কাজলরেখা পর্ব ১৯

কাজলরেখা পর্ব ১৯
তানজিনা ইসলাম

রেহানের অবস্থান রাতের কক্ষে। রাতের সাথে বিশেষ কোনো কাজ নেই ওর। তবুও এসেছে বসে থাকতে। রাত কাজের সময় কোনো কথা বলে না। তবুও রেহানের নিশ্চুপ ওর পাশে বসে থাকতে ভালো লাগে। রেহান পুরোদস্তুর ভাই ভক্ত।

রাতের সঙ্গ ওর কি যে পছন্দের! ও সবসময়ই রাতের পায়ে পায়ে ঘোরে।রাত কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। ওর পরণে ধূসর রঙের হাফহাতা টিশার্ট, ব্ল্যাক ট্রাউজার,কানে এয়ার্পডস লাগানো। এ বাড়িতে রাতের কক্ষটা সবচেয়ে বড়, আলিশান। সবচেয়ে সুন্দর ভিউটা হচ্ছে, কক্ষের বাম সাইডটা।পুরোটা কাঁচ দিয়ে বেষ্টিত। ইয়ার্ড থেকে শুরু করে রাস্তা পর্যন্ত সবকিছু একনজরে দেখা যায়। জোৎস্না গলিয়ে পরছে কাচ ভেদ করে। সে জোৎস্না গায়ে মেখে দুই ভাই নিশ্চুপ নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। এ রুমটা রাতের জন্য বরাদ্দ। রাত এ বাড়িতে আসে না একেবারেই, তখন এই রুমের দরজা তালাবদ্ধ থাকে। কেও প্রবেশ করতে পারে না এ কক্ষে।
রাত এ বাড়িতে না থেকেও ওর দাপটটা যেন এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশি। রেহান গ্রুপে চ্যাটিং করছিলো।রাত কাজ শেষ করে, ল্যাপটপ বন্ধ করে সাইডে রেখে বললো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“কী করছিস?”
-“ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলছি।”
রেহান উত্তর দিলো। হাসিমুখে তাকালো রাতের দিকে।
-“তোর পড়াশোনার কী অবস্থা?”
-“অবস্হা তো সঙ্কটাপন্ন! পড়াশোনা চলছে।কিন্তু আমি তার সাথে চলছি না, এটাই সমস্যা!”
রাত ফিচেল হেসে বললো
-“স্বাভাবিক! এসএসসি তে ভালো করে, ফার্স্ট ইয়ারে উঠলেই ছেলেমেয়েদের পাখা গজায়। তখন তারা মনের সুখে আকাশে উড়ে বেড়ায়। ভালো করে উড়ে বেড়া কেমন, তারপর যখন মিড এ ফেল করবি ঠাস করে নিচে পরবি।”
রেহান মুখ কালো করে বললো

-“পড়তে ইচ্ছে করে না!”
-“কী ইচ্ছে করে?”
-“সারাদিন ঘুরতে ইচ্ছে করে, মোবাইল টিপতে ইচ্ছে করে, ঘুমাতে ইচ্ছে করে।”
-“নিজের ইচ্ছেকে দমাতে হবে। সব ইচ্ছেকে প্রশ্রয়। ওই যে বলে না, সব পেলে নষ্ট জীবন।এটলিস্ট ট্রাই কর, একটু একটু পড়।”
-“তুমিও সিটি কলেজে পড়েছো তাই না, ভাইয়া!”
-“ইয়েস। ইন্টারে যতগুলো এক্সাম হতো, আমি সবগুলোতে টপ করতাম। তুই আমার ভাই না, তোকে তো ফার্স্ট হতেই হবে।”

-“ভাই হলেও৷ তোমার সিচুয়েশন আর আমার সিচুয়েশন তো আলাদা। তুমি তোমার ইন্টারের পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকতে মামুনিকে ছেড়ে, অথচ একবারো বাড়িতে আসতে না। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে। তুমি তোমার ফ্যামিলির সাথে থাকতে না। আমার মতো সবার আদর পেতে না। আমি তো আদরে আদরে উচ্ছন্নে গেছি। তোমার মা আর আমার মা তো এক না। আমার মা তো আমার খবরই নেই না। ভালো করলে দামী দামী জিনিস গিফট করে, খারাপ করলে গালি দেয়। এর মাঝে আমার পড়াশোনার অবস্থা নিয়ে বা আমাকে নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই!”
রাত গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। গুমোট স্বরে বললো

