কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪২
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সকাল সাতটা বাজে।
বাড়ির সব কাজ শেষ করে সৈয়দ নিবাসের দুই গিন্নি মাত্রই দু কাপ চা নিয়ে বসেছেন। রেহণূমার চোখমুখ চকচক করছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বেশ খুশি তিনি। তনিমা জিজ্ঞেস করলেন,
“ কী রে,ঠোঁটে দেখছি হাসি ধরছে না। ব্যাপার কী?”
ভদ্রমহিলা যেন এটুকু বলার অপেক্ষাতেই ছিলেন। অমনি স্ফূর্ত চিত্তে বললেন,
“ আপা, তুশিকে যে কাল কেক বানিয়ে দিলাম ও সেটার খুব প্রশংসা করেছে জানো! আবার আমাকে ধন্যবাদও দিয়েছে।”
তনিমার চোখ মুঁদে গেল। মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আহারে,মেয়ের জন্যে ছোটোটা কি ব্যাকুল হয়ে আছে! সামান্য একটু ধন্যবাদেও কেমন বাচ্চাদের মতো করছে দেখো।
বললেন,
“ আমি তো বলেছিলামই, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আরো কিছুটা সময় দিলে, তুশি তোর সাথে একদম স্বাভাবিক হয়ে যাবে দেখিস।”
রেহণুমা সহাস্যে ঘাড় নাড়লেন। যেন হবেই এরকম। হঠাৎ সচকিতে বললেন,
“ আচ্ছা আপা,তুমি তো এখনো বললে না সার্থ কাল কী বলেছিল!”
তনিমার হাসিটা মুছে গেল অমনি।
আমতা-আমতা করে বললেন,
“ তেমন করে কথা হয়নি রে৷ ও ব্যস্ত ছিল তো।”
“ ব্যস্ত! ওমা,ও না তখনই ফিরল। ঐসময়ে আবার কীসের ব্যস্ততা? আপা,তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছো?”
“ কই,কী লুকোবো?”
রেহনূমা চুপ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,
“ সার্থ বিয়ের ব্যাপারে মানা করে দিয়েছে তাই না!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তনিমা মুখ কালো করে মাথা নুইয়ে ফেললেন। রেহণূমার আনন্দে মাখা চেহারাটাও নিভে গেল সাথে। মন খারাপ করে হাত থেকে কাপ নামিয়ে রাখলেন তিনি। গলা দিয়ে এখন কিছু নামবে না। দুজনের দীর্ঘ শ্বাসঃপ্রশ্বাসের মাঝেই কারো কৌতূহলী স্বর ছুটে এলো,
“ কার বিয়ের কথা হচ্ছে এখানে?”
চকিতে মাথা ঘুরিয়ে ফিরলেন তারা। বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠল অমনি। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গোল গোল চোখে পা থেকে মাথা অবধি রোকসানাকে দেখলেন এক পল।
একটা আঁটোশাটো ফতুয়ার সাথে জিন্স পরেছে। সেটার আবার হাঁটুর নিচে অল্প করে ছেড়া। ঘাড় সমান চুল পনিটেইল করে বাঁধা। পায়ে চকচকে কেডস। পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমে ঢলছে আইরিন। রেহণুমা অবাক হয়ে বললেন,
“ এই সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
রোকসানা কপাল কুঁচকে বললেন,
“ ড্রেসাপ দেখেও বুঝতে পারছো না? অবশ্য বুঝবে কী করে! নিজে তো এসবের ধারেকাছেও যাও না। আমরা জগিং-এ যাচ্ছি।”
আইরিন চোখ ডলতে ডলতে বলল,
“ বাট মাম্মা আই ওয়ান্ট টু স্লিপ। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও।”
“ বেইবি, তুমি তোমার মামিদের কাছে থেকে থেকে একদম অলস হয়ে যাচ্ছো। তুমি জানো ,এ্যাবরোডে মানুষ এর চেয়েও ভোরে জগিং এ যায়? ইটস গুড ফর হেলথ মাই কিউটি।”
“ কিন্তু তুমি তো নিজেই কাল বারোটা অবধি ঘুমালে।”
রোকসানা রেগে রেগে বললেন,
“ কাল আমি জার্নি করে এসেছিলাম তাই ঘুমিয়েছি। এত কথা বলতে হবে না,চুপচাপ চলো।”
আইরিন ঠোঁট ফোলায়। এই জগিংয়ের ভূতটা হঠাৎ মায়ের ঘাড়ে চাপল কেন? নিজে যাবে যাক না,ওকেই বা টানছে কেন সাথে!
রোকসানা তনিমাকে বললেন,
“ আচ্ছা ভাবি শোনো, আমাদের আসতে আসতে নটা বাজতে পারে। তুমি আমার জন্যে টোস্ট আর গ্রীন টি রেডি করে রেখ। যেন এলেই পাই,কেমন?”
