কাজলরেখা পর্ব ১০
তানজিনা ইসলাম
টাইম ফ্লাইস! মাঝখানে কেটে গেছে একমাস। তবে দিন বদলালেও চাঁদনী বা আঁধারের জীবনের কিছুই বদলায়নি। ওঁরা একঘরে থাকে, একই ছাঁদের নিচে অথচ দু’জনের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া ওঁদের মাঝে আর কোনো কথায় হয় না। সকাল- সকাল আঁধার ভার্সিটিতে চলে যায়, আসে সন্ধ্যায়। চাদনী সারাদিন মোবাইল দেখে কাটায়। একা একা বসে থাকে।চ্যাম্পের সাথে খেলে। বেলকনিতে গিয়ে শ্রেয়ার সাথে কথা বলে।আঁধার আসলেও চাদনী কথা বলে না ওর সাথে, আঁধারও কথা বলে না। কি এক অদৃশ্য দূরত্ব ওঁদের মাঝে! ওরা এক টেবিলে বসে খায়ও না। দুপুরে চাদনী একা একা খায়, রাতে আঁধার খেয়ে উঠে যাওয়ার পর খেতে বসে। বা আঁধার ফিরতে দেরি করলে ও আসার আগে খেয়ে উঠে যায়।
আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরেছে চাদনী। উঠেছে এমন না, উঠানো হয়েছে ওঁকে। সকাল সকাল আঁধার এসে চুল টেনে দিয়েছে ওর, পিঠের উপর দু’টো চাপড় বসিয়েছে। প্রায় দশটা মতো এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো ও রাতে।সেগুলোই সকাল ছ’টা থেকে বাজতে শুরু করেছে।ওর এলার্মের শব্দে পাশের রুমে থাকা আঁধারের ঘুম ভেঙে গেছে। নিচে থাকা বুয়ার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু চাঁদনীর অঘোর ঘুম ভাঙেনি। আঁধারের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ায়, ও রেগেমেগে রুমে এসে চুল টেনে ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে চাঁদনীর। এরপর তুমুল ঝগড়া লাগিয়েছে চাঁদনী। সেই ঝগড়া এখনো জারি আছে।বারান্দা থেকে আঁধার চেচাচ্ছে, রুম থেকে চেচাচ্ছে চাদনী। কেও কারো চেয়ে কোনো অংশে কম না। কেও কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজ কলেজে যাবে চাঁদনী। ওদের কলেজের আজ নবীন বরণ অনুষ্ঠান। যদিও ক্লাস শুরু হয়েছে পনেরো দিন আগে থেকে।তবে চাঁদনী যায়নি। শুধু অরিএন্টেশন ক্লাসের দিন গিয়েছিলো।আর সত্যি বলতে খুব বেকার গেছে ওর দিনটা।ওর কোনো বন্ধু হয় নি। কেও ওর সাথে কথাও বলেনি।চাদনী একা একা বসে থেকেছে।পুরো টাইম স্যারদের বকবকানি শুনেছে। এক কথায় পুরো দিনটায় খারাপ গেছে ওর। এরপর একদিনও ও আর কলেজে যায়নি। চাদনী ওঁদের সেকশনের গ্রুপে এড আছে।রোলওয়াইজ ওঁদের আলাদা আলাদা গ্রুপ খোলা হয়েছে। সেখান থেকে চাদনী জানতে পেরেছে আজ ওঁদের নবীনবরণ অনুষ্ঠান। চাদনী প্রথমে ভেবেছিলাে যাবে না। কিন্তু গতকাল আঁধার ওঁকে লোভ দেখিয়েছে, নবীন বরণ অনুষ্ঠানগুলো খুব জাকজমক করে উদযাপন করা হয়।চাদনী না গেলে অনেক কিছু মিস করে ফেলবে।ওর সবকিছু দেখা উচিত। কতদিন আর ঘরকুনো হয়ে থাকবে ও। চাদনীরও যে বাইরে যেতে মন চায় না এমন না, কিন্তু ও কারো সাথে মিশতে পারে না এটাই ওর একমাত্র সমস্যা।
অনুষ্ঠানে ছেলেদের ড্রেসকোড সাদা পাঞ্জাবি, মেয়েদের বাসন্তী রঙের শাড়ি। চাঁদনী শাড়ি পরবে না। ও শাড়ি পরতে জানে না। কোনোদিন শাড়ি পরেনি ও।এটা একবার কথার ছলে আঁধার কে বলেছিলো ও,আঁধার শাড়ি কিনে দেয়নি ওঁকে, বলেছে শাড়ি পরলে ওঁকে কাজের বেটি ছকিনার মতো লাগবে।আরো ফালতু ফালতু কথা বলেছে।ওর শাড়ি পরা নিয়ে আঁধারের সমস্যার শেষ নেই, থাকবে কী করে, চাদনী পুরোটাই তো ওর জন্য সমস্যা!
