কাজলরেখা পর্ব ১৮

কাজলরেখা পর্ব ১৮
তানজিনা ইসলাম

চাদনীকে কোলে করে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো আঁধার। বাথটাবে বসিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দিলো।পানির ফোটা গায়ে পরতেই কেঁপে উঠলো চাঁদনী। রাতে গোসল করার অভ্যাস নেই ওর।তারউপর কনকনে ঠান্ডা পানি।
চাদনী ভেজা চোখে তাকালো আঁধারের দিকে। আঁধার গম্ভীর স্বরে বললো
-“আমি কাপড় এনে দিচ্ছি।পুরো শরীরে ঘষে ঘষে সাবান দিবি।”
-“সবকিছু জোরজবরদস্তি করে আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে তোমার!”
-“হ্যাঁ তাই!”

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেলো আঁধার। আলমিরা খুঁজে চাঁদনীর জন্য পোশাক আর তোয়ালে নিয়ে আসলো। আংটায় ঝুলিয়ে চাদনীর দিকে তাকিয়ে বললো
-“বাইরে থেকে দরজা লক করে দিচ্ছি, গোসল শেষে দরজায় টোকা দিলেই হবে!”
চাদনী বাথটাবে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে। ঝর্ণার পানি ভিজিয়ে দেয় ওর সর্বাঙ্গ।আঁধার দরজা লক করে বেরিয়ে গেলো।কক্ষে গিয়ে বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পরপর চিল্লালো
-“হয়েছে তোর চাঁদ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একবারো উত্তর আসলো না।দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে, উঠে দাড়িয়ে এগিয়ে গেলো। চাদনী বেরিয়ে আসতেই দু’হাতে ওর কাঁধ চেপে ধরলো। ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসালো ওঁকে। চাঁদনীর চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পরে বিছানায়। আঁধার তোয়ালে পেঁচিয়ে দেয় ওর চুলে, হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে দেয়। অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয় ওর ক্ষত স্হানে। পুরো সময়টাতে চাদনী চুপ থাকে। রোবটের মতো বসে থাকে।
আঁধার ওর দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করে

-“চাওটা কী তুমি?”
-“সব তো পেয়ে গেছি।আর তো চাওয়ার কিছুই নাই।”
-“আমি তোমার পুতুল নই আঁধার ভাই। আমি একটা মানুষ।সবসময় নিজের মনমর্জি করতে পারো না আমার উপর। যখন ইচ্ছে ধরো, যখন ইচ্ছে ছুঁড়ে ফেলে দাও, আমার মন নাই? সবকিছু চাপিয়ে দাও কেন?”
-“করলে কী করবি? কী করার আছে তোর? কিচ্ছু না। তোর কোনো ক্ষমতা নেই। আমি যেটা বলবো তোকে সেটাই করতে হবে।
আঁধার ধরতে গেলো চাদনী কে। চাদনী ছিটকে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো
-“ঠিক আছি আমি৷ অনেক দয়া দেখিয়ে ফেলেছো আমার জন্য। এবার যাও।”
চাদনীকে অবাক করে দিয়ে আধার সত্যিই বেরিয়ে গেলো। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো চাদনী। বিছানার হেডবোর্ডের সাথে বালিশ লাগিয়ে, পিঠে হেলান দিয়ে বসলো।আঁধার ভাতের প্লেট নিয়ে কক্ষে ঢুকলো। চাদনী ওর দিকে তাকিয়ে বললো

-“আমি খাবো না!খিদে নেই আমার!”
-“পুরোদিন কিচ্ছু খাসনি।”
-“সে চিন্তা তোমার না!”
-“আমার না তো কার?আর কে তোর চিন্তা করার দায়িত্ব নিয়েছে বল আমাকে।”
আঁধার ভাতের লোকমা ধরলো ওর মুখের সামনে। চাদনী হা করলো না। নাক ফুলিয়ে চেয়ে থাকলো।
-“তুই যদি চাস মুখে ঠেসে দিই, সেটাও করতে পারি আমি। তোর মর্জি। ভালো কথায় হবে না তোকে আসলে।
চাদনী হা করলো। কয়েক লোকমা খেয়ে বললো