তনিমা ঘাড় কাত করলেন।
“ আচ্ছা।”
ভদ্রমহিলা পা বাড়াতে নিলেই পিছু ডাকলেন রেহণুমা,
“ বলছিলাম যে, রোকসানা শোনো!”
রোকসানা চ সূচক শব্দ করে বললেন,
“ সানা ছোটো ভাবি। আর কতবার বলব? অনলি সানা।”
“ হ্যাঁ মানে সানা, বলছিলাম কি ভাই এভাবে বাইরে না গেলে হয় না? আসলে পাড়ার সবাই মোটামুটি আমাদের চেনে তো। একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে তুমি, তাই আরকি বলছিলাম যদি চেঞ্জ করে যেতে।”
রোকসানা মুখের ওপর বললেন,
“ নো ওয়ে। আমি কেন চেঞ্জ করব? শোনো, কে কী মনে করল তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। ইটস স্মার্টনেস। তুমিও বরং এবার একটু স্মার্ট হও, ভাবি। আর কত দিন এরকম ম্যাড়ম্যাড়ে শাড়ি পরে ঘুরবে। আমার মত নিজেকে আপডেট করো। এমনিতেই তোমার গায়ের রং একটু চাপা। সব সময় সং সেজে ঘুরলে কেমন বোরিং লাগবে না?”
আইরিন চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। এই শুরু হয়ে গেছে! তনিমার ভারি মেজাজ খারাপ হলো। নিজে ফকফকে সাদা বলে,কিছু হলেই ছোটোটাকে গায়ের রং নিয়ে কথা শোনায়। কিন্তু উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন একমাত্র ননদ,বেড়াতে এসেছে আবার চলেও যাবে। তাই বললেন না কিছু। রেহণূমাও বরাবরের মতো নিশ্চুপ। স্বভাবে নরম না হলেও শ্বশুরবাড়ির কারোর সাথে তার তর্কে যাওয়ার ধাত নেই। অথচ তক্ষুনি কোত্থেকে ভূতের মতো হাজির হলো তুশি। হাই তুলতে তুলতে এসে দাঁড়াল। কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলল,
“ প্যান্ট শার্ট পরলে মানুষ আবার এস্মাট হয় নাকি! ওমা,তাহলে এতদিন বস্তিতে থেকেও আমি আপনার মতো এস্মাট ছিলাম? আর আপনি কিনা এটুকু এস্মাট হওয়ার জন্যে এতকাল বিদেশে পড়ে ছিলেন?”
সাথে খ্যাকখ্যাক করে হাসল মেয়েটা। চোখেমুখে উন্মত্ত বিদ্রুপ নিয়ে বলল,
“ ধ্যাত, এত পয়সা খরচা না করে আমার কাছে এলেই হতো। আমার থেকে নাহয় দুটো শার্ট প্যান্ট ধার দিতাম।”
রোকসানা বিহ্বল হয়ে বললেন,
“ মানে! অ্যাই তুমি কী বলতে চাইছো? আমি তোমার ওই বস্তির ফুটপাত থেকে কেনা জামাকাপড় পরতাম?”
তুশি কাঁধ উঁচাল,
“ পরলে অসুবিধে কী? আপনার প্যান্টও যে জায়গায় ছেড়া,আমারটাও একই জায়গায় ছেড়া! গাছ আপেলের হোক বা আলুর,শিকড় তো মাটি থেকেই ওঠে।”
রোকসানা চটে কিছু বলতে চাইছিলেন,তুশি কথা কেড়ে নিলো।
মূহুর্তেই কেমন শক্ত গলায় বলল,
“ আপনার কথা পরে শুনব,আগে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, সব সময় আমার মাকে এত খোঁচা দিয়ে কথা বলেন কেন? এসেছেন দুদিন,কিন্তু দুশো কথা খুচিয়ে বলা শেষ। আমাদের বস্তিতে বলে ননদিনী, কুটনা নানী,আপনিই বুঝি সেটা?”
তনিমার চোখ বেরিয়ে এলো। রেহণুমা জিভ কাটলেন। চাপা কণ্ঠে বললেন,
“ আহ চুপ কর।”
কিন্তু ক্রোধে গণগণ করে উঠলেন রোকসানা।
“ কী, কী বললে তুমি আমাকে?”
