কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৮
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
মানুষের শ্বাসনালী কোথায় থাকে? বুকের কোনো পাঁজরে,নাকি গলবিলের কোথাও? তুশি এর উত্তর জানে না। থাকে বোধ হয় কোথাও। কিন্তু এই মূহুর্তে মনে হলো সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কেউ গলা চেপে ধরলে বাঁচার তৃষ্ণায় কোনো প্রানী যেমন ছটফট করে,কাতরায়, চোখ উল্টে আসে,বক্ষস্পন্দন থিতু হয়,ঠিক সেরকম লাগছে। অসাড়,নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। কেউ কি কানে গরম সীসা ঢেলে দিলো? নাহলে এই দগ্ধ হওয়া অনুভূতি কীসের? কেউ একজন বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে হৃদপিণ্ডটা খাবলে-খুবলে তুলে নিচ্ছে হয়ত । তুশি টের পাচ্ছে ওর যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা ঠিক মরে যাওয়ার মতো!
ফ্যালফ্যালে চোখে সম্মুখের পুরুষ পানে চেয়ে রইল মেয়েটা। আকুল হয়ে দেখল গৌড় বর্ণের মুখটার খুঁটিনাটি। ও কি আদৌ ঠিক শুনেছে? উনি সত্যিই বিয়েতে রাজিতে হয়ে গেলেন! তাও ওরই সামনে,অন্য কাউকে! এই দৃষ্টিতে ভেজা বিস্ময়,বিমর্ষ শুকনো মুখটা কিংবা চোখের সামনে বসে থাকা গোটা ছোট্ট মেয়েটাকেই এড়িয়ে গেল সার্থ।
নিজের মতো দাঁড়িয়ে রইল,সেই স্বভাবসুলভ ওষ্ঠপুটে দূর্বোধ্য, তরল হাসি নিয়ে।
আইরিন নিজেই খুব চমকে গেছে। সে স্বপ্নেও ভাবেনি সার্থ হ্যাঁ বলবে,কিংবা আদৌ আসবে এমন দিন। চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আপনি, আপনি সত্যিই বিয়েতে রাজি ভাইয়া? সত্যিই রাজি?”
সার্থ কাঁধ উঁচাল,
“ মিথ্যে কেন বলব?”
তুশির শরীরটা থরথর করে উঠল। একটা ঘূর্ণায়মান চক্করে খুব জোরে কাঁপল হাত-পা। কীভাবে যেন গ্লাসে আঙুল লেগে সেটা পড়ে গেল নিচে।
কাচের গ্লাস কয়েক টুকরো হলো ভেঙে। সেই সাথে চুরমার হয়ে ভাঙল তুশির হৃদয়। একবার,দুবার করে করে বর্বর হাতে কয়েকবার কেউ যেন প্রহার করল,আর ঝনঝন করে ক্ষয়ে পড়ল সে।
অথচ ও টু শব্দ করল না। সার্থর দিকে এতক্ষণ নিস্তব্ধ লেগে থাকা চোখদুটো নামিয়ে আনল আস্তে। এখন ও কী করে শক্ত থাকবে? এখানে যে সবাই বসে আছে। এতগুলো মানুষের সামনে চোখের জলে কীভাবে বাধ সাজাবে তুশি!
তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট জোড়া লুকোনোরও কোনো উপায় নেই। না উপায় আছে, ওর এই টালমাটাল শরীরে একটু রাশ টানার।
গ্লাস ভাঙাতে সবার যেন হুশ এলো। যেমন হাঁ করে চেয়েছিল সকলে,এক চোট নড়েচড়ে উঠল। আসমা ব্যালচা,ঝাড়ু নিয়ে ছুটে এলো কাচের ভাঙা টুকরো তুলতে।
রোকসানার এত কিছুতে খেয়াল নেই। প্রচণ্ড খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললেন,
“ বেটা, বেটা তুমি সত্যি আইরিনকে বিয়ে করবে?”
