কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৩
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সার্থ থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল মিনিট দশেক হবে। অথচ ওকে আবার বাড়ি ঢুকতে দেখে অবাক হলেন তনিমা। এগিয়ে এলেন জোরালো পায়ে। উদ্বেগ নিয়ে শুধালেন,
“ কী রে,চলে এলি?”
“ হু।”
“ যাবি না আজ? শরীর খারাপ নাকি?”
“ না।”
প্রতিটা উত্তর কেমন গমগম করে ছুড়ল। তনিমা ভালো করে দেখলেন ওকে। চোখা নাকটা ফুলকো লুচির মতো লাগছে। কপালের শিরার ভাঁজে গরম ধাঁচ। চোখমুখও ঠিক নেই। কী নিয়ে এত রেগে আছে ছেলেটা?
সার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে এক পল স্টোর রুমের দিকে চাইল। জোরে জোরে পড়ার শব্দ আসছে। ও নিচের ঠোঁট দাঁতে কামড়ে ভাবল কিছু একটা। জিজ্ঞেস করল,
“ অয়ন কখন ফেরে?”
তনিমা বললেন,
“ অয়ন! এইত দুপুরেই আসবে বলল। কেন রে?”
“ এমনি।”
তারপর লম্বা পায়ে রওনা করল ঘরে।
তনিমা আর মাথা ঘামালেন না। এই ছেলের মেজাজ বোঝা তার কম্ম নয়!
সার্থ হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বুক ফুলিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। নিজের ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত সে। এই যে অর্ধেক পথ গিয়েও আবার ফেরত এলো বাসায়, কেন? এই যে ওর মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে,তাও বা কেন? মানুষের জীবনের খুব বাজে একটা ব্যাপার হলো,প্রচণ্ড রাগ হবে কিন্তু রাগের কারণ থাকবে না। তবে সার্থর মনে হলো না, ওর রাগ অযথা। এই তো যতবার তুশির ওই ভাইয়া ডাক কানে এসে লাগছে, ঝাঁঝিয়ে উঠছে সব। মাথার তালু সহ চুলেও যেন আগুন ধরে যাচ্ছে।
সেসময় মিন্তু দরজায় এসে দাঁড়াল। মিনমিনিয়ে ডাকল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ভাইয়া!”
সার্থর তপ্ত মেজাজে এক ফোঁটা ঘি পড়ল অমনি। আবার ভাইয়া! খ্যাপাটে চোখে ফিরতেই ছোট্ট মিন্তু ঘাবড়ে যায়। ভয়ডরে ছুট লাগায় সহসা। সার্থ চ্যাঁচিয়ে ডাকল সাথে সাথে,
“ মিন্তু,শোন!”
ছেলেটার দুরন্ত কদম থামল। ঘুরে চাইল ভয়ে ভয়ে।
সার্থ বলল,
“ ভেতরে আয়।”
এবারের স্বর মোলায়েম। একটু ভরসা পেলো মিন্তু। গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়াতেই বলল,
“ পালাচ্ছিলি কেন?”
“ না মানে,ভাবলাম রেগে আছো।”
সার্থ বড়ো শ্বাস টেনে মাথা ঠান্ডা করল। অন্যের রাগ তো ভাই-বোনের ওপর দেখিয়ে লাভ নেই। জিজ্ঞেস করল,
“ কিছু বলবি?”
“ আমাকে ৫০০ টাকা দেবে? বাবার কা…”
পুরোটা বলার আগেই ওয়ালেট বের করে টাকার নোট বাড়িয়ে দিলো সে। মিন্তুর মুখ ঝলকে ওঠে।
খুশি হয়ে বলে,
“ থ্যাংকিউ, ভাইয়া।”
সার্থ চোখ বুজে চ সূচক শব্দ করল।
“ আবার ভাইয়া! ”
ইউশার ক্লাস শেষ। টানা ক্লাস হওয়ায় দুপুর গড়িয়ে গেছে। ক্লাসরুমের এসি থেকে বাইরে আসতেই প্রখর তাপে চামড়া পুড়ে গেল।
একটু বেশিই গরম আজ। এটুকুতেই মুখ ঘেমে যাতা অবস্থা। অবসন্ন পা টেনেটুনে গেইটের বাইরে এসে দাঁড়াল সে। একবার তাকাল দুপাশে। বাড়ির গাড়িতে ইউশা কম যাওয়া-আসে করে। সেজন্যে আজকেও আসতে মানা করেছিল। অথচ যা রোদ, এখন মনে হচ্ছে গাড়ি এলেই ভালো হতো। রিকশার হদিসে হন্যে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে গেল ইউশা। সবেগে ছলাৎ করে উঠল বুকের ধার।
অদূরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল অয়ন। স্ফূর্তে চিত্তে ডাকল,
“ ইউশা!”