তুশিকে থামানো গেল না।
ফটরফটর মুখে খুই ফুটিয়ে বলল,
“ বলতে তো অনেক কিছু চাই,কিছু ফুপি দেখে বলছি না। আমি আবার বড়োদের রেসপেট করি। আপনিও আমাকে ফলো করবেন। আমার মা সম্পর্কে আপনার বড়ো হয় না? সব সময় ওনাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন ফুপি। ওনার গায়ের রং চাপা না কী সেটা আমার মা বুঝবে। এ নিয়ে আপনার এত সমস্যা কোথায়? ক্যাটক্যাটে ফরসা হলেই যদি সুন্দর হতো তাহলে মানুষ মুলা দেখে নাক কুঁচকাতো না। ”
রেহণুমা ছটফট করে তনিমার দিকে চাইলেন। অথচ মাথা নুইয়ে হেসে ফেললেন তিনি। ভদ্রমহিলা ফিসফিস করলেন বিহ্বল হয়ে,
“ আপা তুমি হাসছো? মেয়েটাকে থামাও।”
এদিকে আইরিন হতবাক,বাকরুদ্ধ। একবার তুশিকে দেখছে আরেকবার মাকে। তার মা এত কথা জানে,অথচ তুশিকে উত্তর দিতে পারছে না?
তুশি আরো কিছু বলতো,পূর্বেই ছুটে এসে ওর মুখটা চেপে ধরলেন হাসনা। অতি বিনয় নিয়ে বললেন,
“ মাফ করেন মা,এই মাইয়ার মুখ বন্দুকের গুলির মতন চলে। খালি কথা কয়। কিছু মনে কইরেন না।”
রোকসানা ফুঁসছিলেন। কিড়মিড় করে কিছু বলার আগেই চোখ পড়ল ওপরে। অফিসের জন্যে পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে বেরিয়েছেন সাইফুল। ভাইয়ের সামনে তো ভাইয়ের মেয়েকে কিছু শোনানো যাবে না। রাগক্ষোভ গিলে গজগজ করে হাঁটা ধরলেন ঘুরে। আইরিন পেছন পেছন ছুটল।
অধৈর্য হয়ে বলল,
“ মাম্মাম, মেয়েটা তোমাকে কত আজেবাজে কথা শোনাল, আর তুমি ওকে কিছু বললে না? ”
রোকসানা ফুঁসতে ফুঁসতে ভাবলেন,
“ বেয়াদব মেয়ে! তোমাকে একটা শিক্ষা না দিলে আমার এক ফোঁটাও শান্তি হবে না।”
হাসনা তুশির মুখ ছেড়েই মাথায় একটা চর মারলেন। তেতে বললেন,
“ সমেস্যা কি তোর? এত আজাইরা কথা কস ক্যা? হেয় তর মুরুব্বি না?”
“ তো কী করব? আমার মাকে কথা শোনালে আমি ছেড়ে দেবো নাকি! আমি এত ভালো মেয়ে নই।”
কথা শেষ হতেই, হুড়মুড় করে এসেই ওকে জড়িয়ে ধরলেন রেহণুমা। ফুঁপিয়ে বললেন,
“ মায়ের প্রতি এত টান! তাহলে দূরে দূরে থাকিস কেন? একটু নাহয় ভুল করেই ফেলেছি,তাই বলে এখনো রাগ করে থাকবি? সন্তান যখন অন্যায় করে,তখন কি বাবা-মা ক্ষমা করে দেয় না? তাহলে বাবা-মা অন্যায় করলে সন্তান ক্ষমা করতে পারে না কেন?”
তুশি উত্তর দিলো না। তবে অভিমানও জিইয়ে রাখল না আজ। দুহাত প্যাঁচিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে। রেহণূমার মনে হলো তার বক্ষপটের খা খা শূন্যতায় ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মমতার তাপে গলে যাচ্ছে ভেতরটা। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন অমনি। তুশি খুব করে চাইছিল শক্ত রাখবে নিজেকে। অথচ চোখের কোণ ছুঁয়ে কতগুলো স্রোতের লাইন নেমে নেমে এসে গলা অবধি থামল।
রেহণূমা দুহাতে ওর মুখটা তুলে বললেন,
“ এখন থেকে আমাকে মা বলে ডাকবি তো?”
চোখে জল নিয়েও,ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল মেয়েটা।
“ ডাকব। মাকে মা না ডেকে যাব কোথায়?”
রেহণূমা খুশিতে দিশা হারিয়ে ফেললেন। মেয়ের কপালে, মাথায় চুমু খেলেন কয়েকবার।
অদূর থেকে সেই দৃশ্যটায় বুক ভরে শ্বাস ফেললেন সাইফুল। হাসলেন হাসনাও। আঁচলের কোণ তুলে তনিমা চোখের জল মুছলেন।
যাক,অবশেষে মা মেয়ের অভিমানের পালা শেষ হলো! এবার সবার সব ভালো হবে। শুধু যদি একটু বুঝতো সার্থটা!