অমনি ‘’ না” বলে চ্যাঁচিয়ে উঠল ইউশা। রীতিমতো চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। আর্তনাদ করে বলল,
না। ভাইয়া তুমি এসব কী বলছো? তুমি কেন আইরিন আপুকে বিয়ে করতে যাবে? তুশির সাথে তোমার একবার বিয়ে হয়েছিল না,একটা মানুষের বিয়ে কয়বার হয়?”
তারপর হাঁসফাঁস করতে করতে তুশির বিষণ্ণ মুখখানা দেখল সে। মেয়েটা মূর্তির মতো বসে আছে। চোখের ভেতর এক প্রস্থ জল। শুষ্ক ঠোঁটটা কাঁপছে ভীষণ গতিতে। ইউশার মাথা আরও ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আর কেউ না জানুক ও জানে,তুশি ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসে। মেয়েটা ছোটো থেকে কিচ্ছু পায়নি। না বাবা মায়ের ভালোবাসা,না একটু সুখ না একটু স্বস্তি,সেই মেয়েটা এখন প্রিয় মানুষকেও হারাবে?
খুব আশা নিয়ে সার্থর দিকে চাইল ইউশা। ব্যাকুল হয়ে বলল,
“ প্লিজ ভাইয়া,তুমি এসব ভুলভাল কিছু করো না প্লিজ!”
উত্তরে সার্থ চুপ।
চেহারায় একটুখানি বদল এলো না,না এলো হাসিতে। হতাশ ইউশার চোখে জল ছুটে এলো অমনি। ভাইয়ের প্রতি দৃঢ় আত্মবিশ্বাসটাও গলে-পচে মাটিতে মিশে গেল।
এদিকে বিভ্রান্ত, অবাক হয়ে চেয়ে রইল অয়ন। কী আশ্চর্য,ইউশা এমন করছে কেন? প্রশ্নটা করেই ফেলল সে,
“ ইউশা,হোয়াটস রং উইথ ইউ? তুই এত ওভার রিয়্যাক্ট করছিস কেন? শুনলি না ওদের বিয়ে বৈধ হয়নি?”
“ কিন্তু কবুল তো বলেছিল অয়ন ভাই। শত শত মানুষের সামনে সই করছিল কাবিননামায়। তাহলে কীসের বৈধতা, আর কীসের অবৈধতা!”
রোকসানা বিরক্ত গলায় বললেন,
“ ইউশা, যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বোলো না। ছোটো ছোটোর মতো থাকো। কীসের কাবিননামা? যেখানে বাবা মা সহ ওর পুরো পরিচয়টাই ভিত্তিহীন। যাদের নাম গার্ডিয়ানের জায়গায় লেখা হয়েছিল,তাদের কোনো অস্তিত্ব আছে? ওসব তো এই মহিলার বানানো নাম ছিল। কী আমি ঠিক বললাম?”
প্রশ্নের শর তেড়ে আসতেই, হাসনা নিরুত্তর মাথা নুইয়ে নিলেন।
রোকসানা ফের বললেন,
“ তার চেয়েও বড়ো কথা, বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার আগ অবধি তো সার্থ এটাই জানতো না যে ঘোমটার নিচে কে আছে! তাহলে কোন যুক্তিতে এটা বিয়ে বলে গণ্য হবে হ্যাঁ?”