মেয়েটার মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। চোখের ভেতর লেপটে এলো বিবর্ণ কিছু ব্যথা। অয়ন ভাই! অয়ন ভাই এখানে কেন?
অয়ন হাসিমুখে এগিয়ে আসছিল,অমনি পাশ ঘুরে হনহন করে হাঁটা ধরল ইউশা। ছেলেটা স্তব্ধ হলো একটু। বিভ্রমে গুটিয়ে এলো চোখ। ইউশার এই আচরণ অয়ন চেনে না। কখনো এমন করতেও দেখেনি। পরপরই পায়ের গতি বাড়িয়ে পিছু ছুটল সে। ডাকল অনেকবার,
“ ইউশা,শোন, ইউশা।”
মেয়েটা জোরে জোরে হাঁটছে। ঢোক গিলছে শক্ত মুখে। বুকের ভেতর গোল উত্তাপের ন্যায় জট পাকানো কান্নাটা উঠে আসছে গলায়। অয়ন ভাই কেন এসেছেন? কী চাইতে এসেছেন?
বাড়িতে সারাক্ষণ ওকে কাটাছেঁড়া করে হয় না? এখন কি গলা চেপে মেরে ফেলবে?
কিন্তু মানুষটার লম্বা পায়ের সাথে কুলানো গেল না। কেমন তেড়ে এসেই পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরল অয়ন। মৃদূ রেগে বলল,
“ ব্যাপারটা কী তোর? এতবার ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?”
ইউশা একদম ওর চোখের দিকে চাইল। শীতল স্বরে বলল,
“ কেন এসেছ? আমার ইউনিভার্সিটিতে তোমার কী কাজ?”
অয়নের মুখ কালো হয়ে গেল।
“ এভাবে কথা বলছিস কেন? আমি তো এর আগেও আসতাম। তুই কত খুশি হতি!”
ইউশা কাঠ গলায় বলল,
“ কিন্তু আজ খুশি হইনি। বিরক্ত হয়েছি।”
অয়ন স্তম্ভিত হয়ে বলল,
“ ইউশা!”
শশব্যস্ত চোখ নামিয়ে নিলো মেয়েটা। অয়নের মুঠোয় থাকা হাতটাকে মোচড়াল একটু। বুক কাঁপছে। কাঁপছে গলার স্বর। অস্থির লাগছে সবকিছু। দলার মতো ফুঁসে ওঠা বেদনার জোয়ার ছিঁড়তে চাইছে ভেতরটা। অয়ন ছুঁলেই ইউশার সব খুইয়ে যায়। দূর্বলতায় নেতিয়ে আসে মন। এক্ষুনি হয়ত কেঁদে ফেলবে সে।
অয়ন আকুল গলায় বলল,
“ তুই কি আমার ওপর রাগ করেছিস ইউশা? আমি কি কিছু করেছি?”
ইউশার চোখ এলোমেলো,
“ না।”
“ মিথ্যে বলিস না। কদিন ধরেই খেয়াল করেছি,তুই তো এমন ছিলি না। কী হয়েছে তোর, বল আমাকে। আমি কিছু করলেও বল। দরকার পড়লে বকাঝকা কর। কিন্তু প্লিজ এরকম করিস না। তুই আমার সাথে ঠিক করে কথা বলছিস না, ইউশা। আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস। আমার খুব খারাপ লাগছে।”
ইউশা তাকাল। ধরা স্বরে শুধাল,
“ আমি কথা না বললে কেন তোমার খারাপ লাগবে, অয়ন ভাই?”
“ কারণ, আমি তোকে ভালোবাসি।”
ইউশার পৃথিবী দুলে উঠল। থমকাল তার চাউনি। বিমর্ষ আদলের সাথে ধক ধক করে সুর বাজল বুকে। ঠোঁট নেড়ে বলল,
“ কীহ?”