-” বড়দের মতো কথা বলছিস কেন? ছোট, ছোটর মতো থাকবি। আর এসব কোত্থেকে জেনেছিস তুই! তোর বাপ ছাড়া আর সবাই আমাকে আদর করতো, বুঝেছিস! দাদুভাই আর নানুভাই অলওয়েজ আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো। আমি অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেশ হোস্টেলে গিয়ে উঠতাম।”
-“জানি, দাদুভাই সব বলেছে। আর আমিই তো, আমার সাথে তোমার লুকোচুরি কিসের! আমি না তোমার ভাই৷ তোমার কষ্ট আমি না বুঝলে আর কে বুঝবে!”
রাতের গম্ভীর আদলে হাসি ফুটলো।বিস্তৃত হেঁসে বললো

-“ও তাইতো। আমার একটা মাত্র ভাই।”
-” কলেজ শেষ করেই আমি তোমার সাথে চট্টগ্রামে চলে যাবো। এবারে কিন্তু তুমি আমাকে আর ঘোল খাওয়াতে পারবে না।”
-“যথাআজ্ঞা। কিন্তু, একটা শর্ত, এইচএসসি তে গোল্ডেন পেতেই হবে। আর মিডটার্ম, ফাইনালে টপ ফাইভের মধ্যে থাকতে হবে অন্তত!”
-“আচ্ছা। আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট। বাট ফার্স্ট হওয়াটা একটু টাফ। শুরু থেকে পড়াশোনা করিনি আমি।চাদনী ফার্স্ট হবে, আই থিংক!”

রাত প্রশ্ন করলো
-“চাদনী কে?”
-“তুমি চাদনী কে চেনো না?”
-“না তো!”
-“ওই যে আমাদের কলেজে গিয়ে যাকে লিফলেট দেওয়ার জন্য স্টেজে ডেকেছিলে৷ আবার যে সিড়ি থেকে পরে গিয়ে তোমার গায়ের উপর পরেছিলো। ও-ই! আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। চেনো তো তুমি, নাম মনে হয়তো!”
-“আচ্ছা, ওই মেয়েটা। ও হে, নাম বলেছিলো আমাকে। দু’বার। মনে ছিলো না!এই ছোট্ট ব্রেইনটা দিয়ে কয়জন কে মনে রাখা যায় বল।”

-“ও খুব ভালো জানো। সরল, ইন্ট্রোভার্ট! আর পড়াশোনায়ও খুব ভালো। ক্লাস স্যার রা কিছু লিখতে দিলে, আমি ওর থেকে কপি পেস্ট মারি। মিডটার্মের জন্যও আগে থেকে বলে রেখেছি। ও বলে, ও কিচ্ছু পারে না, এখনো কোচিং করা শুরু করেনি৷ বইও ধরেনি। অথচ ও একটু দেখলেই সব কেমন কেমন করে যেন পেরে যায়।”
-“খুব ব্রিলিয়ান্ট?”

-“এটা মিডটার্মেই বোঝা যাবে। বাট ও সিরিয়াসলি পড়াশোনা করে না। কিন্তু সব পারে।”
রাত আর কিছু বললো না। হঠাৎই রেহান ফট করে বললো
-“আমার একটা ভাবি লাগবে।”
-“তোর জন্য এখন ভাবি কোত্থেকে আনবো আমি!”
-” বিয়ে করে আনবা। শাবিহা আপু তোমার থেকে ছোট। তোমার উচিত না, শাবিহা আপুর আগে বিয়ে করা!”
রাত ঠোঁট কামড়ে বললো

-“বিয়ে আমার টাইপের না রে! আমার দ্বারা সংসার হবে না। আমি একটা মুক্ত পাখি, ভবঘুরে। সারাদিন রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত থাকি। বন্দী হতে চাই না।”
-“বিয়ে মানেই যদি বন্দীত্ব হতো, তাহলে দুনিয়ার কোনো নেতাই বিয়ে করতো না। শোনো না আমার কথাটা। আমার খুব করে একটা বিয়ে খেতে ইচ্ছে করতেছে। তুমি শুধু হ্যাঁ বলো, একটা ধবধবে ফর্সা মেয়ে খুঁজে দেবো তোমাকে। তুমি তো খুব সুন্দর, তোমার সাথে মিলিয়ে মেয়ে খুঁজতে টাইমও লাগবে অনেকটা। আমার ভাবী কে তো সবদিক দিয়ে পার্ফেক্ট হতে হবে।”

