কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৫০

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৫০
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

“ রিডিকিউলাস সার্থ, যাস্ট রিডিকিউলাস। এরকম একটা বোকামো তুই কীভাবে করলি? তোকে আমি হাতেনাতে সবটা বুঝিয়ে দিলাম,আর তুই সেটা এক ঝটকায় শেষ করে দিলি ভাই! হাউ?”
সার্থ চুপ করে আরেক দিক চেয়ে রইল। হাতে সিগারেট। চোখদুটো লাল। গাড়ির জানলা মাড়িয়ে উষ্ণ, নিশ্চল চাউনিরা পিচের রাস্তায় আটকেছে। এই মুহুর্তে গাড়িতে বসে দুজন। জামিলেরই গাড়ি। ইঞ্জিন বন্ধ করে রাস্তার এক সাইড করে থামানো। পাশেই ছেলেটা অর্নগল হাহুতাশ করছিল। সার্থ নজর ফিরিয়ে হাতের সিগারেটে ফেলল এবার। জ্বলন্ত পোড়া মাথাটা আঙুলের ফাঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিস্পৃহ বনে রইল। জামিল অতীষ্ঠ হয়ে বলল,

“ কী? চুপ করে আছিস কেন? আমার দিকে তাকা। উত্তর দে, এইভাবে সব ঘেটে দিয়ে তুই কী প্রমাণ করলি? আর এখন,এখন স্মোক করেই বা কী বোঝাতে চাইছিস?”
সার্থ পাশ ফিরে তাকাল ,
“ কী বোঝাব?”
“ আমি কিন্তু বোকা নই। তোর বন্ধু আমি। আমি জানি খুব প্যারা না খেলে তুই সিগারেট খাস না। কিন্তু এখন তোর প্যারার কারণ কী? যেচে পুরো ব্যাপারটা এলোমেলো করেছিস,এখন তো তোর আনন্দে ধেইধেই করে নাচার কথা। ”
সার্থ ভারি স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ তোকে আমি এইজন্য ডাকিনি জামিল। আমাকে ব্লেইম দিবি না।”
জামিল অবাক হয়ে বলল,
“ তোকে ব্লেইম দেব না, তো কাকে দেব? দেশের সরকার কে?”
সার্থ চটে বলল,
“ কেন,কী করেছি আমি? এখানে আমার অন্যায়টা কোথায়? আমি তো ভুল কিছু বলিনি। বরং ঐ আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করেছে। মুখের ওপর অস্বীকার করেছে ও আমাকে ভালোবাসে না।”
জামিল পালটা তেতে বলল,
“ তো আর কী করবে? থালাবাসন সাজিয়ে রান্নাবাটি খেলবে তোর সাথে?
অপমান তো তুই-ই আগে মেয়েটাকে করেছিস। তুই আসলে কী আশা করেছিলি সার্থ,এত আজেবাজে কথা শোনানোর পরেও, ও তোকে যারা যারা টাচ মি টাচ মি গান গেয়ে শোনাবে?”
সার্থ ধমকে বলল,

“ চুপ!”
“ পারব না। এসব চোখ রাঙানো টাঙানো গিয়ে তোর আসামীদের দেখাবি। শালার ইউনিভার্সিটিতে তোর বুদ্ধির তারিফ করতাম সবাই। কেউ কোনো ক্যাঁচালে পড়লে তোর থেকে আইডিয়া ধার নিতাম। আর এখন! এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে তুই তো একটা আস্ত পাঠা হয়ে যাচ্ছিস।”
সার্থ গর্জে বলল,
“ জামিল! আর একটাও উল্টোপাল্টা কথা বললে জিভ ছিড়ে ফেলব। তোকে আমি কথাগুলো এইজন্যে বলিনি। বুঝতেই যখন পারছিস সব ঘেটে গেছে,তাহলে এখন সলিউশান বল।”
জামিল ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,

“ দ্যাখ দোস্ত,ভুল কিন্তু আগে তুই করেছিস। ইভেন তোর কোনো দরকারও ছিল না তোর কাজিনকে বিয়ে করতে হ্যাঁ বলে দেয়ার। এখন যা হয়েছে তাতো আর বদলানো যাবে না। ওসব ভুলে গিয়ে বাড়ি যা,আর সুন্দর করে তুশিকে কাছে ডেকে একটা সরি বলে দে।”
হেসে ফেলল সার্থ। মহাভারত অশুদ্ধ হওয়া হাসি। দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ সরি? আমি বলব?