চাঁদনী সিমিলার কালার মিলিয়ে একটা হাঁটু সমান গাউন বের করলো আলমিরা থেকে।ওর অনেকগুলো ড্রেস।প্রায় সব কালারের ড্রেস আছে ওর কাছে।চুলগুলো বেণী করলো, আবার খুলে দিলো। ওর চুলগুলো কোমড় ছাড়িয়ে গেছে। প্রথম দিন কলেজে গিয়েই ও বুঝে গেছে ছেলে-মেয়েগুলো অনেক পশ।চাঁদনী খুব সুন্দরী বা পশ নাহোক অন্তত ওঁদের সাথে একটু তাল মেলাতে ক্ষতি কী! চাদনী আয়নায় তাকালো, কোনো সাজসজ্জা নেই ওর মুখে।চাঁদনী সাজে না তেমন। তবে ড্রেসটাতে কেমন লাগছে সেটা নিয়ে কনফিউশানে পরলো চাদনী। আঁধারের মুখ থেকে জীবনেও ওঁকে নিয়ে প্রশংসা বেরোবে না, চাদনী জিজ্ঞেস করতে চায়ও না। তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুলে আকিব শিকদার কে সেন্ড করলো। টাইপ করে লিখলো, কেমন লাগছে সত্যি করে বলবা।মিথ্যা স্বান্তনা দিবা না। অনুষ্ঠানে যাচ্ছি, পার্ফেক্ট লাগা জরুরি!’ মানুষটা ছাড়া চাঁদনী আর কার থেকেই বা জানতে চায়বে? চাদনী অপেক্ষা করলো আকিব শিকদারের রিপ্লাই আসার।চাঁদনীর ছবিগুলো দেখার পর মেসেজের রিপ্লাই না দিয়ে ডিরেক্ট কল দিলেন তিনি। মুগ্ধ স্বরে আওড়ালেন
-” আমার প্রিন্সেসটাকে অনেক সুন্দর লাগছে।একদম ডিজনি প্রিন্সেস টিয়ানার মতো। বাট সাদা ড্রেস পরলে আরো স্নিগ্ধ লাগতো, আম্মা!”
সাদা কাপড়ের কথা শুনেই চাদনীর মুখ মলিন হয়ে যায়। তবুও জোরপূর্বক হাসি টেনে আকিব শিকদারকে বিদায় দিয়ে কল কাটলো ও। বেরোনোর আগে একপলক আবার আয়নার দিকে তাকালো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কাজল নিয়ে চোখের নিচে মোটা করে কাজল পরলো। কপালে টিপ দিয়ে ওটা আবার উড়না দিয়ে মুছে ফেললো। নাহ, টিপ ছাড়ায় ভালো লাগছে। মন্দ লাগছে না ওঁকে, সুন্দরই। আয়নার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো চাদনী, নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বললো
-“ইউ আর লুকিং বিউটিফুল চাঁদ। বি কনফিডেন্ট! নিজের জন্য সেজেছিস তুই। অন্য কারও পছন্দ না হলেও তোর কিছু করার নেই।”
হ্যান্ড ব্যাগ কাঁধে চড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলো চাদনী। আঁধার সোফার উপর বসে ব্রেকফাস্ট করছিলো, আর টিভি দেখছিলো।চাঁদনী কে নামতে দেখেই ছোট ছোট চোখে দেখলো ওঁকে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত স্ক্যান করলো। চাঁদনী ভ্রু কুঁচকে বললো
-“কী, এভাবে কী দেখছো?”
-“কলেজে উঠার পরপরই তোমার মনে রং লেগেছে দেখা যায়!”
