। সবার কথাবার্তা থামল তাকে দেখে। শওকত একবার চেয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। আগে তো ছেলেটার সাথে কথা বলতে পারতেন না,এখন সেই না পারাটুকু যেন তরতর করে বেড়েছে। চোখে চোখ মেলানোও দুঃসাধ্য!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রোকসানা ওকে দেখেই উঠে এলেন।
হেসে জড়িয়ে ধরলেন দুহাতে। আটখানা হয়ে বললেন,
“ সার্থ,মাই হ্যান্ডসাম বয়! কী খবর তোমার? কেমন আছো?”
ইয়াসির হাসল,খুব ক্লান্ত হাসি।
“ ভালো। তুমি ভালো আছ?”
রোকসানা মাথা নাড়েন। ফের কিছু বলার আগেই,সময় দিলো না ইয়াসির। নিজের মতো জানিয়ে দিলো,
“ থাকো, ফ্রেশ হব।”
পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল সাথে। দুদণ্ড দাঁড়াল অবধি না। তনিমা চাইলেন রেহনূমার দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে উঁচিয়ে কথা বললেন ইশারায়। তারপর মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রমনী। সবার উদ্দেশ্যে জানালেন,
“দেখে আসি ওর কী লাগে না লাগে!”
রোকসানা ভারী হতাশ হয়েছেন। প্রায় মাস ছয়েক পরে দেখা হলো,অথচ ছেলেটা ভালো করে দুটো কথাও বলল না। নীরস গলায় বললেন,
“ ও দেখি এখনো আগের মতোই আছে,ভাইজান। তোমার সাথে কথা বলে,নাকি তাও বলে না?”
শওকতের চেহারায় কালো মেঘ।
জয়নব বললেন,
“ আইরিন না তোকে সব খবর দেয়? তা এটুকু বলেনি?”
ভদ্রমহিলা থতমত খেলেন। গলা ঝেড়ে কাশলেন অল্প। সেসময় আইরিনের নজর অন্য কোথাও। ইয়াসির চলে যাচ্ছে! দুপাশের চওড়া কাঁধ,একেবারে নিঁখুত স্টাইলে ছাটাই করা ঘাড়ের চুল থেকে সব কিছু মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে। দেখতে দেখতে দুই ঠোঁট দুইদিকে সরলো।
বোধ হয় সৃষ্টিকর্তাও চাইছেন,সার্থ ভাই তার হোক। নাহলে যখনই ও সব আশা ফেলে হাত-পা ছেড়ে দিলো,তখনই মাম্মাম এমন পথ দেখাল কেন?
ইউশা বিরস চিত্তে বসে আছে। এসব আসরে তার মন নেই। এমনিতেই ওর মেজাজ ভালো না। ফুপি গল্প করার নামে জোর করে বসিয়ে রেখেছেন। তাও যদি কোনো ভালো কথা হতো। ওই তো প্রতি শব্দের মাঝে মা-বড়ো মাকে খোচা মেরে যাওয়া। এতে যে কী রাগ হয় ইউশার। একটু আগে বড়ো মা চা নিয়ে এলেন,কী দারুণ হয়েছে খেতে। অথচ ফুপি চোখমুখ কুঁচকে বললেন,
“ এত চিনি? আবার লিকার নেই। এটা কেমন চা? এত বছরেও ভাবি চায়ের হাত গড়লে না? ভাইজান খাও কী করে? নাসীর তো এটা খেতেই পারবে না। ওর আবার আমার হাতের চা ছাড়া সহজে ভালো লাগে না।”
তনিমা ফের ভালো করে চা দিতে ব্যস্ত হলেন। শওকত বিরক্তি গিললেন মনে মনে। কিন্তু
অপ্রস্তুত হেসেছেন নাসীর। অথচ ইউশা দেখল,কেমন ফটাফট চুমুক দিয়ে ফুপা কাপ খালি করে ফেললেন। তারপর ওর যখন চোখ পড়ল তুশি কোথাও নেই,উঠে এলো অমনি।
স্টোর রুমে এসে দেখল,খাটের ওপর বোম মেরে বসে আছে মেয়েটা। ইউশা কপাল কুঁচকে বলল,
“ ভাইয়া ফিরেছেন ,আর তুমি কিনা এখানে?”