ইউশা কিছু বলতে গেল, তড়িঘড়ি করে হাতটা চেপে ধরল তুশি। নিস্তেজ চোখ তুলে মাথা নাড়ল দুদিকে। বোঝাল- কিছু বলো না।
ইউশার বুক ভেঙে যায়। ছটফট করে ওঠে। অথচ তুশির এই নীরব বাধা দেয়াতেই দাঁতের গোড়ায় দাঁত পিষে ধরে আরেকজন। রাগটা আরো শক্তভাবে জেকে বসে মাথায়। নিরেট গলায় বলে,
“ এত কথার তো কোনো দরকার নেই। আমি যখন একবার বলে দিয়েছি আমি রাজি,তখন কারো কোনো লেইম যুক্তিতে আমার মতের বদল হবে না।”
সাইফুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন। বললেন,
“ দ্যাখ সার্থ,আমরা তোকে কোনোদিন তোর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে জোর করিনি। আজও করব না। তোর জীবন,তুই ভালো বুঝবি। তুশি আমার মেয়ে বলেই যে কিছু চাপিয়ে দেবো,তাও না। তোর যদি মনে হয় এই সম্পর্ক শেষ করে,আইরিনের সাথে নতুন সম্পর্ক জুড়বি,আমি সব সময়ই তোর জন্যে খুশি হব বাবা। সব সময় দোয়া করব তোর জন্যে।”
জয়নব দুহাতের কব্জিতে মাথায় ঠেকিয়ে বসে আছেন। হাসনা,মিন্তু, রেহণুমা প্রত্যেকে কালো মুখে নিশ্চুপ চেয়ে। এখানে বলার মতো তাদের আর কিচ্ছুটি নেই।
শওকত আর্ত নজরে বারেবারে তুশিকে দেখছেন। কপালে দুটো ভাঁজ। মেয়েটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভেতর ভেতর বেশ ভেঙে গেছে! কিন্তু কেন? ওর মনে কি তাহলে সার্থর জন্যে কিছু আছে?
অবশ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাঙালি মেয়েরা আর কিছু পারুক না পারুক, কবুল বলা মাত্রই স্বামীর প্রতি দূর্বল হতে পারে।
ভদ্রলোক দুপাশে মাথা নাড়লেন। মেয়েটা ভুল জায়গায় আবেগ বসিয়ে ফেলল। সার্থ যা পাথর,এসবের কোনো দাম দেবে না। দিনশেষে তারই তো ছেলে।
তনিমা মৃদূ গলায় বললেন,
“ সার্থ,আমি বলি কি বাবা আরেকটু ভেবে দ্যাখ। এত তাড়া কীসের? একটু ধীরেসুস্থে ভাব। কটা দিন যাক তারপর নাহয়…”
উদগ্রীব চোখে মাকে ইশারা করল আইরিন। অমনি কথা কেড়ে নিলেন রোকসানা,
“ আশ্চর্য ভাবি, তুমি ছেলেটাকে এভাবে ম্যানিপিউলেট করছো কেন? ও কি কচি খোকা? ও যা বলেছে ভেবেই তো বলেছে। বেটা, তুমি একদম ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ। ইউ রিয়েলি ডিজার্ভ সামওয়ান বেটার লাইক আইরিন। তোমাদের দুটোকে খুব মানাবে।
দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি নাসীরকে খবরটা দিই।”
ফোন হাতে নিয়ে উঠতে গেলেন তিনি,সার্থ আটকাল।
“ এক সেকেন্ড ফুপি, এক সেকেন্ড।”
থামলেন রমনী। অমনি তুশি পিঠ সোজা করে বসল। আকুল চোখে ছুটে এলো এক ফালি আশা,ভরসা। নিশ্চয়ই এক্ষুনি বিটকেলটা বলবে, এতক্ষণ সবটা মজা করে বলেছি। আমি কোনো আইরিন- টাইরিনকে বিয়ে করব না ফুপি। কিন্তু না,হলো না এমন।
সার্থ বলল,
“ সব হবে। আঙ্কেলকেও নিশ্চয়ই জানাবে। কিন্তু এর আগে আমার আইরিনের সাথে আলাদা কিছু কথা আছে। আইরিন,উইল ইউ প্লিজ?”