-“হ্যাঁ তো! সারাজীবন সাদা কালো মন নিয়ে কাটিয়ে দিব নাকি!”
আঁধার ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে বললো
-“শুধু শুধু এতো কষ্ট করছিস, বিশ্বাস কর তোর রূপের বাহারে একটা ছেলেও পটবে না চাঁদ!”
-“কাওকে পটানোর জন্য যাচ্ছি না। এমনিই কাজল দিতে মন চেয়েছে তাই দিলাম।নিজের জন্য সেজেছি, কাওকে পটানোর জন্য না। আর শোনো তোমার কোনো কথাই আমার উপর এফেক্ট করবে না, কারণ বাবা বলেছে আমাকে প্রিটি লাগছে। তাই তোমার মতামতের দাম দিচ্ছি না! আজকে আমাকে সুন্দর লাগছে, আয়নায় দেখেছি আমি।”
-“চাচ্চু তোকে মিথ্যা স্বান্তনা দিয়েছে রে চাঁদ। কিন্তু এটাই সত্যি কাজলচোখে তোকে একদম রুমিন ফারহানার মতো লাগছে!”
চাদনী উৎফুল্ল হয়ে বললো
-“ওয়াও সত্যি! রুমিন ফারহানা তো সুন্দর। তার মানে আমাকে সুন্দরই লাগছে!”
-“ভুল, তোর গায়ের রং রুমিন ফারহানার মতো না।
রুমিন ফারহানা তোর চেয়ে ফর্সা।তোকে সুন্দর
লাগার জন্য আগে তোকে রুমিন ফারহানার মতো ফর্সা
রং ধার করে নিয়ে আসতে হবে। লিটারেলি তোকে শাঁকচুন্নির মতো লাগতেছে। দেখিস আবার তোকে পেত্নী ভেবে কলেজের সব পোলাপান না ভেগে যায়!”
চাঁদনী মুখ বাকালো। আঁধার জীবনেও স্বীকার করবে না, চাদনী কে সুন্দর লাগছে। শ্যামলা মেয়েগুলোকে কাজল দিলে এত্তো সুন্দর লাগে! তারউপর চাঁদনী তো সব দিয়েই পার্ফেক্ট। ওঁর কোনো দিক দিয়েই খুঁত ধরা যাবে না। তারপরও আঁধারের ওর গায়ের রং নিয়ে একটা পিঞ্চ মারতেই হবে ওঁকে। তবে এখনকার কথাগুলো ও দুষ্টুমি করেই বলেছিলো, চাদনী বুঝলো কি-না কে জানে!
আঁধার একপাশে করে বসে চাদনী কে বসার জন্য জায়গা করে দিলো। চাদনী গিয়ে বসলো সোফায়। আঁধার চিকেন রোল খাচ্ছিলো৷ খাওয়া শেষ করে প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বললো
-“চিকেন রোল খাবি, না অন্য কিছু?”
-“যেটা দিবা সেটাই খাবো।”
আঁধার কিচেন থেকে চিকেন রোল এনে দিলো ওঁকে। বুয়া বানিয়ে রেখেছিলো সবকিছু। সে এখন অন্য কাজ করছে, তাই আঁধার ভাবলো নিজের চা নিজেই বানিয়ে নেবে।কারণ আবার কলেজে নিয়ে যেতে হবে চাঁদনীকে। বুয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতে লেইট হয়ে যাবে। আঁধার কিচেনে যাওয়ার আগে চাদনী থেকে জিজ্ঞেস করলো
-“চা বানাতে যাচ্ছি, তোর লাগবে?”
-“আমার টা আমি বানায় নিবো!”
-“এতো এটিটিউড তোর, ভাই রে ভাই৷ এটিটিউড নিয়া কবরে যাবি! আমার কী মন চায় জানিস তোর গলাটা টিপে দিতে।”
চাঁদনী কে বকতে বকতে কিচেনে চলে গেলো আঁধার। চাদনী ভেঙালো ওঁকে। আঁধার চাদনীর জন্যও চা বানালো। না বানাতে চেয়েছিলো, আবার ভাবলো মেয়েটার আজ সুন্দর একটা দিন। বাড়িতে থাকলে চাদনীকে আর কষ্ট করে চা বানাতে হতো না। এখানে থেকেই বা বানাবে কেন! আঁধার তো বানাচ্ছেই, আর এক কাপ এক্সট্রা বানালে ক্ষতি কি!