তুশির মনে হচ্ছে ইউশা আজকাল বড্ড পালাই পালাই করছে। পড়াতেই চাইছে না। পড়তে চাইলেই বলছে- অয়ন ভাইকে বলো।
কেন? ও কেন অয়ন ভাইকে বলবে? এত বেশি ওনার ঘরে যাওয়া-আসা করা কি ঠিক? যতই ভাইবোন হোক।
এদিকে সাইফুল গতকাল তুশির স্কুলে গিয়েছিলেন। কথা বলে এসেছেন কর্তৃপক্ষের সাথে। অভিভাবকের স্থানে নতুন করে তাদের নাম ছাপা হয়েছে। সাথে খবর নিয়ে এসেছেন জুনের শুরুতেই ক্লাস ফোরের পরীক্ষা শুরু হবে। খবরটা পেতেই তুশির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কতগুলো দিন, ও ঠিকঠাক পড়াশোনা করেনি। আগের যা পড়াছিল তাও ভুলে গেছে। কতগুলো অংক যে এমনিই পড়ে আছে এখনো। আজকে ইউশাকে চেপে ধরে সব করিয়ে ফেলতে হবে। তুশি ছুটন্ত ঘোড়ার মতো ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল। কোনোদিকে খেয়াল-টেয়াল নেই।
ঠিক সেই সময় ওপাশ থেকে পর্দা সরিয়ে মাত্রই বের হলো সার্থ। দুজনের একটা তুখোর ধাক্কা লাগবে যখনই,তুরন্ত তুশির হাতটা টেনে সরিয়ে নিলো কেউ একজন। ভয়ে ‘আল্লাহ গো’ বলে চ্যাঁচিয়ে উঠল মেয়েটা। ভড়কে দাঁড়িয়ে গেল সার্থ। তাকাল হকচকিয়ে।
তুশি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। হাত থেকে বইখাতা সব পড়ে গেছে নিচে।
অয়ন বলল,
“ রিল্যাক্স তুশি রিল্যাক্স,ইটস মি।”
মেয়েটা ধাতস্থ হলো। চোখ ঝাপটে ঝাপটে বলল,
“ এভাবে টানলেন কেন?”
“ টানব না? আরেকটু হলেই তো ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যেতে।”
সার্থ এতক্ষণ কিছু বোঝেনি। অয়নের শেষ কথায় চেহারা টানটান হলো অমনি।
তুশি দম নিয়ে বলল,
“ ওহ,তাহলে ভালোই করেছেন।”
সার্থ আশ্চর্য চোখে চাইল। দাঁতের নিচে দাঁত বসে যায়।
“ ভালোই করেছেন মানে! কী ভালোই করেছে? এখন ওর সাথে ধাক্কা খেতেও এত সমস্যা?
তুশি নিচে পড়া বইখাতার দিকে চাইল। তুলতে বসল,তক্ষুনি বসল অয়নও। দুজনের কারোরই পরিকল্পনা ছিল না। অপ্রস্তুতিতে কপালে-কপাল ঠুকে গেল তাই। হতবুদ্ধি বনে একে অন্যেকে দেখেই, পরপর হেসে উঠল ওরা। অথচ সেই হাসিতে সার্থের কান ঝা ঝা করে ওঠে। খসখসে হাত মুঠো করে মটমটিয়ে চিবুক ফোটায় সে। জ্বলন্ত চোখে একবার তুশিকে দেখে অয়নের দিক চাইল সার্থ। তারপর খটমটে চিত্তে লম্বা পায়ে নেমে গেল নিচে। চওড়া শরীরটার প্রস্থানপথে চোখের কোণ তুলে এক পল দেখল
তুশি। বুকের ভেতর থেকে উগলে আসা বেদনা ঠেসে ঠোঁটের হাসি ধরে রাখল তাও।
অয়ন সব গুছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল । জিজ্ঞেস করল,
“ এসব নিয়ে যাচ্ছো কোথায়?”
“ ইউশার কাছে, পড়ব।”
“ কিছু আমি তো ক্লাসে যাচ্ছি।”
ইউশার গলা শুনে ফিরে চাইল ওরা। অয়ন কব্জি উলটে হাতঘড়ি দেখে বলল,
“ এখন? মাত্র সাড়ে আটটা বাজে।”
ইউশা ওর দিকে তাকাল না। সোজা তুশিকেই বলল,
“ সাড়ে নটায় ক্লাস। আমি তোমাকে এসে পড়াই তুশি?”
“ আচ্ছা।”
তারপর মাথা নুইয়ে নেমে গেল মেয়েটা। অয়ন একটু অবাক হয়!
ইউশা ওর সাথে কথা বলল না কেন? প্রশ্ন করল
তুশিকে,
“ ওর কী হয়েছে, কিছু জানো?”
তুশি মিটিমিটি হাসল,
“ কেন? খুব ছটফট লাগছে বুঝি?
