কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪১
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
কেক তৈরি । গোলগাল,সুন্দর একটা কেক। তুশি দেখেই খুশি হয়ে গেল। ওপরে আবার রঙবেরঙের কত কী ছড়ানো! মেয়ের ঠোঁটের উজ্জ্বল হাসি দেখে রেহণুমা শুধালেন,
“ তোর মন মতো হয়েছে,মা?”
প্রশ্নটা করলেও,ভদ্রমহিলা ভেবেছিলেন আগের মতোই থমথমে জবাব দেবে মেয়েটা। কিংবা,হয়ত বলবেই না কিছু।
কিন্তু তুশির হাসি আজ কমল না। স্ফূর্ত গলায় বলল,
“ হ্যাঁ, খুব। যাই ইউশাকে দেখাব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!”
ও তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। কিন্তু বুক জুড়িয়ে এলো রেহণুমার। মনে হলো এইটুকু প্রশংসাই তার পৃথিবীতে শান্তি লেপে দিয়েছে। মেয়েটা যে আজ প্রথম ওনার সাথে এমন হেসে কথা বলল!
তুশি কেক এনে সোজা টেবিলে রেখেছে।
ইউশা দেখেই লাফিয়ে উঠল,
“ ওয়াও, চকলেট কেক। আই লাভ চকলেট।”
“ কিন্তু এটা এত কালো কেন? দেখে মনে হচ্ছে আলকাতরা মেশানো। ”
ইউশা শব্দ করে হাসে। দুপাশে মাথা নেড়ে
বলে,
“ তুমিও না!
আচ্ছা যাক গে,তুমি এখন এটা কাটবে? বাড়ির সবাইকে ডাকব?”
“ এই না না ,আগে এর ওপরে কিছু লেখো। তারপর…”
“ কী লিখব?”
তুশি ফিসফিস করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ শোনো,তখন যেটা বললাম ওটা তো আমাদের গোপন কথা। ওগুলো সবার সামনে বলা যাবে না। তুমি ওই কথাটারই প্রথম অক্ষর লিখে লিখে দাও।”
ইউশা হাসতে হাসতে কোণ ঘুরিয়ে লিখল,
-হমভড অর্থাৎ হ্যাপী মন ভাঙা ডে!
তুশি ফের কণ্ঠ চেপে বলল,
“ শোনো,কেক ঘরে নিয়ে যাই চলো। এখানে কাটার সময় হাত তালি দিয়ে ওসব বলা যাবে না। কেউ শুনে ফেললে!
এর চেয়ে চলো, ঘরে গিয়ে চুপিচুপি কাটি।”
“ আচ্ছা আচ্ছা এসো।”
তুশি ঘরে এসে বিছানায় কেক রেখে আসন করে বসল। হাত ইশারা করে ইউশাকেও বসাল পাশে। তারপর ছুরি দিয়ে নরম কেকে পোচ দিতে দিতে বলল,
“ হাত তালি দাও। আস্তে আস্তে বলো,হ্যাপী মন ভাঙা ডে ফর তুশি। আরে দাও… কী হলো?”
ইউশার মুখখানা হুট করেই কালো হয়ে গেল। নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে রইল তুশির মেদুর চেহারায়।
মেয়েটার এই হাসি,এই স্ফূর্তি,আর এই কেক নিয়ে হইহই করে ও কী প্রমাণ করতে চাইছে? কষ্ট হচ্ছে না? বুক পুড়ছে না ভাইয়ার জন্যে? কিন্তু না বোঝাতে চাইলেও তো বোঝে ইউশা। জানে, মেয়েটার ভেতর ওরই মতো ছিন্নভিন্ন হচ্ছে । কিন্তু ইউশা মন মরা থাকলে যেমন সবাই ধরতে পারে,তুশিরটা ধরার সাধ্য কারো নেই। দেখলে কেউ বুঝবেই না,গতকাল রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে বসে এই মেয়েটা অত হাহাকার করে কেঁদেছিল! ইস,সেও যদি এইভাবে শক্ত হতে পারতো!
ইউশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাত তালি দিয়ে দিয়ে বলল,যা বলার।
তুশিকে দেখে মনে হচ্ছে, আনন্দ যেন ধরে না। ছুরি নাড়ছে আর মাথা নেড়ে নেড়ে সুর দিয়ে বলছে,
“ কান্নাকাটির দিন শেষ, কেক কাটার বাংলাদেশ।”
তারপর এক টুকরো তুলে ইউশার সামনে ধরল। জিজ্ঞেস করল,
“ কেমন? মজা?”