তুশি তেতে বলল,
“ তো কী করব? গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খাব?”
ইউশা দুষ্টু হেসে বলল,
“ খেতে যে চাইছ না, তা তো নয়। চান্স দিলেই খাবে।”
তুশি ভেংচি কাটল। পরপরই দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
“ চান্স দেবেন উনি? আমি কি চান্স দেয়ার যোগ্য নাকি। আমি তো একটা গণ্ডমূর্খ।”
ইউশা এবার আমোলে নিলো ব্যাপারটা। বুঝল তুশি সিরিয়াস। কাছে বসে বলল,
“ কী হয়েছে বলো তো তোমার?
সকালে অমন লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটলে,তাহলে বলতে পারলে না কেন?”
তুশি বিষণ্ণ চোখে চাইল। আর্দ্র স্বরে বলল,
“ ভয় করছে। মনে মনে ভালোবাসার চাইতে,সোজাসুজি প্রত্যাখান হওয়ার জ্বালা যে খুব ভয়ানক ইউশা। উনি যদি আমাকে ফিরিয়ে দেন?”
“ বোকা মেয়ে,ফিরিয়ে দেবে কেন?”
“ কেন দেবে না? আমি কি ওনার মনের মতো কেউ?”
“ তুশি, তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি এখন আর বস্তির পকেটমার তুশি নও। তুমি এখন সৈয়দ বাড়ির ছোটো মেয়ে। কারণ,আমি তোমার চেয়ে ১ মিনিটের বড়ো।”
হাসল ইউশা। বলল ফের,
“ এ বাড়িতে এখন ভাইয়াও যা,তুমিও তাই। তোমার পরিচয় বদলে গেছে তুশি। তাহলে ভাইয়া এখন তোমাকে মেনে নেবেন না কেন? ভাইয়া তো জানেন,তোমার সাথে কী হয়েছিল! তুমি চুরি না গেলে আজ তো আমার মতোই হতে। তবে কেন এত বাড়িয়ে-চড়িয়ে ভাবছো?”
তুশির যেন হুশ এলো। সচেতন চিত্তে ভাবল,
“ তাইত! ও কেন নিজেকে ছোটো করে দেখছে? ওতো এখন ইয়াসিরদের বাড়িরই একজন। এই বাড়ির রক্ত বইছে ওর শরীরে। এবার নিশ্চয়ই ওকে বস্তির চোর বলে ইয়াসির দূরে সরিয়ে দেবে না! এখন নিশ্চয়ই ওর ভালোবাসা গ্রহণ করবে মানু্ষটা।
তুশির চেহারায় পদ্ম ফুটল। খলবলিয়ে বলল,
“ তাহলে আমি আবার যাবো ইউশা?”
“ সাহস ফিরেছে বুঝি?”
ও মাথা নাড়ল জোরে,
“ হুঁ।”
“ গিয়ে আবার ফিরে আসবে নাতো?”
তুশির কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস,
“ না। আমি পারব এবার। আমাকে পারতেই হবে।”
“ যাও, আমিও যাই। প্রচুর পড়া বাকি। জানিও কী হয়!”