চাদনীর তবুও কলেজে আসতে আসতে লেইট হয়ে গেছে।ক্লাস শুরু হয় দশটায়, চাঁদনী যখন কলেজে এসে পৌঁছেছে তখন দশটা দশ।রঙবেরঙের কাগজ, লাইটিং এ সাজানো হয়েছে, গেইট থেকে শুরু করে কলেজ মাঠ পর্যন্ত।শহীদ মিনারের সামনে স্টেজের সেটআপ!আগত অতিথি সবার পরণে শাড়ি,পাঞ্জাবি।শুধু চাঁদনীর পরণে সালোয়ার। চাদনী ঠোঁট উল্টালো। কোথায় যাবে বুঝতে পারলো না, তাই সোজা নিজের ক্লাসরুমের দিকে হাঁটা দিলো। এখনো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। চাদনী ক্লাসে গিয়ে দেখলো একজন শিক্ষক ক্লাস করাচ্ছেন সেখানে।বিহ্বল দৃষ্টিতে চায়লো ও। আশ্চর্য! আজ না অনুষ্ঠান, তাহলে ক্লাস হচ্ছে কেন! ওর জানা মতে নবীনবরণের দিনতো ক্লাস হয় না। চাদনী অনুমতি চায়লো
-“মে আই কাম ইন স্যার?”
-“কী চায়?”
ভরাট গলায় প্রশ্ন করলো টিচার। চাদনী সিটিয়ে যাওয়া গলায় বললো
-“স্যার আমি এই ক্লাসের স্টুডেন্ট!”
-“এই ক্লাসের! তা এতো লেইট কেন?”
জবাবে চাদনী হাত কচলালো। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন
-“কাম ইন।”
চাদনী মাথা নিচু করে ক্লাসে ঢোকে।ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্ট সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।একটা বেঞ্চও খালি নেই, পুরো ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্ট। সবার মুখ গোমড়া। চাদনী মিডেলের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো।ওখানে দু’জন স্টুডেন্ট আগে থেকেই বসা ছিলো।ক্যামিস্ট্রি ক্লাস চলছে।টিচার বোর্ডে জৈবযৌগের থিওরি লিখছেন। চাদনী গালে হাত দিয়ে বসলো, ও খাতা-কলম কিছুই আনেনি। আশেপাশে তাকালো ও, কেওই লিখছে না।স্বাভাবিক অনুষ্ঠান মনে করে কেওই খাতা কলম আনেনি। সবাই এমনিতেই রোবট হয়ে বসে আছে।চাদনী আইঢাই করে পাশের জন থেকে জিজ্ঞেস করলো
-“আজ না অনুষ্ঠান, ক্লাস হচ্ছে কেন?”
-” বা*লের কলেজে পড়ি আমরা, বা*লের অনুষ্ঠান হবে।আমাদের আইনস্টাইন না বানিয়ে ছাড়বে না ওরা।”
চাদনী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটার দিকে।মুখের কি বি*শ্রী ভাষা!চাঁদনী অবুঝ স্বরে বললো
-“কিন্তু আইনস্টাইন হওয়ার জন্য তো ফিজিক্স পড়তে হবে, উনি তো রসায়ন পড়াচ্ছেন!”
পাশের দু’জন অট্টহাসলো চাঁদনীর বোকা বোকা কথায়।ক্লাসের পিনপতন নিরবতায় ওঁদের হাসির শব্দটা ভালো করেই শোনা গেলো। ক্যামিস্ট্রি টিচার লেখা বাদ দিয়ে পিছু ফিরে ধমকে উঠলেন।
-“এই কে হাসে? কোন বেয়াদবে এরকম নির্লজ্জের মতো হাসে?”