অন্ধকার আদলেই মাথা নাড়ল মেয়েটা। বোঝাল,মজা। তুশি একটু তুলে নিজের মুখে দেয়। চোখ তুলে ঠোঁট টেনে হাসে। পরপর গলার খাঁজে নামিয়ে নেয় চিবুক। হুট করেই তার সব হাসি উবে গেল। চোখের ভেতর এক পশলা বিষাদের গাঢ় ছায়ায় তলিয়ে এলো পুরোটা। নিজের মুখে কেক পুরতে পুরতে ঢোক গিলল তুশি। টুপ করে এক ফোঁটা জল ছিটকে এসে গালের ওপর পড়ল। তাড়াহুড়ো করে মুছতে নিলে,চট করে হাতটা ধরে ফেলল ইউশা।
“ নিজেকে লুকোচ্ছো কেন,তুশি?”
তুশি চোখ তুলে চাইল। টলমলে চোখজোড়া দেখে ভেতর সুদ্ধ কেঁপে উঠল ওর। হাত বাড়িয়ে বোনের মাথাটা নিয়ে এলো বুকে। একটা ভরসা,আর আস্থার জায়গাই যেন খুঁজছিল তুশি। দুহাতে আকড়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল অমনি।
হাঁসফাঁস করে আওড়াল,
“ আমি কেন ভালোবাসতে গেলাম ইউশা? এখন প্রত্যেকটা মূহুর্ত আমার বুকের পাঁজর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমি গলেপচে যাচ্ছি। ওনার ওই একটুখানি প্রত্যাখান, ওই একটা ‘ভালোবাসি না’ শব্দে আমার গোটা জীবন ক্ষয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা পলকে বুঝতে পারছি,আমি আসলে বেঁচে নেই। আমি কেন ভালোবাসতে গেলাম!”
ইউশা কাঁদল না৷ মাথায় হাত বুলিয়ে ঢোক গিলল শুধু।
“ আমি তোমাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবো তুশি? আমি নিজেও তো এই একই নৌকার মাঝি। শুধু আমাদের তফাত কী জানো? আমি জানি আমার অয়ন ভাই কোনোদিন আমায় ভালোবাসবেন না। আর কোনোদিন ওনাকে পাব না আমি। ওনার উপস্থিতিও এখন আমার কাছে কাঁটার মতো লাগে। ওনার চোখে চোখ পড়লেও আমি কেটেছিঁড়ে যাই। কারণ ওই দৃষ্টিতে আমি আমাকে নয়,কেবল তোমাকে দেখি,তুশি। আর দেখি,যাকে নিজের স্বপ্নপুরুষ ভেবে বসেছিলাম,তার স্বপ্ন কেবল আমার বোনের জন্যে তৈরি। …”
আমি জানি না আমাদের দুজনের মাঝে কার কষ্টের পরিমাণ কতটা গভীর,কার এক তরফা প্রেম,কার না পাওয়ার যন্ত্রণা অনেক বেশি!
এই যে অয়ন ভাই তোমাকে ভালোবাসে বলে অজান্তেই আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমার কাছে একটা কারণ আছে দুঃখ পাওয়ার। কিন্তু তুমি! ভাইয়ার যে তোমাকে ফেরানোর কোনো কারণই নেই। আর এই অকারণে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জ্বালা কি খুব বেশি ধারালো? নিজের দোষ জেনে শাস্তি পাওয়া একরকম হলেও, দোষ না জেনে শাস্তি পাওয়া নিশ্চয়ই ভয়ানক হবে! কিন্তু আমি তোমাকে এই শাস্তির আগুনে বেশিদিন পুড়তে দেবো না। আজ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তুশি, তোমার আর ভাইয়ার মিল আমি করিয়েই ছাড়ব।”
শওকত আজ অনেকদিন পর অফিসে গিয়েছিলেন। নিজের দোষে এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। সাইফুল একা একা সামলাবেই বা কতক্ষণ!
কিন্তু অফিস বন্ধ করার একটু আগেই বাড়ি এলেন তিনি। ঠিক সন্ধ্যার পরপর। অন্যসময় ফেরার সাথে সাথেই তিনি ঘরে যান না। দু মিনিট সোফায় বসেন,ঠান্ডা জলে গলা ভেজান,এরপর আরামসে কামরার পথ ধরেন। আজকেও এসে বসলেন সেখানে। তনিমাকে ডাকবেন এর আগেই চোখের সামনে একটা বাটি ধরল তুশি। শওকত পাশ ফিরে চাইলেন। বাটিতে এক পিস কেক দেখে বললেন,
“ তুই বানালি?”
“ নাহ,ইউশার মা বানিয়েছে।”
শওকত ওর হাতটা ধরে এনে নিজের পাশে বসালেন। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,
“ ইউশার মা তো তোরও মা। আর কত রাগ করে থাকবি?”