ফাক দ্যোস লাইন। আমি ভুল ছিলাম না,ও স্বীকার করেছে ও অয়নকে পছন্দ করে।”
“ আর তুইও বিশ্বাস করে নিয়েছিস! বাহ, তোর বুদ্ধির এত দৌড় ভাই?”
“ কী বলতে চাইছিস?”
জামিল মাথা ঠান্ডা করে বলল,
“ দ্যাখ সার্থ,মেয়ে মানুষ এরকমই হয়। ওদের হ্যাঁ মানে না, আর জানি না মানে ওরা সব জানে।
আর এটাত পরিষ্কার যে মেয়েটা রাগের মাথায় তোকে ওসব কথা বলেছে।”
“ ওর রাগ রাগ,আর আমার রাগ রাগ নয়? আমি বিয়েতে হ্যাঁ বলেছি বলে,ওকেও হ্যাঁ বলতে হবে? কম্পিটিশান হচ্ছে এটা? আমি ওর কম্পিটিটর?”
সার্থ চ্যাঁচাতেই জামিল দুকান চেপে ধরল।
“ আস্তে ভাই আস্তে,কান ফেটে যাবে।”
সার্থ ফোসফোস করে শ্বাস ফেলল। জামিল বলল,
“ তাহলে তুই সরি বলবি না?”
ওর কণ্ঠে অটল জেদ,

“ না।”
“ একটা কথা বলি?”
সার্থ সামনের রাস্তায় চেয়ে রোবটের মতো আওড়াল,
“ জামিল তুই আমার বন্ধু। তুই যা বলবি আমি শুনব। কিন্তু করব সেটাই, যেটা আমার ইচ্ছে হবে।”
জামিল হতাশ,আহত। বলল নিরাশ স্বরে,
“ থাক, তাহলে চুপ করেই থাকি।”
সার্থ দরজা খুলে নেমে গেল হঠাৎ। ও ডেকে বলল,
“ আরে কই যাস? পৌঁছে দিই।”
“ নিজের কাজে যা।”
সার্থ এগিয়ে যায়। জামিল চিল্লিয়ে বলল,
“ দেশে মেয়ে দেখা ছাড়া আমার তো আর কোনো কাজ নেই। আরে সার্থ,শোন পাঠা, সরি শোন দোস্ত… শালার এত মেজাজ! এত ইগো! কোনদিন এই ইগোর চাপে পড়ে মরবি নিজেও বুঝবি না ব্যাটা।”

দুপুরের প্রখর রোদটা মাথায় নিয়ে ইউশা পার্কের ভেতর ঢুকল। বিধ্বস্ত নয়ন মেলে এক পল তাকাল চারিপাশ। অদূরে ঠিক নাক বরাবর সোজা একটা বেঞ্চ পাতানো। পুরোনো খুব,জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট খসে গেছে। শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দটা পায়ে মাড়িয়ে টলটে টলতে সেখানে এসে বসল ইউশা।
বড্ড গরম পড়েছে আজ। সূর্যের তাপে মাটির বুক পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। অথচ ইউশার দুটো মেদূর গাল ছুঁয়ে শ্রাবণের ঘন বর্ষা নামল। চিবুক নুইয়ে ঝরঝর করে কেঁদে উঠল সে।