আইরিন চটপট উঠে দাঁড়াল,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ। ”
তুশির হৃদয়টা নিথর হয়ে গেল। চলন্ত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেমন খাদে পড়ে যায়? মনে হলো ততোধিক উঁচু থেকে তাকেও ছুড়ে ফেলল কেউ। এই যে সারা অঙ্গ কী জঘন্য ভাবে থেতলে যাওয়ার ব্যথা পেলো ও। এই প্রচণ্ড ব্যথা তুশির আর কোনোদিন হয়নি। সার্থ যেদিন ভালোবাসেনা বলে গেল, সেদিনও না। কাল যখন অত অপমান করল,তখনো না। এই যন্ত্রনা খুব আলাদা, আর পুরোপুরি নতুন।
টেবিল ঘুরে যাওয়ার সময় হাস্যোজ্জ্বল আইরিন এক পল তাকাল তুশির পানে। নিষ্পন্দ মেয়েটাকে দেখে মায়ার বদলে হাসি পেলো তার। উত্তেজনায় বুক ফাটিয়ে মিটিমিটি হাসলও সে।
আইরিনকে নিয়ে সার্থ নিচতলার কোনো একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। দোর চাপানোর শব্দ পেতেই ছুরির ঘায়ে দুভাগ হলো তুশি। চোখ খিচে বুকের খাঁজে চিবুক নুইয়ে ফেলল ।
তাহলে শেষমেশ জীবনের খেলায়,ভালোবাসা পাওয়ার এই যুদ্ধে গো হারান হেরে গেছে ও।
এখানে জেতা তো দূর,মাঠে দাঁড়ানোরই ওর আর কোনো যোগ্যতা নেই।
ইউশা আহত চিত্তে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। সার্থর থেকে ও এটা আশা করেনি। ওর সত্যিই বিশ্বাস ছিল বিয়ের কথা উঠতেই ভাইয়া নাকচ করে দেবে।
মেয়েটা হাহাকার করে বলল,
“ ভাইয়া এটা কী করে করতে পারল? কী করে?”
ইউশা আচরণের সবটা অয়নের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে । বিভ্রমে হাবুডুবু খেয়ে বলল,
“ তোর এত সমস্যা কীসের হচ্ছে আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। যাদের মাথা তাদের ব্যথা নেই,তুই বারবার এক গীত গাইছিস কেন?”
ইউশা তিতিবিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। অয়নকে এখন অসহ্য লাগছে ওর। নিজের ভালোবাসা ছাড়া কারোরটা বোঝে না। অন্ধ! দেখতে পাচ্ছে না তুশি কেমন পাথর হয়ে মাথা নুইয়ে আছে? এসব দেখেও বোঝে না কিছু? বলদ মার্কা ছেলে।
তনিমা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। প্রত্যেকেরই মুখের দশা করুণ। চেহারায় পরিষ্কার, ব্যাপারটা কেউ-ই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু ছেলেমেয়ে যখন বড়ো হয়ে যায়,নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে শেখে,শত আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাবা মা অসহায় সেখানে।
হাসনা ফোস করে শ্বাস ফেলে বললেন,
“ দ্যাহেন আমি আপনেগো পরিবারের কেউ না। তয় আমি তুশির দাদি। ওরে পালছি,বড়ো করছি। হেয় দাবি নিয়া একখান কতা কই। সংসার হইল মহব্বতের জিনিস। এই জিনিসে জোরজলুম চলে না। আপনেরা কেউ সারেরে জোর কইরেন না। হের জীবন হের মত গুছাইয়া নিতে দেন। আমার নাতির কপাল শুরুত্তেই পোড়া। আর কী পুড়ব!”
শেষ দুলাইনে বৃদ্ধার গলার স্বর বুজে এলো।
অয়ন কপাল কুঁচকে বলল,
“ আজব ব্যাপার, এখানে কপাল পোড়ার কী আছে? তুশি আর ভাইয়া এতটাও এ্যাটাচড ছিল না, যে এখন ও বিয়ে করাতে তুশির সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।”
ইউশা দাঁত পিষে ভাবল,
“ চুপ করো অয়ন ভাই, চুপ করো। তোমার মত আহাম্মক আমি আমার জন্মে দেখিনি। এই ঘিলু নিয়ে তোমাকে যে কে ডাক্তার বানাল!’’