-“আর না!”
আঁধার মুখ কালো করে জিজ্ঞেস করলো
-“খাবি না? আর একটু আছে!”
-“পেট ভরে গেছে। এতো ভাত তো আমি খাই না।”
-“এমনিতেই অনেক উইক তুই চাদনী!এই পাখির মতো খাবার খেয়ে বাঁচবি কী করে?”
-“মরে গেলেই ভালো না! তুমিও বেঁচে গেলা।”
-“আমার উপর খুব রাগ তোর?”
-“তোমার সাথে থাকলে আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হয় দাদাভাই। এতোটা নিচু তো আমি হতে চাইনি।”
-“আমার খুব কষ্ট হয় চাদনী বিশ্বাস কর। আমি তোর সাথে এমন করতে চাইনা। তবুও কেন যেন, সব উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। আমি রিয়েক্ট করে ফেলি। কেন এমন করি আমি?”
চাদনী মুখ ফিরিয়ে বসলো। আঁধার হাত ধুয়ে ফেললো।নিচে গিয়ে প্লেট রেখে আবার আসলো। চাদনী শান্ত কন্ঠে বললো

-“আবার কেন এসেছো? ঘুমাবো আমি।”
-“আমি আসলে খুবব সমস্যা হয় তোর?”
-“হ্যাঁ।”
কাঠকাঠ উত্তর। কোনো ভনিতা নেই। আঁধার আমলে নিলো না ওর কথা। পাংশুটে মুখে জিজ্ঞেস করলো
-“ডাক্তার ডাকবো? বেশি ব্যাথা পাচ্ছিস?”
-“এটুকু ব্যাথায় ডাক্তারের কোনো প্রয়োজন নেই।”
-“আমার জন্য তো এটুকু না। অনেক বেশি। চাচ্চু তো কোনোদিন তোর গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি। সে ফুল আমার কাছে এসে কিভাবেই না ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে।”
-“নাটক আর কতো করবা?”
-“আজীবন চলতে থাকবে। তুই সহ্য করবি! বলেছিলি তো সাফার করার জন্য জন্মেছিস। আমাকে সহ্য করাও একপ্রকার যুদ্ধ। নাটকে পিএইচডি করা মানুষ আমি।”

আঁধার তার পরিচিত একজন ডাক্তারকে কল করলো। চাদনী বলছে ব্যাথাটা প্রগাঢ় না। অথচ আঁধার চাঁদনীর ব্যাথাতুর মুখটা দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটা ব্যাথা সহ্য করতে পারে না একটুও। ছোটবেলা থেকেই এভাবে হালকাপাতলা ব্যাথা পেলে দুর্বল হয়ে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না।একটু অসুস্থতায় মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না। কয়েকটা ব্যাথার ওষুধের নাম জেনে নিলো আঁধার। ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী খাওয়ালো চাদনী কে। আঁধার বিছানার উপর বসলো। চাদনী বললো

-“তুমি যাও। আমি ঘুমাবো। ঘুমালে ভালো লাগবে আশা করি।”
-“আমার উপস্থিতিতে ঘুমাতে সমস্যা কী?”
-“তোমার রুমে আমি যাই? না তো।কখনো যাই না। কেন তোমাকে আমার রুমে আসতে হবে?৷ তোমার নাটক দেখার মুডে নাই আমি।যাও তো!”
আঁধার মলিন হেঁসে বেরিয়ে গেলো। চাদনী অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। এক বাক্যে মেনে নিলো ওর কথা।এতোটা নরম আঁধার কখন থেকে হয়ে গেছে।

চাদনী বিছানায় এপাশ ওপাশ করলো অনেক্ষণ। ঘুম আসলো না কোনোমতে। স্বাভাবিক। চাদনী ঘুমায় শেষ রাতের দিকে। সারারাত মোবাইলে রিলস দেখার পর ওর ঘুমানোর কথা মাথায় আসে, সকালের আলো ফুটতে দেখলে৷ এমনকি কলেজে যাওয়ার আগের রাত পর্যন্ত ও এভাবে ঘুমায়। দু-তিন ঘন্টা ঘুম দিয়ে কলেজে যায়। ফলস্বরূপ পুরোদিন ও উইক থাকে ভীষণ। আঁধার অনেকবার ওঁকে মোবাইল টিপতে মানা করেছে। এতো মোবাইল দেখা শরীরের জন্য ভালো না।একটা মানুষ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো ঘন্টা কী করে মোবাইল দেখে। কে শোনে কার কথা! চাঁদনী দেখতে পারে, ওর সমস্যা হয় না।