কখনো অয়নের হাসিমুখ ভেবে বুক মুচড়ে ওঠে। কখনো তুশির অসহায় আবেদন মনে করে করে অনুতাপে ইউশা ছারখার হয়ে যায়। যন্ত্রণার বিষে কামড়ে ধরে সারা শরীর। ইউশা আকাশের দিকে মুখ তুলে কেঁদে কেঁদে বলল,
“ আম সরি তুশি, আম সরি। আমি তোমাকে বাধ্য করছি অয়ন ভাইকে বিয়ে করার জন্যে। জোর করছি অন্যের হতে। তুমি আমায় ভুল বুঝো না তুশি। আমাকে খারাপ ভেবো না। আমি যা করেছি শুধু তোমার ভালোর জন্যে। মেজো ভাইয়া তোমাকে কোনোদিন বুঝবে না,কিন্তু আমি জানি অয়ন ভাই তোমাকে মাথার তাজ বানিয়ে রাখবেন। যে মানুষ তোমার পরিচয় না জেনেই তোমাকে ভালোবেসেছিল, তার ভালোবাসা কখনো ভুল হতেই পারে না। এই ভালোবাসা তো অন্য কারো থেকে তুমি পাবে না তুশি। কারো কাছে অতটা যত্নেও থাকবে না।
তুশি, তোমাকে আমি পৃথিবীর সবার চেয়ে খুশি দেখতে চাই। তার জন্য যদি আমাকে তোমার চোখে খারাপ হতে হয়, যদি নিজের ভালোবাসা,ভালো থাকাকে বিসর্জন দিতে হয়,তাহলে তাই সই। কিন্তু তাও তুমি সুখে থাকো তুশি। অয়ন ভাইয়ের খুব আদরের বউ হও তুমি!”

জায়গাটা সুনসান,নীরব। চারদিক গাছ,আর লতাপাতায় ভরা। এমনিও লোকজন কম আসে তার ওপর এই ভরদুপুরে ডালে একটা কাকও বসেনি। ইউশা বসে বসে মন ভরে কাঁদল। এই জন্যেই তো বাড়ি থেকে মিথ্যে বলে এসেছে এখানে। ঘরে এত আহাজারি করে কাঁদা যায় না। দেওয়ালগুলো হাসে। কথা শোনায়। ওরাই বা আর কত চোখের জলের সাক্ষি বয়ে বেড়াবে?
ইউশা টলমলে চোখ ঘুরিয়ে দুপাশের গাছগুলোকে দেখল। এক ফোঁটা বাতাসও নেই। কেমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আচ্ছা, ওরা আবার হাসছে না তো ওকে নিয়ে! এই কান্নাকাটি দেখে বিরক্ত হচ্ছে নাতো!
ইউশা কব্জি উলটে স্যাঁতসেঁতে চোখদুটো মুছল। ব্যাগ খুলে একটা র‍্যাপিং করা বাক্স তুলে আনল হাতে। এর ভেতর একটা কালো শার্ট,আর একটা স্থেটোস্কোপ আছে। অয়নের আগামী জন্মদিনের জন্যে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে কিনেছিল ইউশা। কালো শার্টে অয়ন ভাইকে সবথেকে বেশি সুন্দর লাগে। আর যখন গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে হাঁটেন ইউশা তখন চোখই সরাতে পারে না।

কিন্তু এখন আর এসবের কোনো দরকার হবে না। ইউশা তো আর প্রেম প্রেম নজরে দেখবে না ওনাকে। অয়ন ভাই এখন আগাগোড়া তুশির!
ইউশা বাক্সটার গায়ে হাত বোলাল একবার। পরপর দুপা উঠে এসে একটা ছোট্টো ডোবার ভেতর ছুড়ে ফেলে দিলো।
চোখের জলে নিঃশ্বাস মিশিয়ে বলল,
“ এই বাক্সের সাথে সাথে আমার অনুভূতিও আজ আমি ডুবিয়ে দিলাম অয়ন ভাই। সাথে তোমার জন্যে আমার সব অনুভূতি আমি দাফন করে দিলাম।
পৃথিবীর এক কোনে থাকা ইউশা নামের একটা মেয়ে যে তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো তা তুমি কোনোদিন জানবে না।”