অয়ন সাথে সাথেই বলল,
“ হ্যাঁ। তোকে আমি ছোটো বোনের মতো ভালোবাসি ইউশা। তাহলে তুই আমার সাথে রাগ করলে,আমার কষ্ট হবে না!”
ইউশার সদ্য ফোঁটা স্মিত হাসিটা শেষ। ঝোড়ো বাতাসে প্রখর আলো নিভে সব যেমন আঁধারে ডুবে যায়? তেমন অন্ধকারে তলিয়ে গেল সেও। হুড়মুড়ে কালো মেঘে আকাশের শুভ্রতা মুছে যাওয়ার মতন, ছিনিয়ে নিলো তার সবটুকুনি। বুকের বা পাশ মুচড়ে উঠল। দুমড়ে দিলো তার আশা,ভরসা আর প্রচণ্ড ভালোবাসা! ইউশার আর শক্ত থাকা হলো না। অক্ষিকূটে ছুটে আসতে চাওয়া জলটা লুকোতে পারল না ও। ঠোঁট ভেঙে ফুঁপিয়ে উঠল অমনি।
অয়ন তাজ্জব বনে গেল। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ কাঁদছিস,কাঁদছিস কেন তুই?”
বলতে বলতে টের পেলো মুঠোর ভেতর থাকা ইউশার পেলব হাত কাঁপছে। রীতিমতো থরথর করছে মেয়েটা। শ্বাস নিচ্ছে হাঁ করে। চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে প্রায়। অয়ন উৎকণ্ঠিত আওড়াল,
“ ইউশা,তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?”
উত্তর এলো না। এর আগেই উড়োপাতা খসে পড়ার মতো করে ঢলে পড়ল মেয়েটা। মাটি ছোঁয়ার আগেই ধড়ফড় করে ধরে ফেলল অয়ন। একেবারে মিশিয়ে নিলো বুকে। ইউশা জ্ঞান হারিয়েছে। অয়ন তাড়াহুড়ো করে ওকে কোলে তুলে ফেলল। চিন্তায় মরিয়া হয়ে এগোলো গাড়ির দিকে।
রোকসানা জগিং এর পর কোথাও একটা গিয়েছিলেন। হয়ত শপিং-এ। দুহাত ভরে ব্যাগ নিয়ে সোজা গিয়ে রুমে ঢুকলেন নিজের। সকালে তুশির ওসব কথা এখনো তার মাথা থেকে যায়নি। মুখ দেখেই বেশ বুঝেছেন রেহণূমা। আগ বাড়িয়ে নিজেও আর কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেন না। দু কথা বলতে গেলে,দশটা শুনিয়ে দেবে!
আইরিন ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখল সার্থ সোফায় বসে আছে। হাতে আইপ্যাড। পরনে বাসার জামাকাপড়। অমনি চাঁদ পাওয়ার মতো খুশিতে খলবল করে ছুটে এলো সে। প্রফুল্ল স্বরে বলল,
“ আপনি, আপনি আজ থানায় যাননি?”
সার্থ অনড় পাথরের ন্যায় বসেছিল এতক্ষণ। মাথায় এক বিশেষ উদ্দেশ্য তার। কণ্ঠ শুনে চোখ তুলে চাইল। আইরিনকে দেখে মুখের পেশীতে টান পড়ল একটু। তড়িৎ নজর ফিরিয়ে বলল,
“ না।”
আইরিন চারপাশটা দেখল একবার। মামিরা রান্নাঘরে,মাম্মাম শাওয়ারে ঢুকেছেন। আপাতত এখানে কেউ নেই। সার্থর কাছাকাছি থাকার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়েই মেয়েটা চটপট ঘুরে এসে বসল। মানুষটাকে সে সহজে বাড়িতে পায় না। রাতে যখন আসে ওইটুকু সময় কি আর মন ভরে কথা বলা যায়! আইরিন বসতেই সার্থ সরে এলো একটু। বিরক্তি লুকোতে আইপ্যাডে চোখ রাখল। আইরিন অল্প করে এগিয়ে আসে। একটা সময় আরো কাছাকাছি হয়। না তাকালেও মেয়েটার হাবভাব বুঝে ফেলল সার্থ। স্ক্রিনে চোখ রেখেই গলা ঝারল সে । কিন্তু আইরিনের ওপর প্রভাবই পড়ল না। এসব আকার-ইঙ্গিতের বারণ মাথাতেই নিলো না সে। উলটে মুগ্ধ চোখে বলল,
“ দাঁড়ি ট্রিম করিয়েছেন বুঝি? খুব সুন্দর লাগছে!”