হাসি বন্ধ! চাদনীর পাশের দু’জন ইনোসেন্ট মুখ করে বসলো। স্যার ধরতে পারলো না তাদেরকে। আবার সামনে ফিরে বোর্ডে থিওরি লেখা শুরু করলো। চাঁদনীর পাশের জন ফিসফিস করে বললো
-“এই বেডার মাথা নষ্ট। একটা সাইকো!ক্যামিস্ট্রি ক্লাস করায় আমাদের।ফালতুর একশেষ! সারাক্ষণ সিরিয়াস মুখ করে থাকবে।চোয়ালটাকে এমনভাবে শক্ত করে রাখবে যেন অনেক কষ্টে হা*গা আটকে রেখেছে! দেখো কেমন সাইকোর সাইকো,অনুষ্ঠানের দিনেও পড়াতে চলে এসেছে। আমরা সবাই আটকা পরেছি এখানে।যদি জানতাম এই সাইকো ক্লাসে পিঞ্জর তৈরি করে রেখেছে আমাদের জন্য জীবনেও এ মুখো হতাম না। এখন অনুষ্ঠানে এটেন্ড না করে এ সাইকোর ক্লাস করো। বাই দা ওয়ে তুমি কী নতুন ক্লাসে?”
-“অরিএন্টেশনের দিন এসেছিলাম। সেদিন ওনার ক্লাস ছিলো না। আর এভাবে কেন বলছো টিচার হয় আমাদের, পা*প লাগবে না! গুরুকে সম্মান করা উচিত!”
ওরা আবার তাচ্ছিল্য করে হাসা শুরু করলো চাঁদনীর উপর।চাঁদনীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আবারো হাসির আওয়াজ শোনা গেলো ক্লাস জুড়ে। কিন্তু এবার ব্যাড লাক ছিলো মেয়ে দুটোর।স্যারের চোখে পরে গেলো ওরা। তিনি ওঁদের উদ্দেশ্যে ধমকে বললেন
-“এই মেয়ে এই! দাঁড়াও, দু’জনেই দাঁড়াও।”
ভয়ার্ত মুখে তাকিয়ে, চকিতে উঠে দাঁড়ালো দুজনে।
-“বেয়াদবের মতো হাসতেছো কেন হ্যাঁ! খুব ব্রিলিয়ান্ট তোমরা! আমার পড়া আমলে নেওয়ার দরকার নাই?দেখি বলো, অ্যালকেনের নামকরণের পদ্ধতিগুলো বলো!”
দু’জনের একজনও পারলো না। ওরা এসব আজ থেকে তিনমাস আগে পড়েছে এসএসসির জন্য, মনে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। স্যারের চোখ পরলো ওঁদের পাশে বসা চাঁদনীর উপর।ভয়ে ও মাথা নিচু করে বসে আছে। গম্ভীর স্বরে চাঁদনী কে দাঁড়াতে বললেন তিনি। ভাবলেন চাদনীও হয়তো ওদের সাথে হেসেছে।
-“তুমি বলো, অ্যালকেনের নামকরণের পদ্ধতিগুলো।”
চাদনী ভয়ে ভয়ে উত্তর বললো।স্যার প্রশস্ত হেঁসে ওঁকে বসার অনুমতি দিলেন।দাঁড়ানো দু’জনের দিকে তাকিয়ে ধমকে বললেন
-“বসো!”
দু’জন তড়িঘড়ি করে বসলো।এরপর আর কোনো কথা হলো না ওঁদের মাঝে।স্যার ক্লাস করানো শেষে বেরিয়ে গেলেন। চাদনী ঠোঁট উল্টে তাকালো ওর পাশের জনের দিকে। সে চাঁদনীর দিকে ফিরে হেঁসে বললো
-“বাহ! খুব ব্রিলিয়ান্ট তো তুমি!”
-“এটা তো সিম্পল প্রশ্ন।
-“সিম্পল হলেও এতোদিনে ভুলে যাওয়ার কথা।”
-“ভুলিনা আমি! সহজে কোনো কিছু ভুলি না। যা হয় আমার সাথে, যা কিছু পড়ি আমার মস্তিষ্কে সেট হয়ে যায়!”
মিষ্টি করে হাসলো সে। বললো
-“আমার নাম হাসনা নূর হেনা।তুমি?”
-“আমি চাঁদনী!”
-“খুব মিষ্টি মেয়ে তো তুমি!”
চাঁদনী মলিন হাসে। হাসনার পাশে বসা মেয়েটা উচ্ছ্বসিত হয়ে চাঁদনীর কাছে এলো।গদগদ হয়ে বললো
-“ফ্রেন্ড হবা?”
-“যদি তোমরা বানাও!”
-“তাহলে আজ থেকে আমরা বন্ধু। আর আমি হচ্ছি বৃষ্টি!”