তুশি ধড়ফড়িয়ে উঠল । ছুটল ঠিক বিদ্যুতের গতিতে। বসার ঘর পেরিয়ে যাওয়ার সময়, প্রত্যেকে অবাক হয়ে চাইলেন। সাইফুল বললেন,
“ কই যাস রে মা? আস্তে। পড়ে যাবি।”
তুশি কোনো কথার কোনো জবাব দিলো না। দৌড়ে চলল দিশাহারা পাগলের মতো। জয়নব হেসে বললেন,
“ সার্থ ফিরেছে তো। বোধ হয় ওর কাছেই যাচ্ছে। যাক গে,নাসীর কী বলছিলে বলো।”
ভদ্রলোক ফের কথা শুরু করলেন। কিন্তু আইরিন উদ্রগীব চোখে চেয়ে রইল ওপরের দিকে। তুশি কি সত্যিই সার্থ ভাইয়ের কাছে যাচ্ছে নাকি?
ও উঠতে নিয়েও বসে পড়ল আবার। না,এক্ষুনি কিছু করা যাবে না। আগে পরিস্থিতি ভালো ভাবে হাতে আসুক, এরপর। তাছাড়া ভাইয়ার কাছে গেলেও বা কী? সেইত ঝার খেয়ে বেরিয়েই আসবে।
ইয়াসির ওয়াশরুমে ঢুকল শাওয়ার নিতে৷ কিন্তু ট্যাপে পানি আসছে না। হাতলটাও কেমন নড়বড়ে। অবশ্য সকালেই এমন দেখে গিয়েছিল। মাকে বলে যাবে,মাথায় ছিল না। এদিক ঘাম-ধুলোয় শরীর চ্যাটচ্যাট করছে। ও গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে বাইরে এলো। ঢুকল সোজা অয়নের ঘরে। ওখান থেকে শাওয়ার সেরে আসবে। দু ভাইয়ের রুম পাশাপাশি প্রায়। কিন্তু ওয়াশরুমের দোর ভেতর থেকে লাগানো। পানির শব্দ আসছে। অ্যাপ্রোন,মোবাইল ফোন সব রাখা ঘরে। অয়ন ফিরেছে তাহলে।
ইয়াসিরের অপেক্ষা করার ধৈর্য হলো না।
সারাদিন বীতস্পৃহ কেটেছে। যতই ব্যস্ত থাকুক অসহ্য লেগেছে সবকিছু। যার রেশ আরো বাড়ল এখন। বেরিয়ে আসতে নেবে আচমকা হাজির হলেন তনিমা। এক গাল হাসি নিয়ে বললেন,
“ তুই এখানে। আমি আরো ঘরে খুঁজে এলাম!”
ইয়াসিরের কপাল গোটানো,
“ কেন?”
“ সকালে বলেছিলাম না,কথা আছে?”
“ ওহ। বলো।”
তনিমা একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। শুরু করলেন খুশি খুশি গলায়,
“ কাল রাতে তোর ছোটো মায়ের সাথে আমার কথা হয়েছিল বুঝলি। ভেবে দেখলাম,তোর আর তুশির বিয়েটাতো খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হয়েছে। মানে কেউই কিছু জানতিস না । আবার তুশির জন্মপরিচয় থেকে সব ভুল দেয়া ওখানে। নামটাও তো! সেই দিক থেকে দেখতে গেলে বিয়ে তো বৈধই হয়নি। তো আমি আর ছোটো তোদের আবার নতুন করে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছিলাম। ছোটোই তোর কাছে আমাকে বলতে পাঠাল। সে তো..”
ইয়াসির কথা কেড়ে নিলো,
“ আমি বলেছি?”
থামলেন তনিমা।
“ হ্যাঁ?”
“ বিয়ে নিয়ে ভাবতে আমি বলেছি তোমাদের?”
তনিমার স্ফুর্ত চোখমুখ দমে গেল,
“ না মানে… তুশির আর তোর বিয়ে তো এখন বৈধ না…”
তুশি ইয়াসিরের ঘরে ঢুকতেই যাচ্ছিল। চৌকাঠে থামল ওইপাশের ঘর হতে ছুটে আসা নিজের নাম শুনে। পরপরই শুনতে পেলো ইয়াসিরের দগদগে কণ্ঠ,
“ না হলে না। আমি তো বলিনি আমি তুশিকে বিয়ে করতে চাই। বা ওর সাথের অবৈধ বিয়ে আবার নতুন করে বৈধ করতে চাই। তাহলে তোমরা এত আগ বাড়িয়ে ভাবছ কেন?”