“ রাগ নেই, পড়ে গেছে। এখন যা আছে, অভিমান। এটা মিটতে সময় লাগবে।”
“ আবার এই এক অভিমানেই সার্থর মতো দুই যুগ পার করে দিস না।”
তুশি মৃদূ হেসে বলল,
“ আমার মা তো ওনার বাবার মতো এত ভয়ানক অপরাধ করেনি। তাহলে আমার এক যুগ কেন লাগবে?”
শওকতের সাবলীলতা মুছে গেল।
“ খোঁচা দিচ্ছিস?
অবশ্য সবাই যখন দেয়,তুই বাদ যাবি কেন?”
“ খোঁচা দিচ্ছি না বাবা। শুধু সত্যিটা বলেছি। আপনার হয়ত শুনতে ভালো লাগেনি। দুঃখিত!”
“ নাহ,ঠিকই আছে। আসলে কিছু অন্যায় থাকেই এমন, যার বোঝা চাইলেও নামিয়ে দেয়া যায় না।”
তুশি চুপ করে রইল। শওকত শুধালেন,
“ সার্থকে বলেছিলি, আমার কথাটা?”
দুপাশে মাথা নাড়ল সে। “ না।”
“ বলবি না?”
তুশি স্পষ্ট জানিয়ে দিলো,
“ না।”
শওকতের মুখের আঁধার ছড়িয়ে পড়ল।
ও বলল,
“ মাফ করবেন বাবা,কিন্তু সত্যি কথা এটাই যে আপনার হয়ে আমি ওনাকে কোনো সুপারিশ করতে পারব না। অবশ্য এই ক্ষমতা আমার নেইও। কিন্তু যদি থাকতোও আমি তাও করতাম না।”
“ কিন্তু কাল যে বললি,মন থেকে ক্ষমা চাইলে সবাই ক্ষমা করে দেবে! তাহলে?”
“ আমার যতটুকু জ্ঞান,আমি ততটুকুই বলেছিলাম আপনাকে। ওনার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে বলেছিলাম। ওনার থেকে ক্ষমা এনে দেবো বলিনি।”
শওকতের কণ্ঠ নিভে এলো,
“ ওহ!”
তুশি হাতটা ওনার হাতের ওপর রাখল। বলল,
“ বাবা,সেদিন আমি যখন ওনার কাছে সব শুনেছিলাম,আমার আপনার ওপর খুব রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, যে মানুষটার জন্যে পৃথিবীর এতগুলো মানুষ ভুগেছে, সে কোনো শাস্তি পায়নি কেন? আপনার সাথে কথা বলব না, বলব না করেও
অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব পার করে,আপনার ঘরে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু আমার রাগের এক ফোঁটাও দেখাতে পারিনি। আপনার অনুশোচনা,কান্না,আর ভেতর ভেতর গুমড়ে মরার অনুভূতি বুঝতে পেরে আমার সব রাগ-ক্ষোভ পড়ে যায়। তবে সেটুকু শুধু আমার নিজের জন্যে। কোনো না কোনোভাবে আপনার কারণে আমার পুরো শৈশব,আমার কৈশোর,সব নষ্ট হয়েছিল এটা সত্যি। আপনি জানেন বাবা,আমার বয়স যখন আট বছর? দাদির খুব জ্বর হলো। টানা চারদিন কাজে যেতে পারেনি। ঘরে কোনো খাবার ছিল না।
এক বেলা আমি পানি খেয়ে থাকতাম। যখন কোনো খাবারের দোকানের কাছ থেকে হেঁটে যেতাম,আমার পেট উগলে আসতো খিদেতে। কিন্তু কেউ আমাকে একটা দানাও ফ্রিতে খেতে দেয়নি। আর না,বস্তির কেউ এসে জিজ্ঞেস করেছে,তোরা খেয়েছিস? ওদিকে দাদিও খাটে শুয়ে শুয়ে অসুস্থতায়,খিদেয় কাতরাচ্ছিল । আমি যে কিছু করে খাওয়াব,ওই ক্ষমতাও ছিল না। অসহায়ের মতো যখন রাস্তায় বসেছিলাম, আমার চোখের সামনে একটা লোক রুটি খেয়ে বাকিটা ফেলে দিয়েছিলেন। আমি ছুটে গিয়ে সেটুকু তুলে খেয়েছি। এরপরই আমার মনে হলো, এভাবে চেয়ে চেয়ে খাবার পাওয়া যাবে না। পেট ভরতে হলে,অন্য রাস্তা নিতে হবে। সেই প্রথম একটা ভ্যান থেকে এক থোকা কলা থাবা দিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেলাম আমি। দোকানি কিছু দূর এসে আর তাড়া করেননি। ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম চুরি। সেদিন ওই কলা আমি আর দাদি পেট ভরে খেয়েছিলাম জানেন।”
বলেই তুশি এপাশ ফিরে চোখের পানি ছিটকে ফেলে দিলো।
নাক টেনে নিজেকে সহজ করে বলল,
“ কিন্তু আমার এসব নিয়ে কোনো আফসোস নেই। আমি নিজেকে,নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। আর না এই ভাগ্যের জন্যে আমার আপনার ওপরে কোনো ক্ষোভ আছে। যা আছে, তা কৃতজ্ঞতা,মায়া,ভালোবাসা।
কারণ,আমার জীবনে আপনিই প্রথম আমার মাথায় হাত রেখে আমাকে মা ডেকেছিলেন। আমাকে নিজের মেয়ে বানিয়েছিলেন। বাবা ডাকার অধিকার দিয়েছিলেন। আমার ক্ষমাটাও সেজন্যেই ছিল। কিন্তু বাবা, আর বাকি মানুষগুলো?