-“ফর্সা ধুয়ে পানি খাবো?”
রেহান মুখ কালো করে বললো
-“ফর্সা লাগবে না?আমার অনেক সুন্দরী বান্ধবী আছে!
রাত উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকালো।পূর্ণ চাঁদ উঠেছে আকাশে।আজ বোধহয় পূর্ণিমা।হঠাৎই ওর হৃদয়টা বিষাদে ছেয়ে গেলো।নির্নিমেষ তাকিয়ে বললো

-“আমার বাপও আঠাশ বছর আগে একটা খুব সুন্দরী, অপরূপা মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু কদর করে নি রে৷ জানিস, পুরো দুনিয়ার সামনে তাকে পাগল সাজিয়ে দিয়েছে, নিজের দোষ ঢাকার জন্য। আমি কাওকে বোঝাতে পারি না আমার মা পাগল না। আমার খুব ভয় লাগে কাওকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে। যদি আমিও তার সাথে এমন করি, তাকে কষ্ট দেই! এক রক্ত তো! রক্তের দোষ তো থাকবেই। আমি কাওকে ঠকাতে চাই না রেহান। আমি যেভাবে ঠকেছি, যেভাবে আমার আম্মুর সংসার ভেঙেছে আমি ট্রমাটাইজ হয়ে গেছি রে, এসব বিয়ে, সংসার নিয়ে।”
রেহান অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো রাতের দিকে।

তার বাবা তার কাছে সুপারম্যান। সারাজীবন যাই চেয়েছে তাই পেয়েছে। ওর বাবা ওর মুখ ফুটে বলার আগেই ওর সামনে এনে হাজির করেছে। অথচ তার বড় ভাইয়ের কাছে তার বাবা ঠিক উল্টো টা। জঘন্য একজন ব্যাক্তি! রাত উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে অদূর আকাশে। ওর মনটা খারাপ হয়ে গেছে৷ এভাবে হুটহাট ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। খুব বেশি খুশি, সুখ ওর জীবনে ধরা দেয়নি কোনোদিন। এ দুনিয়াতে দু’টো জিনিস ও খুব বেশি ঘৃণা করে, এক ওর বাপ। আর হলো বিয়ে করে সংসার করা। সবাই ঠিকই ছেড়ে চলে যায় একদিন। এসব ভালোবাসা, বিশ্বাস সবকিছুই মরিচীকা। একসময় সব হারিয় যায়। তারপর সাফার করে ইনোসেন্ট রা, যারা কোনো দোষই করেনি। যে বেশি ভালোবাসে তার জ্বালাটা সবচেয়ে বেশি।

চাঁদনী ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলো, আঁধার ওর হাত জড়িয়ে গালের নিচে রেখে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে ওর বিছানায়। তবে ওর থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে, যতোটুকু ওর হাত যায়। চাদনী কিছুক্ষণ মলিন মুখে তাকিয়ে থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো৷ আঁধারের বাচ্চা বাচ্চা মুখ। যাকে বলে বেবি ফেইস। দেখতে ইনোসেন্ট লাগে। মনে হবে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না, অথচ কাটাশুদ্ধ যে চিবিয়ে ফেলে সেটা চাদনী ছাড়া আর কে জানবে।

চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর পরে আছে, আদুরে লাগছে দেখতে। চাদনী দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, খুব দুর্বল লাগছে ওর নিজেকে। গায়ে হালকা জ্বর। এই একটা সমস্যা ওর, ব্যাথা পেলে রাত না পেরোতেই জ্বর উঠে যায়। চাদনী মুখ ধুয়ে এলো। আঁধারের এ রুমে ঘুমানোর কারণটা জানো না ও। আঁধার উঠলে জিজ্ঞেস করতে হবে, ওকে আলাদা রুম দিয়ে আবার নিজের রুম ছেড়ে ওর বিছানায় ঘুমাতে আসার মানে কি! চাদনী মোবাইল নিয়ে বেলকনিতে বসলো। ওখানে একটা একক সাদা চেয়ার রাখা আছে। গতকালকের রিলস দেখাটা বাকি রয়ে গেছে।
একটু পর আঁধার ঘুমঘুম চোখে উঁকি দিলো বেলকনিতে। উঠেই চাদনীকে না পেয়ে খুঁজতে এসেছে বোঝা যাচ্ছে। চাদনী রিলস দেখায় খুব মনোযোগী, এই একটা কাজ করার সময় দিনদুনিয়ার কোনো হুশ থাকে না ওর। আঁধার ডাকলো

-“চাঁদ!”
চাদনী ফিরে তাকালো ওর দিকে। আঁধার বেলকনিতে এসে রেলিঙের সাথে ঘেষে দাড়ালো। চাদনী ছোট ছোট চোখ করে তাকালো ওর দিকে। বললো
-“আমার রুমে ঘুমালে কেন?”
-” রুমে তোর নাম লেখা আছে!”
-“আলবাত লেখা আছে। আমার পড়ার টেবিলে রাখা প্রতিটা খাতায় আমার নাম লেখা আছে। তোমার রুম থাকতে, তুমি আমার রুমে আমার বিছানায় শুলে কেন?”
-“তোর উপর শুইনি সেটা তোর ভাগ্য বল!”
-“ছি*হ! কি বলতেছো!”
চাদনী চেচিয়ে উঠলো। আঁধার কথা ঘুরিয়ে বললো
-“না মানে, তোর উপর উঠে তোর গলাটা টিপে দিই নি এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলাম। কাল রাতে যা তা বিহেভ করেছিস তুই আমার সাথে।”

-“ইদানীং বেশিই উল্টাপাল্টা কথা বলছো তুমি! সকাল সকাল ঝগড়া করবা না তো। মুড নেই একদম। যাও তো!”
আঁধার এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত ছোয়ালো।চিন্তিত মুখে বললো
-“অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়েও কোনো কাজ হলো না। সেই জ্বর উঠলো।”
চাদনী কিছু বললো না। আবারো রিলস দেখায় মনোযোগ দিলো। আঁধার বললো
-“নিচে নামতে পারবি? না এখানেই নাস্তা নিয়ে আসবো তোর জন্য?”
-“এমন বিহেভ করতেছো, যেনো আমার পা একেবারেই ভেঙে গেছে। আমি আর উঠে দাড়াতে পারবো না।”
-“ঠিক আছে, নিচে আয় তাহলে। আই এম ওয়েটিং!”

আঁধার বেরিয়ে গেলো।চাদনী ওদের ফ্রেন্ডস ফরএভার গ্রুপে ঢুকলো। কালরাতে গ্রুপে চাদনী একটিভ থাকতে পারেনি। অনেকগুলো মেসেজ এসে জমা হয়েছে। চাদনী স্ক্রল করে। রাত দু’টোর দিকে নিজের আইডি থেকে যাওয়া মেসেজগুলো দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো চাদনী। ও তো কালকে কোনো মেসেজ দেয়নি। চাদনী স্ক্রল করে দেখে।প্রথম মেসেজটা রেহানের।চাদনীকে মেনশন দিয়ে লিখেছে, তোর পায়ের অবস্থা কেমন এখন? হাঁটতে পারছিস! বাকি তিনজন রিপ্লাই দিয়ে সেইম প্রশ্নটা করলো। চাদনী একটিভ নেই দেখে হাসনা লিখলো
-“কিরে দোস্ত কই তুই? নেতা সাহেবের ধমক খেয়ে অনলাইনে আসায় বন্ধ করে দিয়েছিস! ব্যাথাটা কোথায়, পায়ে না-কি বুকে!”
সবাই হাহা দিলো ওর মেসেজে। ওর মেসেজের উত্তরে রেহান লিখলো