আর না পেরে আঁধার রাত তিনটায় এসে ওর কক্ষে উঁকি দিতো, চাদনীকে সজাগ মোবাইল টিপতে দেখলে ছো মেরে কেড়ে নিয়ে যেতো।সকাল হলে ফেরত দিতো। সে মেয়েটার রাত বারোটায় ঘুম আসবে না এটাই স্বাভাবিক। ব্যাথার চোটে মোবাইল দেখতে ইচ্ছেও করছে না।
রাত দুটোর দিকে আঁধার উঁকি দিতে আসলো চাঁদনীর কক্ষে। চাদনী তখনও ঘুমায়নি। কিন্তু ও বিপরীত পাশে ফিরে থাকায় আধার মনে করলো ঘুমিয়ে গেছে। আঁধার পা টিপে টিপে কক্ষে ঢুকলো, নিঃশব্দে। চাঁদনীর মাথার উপর হাত রাখতেই, ও চোখ বোজা অবস্থায় বললো

-“তুমি আবার আমাকে বিরক্ত করতে আসছো!”
আঁধার কিছু বললো না।৷ মুখ কালো করে চেয়ে থাকলো ওর দিকে।
চাদনী চোখ মেললো।মাথার নিচে হাত রেখে বললো
-“আঁধার ভাই! কিছু বলবা?”
-“ঘুমাস নাই এখনো?”
-“ঘুম আসতেছে না।”
-“তোর পায়ের অবস্থা কেমন এখন?”
-“অনেক ব্যাথা!”
আঁধার জায়গা নিয়ে বসলো ওর পাশে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কেমন করে যেন প্রশ্ন করলো
-“তুই আমার কে হোস চাদনী?”

চাদনী অবাক দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। আবার নিজেকে সামলে ঠান্ডা গলায় বললো
-“সেটাতো আমারো প্রশ্ন! কে হই আমি তোমার? কেন আমি তোমার সাথে আছি!”
-“আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে না!”
-“পুতুল বিয়ে!”
-“কবুল বলাটা তো মিথ্যা না।”
-“আমাকে তোমার মানতে না পারাটাও মিথ্যা না!”

চাদনীর পিঠের নিচে দু-হাত গলিয়ে, আঁধার ওকে টেনে নিলো নিজের কাছে।বুকের সাথে ওর ক্ষুদ্র, দুর্বল দেহটা মিশিয়ে নিলো। চাদনী সরতে চায়। আঁধার চেপে ধরে রাখে। চাদনী আর্তনাদ করে বললো
-“একটা কালির ড্রাম কে ছুঁচ্ছো, লজ্জা করছে না! নির্লজ্জ!”
চাদনীর বাহু আঁকড়ে ধরে আঁধার টানলো ওঁকে নিজের কাছে, খুব কাছে। এতোটা কাছে যে, দু’জনের শ্বাস মিশে গেলো একে অন্যের সাথে।আঁধার ওর মাথার উপর থুতনি ঠেকিয়ে অসহায় গলায় বললো
-“আমি তোকে হারাতে চাই না চাদনী! আমি তোর সাথে থাকতে চাই। আমি এখন তোকে ফিল করতে পারি। আগেও পারতাম।তবে স্বীকার করতাম না। এখন করছি। আমি নিজেকে বুঝতে পারছি না। আমি তোকে হারিয়ে নিজে ভালো থাকতে পারবো না কখনোই। আমার সাথে থেকে যাওয়া যায় না।আমার খালি মনে হচ্ছে তুই চলে যাবি।আমি তোকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি, এসব কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমাকে একলা করে দিয়ে চলে যাবি। তুই যায়তে পারবি না। আমি তোরে ছাড়বো না।”