সার্থ বিব্রত হয়। উত্তরের বদলে নিরেট মুখে বলে,
“ ওপাশে জায়গা আছে আইরিন। সামনেও এতগুলো সোফা খালি। সরে বসো।”
শক্তপোক্ত কথাটায় আইরিনের বিমোহ মুছে গেল। মুখ কালো করে সরল,তক্ষুনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তুশি। ওরনা নাচাতে নাচাতে বলছিল,
“ সব পড়েছিইই, সব পড়েছি।”
বলতে বলতে সোফায় তাকাতেই হোচট খেল মেয়েটা। আইরিন আর সার্থ পাশাপাশি, তাও আবার এমন ফাঁকা বসার ঘরে!
তুশির মাথার ভেতর বারুদ জ্বলে উঠল।
কটমটিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে। সার্থ যেই দেখল তুশি এসেছে,চিবুক কঠিন করল অমনি। সাথে সাথে নজর নামিয়ে নিলো হাতে। যেন মেয়েটাকে সে দেখেনি,দেখলেও পাত্তা দেবে না। তুশির মেজাজ চড়ে গেল।
কত বড়ো খারাপ, বদমাইশ একটা লোক। ওর ভাইয়া ডেকে ঘরে যেতে দেরি,আর ডাইনিটাকে পাশে বসাতে দেরি নেই? তাও কী আঠার মত চিপকে আছে দেখো! কই,ওকে তো এভাবে কখনো বসাল না। উলটে ও ধারেকাছে এলেও কেমন ছ্যাৎ করে ওঠে। তুশি রাগে কী করবে বুঝতে পারল না। মন চাইল আইরিনের হাতটা টেনেহিঁচড়ে ধরে সার্থর পাশ থেকে তুলতে। দিকদিশা না পেয়ে ও হনহন করে আইরিনের সামনে গিয়ে থামল। সার্থ চোখের কোণ তুলে নিঃশব্দে তাকাল এক পল।
তুশির তপ্ত চোখমুখ দেখে একটু ঘাবড়ে গেল আইরিন।
আচমকা তুশি হাত বাড়াল,হকচকিয়ে মুচড়ে উঠল সে।
ভাবল, সার্থর পাশে বসাতে মারবে। কিন্তু ওর পাশ থেকে টিভির রিমোর্ট তুলল মেয়েটা। কাঁধের চুল পেছনে ঠেলে বলল,
“ মশা মেরে তুশি হাত গন্ধ করে না।”
সার্থ স্ক্রিনে চোখ রেখে সন্তপর্ণে গালের ভেতর জিভ ঠেলে হাসল। পরপরই সেটুকু গায়েব করল গম্ভীরতায়। অপমানে আইরিন খিটমিট করে ওঠে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় সার্থ পাশে থাকায়। তুশি এসে ধপ করে ওদের সামনের সোফায় বসল। ছাড়ল টিভি। জোরে জোরে রিমোর্ট চেপে চ্যানেল পাল্টানোর মাঝে, আড়চোখে সার্থর পাশে আইরিনকেই দেখল কয়েকবার।
তক্ষুনি আইরিনের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। ভালোই হয়েছে বস্তির মেয়েটা এখানে এসে বসায়। এবার ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে সার্থর সাথে মিশবে।
ও খুব ঢং করে বলল,
“ কী দেখছেন, ভাইয়া? নিউজ?”