-“ধমক দিলো সেটা দেখলি, পক্ষ নিলো সেটা দেখলি না, অকৃতজ্ঞের দল। আমার ভাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছে না-কি জিজ্ঞেস কর, তোর বান্ধবী থেকে!”
ওর এই মেসেজের পর থেকেই রেহানের ভাইকে নিয়ে কথা বলছিলো হাসনা আর বৃষ্টি।বৃষ্টি লিখলো
-” তুই খুব লাকি যায় বল। ইশ! সিনগুলো আমার সাথে হলেও পারতো। প্রথমে সিড়ি থেকে ফিল্মি স্টাইলে গিয়ে গায়ে পরা।তারপর হিরোর মতো পক্ষ নেওয়া। ওয়াও!”
আরো অনেক ডেলুলু কথাবার্তা গ্রুপ জুড়ে। এরপর অনেক কথার মাঝে, প্রায় মধ্যরাতের দিকে ওর দিক থেকে মেসেজ গেছে

-“ভাই এসব বলিস না, প্লিজ। আমার গার্ডিয়ান খুব স্ট্রিক্ট। এসব দেখলে কলেজে যেতে দেবে না আমাকে আর। তোরা যদি আরেকবার এসব বলিস, আমি আর কোনোদিন কথা বলবো না তোদের সাথে। আর ওই ছেলেটার মধ্যে পেয়েছিস টা কী তোরা? সব মেয়ে এমন পাগল হয়ে যাচ্ছিস কেন তার জন্য? এসব মেয়েদের মানুষ ছ্যাচড়া বলে। ছেলে কি দেখিস নাই কোনোদিন। এমন আবলামি করছিস কেন সবাই মেলে। তোরা ক্রাশ খাইলে খা।আমি বাপ ক্রাশ ট্রাশ কিছু খাইনি। অতো আহামরি কোনো মানুষ না, যে একযোগে সবাইকে ক্রাশ খেতে হবে। আমি তোদের মতো ছ্যাচড়া না!”

চাদনী আকাশ থেকে পরলো। এই মেসেজ কখন লিখলো ও। ও তো কাল রাতে ফোন হাতে নেওয়ার অবস্থায় পর্যন্ত ছিলো না। সেখানে কি-না মধ্যরাতে এসব মেসেজ গেছে, যখন ও ঘুমে তলিয়ে ছিলো।
চাদনী পরের মেসেজগুলো দেখলো। সবাই অ্যাংরি ইমোজি দিয়েছে ওর মেসেজে। রেহান ওর ভাইয়ের সাইড নিয়ে যুক্তি দিয়েছে। হাসনা আর বৃষ্টিও অনেকগুলো মেসেজ দিয়েছে। চাদনী সেসব মেসেজ মনোযোগ দিয়ে পড়ার ধৈর্য পেলো না। আর সিয়াম তো অলওয়েজ সবার সাইড নেয়, সে সবসময় জোয়ারের আগে আগে, ভাঁটার পিছে পিছে। সবার যুক্তিতে তার পক্ষে মেসেজ করেছে।

চাদনী কিছুক্ষণ পাথরের মতো বসে থাকলো।আঁধার ওর ফোন নিয়ে লিখেছে এসব! নয়তো জ্বিনে তো আর এসে লিখে দিয়ে যায়নি। এ বাড়িতে ও আর আঁধার ছাড়া তো আর কেও থাকে না। কাল রাতে আঁধার ওর রুমে ছিলো। রাত জেগে এসব করেছে ছেলেটা। কিন্তু আঁধার ওর স্ক্রিন লক জানলো কী করে।ছেলেটা এসব কেনো করলো! কেন চাদনীর শান্তি সহজে হয় না ওর।

চাদনী তটস্থ উঠে দাড়ালো। যেসব মেসেজ ওরা করেছে সে সবের প্রেক্ষিতে চাদনী এমনিতেই ওদেরকে এসব বলতে মানা করতো। আঁধারের বলতে হতো না। কিভাবে রুডলি মেসেজ করেছে। ছ্যাচড়া বলেছে ওদেরকে। চাদনীর ভয় লাগে। ওরা যদি ফ্রেন্ডশিপ ভেঙে দেয় ওর সাথে! আর যদি কথা না বলে! ওই চারটা মানুষ ছাড়া কলেজে আর কথা বলার মতো কেও নেই ওর। ওরা ওর মানুষিক শান্তি।কথা বলার জন্য একটা সাহারা। দু’টো বছর একা একা কি করে কাটাবে ও।
চাদনী হতভম্ব হয়ে নিচে নামলো। আঁধার তখন কিচেনে কফি বানাচ্ছিলো। হন্তদন্ত হয়ে কিচেনের দরজার পাশে দাঁড়ালো চাদনী। ধরফরিয়ে বললো