কিছু হলেও বা,আমি কেন বলব? আপনি খুঁজে বের করুন। এটাতো আপনারই দায়িত্ব,ভাইয়া।”
তারপর সেও নেমে গেল। অয়ন কিছুই বোঝেনি। বিড়বিড় করে বলল,
“ আমার দায়িত্ব?”
“ আম্মা,রোকসানা তো এখনো এলো না। ওর নাস্তাটা কি এখন বানাব,না আরো পরে?”
“ ছাড়ো তো বউমা। যখন আসবে তখন দেখা যাবে। এত না ভেবে খেতে বসো।”
তনিমা ঘাড় নাড়লেন। প্রৌঢ়া শুধালেন,
“ শওকত কোথায়? আজকেও ঘরে খাবে নাকি?”
জবাব দিলেন সাইফুল,
“ ভাইজান বেরিয়ে গেছে আম্মা। সেজন্যেইতো এত আরাম করে খাচ্ছি।”
“ ওহ!”
রেহনূমা হাসিহাসি মুখ করে বললেন,
“ আপা,রোকসানা আসাতে একটা ব্যাপার কিন্তু ভালো হয়েছে। বলো তো কী?”
“ কী?”
“ এই যে,আম্মা রোজ আমাদের সাথে খেতে বসেন।”
জয়নব হাসলেন। বললেন,
“ রোকসানার জন্যে আসি না রে মা। আসি তোমার মেয়ের জন্যে। তুশি সেদিন আমার ঘরে গিয়ে কী বলেছে জানো?”
রেহণুমা একটু ঘাবড়ে গেলেন। মেয়েটা আবার মাকে কী বলল?
“ কী,কী বলেছে আম্মা?”
“ বলেছে, ছোটো থেকে তো তোমার কোলে উঠে জ্বালাতে পারিনি। এখন আবার খাবারও ঘরে একা একা খাও। কেন বুড়ি? একটু কষ্ট করে নিচে নামা যায় না? এত হাট্টাগোট্টা দুটো নাতি তোমার। হাঁটতে না পারলে তাদেরকে বলবে পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যেতে৷ তাও তোমার আসা চাই। সবাই একসাথে খেতে না বসলে ভালো লাগে নাকি!”
কথাটায় স্বশব্দে হেসে উঠল সবাই। রেহণুমা দুপাশে মাথা নেড়ে বললেন,
“ এই তুশিটাও না,কখন যে কী বলে!”
সার্থ তখনই চেয়ারে বসেছিল। এসেই শুনল,এখানেও তুশির নাম। এমনিই ওর মেজাজ খিচড়ে আছে। তনিমা সামনে প্লেট দিতেই তুরন্ত ঠেলে দিয়ে বলল,
“ খাব না।”
“ অন্য কিছু খাবি তাহলে?”
“ কফি।”
“ খালি পেটে কফি? শরীর খারাপ করবে তো।”
সার্থ গমগম করে বলল,
“ যা চেয়েছি দাও তো , এখন এত কথা ভালো লাগছে না।”
সবাই বিভ্রান্ত চোখে মুখ দেখাদেখি করল। মিন্তু মিনসে চেহারায় খাবার গালে দেয়। মেজো ভাইয়াটা দিনদিন আরো মেজাজি হয়ে যাচ্ছে। নাহ,সে জীবনে কখনো পুলিশ-টুলিশ হবে না। তাহলে
আসামি ধরতে ধরতে ওরও মাথার রগ ফেটে যাবে।
ইউশা আর তুশি এলো তখনই। তুশিকে দেখেই তনিমা বললেন,
“ ওমা,তুই এত বইখাতা নিয়ে কই যাচ্ছিস?”
“ যাচ্ছিলাম ইউশার কাছে।
কিন্তু ওর ক্লাস আছে।”
মিন্তু টান দিয়ে বলল,
“ আরে বাহ বাহ, বাহ বাহ, ছন্দ মিলে গেল।”
সাইফুল চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“ তুমি চুপচাপ খাও। খাবার সময় এত কথা বলো দেখেই ৩৩ ছাড়া কপালে কিছু জোটে না।”
ছেলেটা ঠোঁট ওল্টায়,
“ দিদুউউউন…”
বৃদ্ধা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“ সাইফুল, তোর তো সাহস কম না। আমার সামনে আমার নাতিকে এসব বলছিস!”