বড়ো মা, আপনার বড়ো ছেলে, ঠকে যাওয়া সেই জেসমিন আর তার অনাগত সন্তান! এদের হয়ে ক্ষমা করার অধিকার তো আমার নেই। ওদের ক্ষমা ওদের কাছে। যদিও বড়ো মা এত কিছু জানেন না। কিন্তু আপনার মেজো ছেলে সব জানে। সে নিজের চোখে তার পরিবারকে কষ্ট পেতে দেখেছে। আপনার সব অন্যায় জেনেও নিজের ভেতরে চাপা দিয়েছে কেবল,পরিবারের ভালোর জন্যে। তার কাছে তো আপনি অনেক বড়ো অপরাধী বাবা! আর তাই সে-ই ঠিক করবে আপনাকে সে ক্ষমা করবে কি না। এই বিচার,এই সিদ্ধান্ত শুধু তার বাবা। এখানে আমি কেউ না,কিচ্ছু না।”
শওকত মাথা নুইয়ে চুপ করে রইলেন। কথার পিঠে যুতসই উত্তর জানা নেই৷ হঠাৎই তনিমা এলেন সেখানে। হাসিহাসি মুখ করে শুধালেন,
“ বাবা মেয়েতে এত কী কথা হচ্ছে?”
কণ্ঠ পেতেই দুজন ঠিকঠাক হয়ে বসল। তনিমা ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে এসেছেন। স্বামীর দিকে এগিয়ে দিলেন সহাস্যে। তুশি জবাব দিলো ঝটপট,
“ বাবাকে কেক খাওয়াচ্ছিলাম।”
“ ওহ,কেক?
তোমার মেয়ে আজ কী করেছে জানো? কী একটা সেলিব্রেট করবে বলে কেক বানিয়েছে। আবার ইউশাকে নিয়ে কেটে, সবার রুমে রুমে দিয়ে আসছে।”
শওকত টেনেটুনে হাসলেন,
“ বাহ! ভালোই তো।”
তারপর ফোস করে শ্বাস ফেলে গ্লাসে চুমুক দিলেন তিনি। পুরুষালি মলিন মুখটায় চেয়ে তুশির কষ্ট হলো। নীরস চিত্তে ভাবল,
“ আমি জানি বাবা, আমার কথাগুলো আপনার খুব খারাপ লেগেছে। কিন্তু আমি কী করব বলুন! আমি তো সিনেমার সেই নায়িকা নই,যে এক হাতে সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। এক বাবা-ছেলের বছরের পর বছর ঘটে আসা নীরব দ্বন্দ্বে আমি স্রেফ তৃতীয় ব্যক্তি। এসবে হস্তক্ষেপ করার সাধ্য আমার নেই। যদি আপনার ছেলের কখনো মনে হয় , সে আপনাকে ক্ষমা করবে,তো করবে। কারো কথাতে,সুপারিশে ক্ষমা পাওয়াও যা,না পাওয়াও তাই। কোনো তৃপ্তি নেই এতে। তাই আমি চাই আপনি পরিতৃপ্ত হন। আপনার ছেলে আপনাকে মন থেকে মাফ করুক। আপনারাও বাকি পাঁচটা বাবা ছেলের মতো হন। কিন্তু সেই দিন কবে আসবে,আদৌ আসবে কিনা আমি জানি না!”
তনিমা জিজ্ঞেস করলেন,
“ তুশি,অয়নের কেকটা দিয়েছিলি? ওতো সেই তখনই বলে গেল,এসে খাবে।”
“ ওটাতো আমি ইউশাকে দিয়ে আসতে বলেছিলাম।”
“ কিন্তু সে যে ঘরে চলে গেল। বলল,অনেক পড়া বাকি।”
“ হ্যাঁ ও আজকাল খুব পড়ছে। যাই, আমিই যাই।”
তুশি অয়নের ঘরে যাচ্ছিলই, হঠাৎ পিছু ডাকল ইউশা,
“ তুশি?”
“ হুউ?”
ফিরে চাইল সে। ওকে দেখেই বলল,
“ আরে এইত তুমি। তোমাকে যে বললাম ওনার কেক দিয়ে আসতে। দিলে না কেন?”