তনিমা অবাক হয়ে বললেন,
“ এভাবে কেন বলছিস? আগে তো তুই তুশিকে মানতে চাসনি ও চোর ছিল, বস্তিতে থাকতো তাই। কত কী বলতি সেসময়! এখন তো ও আমাদের বাড়ির মেয়ে। এসব চুরিটুরিও করে না। তাই আমি ভেবেছিলাম এবার আর তোর কোনো আপত্তি থাকবে না।”
ইয়াসির চ্যাঁচিয়ে উঠল,
“ সব সময় তুমি নিজের ভাবনা আমার মধ্যে বসিয়ে দেবে না। একবার তোমার ইমোশনাল ব্লাকিমেইলিং এর জন্যে বিয়ের স্টেজ অবধি গেছিলাম। যথেষ্ট অপমান হয়েছে সেদিন। এখন আবার চাইছো এসব করে তুশিকে আমার ওপর চাপিয়ে দিতে!”
তুশি নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। চাপিয়ে দিতে মানে! ও কি ইয়াসিরের কাছে বোঝা?
তনিমাও একই কথা বললেন,
“ চাপিয়ে দেবো কেন? ও তোর স্ত্রী বলেই না…”
ইয়াসির ফের কথা টেনে নেয়,
“ এক্ষুনি না বললে বিয়ে বৈধ হয়নি? তাহলে কীসের স্ত্রী? সেই হিসেবে তুশি তো আমার কেউ না।”
তুশির বুকে দুম করে লাগল। কাঁপলো দুটো স্বচ্ছ চোখ। ও কেউ না?
ইয়াসির কঠিন স্বরে ঘোষণা দেয়,
“ তুশিকে আমি পছন্দ করি না। আমার ভালো লাগে না ওকে। আর যার প্রতি আমার কোনো ভালোলাগা,ভালোবাসা কিচ্ছু নেই তাকে নিয়ে আমি কেন একটা সংসার টেনেহিঁচড়ে চালাতে যাব?”
তুশি থমকে গেল। থমকাল তার গোটা পৃথিবী। চোখের সামনে আস্ত আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। মনে হলো ইয়াসির বলেনি, বিষ মেখে একটা ধারালো তীর ছুড়ে দিয়েছে। যা সপাটে এসে হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে গেছে ওর। দুর্বলের মতো এক পা পিছিয়ে গেল সে। চোখ থেকে একটা জলের রেখা গড়িয়ে গলা অবধি নামল।
তনিমা হতবাক হয়ে বললেন,
“ তোর তুশিকে পছন্দ না?”
“ না!”
তুশির আর কিছু শোনার সাহস হলো না। বুকের ভেতর নিঃশব্দে কিছু একটা গুড়িয়ে যাচ্ছে। হাতড়ে হাতড়ে ওর সব আশা,কল্পনা নিংড়ে নিচ্ছে যেন। মেয়েটা তড়িৎ ঘুরে হাঁটা ধরল।
তনিমা কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইলেন। ইয়াসিরের মুখের হাড় শক্ত। স্পষ্ট নিরেট কপালের ভাঁজ। ঠোঁট টিপে ওপরের দাঁত ঘষছে নিচের পাটিতে। ভদ্রমহিলা বুঝলেন না ওর এত রাগ কীসের? কীসের এত তপ্ততা?
খুব আস্তে শুধালেন,
“ তাহলে তুই এখন কী চাস?”
ইয়াসির দৃঢ় জবাব দিলো,
“ যাই চাই, চাই। তবে তুশিকে চাই না। আর কিছু?”