তুশি বড়ো করে দম ফেলল। নাক টানল। দুহাত দিয়ে ঘষল সারামুখ। বলল ভীষণ স্বাভাবিক গলায়,
“ তোমরা এসব মরার আলোচনা বন্ধ করো তো এবার। যার যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুক,আমার কিছু যায় আসে না। আমাকে আমার মতো খেতে দাও।”
কাঁপা আঙুল নেড়ে পরোটা ছিড়ে ভাজিতে ডুবাল সে। জোর করে ঢোকাল মুখে। কিন্তু নামলে তো! ভেতরে যে দলার মতো একটা কান্নার পাহাড় ওটা ঠেলার সাধ্য এই খাবারটুকুর নেই।
সার্থ, আইরিনকে নিয়ে বেরিয়ে এলো তক্ষুনি। দুজন এসে দাঁড়াতেই রোকসানা বললেন,
“ কথা শেষ?”
আইরিন বলল,
“ হ্যাঁ মাম্মা,এবার তুমি কাকে কি জানাবে জানাও।”
“ যাক আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে ভাবি-ভাইজান,আমি কিন্তু কথা পাকা করে ফেলছি। নাসীর এলেই আলোচনায় বসব। শুভ কাজে দেরি করা যাবে না। আমাদের আবার ব্যাক করতে হবে তো।”
উত্তরে নিশ্চুপ সকলে।
তনিমা প্রসঙ্গ কাটাতে বললেন,
“ নাস্তা করবি, সার্থ?”
“ না। তাড়া আছে,বেরোব।”
এক পা বাড়াতে গেলেই কথা বললেন
জয়নব। জিজ্ঞেস করলেন,
“ দাদুভাই, জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিচ্ছো তো? পরে আবার পস্তাবে না তো?”
রোকসানা হাঁ করতে গেলেই, হাত তুললেন বৃদ্ধা। পুরু কণ্ঠে বললেন,
“ তুমি থামো। আমি ওর থেকে শুনতে চাই।”
সার্থ নির্লিপ্ত। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ আমি কেন পস্তাব? স্ট্রেইঞ্জ!”
“ তা হঠাৎ আইরিনকেই বিয়ে করবে কেন জানতে পারি?”
“ এ নিয়ে আমি কাউকে কোনো কৈফিয়ত দেবো না।”
তনিমা তাজ্জব বনে বললেন,
“ সার্থ, তুই কীভাবে কথা বলছিস আম্মার সাথে? আমার ছেলে তো এমন নয়।”
বৃদ্ধার মুখ মলিন হয়ে গেল। এতটা রুক্ষ ভাবে ওনার সাথে কেউ কথা বলে না। শওকত বিদ্রুপ করে হাসলেন। বললেন,
“ আপনার আদরের নাতির কথাবার্তা তাহলে এই অবধি এসে দাঁড়াল,আম্মা? সত্যিই,না হেসে পারলাম না।”
সার্থ চোখ বুজে চ সূচক শব্দ করল। একজনের রাগ ও অন্যের ওপর কেন দেখাচ্ছে?
গুরুগম্ভীর পরিবেশের ইতি টানতে মুখ খুলল
অয়ন। প্রফুল্ল স্বরে বলল,
“ ভাইয়া, আ’ম সো হ্যাপি ফর ইউ। কংগ্রাচুলেনশস! ”
সার্থর প্রথমবার অয়নের গদগদ ভাব সহ্য হলো না। তাও হাসল।
খুব গম্ভীর মুখে একটা টেনে আনা হাসি। কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ থ্যাংকিউ সো মাচ অয়ন। আশা করি আমার বিয়েতে তোর উপকারই হচ্ছে।”
অয়ন ভ্রু বাঁকাল।
ওর আবার কী উপকার?
অবশ্য একটা চমৎকার যে ঘটছে তা ঠিক। ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেলে, ওর বাঁকা রাস্তা আরামসে সোজা হয়ে যাবে।
সার্থ আড়চোখে ফের তুশির দিকে চাইল। যাকে এই মূহুর্তে ওর কাছে একটা বোবা মূর্তি ছাড়া কিচ্ছুটি মনে হলো না। চুপচাপ খাচ্ছে। ঘনঘন খাবার তুলছে মুখে। যেন চারপাশের কিচ্ছুতে কোনো আগ্রহ নেই। অ্যাটিটিউড হাহ?