ইউশার জবাব তৈরি,
“ মনে ছিল না”
“ অয়ন ভাইয়ের কেক দিতে তোমার আবার মনে নেই বলছো? এও বিশ্বাস করতে হবে এখন? কী হয়েছে সেটা বলো!”
“ তেমন কিছু না তো। আসলে আমার পরশু থেকে এক্সাম। তাই খুব পড়ছি। ভালো রেজাল্ট করতে হবে না?”
তুশি মাথা ঝাঁকাল,
“ হুউউম সে তো হবেই। নাহলে যে ডাক্তারের সাথে মানাবে না।”
ইউশা বিরস হেসে বলে,
“ তুমিই দিয়ে এসো, যাও।”
অথচ শেষ শব্দ অবধি আসতে আসতে ওইটুকু হাসিও ফুরিয়ে গেল তার। অয়নের সাথে তুশিকে কথা বলতে দেখলে ওর খারাপ লাগে না কখনো। খারাপ লাগে তখন,যখন তুশির দিকে অয়নের মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা চোখজোড়া দেখে। যখন তুশির সাথে আগ বাড়িয়ে গল্প করতে আসা অয়নের আড়ালে,এক ছটফটে প্রেমিককে দেখতে পায়। এসব দৃশ্যে ইউশার আত্মায় টান পড়ে। বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে হৃদয় খুবলে আনার মতো টান।
তুশি বলল,
“ সে দিয়ে আসছি। কিন্তু… ইউশা, আমার না কিছু ইংরেজির অর্থ লেখা বাকি। আবার উচ্চারণটাও। আমি যা যা পারি না সব দাগ দিয়ে দিয়ে রেখেছি। তুমি একটু আমাকে লিখে দেবে?”
ইউশা কিছু বলতোই,হঠাৎ চোখ পড়ল তুশির পেছনে। সার্থ আসছে। অমনি ও সোজা হলো। জোরে জোরে বলল,
“ আমি পারব না গো। আমার সময় নেই। তুমি এক কাজ করো ,তুমি অয়ন ভাইয়ের কাছে যাও।”
অমনি সার্থ দাঁড়িয়ে গেল। তাকাল ঘাড় ঘুরিয়ে। ইউশা ভান করল দেখেইনি। তুশির ভেতর দোটানা,
“ ওনার কাছে যাব?”
ইউশা এক মস্ত টান দিলো কথায়,
“ হ্যাঁয়ায়ায়া। কেন যাবে না? তোমার তো সব সময় ওনার কাছেই গিয়ে পড়া উচিত তুশি। উনি ইংরেজিতে কত দূর্দান্ত রেজাল্ট করেছেন তুমি জানো? ওনাদের যে মোটা মোটা বইগুলো,সব তো ইংরেজিতেই লেখা। যাও যাও,ওনার কাছে যাও। অয়ন ভাই তোমাকে সব একেবারে হাত ধরে ধরে শিখিয়ে দেবে।”
তুশি অবোধ বালিকার মতো ঘাড় হেলাল,
“ আচ্ছা।”
তারপর পিছু ফিরতেই থমকাল একটু। একদম মুখোমুখি সার্থ দাঁড়িয়ে। শক্ত হাত মুঠো করা। গতানুগতিক কপালে সেই এক গুচ্ছ ভাঁজ। গৌড় বর্ণের মুখটা দেখে অনুভূতিতে তুশির বুক ধ্বক করে উঠল। অথচ এক পল চেয়েই চোখ নামিয়ে ফেলল আবার। পরপর বাটি হাতে সুরসুর করে অয়নের রুমে ঢুকে গেল সে।
সহসা দন্তপাটি খিচে ধরল সার্থ। মেজাজ খারাপ করে চাইল ইউশার দিকে। অথচ মেয়েটা দাঁত বের করে হাসল। খুব খাতির করার মতো শুধাল,
“ কী খবর ভাইয়া? তুমি আজ এত তাড়াতাড়ি এলে?”
সার্থ নাক ফুলিয়ে বলল,
“ কোথায় যাচ্ছিস?”
ইউশা যাচ্ছিল চা বানাতে। পড়ার সময় ঝিমুনি কাটাতে সুবিধে হবে বলে। অথচ বলল,
“ নিচে,টিভি দেখব।”
সার্থ ফুঁসে উঠল একটু,
“ তোর না সময় নেই? অনেক ব্যস্ত! টিভি দেখবি কী করে? ”
“ হ্যাঁআয়ায়ায়া,নেই তো। কিন্তু বিনোদনেরও তো দরকার আছে বলো, ভাইয়া। সব সময় শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলে মেজাজ তোমার মত খিটমিটে হয়ে যাবে না?”