যেতে যেতে তুশি শুনতে পেলো এটুকু। ভেজা চোখের মরা চাউনিতে ফিরে চাইল আবার। মনে হলো কেউ একজন ওর গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে সব স্বপ্ন ছিঁড়েখুঁড়ে টেনে বের করে ফেলল। এত যন্ত্রণা,এত ব্যথা… আচ্ছা মানুষটা কি টের পাচ্ছে ওর অন্তরের হাহাকার? বুঝতে পারছে তুশি টুকরো টুকরো হচ্ছে,টুকরো হচ্ছে ওর বুকটা? জানতে পারছে কিছু!
ইউশা নিজের ঘরে যেতে নেয়,হঠাৎ পথে বাঁধল অয়ন। শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে আসছে সে। ইউশা চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে পাশ কাটাতে নিলো, তক্ষুনি ডাকল সে,
“ ইউশা শোন।”
মেয়েটা চোখ বুজে ক্লান্ত শ্বাস ফেলল। যত চাইছে অয়নের থেকে দুরুত্ব রাখতে,তত যেন বাধ সাধছেন উনি। ভালো তো বাসে না,তবে ওর কাছে কী চাইছে আবার? একটা ভাঙা মন নিয়ে ইউশা যে বেঁচে আছে এখনো, অয়ন ভাইয়ের কি সেটুকুও সহ্য হচ্ছে না? কেন বুঝতে পারছেন না উনি,ওনাকে দেখলে ইউশার আরও দূর্বল লাগে। কানায় বুক ভেসে যায়। সব অস্থিরতা দমিয়ে শান্ত মুখে ফিরে চাইল মেয়েটা। নিভু গলার স্বর,
“ হু? কিছু বলবে?”
অয়নের ফরসা মুখ তারার মতো জ্বলছে। চোখদুটো হাসি হাসি। কথা নেই বার্তা নেই,আচমকা এসেই ইউশাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা ভড়কে গেলেও, থামল তার বক্ষঃস্পন্দন। হৃদয়পটে চাপ পড়ল প্রখর কিছুর। ধক ধক করতে করতে থেমে গেল একটা লম্বা লাইনে ফুলস্টপ পড়ার মতো। এর আগেও অয়ন ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। যখন মেডিকেলে চান্স পেল,আবার যখন ইউশা এসএসসিতে এ প্লাস পেলো। খুব খুশি হলেই অয়ন ভাই জড়িয়ে ধরেন বোধ হয়। কিন্তু আজ,আজ এত খুশি কেন উনি?
অয়ন সরে এলো। ইউশার দুবাহু ধরে হড়বড় করে বলল,
“ আমি আজ খুব খুশি ইউশা। খুব খুব খুব খুশি। তুই জানিস, তুশি আর ভাইয়ার বিয়েটা হয়ইনি। ওদের বিয়েও বৈধ নয়।”
মেয়েটা স্তম্ভিত আওড়াল,
“ কীহ?”
“ হ্যাঁ। একটু আগে মামুনি এসেছিল আমার রুমে। ভাইয়াও বোধ হয় কোনো কাজে এসছিল। আমি শাওয়ারে ছিলাম,সব শুনেছি। ও বলছিল ও তুশিকে ভালোবাসে না। পছন্দই করে না নাকি। মামুনি আবার ওদের বিয়ের কথা তোলাতে খুব চ্যাঁচামেচিও করল। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি অবশ্য আগেই শিয়র ছিলাম,আজ তো আমার সব চিন্তা একেবারে শেষ। তুশিকে পাওয়ার মাঝে আর কোনো বাধাই তাহলে রইল না বল।”
ইউশা বাকরুদ্ধ,বিস্মিত। অয়নের চকচকে হাসিটা যেন এক টুকরো আগুন। একেবারে তেড়ে এসে দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিলো ওকে।
অয়ন নিজেই বলল,
“ আমি ভাবছি তাও ভাইয়ার সাথে একবার কথা বলে নেব। একটা কাবিন-নামা তো আছে। সেটা বরাবরের মতো বাতিল করার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তুশির সাথে ভাইয়ার কোনো ভাবেই কোনো কানেকশন না থাকে। কী বলিস?”