সার্থর ছোট্ট উত্তর,
“ হু।”
তুশি মটমট করে ভাবল,
“ যাই দেখুক,তাতে তোর কী? আমার বিটকেলের পাশ থেকে ওঠ ডাইনি। নাহলে…”
তুশি নাহলের পর আর কিছু বলতে পারল না, পূর্বেই খেয়াল করল আইরিন একটু একটু করে সার্থর দিকে এগোচ্ছে। সহসা ও শিরদাঁড়া সোজা করে ফেলল।
আইরিন আর সার্থর মাঝে তখন দু ইঞ্চি ফাঁকা। সার্থর এক হাত পাশে রাখা ছিল। তুশির ছটফটে চাউনি দেখে চতুরের ন্যায় হাসল আইরিন। আলগোছে নিজের হাতটা রেখে যেই সার্থর আঙুল ছুঁতে যাবে গলা ফাটিয়ে “নায়ায়ায়ায়া” বলে চ্যাঁচিয়ে উঠল তুশি। ঐ এক চিৎকারে চমকে গেল সবাই। আইরিন ভয়ে দু হাত দূরে ছিটকে গেল। সার্থর মুঠো থেকে আইপ্যাড খসে পড়ল নিচে। তুশি দাঁড়িয়ে গেছে। শ্বাস নিচ্ছে হাঁপানোর মতো। সার্থ ভড়কে বলল,
“ কী,কী হয়েছে?”
তুশি হাত দিয়ে দেখাল,
“ তেলাপোকা!”
আঙুল তাক করতেই হুড়মুড় করে উঠে পড়ল আইরিন। আর্তনাদ করে বলল,
“ কোথায়,কোথায়?”
“ তোমার মনে।”
তারপর ধুপধাপ পায়ে কোথাও একটা চলে গেল সে। আইরিন আহাম্মক বনে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরপরই রাগে কড়মড় করে ইংরেজিতে গালাগালি করল।
সার্থ তার মনের কথা শোনেনি। বিভ্রান্ত চিত্তে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল সে। তুশির এই হাবভাব তো অন্যরকম! সার্থর কোথাও গিয়ে মনে হলো,আইরিন পাশে বসাতেই মেয়ের এই হঠাৎ ফুঁসে ওঠা। চোরটা কি তবে ওর পাশে আইরিনকে দেখে জেলাস ফিল করছে?
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল খাবার টেবিলে। আইরিন পাশের চেয়ারটা খালি রেখেছে। তুশি কি আর বোকা? ঢেড় বুঝেছে নিজের পাশে বিটকেলটাকে বসানোর পায়তারা ওসব। সে এসেই দুম করে বসে পড়ল ওতে। আইরিন আর্তনাদ করে বলল,
“ এ কী! এখানে বসেছ কেন?”
তুশি অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“ চেয়ারে তো বসতেই হয়। তুমি বুঝি চেয়ারে শুয়ে থাকো?”
আইরিন রেগেমেগে বলল,
“ শাট আপ,ওঠো বলছি।”
তারপর একটু কণ্ঠ চেপে বলল,
“ এখানে সার্থ ভাই বসবেন। তুমি ওঠো।”
তুশির শরীর চিড়বিড় করে উঠল। মুখের ওপর বলল,
“ পারব না। আমি নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কোনো সার্থ নিয়ে ভাবি না। সরি!”
আইরিন চটে কিছু বলতে গেলেই সামনে থেকে চোখ রাঙালেন রোকসানা। মেয়েটা ঠোঁট উলটে চুপ করে গেল। তুশি রেহনূমাকে বলল,
“ মা,ইউশা এখনো আসছে না কেন? ও তো দুটোর মধ্যে চলে আসে।”
রেহনূমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়াল ঘড়ি দেখলেন। আড়াইটা ক্রস করছে। চিন্তিত গলায় বললেন,
“ আমিও তাই ভাবছি। কল করলাম দুবার, ধরল না।”
তুশির নিজেরও চিন্তা হচ্ছে। তারপর শ্বাস ফেলতে ফেলতেই সোজা হলো হঠাৎ। সার্থ হাত ধুয়ে এসে বসেছে মাত্র। দুজনের চোখে-চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো তুশি। সার্থর মেজাজ চটে গেল। অয়নের সাথে কথা বলতে গেলে তো হাসতে হাসতে দাঁত খুলে যায়,আর ওকে দেখে মুখের কী অবস্থা করছে দেখো! ইচ্ছে করছে এক চড় মেরে গোল বানিয়ে ফেলতে। দু ইঞ্চি মেয়ের দশ ইঞ্চি ভাব!