সার্থ তপ্ত চোখে চাইতেই, কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ না মানে,বলতে চাচ্ছিলাম শরীর খারাপ হয়ে যাবে না? আগেরটা ভুলে মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছিল।”
পরপরই সাগ্রহে বলল,
“ কিন্তু কেন ভাইয়া? তুশিকে অয়ন ভাইয়ের ঘরে পাঠালাম বলে তুমি কি রাগ করলে? ওকে কি তাহলে তোমার ঘরে যেতে বলব?”
“ বলেছি আমি?”
ইউশার স্বর মিনমিনে,
“ ভেবেছিলাম বলবে।”
সার্থ কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“ এত আগ বাড়িয়ে ভাববি না।”
যেতে নিলেই ইউশা পেছন থেকে বলল,
“ ওকে তোমার ঘরে পাঠাব কিনা,বললে না তো!”
সার্থ কড়া চোখে ফিরে তাকাল। ভোলাভালা,নিষ্পাপ মুখে মাথা নুইয়ে নিলো ইউশা। ও রুক্ষ স্বরে বলল,
“ কোনো দরকার নেই।”
হনহনে পায়ে চলে গেল তারপর। ইউশা হতাশ চোখে ভাবল,
“ ভাঙবে, তবু মচকাবে না।”
তুশি বাটি টেবিলে রাখতেই ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলল অয়ন। হাসলও সাথে সাথে,
“ হেই তুশি,বোসো বোসো।”
নিজের পাশ দেখালেও, তুশি পাশে বসল না। বসল কাছেপিঠের ওই চেয়ারটায়।
বলল অবাক হয়ে,
“ আপনার সেই ক্লাস এখনো শেষ হলো না?”
“ ওটা শেষ। আমি এতক্ষণ একটা ভিডিও কনসালটেশন করলাম।”
“ সেটা কী?”
“ এটা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের যারা টাকার জন্য ডাক্তার দেখাতে আসতে পারছে না,তাদের প্রযুক্তির সাহায্যে একটা ভিডিওর মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া। তাদের সমস্যার কথা শোনা, তারপর ওষুধপত্র সাজেস্ট করা। এটাতে অনেকে ফি’স নেয়,কিন্তু আমি ফ্রিতে দিচ্ছি।”
তুশি মুগ্ধ হয়ে বলল,
“ আপনি খুব ভালো মানুষ!”
“ ইউ অলসো।”
ও ভ্রু বাঁকাল,
“ কীভাবে বুঝলেন?”
অয়ন অবিলম্বে বলল,
“ ভালো নাহলে কেউ নিজের ভাঙা পা নিয়ে অন্যকে হাসপাতালে নেয়? তাও ভ্যান চালিয়ে।”
তুশি ক্লান্ত শ্বাস ফেলল,
“ আপনারা সবাই এখনো ওখানেই পড়ে আছেন। ওটা তো একটা মানুষ হিসেবে মানুষের দায়িত্ব।”
“ কিন্তু সবাই তো এই দায়িত্ব পালন করে না। সোস্যাল মিডিয়ায় দেখতে পাবে,কীভাবে একজনের বিপদ দেখেও আরেকজন তাকাতে তাকাতে পাশ কাটিয়ে যায়।
আচ্ছা ছাড়ো এসব। তোমার কেকের কথা বলো, কী উপলক্ষে বানালে বললে না তো।”
তুশি কাঁধ উঁচাল,
“ এমনি।”
“ সত্যি?”
“ হু।”
“ ওকেই,তা তোমার পড়ার কী খবর? আর তো বইটই নিলে না।”
তুশি মন খারাপ করে বলল,
“ নিয়ে কী করব, ইউশার তো পরীক্ষা। আপনিও ব্যস্ত।”
অয়নের চোখেমুখে উদ্বেগ,
“ কে বলেছে আমি ব্যস্ত? তোমার জন্যে আমি সব সময় ফ্রি!”
“ তাই?”
“ অভিয়েস্লি।”
তুশি খুশি হয়ে বলল,
“ ইস, সবাই যদি আপনার মতো এত মিশুকে,ভালো আর মজার হতো! আপনি কিন্তু সব সময় এরকমই থাকবেন।”
অয়নের চোখমুখ পাল্টাল। বিমোহের একটা সূক্ষ্ণ ধারায় মজে এলো নজর। কণ্ঠ খাদে নিয়ে বলল,
“ আর তুমি সব সময় এমনই হাসবে, তুশি। তোমার হাসিটা ভীষণ সুন্দর! গালের পাশে একটা আস্ত পুকুর জেগে ওঠে। না হাসলে ওটা দেখা যায় না।”
তুশি সব প্রশংসা বাদ দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল তৎক্ষনাৎ ,
“ আর ইউশার হাসি, ওর হাসি কেমন লাগে আপনার!”