ইউশা চোরা চোখে সার্থকে দেখছে। কেমন পাথর সেজে বসে আছে চেয়ারে। চোখ তুলছে না,মুখ নড়ছে না। চিবুকের হাড়গুলো কীরকম কড়মড় করছে দেখো! খেয়াল করল অয়নও এসেছে সেথায়। অমনি ও টেনে টেনে বলল,
“ আমি তো তোমাকে বললাম,অয়ন ভাইয়ের কাছে পড়ার কথা। আমার থেকে ভাইয়া ভালো বুঝিয়ে দেবেন। ভাইয়া তো এ বাড়ির সবচেয়ে বেশি মেধাবী ছাত্র তুশি! বিশ্বাস নাহলে সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো। এইত,মেজ ভাইয়াও এখানে আছে। ওনার থেকেই শোনো না। আমি ঠিক বলেছি না বলো, ভাইয়া! তুশির এখন ওনার কাছে বেশি বেশি পড়তে যাওয়া উচিত না, বলো?”
সার্থ দাঁত খিচে বলল,
“ তুলে এক আছাড় মারব। আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
তারপর দুমদাম করে উঠে গেল সে। রেখে গেল হতচকিত হয়ে বসা থাকা মানুষদের। সাইফুল অবাক হয়ে বললেন,
“ সার্থর আবার কী হলো?”
ইউশার পেট ফেটে এলো হাসিতে। অথচ দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
“ এভাবে বকল কেন? কী এমন বললাম আমি?”
তুশি মায়ায় নিঃশেষ হয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ কষ্ট পেও না ইউশা। জানোই তো বিটকেলটা কত খচ্চুরে।”
জয়নব বললেন,
“ কিন্তু ও হঠাৎ রেগে গেল কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
তুশি কণ্ঠ চেপে বলল,
“ কিছু ষাড় থাকে দিদুন,যাদের সামনে লাল কাপড় দেখাতে হয় না। এমনিই এসে গুঁতো দিয়ে যায়। তোমার এই নাতিটাও অমন।” বিভ্রমে ভরা পরিবেশ বদলে গেল অমনি। ফের হুহা শব্দে স্রোত বইল হাসির।
সার্থ তখন বসার ঘরে শক্ত হয়ে বসেছিল। হাসির আওয়াজে মাথা গরম হলো আরো। সে যে না খেয়ে উঠে এলো,তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। সব কেমন হইহই করছে!
আর ওই একজন, হঠাৎ এত পড়াশোনার ইচ্ছে উদয় হলো কেন? নিশ্চয়ই অয়নের সাথে হাসাহাসি করার সুযোগ পাবে বলে। সার্থ চটে যেতে যেতেও সোজা হলো আবার। মনে পড়ল দাদির কথা- ঘোষণা করে লড়াইয়ে সে নামেনি। কিন্তু এরকম নীরব চোটপাট করলেও তো হেরে যাওয়া হবে। সৈয়দ সার্থ আবরার তো হেরে যেতে শেখেনি। প্রতিপক্ষ যেই থাকুক,সে জিতবে। আর প্রসঙ্গ যদি তুশির হয়,জিততে তো হবেই।
তারপর
মিনিট দশেক কাটল। কফি নিয়ে এখনো আসেননি তনিমা। তবে সার্থ খেয়াল করল
অয়ন বের হচ্ছে। কানে ফোন,দরকারি কল পেয়েছে হয়ত। ইউশাও বের হবে এখন। অয়ন লাইন কেটেই বলল,
“ চল, তোকে নামিয়ে দিই।”
ইউশা প্রস্তাব নাকচ করে বলল,
“ বাবার সাথে যাব। লাগবে না।”
তুশি বলল,
“ ইউশা, বাবাকে একটু বলবে আমার জ্যামিতিবিক্স লাগবে।”
“ আচ্ছা।”
কিন্তু ঢোক গিলল সে। ও বাবার সাথে যাচ্ছে না। কথাটা কেবল অয়নকে এড়িয়ে যেতে বলেছে।
অয়ন তক্ষুনি বলল,
“ চাচ্চুতো ফিরবে সেই রাতে। সময় পাবে না। তুমি আমাকে বলো তুশি,তোমার আর কি কি লাগবে?”
ইউশা জানে,এখন শ্বাস নিতে কষ্ট হবে ওর। চোখ ভিজে আসবে মেঘে ঢাকা আকাশের মতো। কিন্তু এসব যে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। নিশ্চুপ পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল তাই।
সার্থ চুপচাপ বসে শুনছিল। চোখের সামনে মেলে রাখা ফোন। হাবভাব এমন- যেন ওদিকে তার আগ্রহই নেই। কিন্তু অয়নের এই আগ বাড়িয়ে আদিখ্যেতায় কান খাড়া করে নিউজফিডে ব্যস্ত হাতটা সাথে সাথে থামাল। জ্বলজ্বলে স্ক্রিনে শক্ত করে পিষে রাখল আঙুল।
তুশি বলল,
“ আর কিছু লাগবে না।”
“ ফ্লাওয়ার্স?”