তনিমা আর আসমা রান্নাঘর থেকে খাবার ঢেলে এনে টেবিলের ওপর
রাখছিলেন। সার্থ ভাতের চামচে হাত দিতে গেল,তুরন্ত নিয়ে নিলো আইরিন। ব্যতিব্যস্ত আওড়াল,
“ আমি দিচ্ছি,আমি দিচ্ছি।”
তুশি দাঁত খিচে ভাবল,
“ কেন রে? তুই দিবি কেন? এখানে বিটকেলটার মা আছে,বউ আছে। হোক সে বউ অবৈধ,কিন্তু বউ তো। তাহলে তোর এত ছুঁকছুঁকানি কীসের!”
আইরিন শুধু ভাতেই থেমে রইল না। মাংস থেকে শুরু করে শসা,লেবু,কাবাব এমনকি পানিটাও ওর গ্লাসে ঢেলে দিলো। রোকসানা মেয়ের কাজবাজে হতাশ হয়ে পড়লেন। ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে মাথা ঠেসলেন হাতে। সেদিন এত করে বোঝালেন,তাও এ মেয়ে শুনছে না?
সার্থর চেহারায় অস্বস্তি। দুবার বলল,
“ আইরিন আমি পারব। তুমি বোসো।”
“ আমি দিই না,ভাইয়া। কোনো সমস্যা নেই।”
তুশি খটমট করে ভাবল,
“ কোনো সমস্যা নেই তোকে বলেছে? তুই-ইতো সবথেকে বড়ো সমস্যারে ডাইনি।”
নাহ,এই ডাইনিকে একটা শিক্ষা না দিলে হবে না।”
আইরিন মুখোমুখি থাকা সার্থকে বসে বসে নাগাল পাচ্ছিল না। তাই খাবার সার্ভ করতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
আর সেই সুযোগটাই লুফে নিলো তুশি। একবার সতর্ক চোখে সবাইকে দেখে,পা দিয়ে আস্তে করে চেয়ারের পায়াটা ঠেলল একটুখানি। তারপর আরেকটু ঠেলল। তারপর আরেকটু। চেয়ার তখন আইরিনের থেকে কয়েক মিটার দুরুত্বে চলে গেছে । অথচ
মেয়েটা ওসব খেয়ালই করল না। নিঁখুত যত্নে সার্থকে এটা সেটা বেড়ে দিলো সে। তনিমা-রেহণুমা সব দেখে শুধু দীর্ঘশ্বাসই ফেললেন।
আইরিন হেসে বলল,
“ আর কিছু লাগবে ভাইয়া?”
“ নো,থ্যাংকিউ।”
মেয়েটা শ্বাস টানে। ভেতর ভেতর গর্বে ফুলছে সে। ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। ইস,তুশির সামনে এসব করল,নিশ্চয়ই হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে?
আইরিন আত্মগরিমায় ফুলেফেঁপে যখনই শরীরটা চেয়ারে রাখতে যাবে, অমনি ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল । তুরন্ত হুহা করে হেসে উঠল তুশি।
কিন্তু খাবার টেবিলে যেন ছোট্ট একটা বাজ ফেলল কেউ। এক চোট ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সবাই। ‘মাগো’ বলে চ্যাঁচিয়ে উঠল আইরিন। রোকসানা ভাত ফেলে ছুটে এলেন।
হা হুতাশ করে বললেন,
“ মাই বেইবি,মাই বেইবি তুমি পড়লে কী করে?”
আইরিন ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। মারবেল মেঝেতে পড়ায় লেগেছে খুব। পিঠের হাড় বোধ হয় আস্ত নেই। ব্যথায় গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলল,
“ মাম্মাম,মাম্মাম আমার কোমর।”
রেহণুমা,তনিমা দুজনেই এসে ওকে দুপাশ থেকে ধরলেন। সার্থ খাবার রেখে দাঁড়িয়ে গেছে। হতবুদ্ধিতা দৃষ্টিতে।
আইরিন ওকে দেখতেই আরেকটু ব্যথা পাওয়ার ভান করল। সেবার ওয়াশরুমে পড়ে যাওয়াতে সার্থ তুশিকে কোলে নিয়ে নিজে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল। তাহলে এখন ওকেও নিশ্চয়ই এমন করবে?