ইউশা কিছুক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মানস্পটে অতীতের স্মৃতি নিয়ে দিশাহারা পথিকের মতো ছটফট করে খুব। সেই যে ওর জ্বরের দিন অয়ন ভাই মাথার কাছে বসেছিলেন,ওর পরীক্ষার হলে কেমন বুকে মিশিয়ে মিশিয়ে নিয়ে গেলেন ওকে, সেসব ইউশা কেমন করে ভুলবে?
চাইলেই কি সব কিছু ভুলে যাওয়া সম্ভব! তাই অয়ন ভাইকেও ও ভুলতে পারবে না। কক্ষনো না। অয়ন ভাই থাকবেন, যতদিন ও বাঁচবে ততদিন ওর হৃদয়ের খুব গভীরে থাকবেন তিনি। যার হদিস কেউ হৃদপিণ্ড কেটেকুটে ফেললেও কোনোদিন পাবে না।
ইউশা ফের চোখ মুছে বড়ো করে শ্বাস নিয়ে মাথা তুলল। চমকে,থমকে শক্ত হয়ে গেল অমনি। সানগ্লাস পরা এক পুরুষ, গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম জড়িয়ে খুব দ্রুত হেঁটে আসছে। মেয়েটা শিরদাঁড়া সোজা করে ফেলল। এই রে,মেজো ভাইয়া এখানে কেন! সার্থ এসে দাঁড়াল সামনে। কপালে গাঢ় ভাঁজ নিয়ে বলল,

“ তুই এখানে কী করছিস?”
ইউশার গ্রহ নক্ষত্র ভয়ে জট বেঁধে গেল। তুতলে বলল,
“ আমি মানে আমি…”
সার্থ সন্দেহী চোখে চেয়ে থাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায়। ইউশা মিনমিন করে বলল,
“ আমি একাই এসেছি ভাইয়া। কোনো ছেলের সাথে আসিনি।”
সার্থ তপ্ত কণ্ঠে বলল,
“ আমি বলেছি সে কথা?”
ইউশা দুপাশে মাথা নাড়ল। বোঝাল, না।
“ তোর এখানে কী কাজ?”
ও জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ ক্লাসটা হঠাৎ ক্যান্সেল হয়ে গেছিল। এত রোদ দেখে ভাবলাম একটু এখানে এসে বসি।”
তারপর ভয়ে ভয়ে তাকাল ওর পানে। সার্থর চিবুক শক্ত। ইউশা উদ্বেগ নিয়ে বলল

“ সত্যি বলছি।”
“ সত্যি না মিথ্যে, সেটা বাড়ি গিয়ে দেখছি। আপাতত এখান থেকে যা। জায়গাটা ভালো নয়।”
ইউশা ঘাড় কাত করল।
“ তুমি এখানে কেন ভাইয়া? জানলে কী করে আমার কথা?”
“ শরীফ দেখেছে। পাশের রোডে সম্মেলন আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জামশেদ তালুকদার আসছেন। রাস্তায় জ্যাম বাড়বে,তুই ব্যাগ নিয়ে আয়।”
“ আচ্ছা।”
“ দাঁড়া। গেইটের বাইরে অপেক্ষা কর। একা যেতে হবে না, আমি জিপ পাঠাচ্ছি।”
ইউশা মাথা নাড়ল।
বেঞ্চের ওপর থেকে ব্যাগটা তুলতে তুলতে ফিরল হঠাৎ। কণ্ঠে উৎকণ্ঠা অথচ খুব বিনয় নিয়ে শুধাল,
“ ভাইয়া,তুমি কি সত্যিই আইরিন আপুকে বিয়ে করবে?”
সার্থ এক পা বাড়িয়েছিল যেতে। থমকে দাঁড়াল অমনি। গম্ভীর গলায় বলল,