ইউশা উত্তর দিলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। নিষ্প্রভ মেয়েটাকে দেখে অয়ন ভ্রু গোছায়,
“ কী হয়েছে বল তো তোর? আজ সারাদিন এমন মরার মতো ঘুরছিস দেখলাম। কেউ কিছু বলেছে?”
ইউশা একটু শুকনো ঢোক গিলল। জানাল ছোটো স্বরে,
“ বুকে খুব ব্যথা করছে অয়ন ভাই।”
অয়ন ডাক্তার। তাই সবার আগে মাথায় ডাক্তারি চিন্তাই এলো।
চেহারা টানটান করে বলল,
“ বুকে ব্যথা করছে? সারাদিনে নির্ঘাত ঠিক করে কিছু খাসনি? নাকি ভাজাপোড়া খেয়েছিস? ফুচকা,তাইত!”
ইউশা ঠোঁট টেনে কাষ্ঠ হাসল। মনে মনে বলল,
“ আমি বিষ খেয়েছি অয়ন ভাই। এক তরফা ভালোবাসার বিষ। এই বিষ শুধু আমার বুকটাই না,পুরো আমাকেই পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। আমার হৃদপিণ্ড থেকে শিরা-উপশিরা,আমার আত্মা অবধি ঝলসে যাচ্ছে দেখো! দেখতে পাচ্ছো অয়ন ভাই?”
অয়ন ব্যতিব্যস্ত হলো,
“ আমি ওষুধ দিচ্ছি দাঁড়া।”
ইউশা মৃদূ স্বরে থামাল,
“ লাগবে না। আমার এই ব্যথাটা এত ভয়ানক, ও আর কোনোদিন সারবে না।”
অয়ন বোঝেনি,
“ মানে!”
ইউশা বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে হাসল। বলল,
“ কিছু না। অনেক পড়া জমে গেছে। যাই হ্যাঁ?”
তারপর কেমন এলোমেলো পায়ে চলে গেল মেয়েটা। অয়ন বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে রইল সে পথে। কী যে হয়েছে ওর!
তুশি মেঝেতে বসে আছে। দু হাঁটু বুকের সাথে ভাঁজ করে, মাথাটা নুইয়ে রেখেছে তারওপর। বারবার কানে বাজছে, ইয়াসিরের সেই নিষ্ঠুর কথা,
“ আমি তুশিকে চাই না। পছন্দ করি না ওকে। তুশিকে আমার ভালো লাগে না।”
তুশির দুভাগ হওয়া বক্ষপট ফের ধ্বসে পড়ল। যেভাবে হৃদয়ের চলাচল কমে গিয়ে মানুষ মারা পড়ে? তেমনই মৃত মনে হলো নিজেকে। ভাগ্যিস ও সকালে কিছু বলতে পারেনি। বললে কী হতো? সেই তো প্রত্যাখান হয়ে ফিরে আসতো ঘরে। এখন তুশির মনের কথা আর কেউ জানবে না। কেউ না!
ঠিক সেই সময় মনে হলো ঘরে কেউ এসেছে। অল্প আলোর মাঝে একটা দীর্ঘ দেহের অবয়ব ভেসে উঠেছে ফ্লোরে। ডাকল ভীষণ ঠান্ডা গলায়,
“ তুশি!”