মেয়েটা ঠোঁট ভেঙে কাঁদার ভান করে বলল,
“ মাম্মাম আমি এভাবে উঠতে পারব না। সার্থ ভাইকে বলো না আমাকে ঘরে দিয়ে আসতে!”
তুশির মাথায় বোম পড়ল। দপ করে হাসিটা নিভে গেল এবার। ফুঁসে উঠল সাথে সাথে,
“ কেন, উনি কেন দিয়ে আসবেন? আর কীভাবেই বা দিয়ে আসবেন? ওনার কাছে কি পাখা আছে,যে তোমাকে নিয়ে উড়ে যাবে? আর সবথেকে বড়ো কথা যতই কাজিন হোক,তুমি নিশ্চয়ই পরপুরুষের কোলে উঠতে চাইবে না।”
সার্থ কপাল কুঁচকে চোখ সরু করল। তুশির ভাবমূর্তি তো সুবিধের লাগছে না।
তনিমাও তাল মিলিয়ে বললেন,
“ সেইত সেইত। একটু কষ্ট করে ওঠ আইরিন। আমার হাতটা ধর,ঠিক পারবি।”
আইরিন গো ধরে বলল,
“ এভাবে হবে না মামি। আমি ব্যথা পেয়েছি,তাই আমিই বুঝতে পারছি। আমি উঠতেই পারব না। সার্থ ভাই,প্লিজ আমাকে দিয়ে আসুন না।”
সার্থ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। চেহারায় বিরক্তি নিয়ে তাকাল এদিক ওদিক।
তুশি মুখ শক্ত করে ভাবল,
“ একবার খালি এই মেয়েকে কোলে নিয়ে দেখুন। আপনার আঙুল কেটে আমি ঝাঝরা করে ফেলব।”
তক্ষুনি বাড়ি ঢুকলেন নাসীর। হাসতে হাসতে এসেও,ঘরের দৃশ্যটায় হকচকিয়ে গেলেন। ছুটে এসে বললেন,
“ এ কী,তোমার কী হলো আইরিন?”
সার্থ বলল,
“ ব্যথায় উঠতে পারছে না। আঙ্কেল,আপনি বরং ওকে ঘরে নিয়ে যান।”
আইরিনের চেহারায় মেঘ ছুটে এলো। খুব করে চাইল- পাপা না বলে দিক। কিন্তু বুক জুড়িয়ে গেল তুশির। দ্বিতীয় দফায় সার্থর প্রতি বিমোহে ফেঁপে উঠল বুকটা। এইত, তার কিউট বিটকেল!
নাসীর বললেন,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যাচ্ছি। এসো মা!”
দুহাত বাড়াতে গেলেই আইরিন হাত তুলে থামাল। থমথম করে বলল,
“ লাগবে না পাপা। আমি পারব।”
তারপর মায়ের হাতটা ধরে আস্তেধীরে উঠে দাঁড়াল সে। কোনোরকম টলতে টলতে ঘরে রওনা করল। রোকসানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের পিছু নিলেন । যেতে যেতে বললেন,
“ ভাবি,আমাদের খাবারটা ঘরে পাঠিয়ে দাও।”
তনিমা ঘাড় নাড়লেন। রেহণুমা ফিসফিস করে বললেন,
“ এতক্ষণ বলল দাঁড়াতেই পারবে না। এখন দিব্যি হেঁটে গেল। কিছু বুঝতে পারলে আপা?”
ভদ্রমহিলা ফোস করে শ্বাস ফেলে বললেন,
“ মাঝেমধ্যে কিছু ব্যাপার বুঝেও না বোঝার ভান করতে হয়। নে, খেতে বোস। আমি দেখে আসি হাসনা খালার নামাজ শেষ হলো কিনা।”
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪২
তুশির ঠোঁটে ফিচেল হাসি! গালে হাত দিয়ে সার্থর দিকে নিষ্পলক চেয়েছিল সে। যখনই মানুষটা ফিরল,হাসি মুছে ফেলল অমনি। উলটে ভীষণ সাহস নিয়ে ভেঙচি কাটল একটা। সার্থ তব্দা খেল,চমকে গেল। বোকার ন্যায় চোখ ঝাপটে ভাবল,
“ চোরটা ওকে ভ্যাঙাল? কত বড়ো সাহস!”