চাদনী একপেশে হাসলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো
-“যে ছেলে দুনিয়ার সামনে নিজের বউয়ের পরিচয় টা পর্যন্ত দিতে পারে না, লজ্জা পায়। তার মুখে এসব কথা মানায় না! তুমি একটা কাপুরুষ আঁধার ভাই। আর যাই হোক, একটা কাপুরুষের সাথে সংসার করা যায় না।আমি সারাজীবন নিজের পরিচয় নিয়ে সংশয়ে ভুগতে পারবো না।আমাকে নিয়ে মানুষের সামনে, তোমার লজ্জিত মুখও দেখতে পারবো না।”
আঁধার নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরলো চাদনীকে। ওর গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে রাখলো। চাদনীর এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নাই ওর কাছে।

চাদনী অনেক চেষ্টা করে ছাড়া পেতে, শেষমেশ না পেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায়। আঁধার কোলে নিয়ে বসে থাকে ওঁকে। চাঁদনী ছোটবেলা থেকেই ভীষণ উইক। ছোট বিষয় নিয়ে প্যানিক করে। ছোট ছোট অসুস্থতাও ওর জন্য অনেক কষ্টের। ও অসুস্থতা নিতে পারে না।আঁধারের বিহেভিয়ারও একটুও বদলায়নি।ও এমনই করে সবসময় চাঁদনীর সাথে। নিজে কথার বানে ফালা-ফালা করে ফেলবে। আরেকজন একটা কষ্ট দিয়ে কথাও বলতে পারবে না। একটা ফুলের টোকাও দিতে পারবে না। আঁধার ওঁকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলো। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, মলিন হেঁসে বললো

-“তুই খুব মায়াবী রে চাঁদনী। আল্লাহ তোরে নিখুঁতভাবে বানিয়েছে।শুধু তোরে সেটাই দিলো না যেটা আমি চাইতাম। তোর এই একটা কমতির জন্য আমি সবসময় শাবিহার কাছে ছোট হই। ও অপমান করে কথা বলে আমাকে। তুই আর একটু ফর্সা হলেই আমি ওর সাথে চ্যালেঞ্জে জিতে যেতাম। তবুও তোর সুন্দর মুখের দিকে তাকালে আমার সব আফসোস নাই হয়ে যায়।”

আঁধার ঠোঁট নামিয়ে চুমু খেলো চাঁদনীর থুঁতনি তে।পরপর সরে এলো। ওর ঘুম ভাঙবে না এটা জানা কথা। সহজে ঘুমায়ও না, সহজে ঘুম ভাঙেও না। বড্ড শক্ত ওর ঘুম। কিন্তু ও জেগে থাকলে, এক্ষুনি চিল্লাপাল্লা করতো। চেঁচাতো! আধারের কাছে যাওয়া একদম সহ্যই করতে পারে না মেয়েটা। এটাই স্বাভাবিক! যে মানুষটা উঠকে বসতে কথা শোনায়, তার দু সেকেন্ডের ভালোবাসা দেখানোর কোনো মানে নাই। কিন্তু আঁধার সেটা মানতে পারে না। ওর রাগ হয়। ইগো হার্ট হয়।কেন চাদনী ওর থেকে দুরে দুরে থাকবে। যেখানে শাবিহা ফিরতে চেয়েও পারছে না, সেখানে চাদনী কেনো ওঁকে দূরে সরিয়ে দেবে। আঁধারের ঈর্ষা হয়! মাঝে মাঝে রাগের বসেও অনেক উল্টাপাল্টা বলে ফেলে ও চাঁদনী কে। চাঁদনীর উচিত ওঁকে মূল্যায়ন করা। অথচ মেয়েটা যা তা ব্যবহার করে ওর সাথে।এতো কীসের দেমাগ ওর? কীসের এতো অহংকার?আঁধার ওর কপালের উপর থুতনি
ঠেকালো। গুমোট স্বরে আওড়ালো

কাজলরেখা পর্ব ১৭

-“যার অস্তিত্বে ভর করে টিকে আছিস, সে আঁধারে তোর এতো বিদ্বেষ কীসের চাঁদনী?অন্ধকার আছে বলেই চাঁদের এতো কদর!আঁধার বিহীন চাঁদের কোনো মূল্য নেই৷ আমি ছাড়া তুই, আপাদমস্তক মূল্যহীন!”

কাজলরেখা পর্ব ১৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here