বিধ্বস্ত মুখ তুলে চাইল মেয়েটা। দুটো রক্তিম নজর সরাসরি গিয়ে বর্তাল ইয়াসিরের শক্তপোক্ত চিবুকে। কালো টিশার্টের সাথে চেক চেক ট্রাউজার পরনে। সদ্য গোসল করাতে ছোটো চুলগুলো এখনো ভেজা। কতক লেগে আছে ফরসা কপালের ত্বকে।
তুশির বুক মুচড়ে ওঠে। এত চমৎকার মানুষটা ওর হবে না। ও তো জানতোই,তৈরিও ছিল। তাহলে আবার কেন এত গভীর ভাবে ভালোবাসার সাহস করতে গেল? কেন স্বপ্ন দেখল দুজনের ছোট্ট সংসার নিয়ে?
তুশি উঠে দাঁড়াল। ইয়াসিরের আর ডাকতে হয়নি, নিজে থেকেই অবসন্ন পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল সে। মাথা নিচু করে বলল,
“ জি?”
ইয়াসিরের নজর পাথুরে। আবেগের ছায়া মাত্র নেই। সোজাসুজি বলল,
“ তোমাকে আমি এই বাড়িতে কেন এনেছিলাম জানো?”
তুশি ঘাড় নাড়ল দুপাশে। বোঝাল,না।
“ ঋণ শোধ করতে।”
মাথা তুলল মেয়েটা। বিমর্ষ চোখে কৌতূহল,
“ কীসের ঋণ?”
ইয়াসির দুই হাত পকেটে গুজে দাঁড়ায়। বিলম্বহীন বলে দেয়,
“ তোমার হয়ত মনে নেই,কিন্তু আমার মনে আছে। একদিন তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে। রুস্তমের লোক যখন আমাকে অ্যাট্যাক করেছিল তখন।”
তুশির ওসব মনে করার ইচ্ছে হলো না। নিজের টনটন করা পাঁজরটাকে সামলাতেই যে ও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
ইয়াসির নিজেই বলল,
“ তোমার প্রতি আমার ফার্স্ট ইম্প্রেশান ভালো ছিল না। একটা চোরের ওপর একজন পুলিশ অফিসারের ধারণা যা হওয়া উচিত, ঠিক তাই ছিল। তবে সেদিন আমার বিপদে তুমি যেভাবে এগিয়ে এসেছিলে,আমি নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম তোমার মাঝেও একটা ভালো মন আছে,মনুষ্যত্ব আছে। নাহলে কেউ নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আরেক অচেনা মানুষকে এভাবে বাঁচাতে আসে না। জেনেবুঝে আমি কখনো কারো কাছে ঋণ রাখিনি। আমার মনে হয়েছিল যে কোনো ভাবে তোমার এই উপকারের প্রতিদান আমার দেয়া প্রয়োজন। তারপর থেকে আমি প্রায়ই তোমাকে রাস্তাঘাটে দেখতাম। খারাপ লাগতো। মনে হতো তোমার এই উদ্ভট,ডানপিটে জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হওয়া উচিত। যদি সুযোগ থাকতো,আমি নিশ্চয়ই তেমন কিছু করতাম যাতে তোমার জীবন সহজ হয়।
কিন্তু, দূর্ভাগ্যবশত আমার কাছে সেই সুযোগটা এসেছিল,তোমার সাথে আমার বিয়ের মাধ্যমে।”
তুশি কাতর চোখে চেয়ে রইল। অনুনয় করল মনে মনে,
“ দূর্ভাগ্য বলবেন না, সার। ওইদিনটাই যে আমার জীবনের সবচাইতে সৌভাগ্যের দিন ছিল। বিয়ে হয়েছে কি হয়নি আমি জানি না। অন্তত আপনার জন্যে কবুল বলেছিলাম,আমার কাছে আজীবন এটুকুই সূর্যের মতো সত্যি হয়ে থাকবে।”
ইয়াসিরের কথায় ভণিতা নেই। বলে গেল অনর্গল,