-“দাদাভাই, তুমি আমার মোবাইল চেক করেছো?”
আঁধার নিজের কাজে মনোযোগ থেকে বললো
-“হ্যাঁ,করেছি। তো?”
-“কেনো করেছো? আমার ফ্রেন্ডসদের কী বলেছো তুমি? আমার মোবাইল আমার পারমিশন ছাড়া নিয়ে নিলে? মনে নেই ট্রেনে কি বলেছিলা তুমি, মানুষের পার্সোনাল জিনিস তার পারমিশন ছাড়া নিতে নেই!”
চাদনী রাগী রাগী কন্ঠে বললো কথাগুলো। আঁধার ভাবলেশহীন ভাবে ওর দিকে না তাকিয়ে বললো

-” ওটা আমার ক্ষেত্রে! তোর ক্ষেত্রে না!আমার যখন ইচ্ছা আমি তোর মোবাইল ধরবো, চেক করবো। উল্টাপাল্টা করলে, গতরাতে যেভাবে প্যাচ লাগিয়েছি ওভাবে তোকে শিক্ষা দিব। তাতেও না হলে মা’র খাবি।মোবাইল টা আমি তোকে কিনে দিয়েছি। তাই ওটা তোর পারসোনাল জিনিস না!”
চাদনী ঝাঁঝালো স্বরে বললো
-“আমার কোনো পার্সোনাল জিনিস থাকতে পারে না?”
আঁধার চোখ পাকিয়ে বললো
-“না পারে না!আর রাগ কাকে দেখাচ্ছিস তুই!আমাকে নেগলেক্ট করবি! এত সহজ? আমার কাছে কীসের পার্সোনাল জিনিস তোর?”

-“তাই বলে আমার ফ্রেন্ডস গ্রুপে উল্টাপাল্টা মেসেজ দিবা। কিভাবে রুড হয়ে কথা বলেছো তুমি ওদের সাথে। ওরা মনে করবে আমি এসব বলেছি।”
-“বেশ করেছি বলেছি। একটা বাইরের ছেলেকে নিয়ে কি কি বলছিলো তোকে! ওই নেতার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, তোর মতো একটা মেয়েকে চয়েস করবে। তুই বললি না কেন ওঁদের কে, তুই যে বিবাহিত।”
-“তুমি নিজেই মানা করেছো। তুমি বলেছো তুমি আমার পরিচয় দিতে পারবে না। গার্ডিয়ান হিসেবে দরকারে কলেজে যাবা, হাসবেন্ড হিসেবে যেতে পারবা না। একটা কালো মেয়ের স্বামীর পরিচয় তুমি দিতে পারবে না, তোমার লজ্জা লাগবে, নিজেই বলছো!”

-“এখন বলতে বলছি না! তোর ফ্রেন্ডদের কে বলে দিবি, তুই বিবাহিত। বেগানা একটা পুরুষের সাথে যাতে তোকে শিপ না করে। আরেকবার যদি এসব দেখি আমি, খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।
চাদনী তপ্তস্বরে বললো
-“শিপ করলেই হয়ে গেলো! আমি নিজেই মানা করতাম, তোমাকে বলতে হতো না! ওরা এসব ফান করেই বলছিলো! কোথায় সে আর কোথায় আমি।”
-“তা তো জানি আমি। দুনিয়ায় এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকতে, তোর মতো কালির ড্রাম কে সে কখনো চয়েস করবে না সেটা আমার জানা কথা। যেটা করে আমি পস্তাচ্ছি, সেটা সে আগ বাড়িয়ে কেন করতে যাবে!”
চাদনী চুপ করে গেলো। আঁধার আবারো খোঁচা, খুব খারাপ ভাবে দিলো।সাথে আবারো জানিয়ে দিলো, একটা কালো মেয়েকে বিয়ে করে ও আফসোস করছে, পস্তাচ্ছে। চাদনী মলিন হেঁসে বললো