অয়ন ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
“ ইউশার হাসি?”
“ হুউউ। ওর হাসি সুন্দর নয়?”
অয়ন চোখের পাতা একবার ডানে বামে ফেলল। কপাল গুটিয়ে বসেছে একটু। ইউশার হাসিটা আসলে কেমন? সেভাবে কখনো খেয়াল করেনি তো!
সার্থ এসির পাওয়ার একদম তলানিতে দিয়েছে। তবুও মনে হচ্ছে মাথার তালুর জ্বালাপোড়া যাচ্ছে না। ওইটুকু মেয়ে,ওইটুকু মেয়ে যাকে ও এক হাতে তুলে একটা আছাড় মেরে অজ্ঞান করে দিতে পারবে সে ভাব নিচ্ছে ওর সাথে? চোখে চোখ পড়লে এমন ভান করছে যেন দেখতেই পায়নি। কেউ নেই এখানে?
ওর কীসের এত ভাব? সার্থ বলেছে,ভালোবাসে না সেই রাগ দেখাচ্ছে? বেশ করেছে বলে। ওর ইচ্ছে, ও ভালোবাসবে কীনা। তাতে এইভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কী আছে? কীসের এত তেজ!
আবার ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে অয়নের ঘরে যাচ্ছে। সারাদিনও নিশ্চয়ই এসবই করে বেড়ায়। শুধু শুধু পড়াশোনার নাটক। পড়তে তো দেখে না। টইটই করে ঘুরছে। হাতের মধ্যে ওরনা নাচিয়ে হাঁটছে। বিরক্তিকর মেয়ে একটা! সার্থের চোখ পড়ল আয়নায়। স্বীয় চিবুক পাথরের মতো কঠিন হয়ে আছে। আশ্চর্য, এই কাঠিন্যতা কীসের?
শ্বাস তো স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছে,তাহলে এমন হিঁসহিঁস শব্দ হচ্ছে কেন? ও দুই গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। ওই চোর এসেই ওর সব পুরো উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। মেজাজের দফারফা করে ফেলছে একেবারে। মন চাইছে,হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে একদম জেলে ভরে দিতে। সারাদিন সার সার করে কাঁদবে,ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন বলে চ্যাঁচাবে বুঝবে মজা।
সার্থ রাগে-ক্ষোভে গায়ের জামা খুলে ছুড়ে মারল মেঝেতে। অমনি কেউ একজন বলল,
“ কী ব্যাপার,মাথাটা খুব গরম মনে হচ্ছে?”
সার্থ তাকাল।
জয়নব এসেছেন। অমনি ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ দিদুন,এসো।”
বৃদ্ধা খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। ফ্লোরে পড়ে থাকা ইউনিফর্মটা তুলতে গেলে,বাধ সাধল সার্থ।
হাত বাড়িয়ে তুলল নিজেই।
“ বোসো।”
বিছানায় বসলেন তিনি। ও বলল,
“ আজ হঠাৎ আমার ঘরে?”
“ তোমার খবর নিতে এলাম। দিনকাল কেমন যাচ্ছে?”
সার্থ সন্দেহী চোখে চাইল। হেসে ফেললেন জয়নব।
“ অমন করে তাকিও না। মনে হচ্ছে পুলিশের ডেরায় বসে আছি। জেরা করবে এক্ষুনি।”
সার্থ চোখ সরিয়ে, নিচের ঠোঁট কামড়াল।
জয়নব বললেন,
“ বোসো এখানে।”
“ ইচ্ছে করছে না। এভাবেই বলো!”
ফোস করে শ্বাস ফেললেন প্রৌঢ়া। বললেন,
“ তোমার মা আমার ঘরে এসছিল। বলল,তুমি নাকি তুশির সাথে সম্পর্কটা আর টানতে চাইছ না।”
সার্থ চুপ করে রইল। দাঁতের নিচে এখন নিচের ঠোঁট পিষছে। উনিই বললেন,
“ দাদুভাই, জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নিতে হয়। আমরা তোমাকে কখনো কিছু নিয়ে জোর করিনি। কিছু চাপিয়েও দিইনি। এবারেও দেবো না। তোমার বাবাকে নিজেদের পছন্দে বিয়ে করিয়েছিলাম। হ্যাঁ সে মানা করেনি,কিছু বলেওনি। কিন্তু তার ফল একটু হলেও আমার সায়ন দাদুভাই ভুগেছে। তোমরাও যথেষ্ট ভুগেছ। সেদিন থেকেই আমি শিখেছি,নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর ঠেসে দিতে নেই। তাই তোমার জীবন,তুমিই বেছে নেবে তোমার কী করা উচিত! তবে একটা কথা বলব যা করবে তাড়াতাড়ি, কারণ সময় গেলে সাধন হবে না।”
সার্থ ফিরল দাদির মুখের দিকে। বুঝতে না পেরে বলল,
“ মানে!”