“ দেখো, চাইলে মাঝহারের সাথে সাথে ফ্রড কেসে আমি তোমাকেও জেলে ভরতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। তুমি যখন স্বীকার করেছিলে, টাকার জন্যে তুমি একটা মিথ্যে বিয়েতেও মত দিয়েছ তখন আমার সেই চাওয়াটাই জেদে বদলে গেল। তখনই নিজের কাছে শপথ করেছিলাম,তোমাকে আমি পালটে দেবো। এই চোর,পকেটমার মেয়েটাকে একটা সভ্য মানুষের মতো বাঁচতে শেখাব একদিন। আর তাই শাস্তি দেয়ার নাম করে তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। যাতে তুমি আমার চোখের সামনে, আমার নিয়ন্ত্রনে থাকো।
আমি জানতাম,আর কেউ নাহলেও ইউশা আর মা তোমাকে কাছে টেনে নেবে। যাতে তোমাকে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়, তাই আমি বাড়ির সব কাজ তোমাকে দিয়ে করাতে বলেছিলাম। চেয়েছিলাম তোমাকে এখানে রেখে সভ্য বানাতে। কারণ,মানুষ একবার সভ্যতা,ভদ্রতার ছোঁয়া পেলে সে চাইলেও আর খারাপ হতে পারে না। আর আমি আমার কাজে সফল হয়েছিলাম,তুশি। যেদিন তোমাকে বাড়ির সবাই মিলে চোর বলছিল,আর তুমি কষ্ট পেয়ে কাঁদছিলে,ছটফট করছিলে নিজেকে প্রমাণ করতে তোমার সেদিনকার চাউনি দেখে আমি বুঝে গেছিলাম, আই হ্যাভ এচিভড মাই গ্যোল!
এরপর একটু থামল ইয়াসির। দুবার চোখের পাতা ফেলল মেঝের দিকে চেয়ে। স্বল্প বিরতি নিয়ে বলল,
“ তুশি, তুমি যেদিন আমাকে ওষুধ লাগাতে এসেছিলে,সেদিন তোমার হাবভাব দেখে আমার কিছু ঠিক মনে হয়নি। আমি চাইনি আমাকে নিয়ে তুমি কোনোরকম কোনো বাড়তি কিছু ভাবো। তাই ওভাবে তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম। ব্যাপারটা যাতে না ছড়ায়,সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পরেরদিনই তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার। কিন্তু…. তা আর হয়নি।”
ফের একটু থেমে বলল,
“ দ্যাখো, এই বাড়ির সাথে তোমার সম্পর্ক যাই হোক,আমি তোমাকে বলব,তুমি আমার ওপর কোনো এক্সপেকটেশানস রেখো না। যে বিয়ের কোনো মানে নেই,কোনো বৈধতা নেই,আই থিংক তুমিও চাইবে না এরকম একটা খাপছাড়া সম্পর্কে ঝুলে থাকতে।
আমি মাকেও বলেছি তোমাকেও বলছি..
আই ডোন্ট লাইক ইউ তুশি। আই ডোন্ট ফিল ফর ইউ।”
তুশি চিবুক নুইয়ে চুপ করে রইল। ইয়াসির বলল,
“ তুমি আমার সহানুভূতিতে ছিলে,এখনো আছো। কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতির ছিটেফোঁটাও নেই।
বুঝেছ নিশ্চয়ই?”
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৬
ভীষণ নিষ্ঠুর কিছু বাক্য,অথচ উত্তরে শুধু ঘাড় নাড়ল তুশি। ইয়াসির কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না। বেরিয়ে গেল লম্বা পায়ে। তার প্রস্থান নিশ্চিত হতেই এতক্ষণে গলার খাঁজ হতে মুখ তুলল তুশি। চলে যাওয়া শরীরটাকে দেখতে দেখতে ঠোঁট জোড়া ভেঙে এলো প্রচণ্ড কান্নায়। তুরন্ত মেঘ ফেটে আসা বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বসে পড়ল। তুলতুলে বালিশটাকে বুকে চেপে মুখ গুঁজে দিলো তাতে। বুজে আসা কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
“ কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি,খুব ভালোবাসি।”