-” তোমাকে পস্তাতে তো বলিনি আমি। ছাড়তেছো না কেন? তালাক বললেই তো সব শেষ। বা একটা সাইনেই তোমার সব আফসোস শেষ হয়ে যাবে।
এটা বারবার বলার দরকার নেই তো। সবসময় আমার জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে কী পাও তুমি!”
আঁধার কিছু বললো না। নিশ্চুপ কফি ঢালতে থাকলো কাপে। চাদনী এসে সোফার উপর বসে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, এখান থেকে কোথাও পালিয়ে গিয়ে সবাই কে বাচিয়ে দিতে। আর কতদিন একটা মানুষের উপর এভাবে বোঝা হয়ে থাকবে ও। একটা মানুষ কতক্ষণ আফসোস করতে পারে, কতক্ষণ আরেকটা মানুষকে নিচু করে করে কথা বলতে পারে।
আঁধার কফি আর সেন্ডউইচ নিয়ে বেরিয়ে এলো। গোল কাচ টেবিলের উপর ট্রে রেখে ওর পাশ করে বসলো। চাদনী দুরে সরে বসে। আঁধার বললো

-“খাইয়ে দিব?”
-“পা ভাঙছে, হাত না।”
-“রাগ করেছিস?”
-“না!”
-“কেন বারবার রাগাই দেস আমাকে? ভালো মেয়ে হয়ে থাকা যায় না? একটু কথা শুনলে কী হয়?”
-“আফসোস হয়, আফসোস! কালো হয়ে জন্ম নেওয়ার আফসোস!”
আধার ওর হাত ধরে বললো
-“চাদনী! আমি তোকে ওভাবে বলতে চাইনি! সরি! সো সরি! এভাবে মুখ কালো করে থাকিস না!”
চাদনী হাত ঝাড়া মেরে সরালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো
-“তুমি বলতে চাও না। কিন্তু বলে ফেলো। আমার হৃদয়টা ফালা ফালা করে দাও! আমার কমতি টা মনে করিয়ে দাও।”
আঁধার আর কিছু বলার আগেই, চাদনী সেন্ডউইচ হাতে নিলো। মুখে পুরে বললো

-“খিদে পেয়েছে খুব। প্লিজ আর কিছু বলো না। ইদানীং এসব একদম টলারেট করতে পারি না!”
আঁধার প্রথমে কফি নিলো। চুমুক দিয়ে বললো
-“পুরোটা শেষ কর! ওষুধ খেতে হবে!”
আঁধার আড়চোখে তাকালো ওর দিকে। চাদনীর মুখে খাবার ঠাসা। ওর গলা দিয়ে খাবার নামছে না, আবার বোঝাও যাচ্ছে খুব খিদে পেয়েছে। ইশ! অসুস্থ মেয়েটাকে এভাবে না বললেও পারতো ও! ও তো বলতে চায় না। মন থেকে একটা কথাও বলে না। তবুও রেগে গেলে কেন যেন, ঠাস ঠাস এসব কথা কোত্থেকে চলে আসে৷ আঁধারের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

-“আমার স্ক্রিন লক জানলে কী করে তুমি?”
চাদনীর প্রশ্নে আঁধার তাকালো ওর দিকে। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললো
-“তোর স্ক্রিন লক, এফবি পাসওয়ার্ড, গুগল পাসওয়ার্ড, ইন্সটাগ্রাম পাসওয়ার্ড বাকি তোর মোবাইলে যতো অ্যাপ আছে সবগুলোর পাসওয়ার্ড জানি আমি!”
চাদনী অবাক হয়ে বললো
-“কী করে?”
-“তোর আর আমার গুগল পাসওয়ার্ড এক। তোর মোবাইলের সব সেটিং আমার মোবাইল থেকে করা। কোন অ্যাপে কী করিস, কার সাথে কথা বলিস সব তোর মোবাইল ধরা ছাড়াই জেনে যাই আমি! তোর মোবাইলের সব নোটিফিকেশন আমার কাছে চলে আসে!”
চাদনী উদগ্রীব স্বরে বললো

-“এমন সেটিং কেন করেছো তুমি? কখন করেছো?”
-“যেদিন তোকে মোবাইল দিয়েছিলাম সেদিনই!”
-“এভাবে আমার উপর নজরদারি করো তুমি?”
-“হু!”
-“আমার কোনো প্রাইভেসি নাই। তোমার প্রাইভেসি তে হস্তক্ষেপ করি আমি? জিজ্ঞেস করি কার সাথে কথা বলো তুমি? কোথায় যাও?”