দেখবে এই অ্যাটিটিউড কতক্ষণ থাকে!
ও ঘুরে সদর দরজার দিকে পা বাঁড়ায়,অমনি গলা তুললেন
শওকত,
“ এক মিনিট।”
থামল সার্থ, চাইল অল্প ঘাড় ঘুরিয়ে।
ভদ্রলোক জয়নবকে বললেন,
“ আম্মা, আপনার মেজো নাতির বিয়ে যখন অর্ধেক পাকাই হয়ে গেল, তাহলে তো তুশি এখন এই মিথ্যে সম্পর্ক থেকে পুরোপুরি দ্বায়মুক্ত। তাই না?”
বৃদ্ধা কিছু না বুঝলেও,মাথা নাড়লেন। বোঝালেন- হ্যাঁ।
“ তাহলে আপনার মেজো নাতি বিয়ে করতে পারলে,তুশিও নিশ্চয়ই পারবে?”
চমকে ফিরল সকলে। আকাশ থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ল তুশি। সার্থর চোখমুখ সহসা সজাগ হয়ে গেল। টানটান চেহারায় বাবার পানে চেয়ে রইল সে।
তনিমা চাপা গলায় বললেন,
“ কী চাইছ কী তুমি?”
শওকত সোজাসাপটা সার্থর দিকে চাইলেন। বাবা-ছেলের নির্বাধ চোখাচোখি হলো। যেন লড়াইয়ের ময়দানে দুজন প্রতিপক্ষ দেখল একে অন্যের মুখটা। পরপরই ঘোষণা করলেন উঁচু স্বরে,
“ সাইফুল,ঘটক ডাকো। ছেলে দেখতে হবে। আমিও আমার মেয়ের বিয়ে দেবো। ”
বসার ঘরে যেন বোম পড়ল। ঝলসে গেল সার্থর মাথার তালু। ঠোঁট
হাঁ করে ফেলল বাকিরা। তুশি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বলল,
“ মা মানে…আমার বিয়ে?”
“ হ্যাঁ। সবাই বিয়ে করলে তুই কেন পারবি না? আমার মেয়ের ভালোমন্দ দেখব,বাবা হিসেবে এটুকু অধিকার তো আমার আছে। তোরও বিয়ে হবে। বরং, এই সৈয়দ পরিবার থেকেও আরো উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ঘরে তোকে পাঠানোর ব্যবস্থা করব আমি।”
তুশির মাথার কোষ গুলোও রুদ্ধ হয়ে গেল। রক্তস্পন্দন থমকে দাঁড়াল সকল শিরায়-উপশিরায়।
“ সাইফুল, তুমি শুনেছ কী বলেছি?”
ভদ্রলোক নড়ে উঠলেন। চোখেমুখে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। খুব আস্তে বললেন,
“ জি মানে,আচ্ছা ভাইজান।”
“ তাহলে আজ আর অফিসে যাব না। খবর দাও ওনাকে। বিকেলের মধ্যেই ছেলে ঠিক করব। আশা করি,এতে কারো কোনো সমস্যা হবে না।”
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৭
শেষ কথাটা ছেলের দিকে ঠান্ডা চোখে চেয়ে চেয়ে বললেন শওকত। সার্থর পোক্ত চিবুকের হাড় ভেসে আছে। হাত মুঠো করে, তপ্ত চোখে ঢোক গিলল সে।
এতক্ষণে নিজেকে নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পেলো অয়ন,ঠোঁটটা মেলে হাঁ করল, দুম করে কথার তির ছুড়ে দিলো ইউশা,
“ কষ্ট করে ছেলে দেখতে হবে না চাচ্চু। তুশিকে অয়ন ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিন। অয়ন ভাই তুশিকে পছন্দ করে।”
 