“ তা দিয়ে তোর কোনো দরকার?”
“ তুশি তোমা…
সার্থ মাঝপথেই কেমন হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
“ ইউশা তোকে আমি যেতে বলেছি।”
ইউশার খুব রাগ হলো এবার।
তার বোনের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করছে, আবার তাকেও ধমকাচ্ছে। চোখেমুখে একটু মায়া,একটু অনুশোচনাও নেই। আসলে একদম ঠিক নামই দিয়েছে তুশি,ভাইয়া সত্যিই একটা বিটকেল….
*** নিস্পন্দ,ফাঁকা রাত। বাঁকা চাঁদটাও কেমন মলিন ভাবে শুয়ে আছে আকাশে। ছাদজুড়ে হুহু বেগে ছুটতে থাকা বাতাসের ঝাপটায় তুশির ওরনার মাথা উড়ছিল। সেপ্টেম্বরে সারাদিন গরম পড়লেও রাতে টুকটাক শীত পড়ে। তুশি ছাদে দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা সময়। চিলেকোঠার বাল্ব ছাড়া এখানে কোথাও আর কোনো আলো নেই। বসার ঘরে বড়োদের আড্ডার আসর বসেছে । হাসিঠাট্টার আওয়াজ এখানে দাঁড়িয়েও শুনছে সে। কিন্তু সেসবে তুশির আগ্রহের ছিঁটেফোঁটাও নেই। ও বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ভিন্ন অনুভূতি শুষে নিতে ব্যস্ত।

এই ছাদ তার কাছে খুব প্রিয় একটা জায়গা। পাঁচিল ছোঁয়া শরীরটা ঘুরিয়ে একপল ঐ দোলনার দিকে চাইল সে। এই দোলনায় বসে প্রথম সার্থ ওর সাথে সুন্দর করে কথা বলেছিল। একটা গোটা রাত কেমন চোখের নিমিষে কেটে গেল তাতে। আর তারপর, তারপর এখানে বসেই তো মানুষটা প্রথম ছুঁয়েছিল ওকে। পেশিবহুল হাত ছড়িয়ে কেমন আষ্ঠেপৃষ্ঠে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল!
সেই দিন আর কোনোদিন আসবে না। তুশির চোখ জ্বলে ওঠে। অশ্রুতে কার্নিশ ডুবে যায়। ঠোঁট ভেঙে কঁদে ফেলে সহসা।
আচমকা টের পেলো কেউ একজন এদিকেই আসছে। জুতো নিয়ে সদর্পে হেঁটে আসার শব্দ স্পষ্ট পাচ্ছে তুশি। অমনি তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছল সে। হুট করে চেহারা টানটান করে ফেলল। এক আশার প্রদীপ ঝলকে দিলো বুকের ধার। বিটকেল!
চকিতে পিছু ঘুরে চাইল তুশি। প্রত্যাশায় ঝলমলানো দৃষ্টিরা মুষড়ে পড়ল সহসা। হাস্যোজ্জ্বল মুখে এসে থামল অয়ন।
ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

“ কী ম্যাডাম,এত রাতে ছাদে কী করছেন?”
অয়নের কথার সুর বদলে গেছে।
তুশি মাথা নোয়াল। মনের শত আপত্তি,অস্বস্তি চেপে জানাল,
“ এমনিই দাঁড়িয়েছিলাম। আপনি এখানে?”
“ তোমাকে না দেখে খুঁজছিলাম। পরে তোমার দাদি বললেন তুমি ছাদে।”
খুব নিসংকোচে বলল অয়ন। আজ কথায় সামান্য তম রাখ-ঢাক নেই।
তুশি কিছু বলল না। ও নিজেই শুধায়,
“ নিচে সবাই কী নিয়ে আলোচনা করছে জানো?”
“ না।”
“ আমাদের বিয়ের তারিখ নিয়ে।”

তুশি অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। অয়ন এসে পাশে দাঁড়াল তখনই। বলে গেল নিজের মতোন,
“ সবাই ভাইয়া, আইরিন আর আমাদের বিয়ে একই দিনে ঠিক করতে চাইছে। ফুপিরা সেজন্যে কাল ওনাদের বাড়ি ফিরে যাবে। এ সপ্তাহেই সেখানে একটা গেট টুগেদার পার্টি রাখবেন শুনেছি। পার্টিতে ভাইয়া আর আইরিনের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট হবে।”
তুশির বুকের পাঁজর টনটন করে উঠল। ছোটো করে বলল,
“ ওহ।”
অয়ন ধীর স্বরে ডাকল
“ তুশি?”
মেয়েটা না তাকিয়েই জবাব দেয়,
“ বলুন।”
“ তুমি খুশিতো?”
তুশি মলিন হেসে বলল,