সার্থ চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। তুশি ভেবে ভেবে মনে করল,
ইউশা বেলিফুল খুব পছন্দ করে। যদি অয়নকে দিয়ে আনিয়ে চমকে দেয়া যায়! পরীক্ষার চিন্তায় যা উদাস হয়ে ঘুরছে,খুব খুশি হবে মেয়েটা। অমনি প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
“ হ্যাঁ বেলী।”
অয়ন ভ্রু গোছাল,
“ বেলী? কিন্তু তোমার তো গোলাপ পছন্দ।”
তুরন্ত,সার্থ খ্যাপাটে চোখে চাইল। গোলাপ পছন্দ? কই ওকে তো কখনো বলেনি। অথচ অয়ন সব জানে!”
তুশি বলল,
“ বেলীও। আনবেন?”
“ নিশ্চয়ই! আসি।”
অয়ন বেরিয়ে যেতেই তুশি দোর চাপাল। এক
হাতের ভাঁজে বই-পুস্তক তখনো আছে। তারপর গুনগুন করতে করতে পথ ধরল ঘরের। সার্থের মতো একটা দীর্ঘদেহী মানুষ যে সোফায় বসে আছে,দেখেইনি যেন। এতক্ষণের সব ঘটনা,তারওপর তুশির এই নীরব অবজ্ঞায় সার্থের মাথায় রক্ত চড়ে বসল। রাগে ফুলকি তোলা আগুন ছুটে এলো চোখে।
যখনই মেয়েটা পাশ কাটিয়ে যাবে,আচমকা থাবা দেয়ার মতো করে কনুই টেনে ধরল সার্থ।
তুশির বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। চমকে গেল খুব।
ভালো করে তাকাতেও পারল না,কেমন টানতে টানতে কোথাও একটা নিয়ে চলল সার্থ।
স্টোর রুমের পাশে খালি একটা জায়গা আছে। একেবারে তুশিকে সেখানে এনে থামল সে। ছুড়ে ফেলার মতো দাঁড় করিয়ে, বজ্রস্বরে বলল,
“ অ্যাই চোর অ্যাই, সমস্যা কী তোমার?”
তুশি ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। শ্বাস পড়ছে জোরালো। টানাহেঁচড়া করে সম্বিৎ ফিরল এইবার। প্রথমেই নজর পড়ল সার্থের দপদপে আঁখিতে। পরপর খেয়াল করল হাতের পেলব ত্বকে পাঁচটা আঙুলই দাবিয়ে দিয়েছে সে।
এমন রুক্ষ স্পর্শ,এমন ফুটন্ত জলের মতো তপ্ত দৃষ্টি – অথচ তুশির হৃদয় নুইয়ে এলো। বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ হাহাকার তুলে নড়ে উঠল ফের। সে এক টালমাটাল, অস্থির অনুভূতি! অন্তঃপটের কোথাও যেন হুহু করে বাজল,
“ সান্সোনে কাহা রুক মোড লিয়া,
কোয়ি রাহা নাজার নেহি আয়ে।
ধারকাননে কাহা দিল ছোড দিয়া,
কাহান ছোড়ে ইন জিস্মোনে ছায়ে।
য়েহি বারবার সোচতা
হুন তানহা ম্যায় ইহায়া…
মেরে সাথ-সাথ চাল
রাহা হ্যায় য়্যাদো কা ধুয়া….
যো ভেজি থি দুয়া,
ওও জাকে আসমা,
সে য়ুন টাক্রা গায়্যি,
কে আগায়্যি হ্যায় লট কে স্যদা…”
এক জোড়া নিভন্ত,কাতর চোখে চোখ পড়তেই সার্থের ক্ষুব্ধ চিবুক নিভে যায়। দৃষ্টি নরম করে ঢোক গিলল সে। গলার শিরায় ভেসে উঠল এক টুকরো অদ্ভুত স্থিরতা। হাতের ঐ পোক্ত বাঁধন একটু আলগা হলো এবার। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ছাড়িয়ে আনল তুশি। কপাল কুঁচকে বলল,
“ কী আশ্চর্য, এখনো চোর চোর করছেন কেন? আমি এখন আর চোর নই। এখন আমি এই বাড়ির মেয়ে- সৈয়দ মেহরিন রহমান তুশি। না না,সৈয়দ ইনায়া রহমান তুশি। বুঝেছেন?”
সার্থের নম্রতা শেষ। তুশির হম্বিতম্বিতে মেজাজ পালটে গেল। ফের কটমটিয়ে বলল,
“ তুমি কে সেটা জানার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তোমার সমস্যাটা কোথায় আমি শুধু সেটুকু জানতে চেয়েছি। কী শুরু করেছ ইদানীং? ”
তুশি যেন আকাশ থেকে পড়ল,
“ আমি? আমি আবার কী করলাম? করলেন তো আপনি। এভাবে কেউ মেয়ে মানুষের হাত ধরে টানে? লোকে দেখলে কী বলবে!”