চাদনী খুশিতে মাথা ঝাকালো। হাসনা বললো
-“চলো বাইরে যাই।এতোক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হলো বলে।”
চাদনী বেজায় খুশি। এই প্রথমবার কোনো বন্ধু হয়েছে ওর।তাও ওরা নিজ থেকে এসে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে ওর সাথে। কলেজ মাঠে নামতেই হাসনা আর বৃষ্টি কাওকে খুঁজতে শুরু করলো। চাদনী জিজ্ঞেস করলো
-“কাকে খুঁজছো!”
-“আমাদের ফ্রেন্ড।”
হাসনা আশেপাশে তাকাতে তাকাতে উত্তর দেয়।
-“তোমাদের আরো ফ্রেন্ড আছে?”
-“হুম,আরো দু’জন আছে। আমাদের স্কুল ফ্রেন্ড। সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে আমরা চারজন একসাথে আছি।”
-“বাহ!”
তক্ষুণি দু’জন ছেলেকে ওঁদের কাছে আসতে দেখা গেলো।বৃষ্টি রেগেমেগে বললো
-“কীরে জানোয়ার! কই ছিলি তোরা?”
-“আমরা তো ঘুরছিলাম।ডেকোরেশন অনেক সুন্দর হয়েছে রে ভাই। তোমরা তো ভাই ব্রিলিয়ান্ট মানুষ, অনুষ্ঠান রেখে ক্লাস করতে যেতে হয়। আমরা বাবা অতো পড়ুয়া না।”
হেঁসে বললো একজন। হাসনা বললো
-“থা*প্পড় খাবি বে*য়াদব। ইচ্ছা করে ছিলাম মনে হয়। ধরা খেয়েছি ক্লাসে গিয়ে।নয়তো ওই সাইকোর ক্লাস কে করে!”
-“বলেছিলাম ক্লাসে যাস না।আমাদের সাথে ক্যাম্পাসে চক্কর দে।ভালো হয়েছে একদম। আরো বেশিক্ষণ ক্লাস করানো উচিত ছিলো।”
একটু থেমে আবার চাদনী কে দেখিয়ে বললো
-“ও কে?”
-“আচ্ছা ও, ও হচ্ছে আমাদের নিউ ফ্রেন্ড চাঁদনী!”
চাঁদনীর হাত ধরে বললো বৃষ্টি। ছেলে দু’জন কে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো
-“ও হচ্ছে সিয়াম, আর ও রেহান! ওরা দু’জনও আজ থেকে তোমার ফ্রেন্ড!”
চাঁদনী আমতাআমতা করে হাসলো। ও ভেবেছিলো মেয়ে ফ্রেন্ড হবে হয়তো বাট ওরা তো ছেলে। চাদনী কী করে ছেলেদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবে! ও তো মেয়েদের সাথেই ভালো করে কথা বলতে পারে না।
-” ও মনে হয় ফ্রেন্ড হতে চাচ্ছে না আমাদের?” উদগ্রীব স্বরে বললো রেহান।চাঁদনী কিছু বলতে যাবে তার আগে হাসনা তড়িঘড়ি করে বললো
-” আরে না ! ও অনেক ইনোসেন্ট রে। ইন্ট্রোভার্ট! এই চাঁদনী তুমি ওঁদের বন্ধু হতে চাও না?”
চাঁদনী ডানে বায়ে মাথা নাড়ালো।মানে ও বন্ধু হতে চায়। রেহান ওঁদের কথায় বাগড়া দিয়ে বললো
-“আচ্ছা, এখন এসব কথা রাখ। চল আগে আমরা চেয়ারে গিয়ে বসি। এমনিতেই সামনের দিকের চেয়ারগুলো ভরাট হয়ে গেছে। পিছনে জায়গা ধরে রেখেছি আমরা তোদের জন্য!”
সবাই গিয়ে পিছনের সারিতে চেয়ারে বসলো। চাঁদনী আশেপাশে তাকিয়ে বললো
-“অনুষ্ঠান তো এখনো শুরু হয়নি। এতো লেইট কেন হচ্ছে?”