“ আপনার কী মনে হয়!”
পাঁচিলের ওপর তুশির হাত রাখা ছিল। আচমকা সেটা খপ করে মুঠোয় ধরল অয়ন। তুশি চমকে গেল। তাকাল হতবুদ্ধি চোখে। অয়ন উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ তুশি আমি জানি না ইউশা তোমাকে কী বলেছে,বা সবটা ও তোমাকে বোঝাতে পেরেছে কিনা! কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু ভাইয়ার সাথে আগে কথাবার্তা বলেই নিয়েছিলাম। আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,ও তোমাকে নিয়ে সিরিয়াস কিনা।

ও যখন বলল,ওর মনে তোমাকে নিয়ে কিচ্ছু নেই তখনই আমি এগিয়েছি। আর সেই এগিয়ে যাওয়া অনুভূতিতে আমি আর রাশ টানতে পারিনি। আমি সত্যিই তোমাকে খুব পছন্দ করি তুশি। আই ট্রুলি লাভ ইউ উইথ অল মাই হার্ট!”
তুশি স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল কিছু পল। টের পেলো সমস্ত শরীর ঘেন্নায় অস্বস্তিতে রিরি করে উঠছে।
যাকে ও শুধুমাত্র নিজের বোনের জন্যে ভেবেছে, বোনের ভালোবাসার মানুষ হিসেবে দেখেছে তার মুখে এসব কথায় কেমন জঘন্য লাগল সব কিছু। তুশি হাতটা মুচড়াল। শক্ত কণ্ঠে বলল,

“ হাত ছাড়ুন অয়ন ভাই।”
“ কেন তুশি,এখন তো আমাদের বিয়ে হচ্ছে। উড বি হয়ে তোমার হাত ধরতে পারি না আমি?”
“ যখন বিয়ে হবে, তখন দেখা যাবে। তার আগে এসব আমার পছন্দ নয়। ছাড়ুন।”
অয়ন ছাড়ল না। বলল,
“ আগে বলো,আমাকে নিয়ে তোমার অনুভূতি কী? তারপর!”
সার্থ হাজির হলো তখনই। থানা থেকে ফিরেছে অনেকক্ষণ। পরনে টিশার্ট,কালো ট্রাউজার। হাতে কফি মগ নিয়ে যখনই ছাদের চৌকাঠে এলো,সামনের দৃশ্যে পা জোড়া থমকে গেল সহসা। তুশির হাত অয়নের মুঠোয়। একেবারে ছেলেটার বুকের কাছে নিয়ে ধরা! কয়েক পল
স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইল সে। পরপরই ভীষণ ক্রোধে শরীরের রক্ত সুদ্ধ টগবগ করে উঠল। ফুটন্ত দাবানলের আঁচে যেন ছিঁড়ে গেল মাথাটা।

তুরন্ত কফি মগটা ধরেই সজোরে এক আছাড় মারল সে।
ছাদের শক্ত মেঝেতে পড়া মাত্র একটা বিকট শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। আঁতকে ফিরল ওরা দুজন। অয়ন সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ছেড়ে দিলো তুশির। দ্রুত পায়ে এসে ভাইয়ের কাছে দাঁড়াল। ফ্লোরে গড়িয়ে যাওয়া কফি , ছড়িয়ে থাকা মগের ভাঙা টুকরো দেখে অবাক হয়ে বলল,
“ ভাইয়া, এটা ভাঙল কী করে? ”
সার্থর রক্তিম চোখ তখন তুশির ওপর। দুপাশের চিবুকের কটমটে ভাবের মাঝেই,তুশি চট করে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এই সরাসরি অবজ্ঞার তীর সাইসাই করে এসে বসল সার্থর বুকে। বলিষ্ঠ দেহ রাগে থরথর করে উঠল। অথচ দাঁত পিষে খুব আস্তে বলল,

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৪৯

“ হাতে থেকে পড়ে গেছে।
ইউ গাইস ক্যারি অন।”
তারপর ঘুরে নেমে গেল সে। তুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল,চোখের জল গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছল ত্রস্ত বেগে।

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৫১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here