“ কীহ?”
“ কীসের কী? আপনার আর আমার মধ্যে কি স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক আছে? নেই তো। আমাদের বিয়ে না ভুলভাল বিয়ে ছিল? তাহলে যখন-তখন এভাবে আমার হাত ধরবেন না। আপনি আমার কেউ না,কেউ না-য়ের মতো থাকবেন।”
সার্থ বিমুঢ়,স্তব্ধ!
অথচ কী সাবলীল তুশি। এত গুলো কথা কেমন ফটাফট শেষ করে দম নিলো সে। সার্থের বিস্ময় বা হতভম্বতায় যেন কিচ্ছু যায় আসে না। পরপরই আগের কথা শুধরে নিয়ে বলল,
“ ওহ না না,ভুল বলেছি। আপনি হলেন আমার বাবার বড়ো ভাইয়ের ছেলে। মানে আমারো চাচাতো ভাই,আমার বড়ো ভাই।”
সার্থের মাথায় বাজ পড়ল। স্তম্ভিত আওড়াল,
“ বড়ো ভাই!”
তুশি ঘাড় ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
“ হিসেবে এমনটাই তো দাঁড়ায়। চাচাতো ভাই তো ভাইয়ের মতোই তাই না?
তাহলে এবার থেকে আমিও আপনাকে ইউশার মতো মেজো ভাইয়া বলে ডাকব। সেক্ষেত্রে একজন ভাইয়ের মতো করে আপনি আমার হাত ধরতেই পারেন। ঠিক আছে, ভাইয়া?”
সার্থ তাজ্জব হয়ে বলল,
“ হ্যাভ ইউ লস্ট ইয়র মাইন্ড? আমি তোমার ভাইয়া?”
“ তাহলে আপনি আমার কে?”
প্রশ্নটা কোনো প্রশ্ন নয়, শূন্য আকাশের পানে চেয়ে থাকা এক চাতকের বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করার মতো আকুলতা এ! তুশির হরিণের ন্যায় কালো চোখে হাজার প্রস্থ আশা,আর বুকের কোথাও গিয়ে খটখট করা আশ্চর্য কম্পন!
যেন সার্থ মুখ ফুটে বলবে- আমি তোমার সব তুশি। বিয়ে হোক বা না হোক, আমরা কবুল বলেছি মানে আমিই তোমার স্বামী।
কিন্তু সেসব হলো না। শক্ত চিবুক কষে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। এই সরাসরি ছুরির মতো অবজ্ঞা, তুশির সব প্রতিক্ষায় রক্তের লম্বা দাগ টানলো। হৃদয়টা নিঃশব্দ ব্যথায় চুরমার হলো ফের।
ফোস করে শ্বাস ফেলে, মিহি স্বরে বলল,
“ আপনি কি আর কিছু বলবেন?”
সার্থের রুঢ় স্বরে ঝাঁঝ,
“ কেন,দাঁড়িয়ে থাকতে পা খসে যাচ্ছে?
একটু আগে তো অয়…”
তুশি কথা টেনে নিলো। চটাং চটাং করে বলল,
“ হ্যাঁ যাচ্ছে। অহেতুক আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব কেন? আমার কি কোনো কাজ নেই? কত পড়া আমার! আর আপনি এরকম কিছু না বললে শুধু শুধু টেনেটুনে আনবেন না। এতে আমার অসুবিধে হয়। বুঝেছেন?
এখন আসি ভাইয়া। ভালো থাকবেন।”
তুশি চলে গেল। একবার ফিরেও তাকাল না। দ্বিতীয় দফায় স্তব্ধ, নির্বাক সার্থ। থ বনে আওড়াল,
“ ভাইয়া! আমি ভাইয়া?”
তক্ষুনি তনিমা কফি নিয়ে এলেন।
“ কী রে, তুই এখানে? আমি আরো ওদিকে খুঁজে এলাম। এই নে, তোর কফি।”
সার্থ খিটমিট করে বলল,
“ খাব না।”
“ ওমা কেন?”
“ জানি না।”
“ এ আবার কী কথা? এইতো বললি কফি খাবি।”
সার্থ হালকা চ্যাঁচাল,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪১
“ এখন তো বলছি খাব না।”
“ তাহলে আমি এখন কফিটা দিয়ে কী করব?”
“ ভাইয়াকে গিয়ে খাওয়াও,যাও।”
তারপর গজগজ করে বেরিয়ে গেল সে। তনিমা নির্বোধ বনে গেলেন।
বিড়বিড় করে বললেন,
“ আমার আবার ভাইয়া এলো কোত্থেকে?”