“ দেখো,আমার বয়সটা কিন্তু এমনি এমনি বাড়েনি। চুলগুলোও অকারণে পাকেনি কিন্তু।
এত বছরে জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ভালোই হয়েছে। কিছু দেখলে বুঝতেও পারি। “
“ কী বলতে চাইছ তুমি দিদুন?”
জয়নব রয়েসয়ে বললেন,
“ তুমি অয়ন আর তুশিকে কখনো খেয়াল করেছ?”
তুরন্ত সার্থের চেহারা টানটান হয়ে গেল। গুটিয়ে রাখা চোখজোড়া সজাগ হলো তড়িৎ । জয়নব বললেন,
“ আমি ওদের অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করেছি। আজ সকালেও করলাম। আর, একটু আগে এ ঘরে আসতে আসতে পাশের ঘর থেকে ওদের হাসাহাসির শব্দও শুনলাম। অয়ন জোয়ান ছেলে। তুশিরও বয়স কম। বেশি মেলামেশায় হিতে কখনো বিপরীত হয় কিনা ভেবে দেখেছ?”
সার্থ সাথে সাথে বলল,
“ হলে হবে৷ আই ডোন্ট কেয়ার!”
“ সত্যিই কি তাই?”
সার্থের কণ্ঠ দৃঢ়,
“ হ্যাঁ তাই। তবে অয়ন আমার ভাই। ও নিজের স্ট্যাটাস নিয়ে খুব পজেসিভ। ও এমন কিছুই করবে না যাতে ওকে নিয়ে কেউ কখনো দুটো বাজে কথা বলতে পারে। ওকে আমি চিনি। তুমিই বেশি বেশি ভাবছো!”
জয়নব মুচকি হাসলেন,
“ দাদুভাই কে কী করবে, না করবে আমি জানি না। আমার যা মনে হয়েছে, তোমাকে শুধু তাই বললাম। আগুন আর বরফ কখনো একসাথে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। পানি হয়ে সব ভাসিয়ে দেয়।”
তারপর একটু দম নিয়ে বললেন,
“ তুশির অতীত ধরে যদি বলি,ও তো একটা চোর ছিল তাই না? অথচ ওই চোর মেয়েটার চোখে তোমার জন্যে আমি অঢেল সম্মান দেখেছি। সেটা কিন্তু ভালোবাসাও হতে পারে। আর আমি তোমাকে যতটুকু চিনি,কেউ তোমাকে তোমারই সামনে ভালোবাসবে আর তুমি তা বুঝবে না,তা হতেই পারে না।”
সার্থের কপাল কুঁচকানো। চোখ নিচে। শুকনো ঠোঁটটা জিভ দিয়ে ভেজাল।
চোখের পর্দায় ভেসে উঠল সুরম্য কিছু অতীত। বাড়ি ফেরা মাত্রই তুশির তাকে দেখে ছটফটানো,ওই প্রতিক্ষীত দৃষ্টি,ছাদে ওর পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, হাতে কেক নিয়ে খাওয়াতে এসে সেই চেয়ে থাকা, ওর বুকের ঘায়ে ওষুধ লাগাতে লাগাতে চাউনির ধরণ,আর তারপর বলা- আপনারই তো রক্ত।
চট করে চোখের পাতা নেড়ে মাথা থেকে ওসব ঝেড়ে ফেলল সার্থ। শুনতে পেলো জয়নব বলছেন,
“ আমি আজ একটা কথা বলি দাদুভাই,শোনা না শোনা তোমার ব্যাপার। তুমি যদি বুঝে যাও তুশি তোমাকে ভালোবাসে, তাহলে একটা ফয়সালায় এসো। তার আগে নিজেকেও প্রশ্ন করো,তুমি কী চাও!
যদি তুশিকে চাও,সম্পর্কের রাশ টানো। দুরুত্ব ঘোচাও। আর যদি ওকে না চাও তবে চলতে দাও এমন। কিন্তু সব জেনেবুঝে অবহেলা করে ঝুলিয়ে রেখ না। মানুষ এক বেলা না খেতে পেরে মরে না,মানুষ মরে অবহেলায়!”
সার্থের অগোছালো নজর অন্যদিকে। শক্ত মুখে বলল,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪০
“ আমার যা বলার,মাকে বলে দিয়েছি।”
বৃদ্ধা নিরাশ হলেন। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
“ বেশ, তবে যা হচ্ছে হোক। তাহলে আমরা দুজন একটা লড়াইয়ে আসি চলো। তোমার পুলিশী তীক্ষ্ণতা না আমার বয়সের অভিজ্ঞতা, দেখি কে জেতে! বাজি রইল কেমন? আর আমি জানি এই বাজিতে তুমি গো হারান হারবে।”