-“জিজ্ঞেস কর! আমি তো মিথ্যা বলি না তোকে। তুই তো জিজ্ঞেস করিস না। তোর এসব জানার ইচ্ছে নেই, আমাকে নিয়ে কোনো ইন্টারেস্টই নেই তোর। কিন্তু আমার তো আছে! তুই কাদের সাথে মিশিস, কী করিস আমাকে তো জানতে হবে। আমার কাছে কোনো প্রাইভেসি নাই তোর! থাকতে পারে না!”
-“আমি তোমাকে সবকিছু বলি না আঁধার ভাই? সন্দেহ করো? নিজেই বলো কেও ফিরেও তাকাবে না আমার দিকে। আবার নিজেই এভাবে খবরদারি করতেছো!”
-“আমি তাকাই না বলে অন্য কেও তাকাবে না এমন তো না। যার তাকানোর সে এমনিতেই তাকাবে। কিন্তু আমার সেটা সহ্য হবে না। তোর উপর কেও নজর দিতে পারবে না। আমি তোকে ট্রাস্ট করি। কিন্তু এই জেনারেশন বেশি খারাপ।

তুই টিনএজ। যেকোনো সময় তোর মাইন্ড চেইঞ্জ হয়ে যেতে পারে। ফ্রোন্ডসদের পাল্লায় অনেক কিছু করে ফেলতে পারিস! আমি তো তোকে সে সুযোগ দেবো না। ওরা যে তোরে শিপ করছে আরেকটা ছেলের সাথে, এটাও তোর মনে প্রভাব ফেলবে। এখন তোর ওদের কথাগুলো ভালো লাগছে না। কিন্তু কয়েকদিন পর হয়তো ভালো লাগবে। তোর মন অন্য কোথাও গিয়ে পরবে। তুই ভুলে যাবি তুই বিবাহিত। যেহেতু তোর বয়স এখনো কম, আমার সাথে তেমন কোনো কথাবার্তা হয় না তোর স্বাভাবিক অনেক কিছুই হতে পারে। বাট আমি তো তোকে ভুলতে দেবো না চাদনী!”

সহজ স্বীকারোক্তি! কোনো ভাবলেশ নেই, যেন এসব স্বাভাবিক কথা। চাদনীর রাগ লাগতেছে খুব করে! আঁধার ওঁকে পেয়েছে টা কী? এতটা খবরদারি, এতটা লুকোচুরি! শেষমেশ নজরদারি করছে ওর উপর।ওর বাবাও তো কোনোদিন, এতটা ধরে বেঁধে রাখেনি ওঁকে! আঁধার ওর ঘরে থাকতে দিচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, পড়াচ্ছে তাই যা চায় তা করবে। এভাবে হস্তক্ষেপ করবে ওর স্বাধীনতায়। এদিকে বলে বউ বলে মানে না, ওদিকে ঠিকই ওর জন্য সীমারেখা টেনে দিচ্ছে।
চাদনী ফুঁসছে। আঁধার মিষ্টি করে হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে। ওর নাক টেনে দিয়ে বললো

কাজলরেখা পর্ব ১৮

-“রাগ লাগছে জান? কী করবো বল, অমতে হলেও আমার সাথে ওরা তোকে বেঁধে দিয়েছে। আমার জিনিসগুলো আমি খুব সেইফটির মধ্যে রাখি। খুব কনসার্ন আমি আমার জিনিসগুলো নিয়ে। আমার কিছু শুধুই আমার, আর আমি শেয়ার করি না চাঁদ! আঁধারের জিনিসের উপর কেও নজরও দিতে পারে না। নিয়ে যাবে তো দুরের কথা। আমি তোকে ছাড়বো না। আর না তোকে ছাড়তে দেবো। তুই আঁধারকে ছেড়ে যেতে চায়লে ধ্বংস হয়ে যাবি রে চাদনী! তুই আঁধারের না হলে আঁধার তোকে ধ্বংস করে দেবে। তোর ধ্বংসাবশেষও বাচবে না!”

কাজলরেখা পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here