-“বিশেষ অতিথি আসেনি এখনো তাই, সে আসলে তবেই অনুষ্ঠান শুরু হবে।”
হাসনা উত্তর দিলো।চাদনী বিহ্বল স্বরে জিজ্ঞেস করলো
-“বিশেষ অতিথি কে?”
হাসনা বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে বললো
-“তুমি জানো না?”
-“না তো!”
-“আমাদের নেতা আসবে।”
-“নেতা! কীরকম নেতা? পাতি নেতা?” চাঁদনীর কন্ঠে রসিকতা।
-“মজা লও?জাতীয় সংসদের আসনপ্রাপ্ত সদস্য। শুধু জাতীয় সংসদ সদস্য না, সিটি কলেজের ফাউন্ডারের ছেলে।আমাদের কলেজের অনেকগুলো ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত আছে!”
-“কী বলো?”
-“হুমম।”
-“অনেক হ্যান্ডসাম। দেখছো না, সিনিয়র আপুরা
যেভাবে গেইটের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!”
চাদনী তাকালো গেইটের দিকে।কয়েকজন সিনিয়র ভাইয়া আপুরা পাঞ্জাবি, শাড়ি গায়ে, হাতে ফুল নিয়ে অপেক্ষমান। চাদনী চেয়ে থাকলো। সবার দৃষ্টি সেদিকে।তৎক্ষনাৎ সাদা কালো গাড়ি বহর ঢুকলো গেইট দিয়ে। সিরিয়ররা ফুল ছিটিয়ে স্বাগত জানালো তাঁদের। কয়েকজন সিনিয়র ছেলে আগ বাড়িয়ে রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া শুরু করলো। সবাই ঘিরে রেখেছে গাড়িটাকে। কে নামছে দেখা যাচ্ছে না। চাঁদনী উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো।সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন যুবক গাড়ির দরজা খুলে নামলো। ফুলের বৃষ্টি হলো তার উপর। তার চোখে সানগ্লাস। সূর্যরশ্মি সে রোদচশমার উপর পরে চকচক করছে। চাদনী এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকেই ও কোনো ছেলের উপর আকর্ষণ অনুভব করে না, ওর মায়া-ভালোবাসা সবকিছু একজনকে ঘিরেই ছিলো। ওর বাবা! মানুষটা ব্যাতিত আর কোনো ছেলেকে দেখার সুযোগ হয়নি চাঁদনীর। চাদনী দেখার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু আজ বোধহয় চাঁদনীর চোখ দু’টো আকর্ষিত হলো।ও খুব করে চায়লো নিজেকে আঁটকাতে। তবুও নিজের মনটাকে ক্রাশ খাওয়া থেকে আটকাতে পারলো কি-না কে জানে! দৃষ্টি সরিয়ে আনতে চায়লো চাঁদনী। কিন্তু পাশে বসা ওর সদ্য হওয়া দুই বান্ধবীর জন্য পারলো না। ওরা ওর কাঁধে হাত রেখে সামনে দূরে দাঁড়ানো পুরুষটার সৌন্দর্য গিলছে। চাঁদনী আবার তাকালো সামনে। মনে মনে তওবার দোয়া পড়ে নিলো। এভাবে বিবাহিত হয়ে বেগানা পুরুষকে দেখা বড্ড অন্যায় হয়ে যাচ্ছে ওর।চাঁদনী পাশে থাকা হাসনা থেকে জিজ্ঞেস করলো
-“এই ওনার নাম কী?”
-“ওয়াও কি সুন্দর! আমি কখনো সামনাসামনি দেখিনি ওনাকে। শুধু টিভিতে দেখেছিলাম! বাস্তবে উনি আরো বেশি হ্যান্ডসাম।”
চাঁদনীর উত্তর না দিয়ে মোহময় স্বরে আওড়ালো হাসনা। চাঁদনী কপাল চাপড়ালো দুই বান্ধবীর অবস্থা দেখে। হাসনা বললো
কাজলরেখা পর্ব ৯
-“কী যেন বলছিলে চাঁদনী!”
-“ওনার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম।”
-“ওনার নাম আবরার এহসান রাত!”
অন্যমনস্ক হয়ে বললো হাসনা। আবার চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে হুড়মুড়িয়ে বললো
-“এই,এই চাঁদনী!তোমার নামের সাথে ওনার নামের মিল আছে। চাঁদ, রাত। সুন্দর না?”